ফাল্গুনী ঘোষ

মায়াজম
3

                           ফকিরচাঁদের ঘরবাড়ি







সাপের চেরা জিভের মতো হিলহিলে লাল রেখাটি নিকষ সবুজে নিপুণ ঘাই মেরেছে যেখানে, সে স্থানিক মোহ এখন আঁজলায় নিতে ইচ্ছে করছে ফকিরচাঁদের। যেখানে নিঃসঙ্গ চরাচরের একমাত্র সাথী ফকিরচাঁদ, সেখানে একাকী দিগন্তে নিকষ সবুজের বুক চিরে মোরামের রাস্তা হিসিয়ে উঠেছে যেন। তার মাথার উপরে রহস্যময় নীলে ঘরবাড়ি, লোকলস্কর, রাজ্যপাট, ভাঙাগড়ার খেলা অবিরত। ফকিরচাঁদকে তারা দেখেও দেখে না। সবুজ নীলের দোলখেলায় মৃদু আঁশের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে কাশের রেণু। অধরচাঁদ হেসে হেসে ছাপ রেখে সরে সরে যান এ পথে। পথের রেখায় রেখায় আনন্দরেণু বিছিয়ে মা আসবেন যে। আর মাত্র কটা দিনের অপেক্ষা।
পুরাতন পথের খাঁজেভাঁজে শরৎ উঁকি দিয়েছে এখন । ইতিউতি নিশানা রেখে চরাচরকে দুলিয়ে দেওয়াই তার কাজ। এসময় ফকির নিঃশ্বাস ফেলারও ফুরসৎ পায় না। এ গাঁ সে গাঁ থেকে হাঁকডাক লেগেই থাকে। মায়ের প্রতিমা নির্মাণ ছাড়াও সম্ভ্রান্ত গৃহস্থের পাকা ও মেটে বাড়ি খড়ি দিয়ে নিকিয়ে রঙিন ফুল নকশা আঁকিয়ে নেওয়ার জন্যই এত হাঁকডাক। ফকিরচাঁদ চিত্রকর। লোকে ডাকে ফকির পোটো। ঐ তার নেশা ও পেশা। নেশার টানেই সে বেশি ছোটে। যদিও পোটোরা আজকাল সাইকেলের উপরেই বেশি ভরসা রাখে, কিন্তু দূর দূরান্তরের ভিন গাঁয়ের চলনে নিজের শক্তপোক্ত পা’ই ফকিরচাঁদের ভরসা। তাছাড়া এ রাস্তার চোরকুঠুরিতে ফকিরচাঁদের আলাদা নেশা। পথে-প্রান্তরে বনে-বাদাড়ে ঝিকুরঝুকুর সবুজ নীলের জাফরি কাটা ছোঁয়াছুঁয়িতে এক নিরীহ বালকের চকচকে কাচের মার্বেল আর ডাঙগুলি যেদিন থেকে হারিয়ে গেছে, সে কোন আনজনমের বেলা থেকেই যেন তার জন্মজন্মান্তরের নাড়ী বাঁধা পড়েছে এখানে।
সেসব গভীর দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরের পর্দা উঠিয়ে নিরীহ বালকের হাত ধরবে বলেই তো সিংকত্তার ডাকে এ গাঁয়ে ছুটে আসা। এখানে আসবে শুনেই এক দুর্বার রাগ আর অভিমান তাদের পিতা পুত্রের সম্পর্কের বাঁধে ফাটল ধরিয়েছে। অবশ্য বাবার রাগ করা সঙ্গত। তবু ফকির কোনো এক অকারণেই সিং কত্তার উপর রাগ করে উঠতে পারে না। সেই অকারণের এক প্রান্তে যদি থাকে আলাভোলা ফকিরের ফকিরী স্বাভাব, সমান্তরাল অন্য প্রান্তে অবশ্যই রয়েছেন গিন্নীমা। ছায়াঘেরা শান্ত দৃষ্টি, সদ্য যুবতীর উঠলে ওঠা যৌবনের মতো একঢাল কালো পরিচর্চিত চুলে, লাল পেড়ে ঘিয়া খোলের কড়কড়ে শাড়িটির আঁচল গলায় জড়িয়ে যখন তিনি এসে দাঁড়াতেন তখন যেন সাক্ষাৎ মা দুগগা!
সিং বাড়িকে তারা বলত ‘বড় বাড়ি’। দখিনদুয়ারি সিং দরজা পেরিয়ে পশ্চিমপানে বেড় দিয়ে আরেকটু উত্তর দিকে এগোলেই সিংবাড়ির মা দুগগার মন্দির। গাঁয়ের সবাই বলে ঠাকুরবাড়ি। ঠাকুরদালানের সামনের আঙিনায় এঁটো সকড়ির রাশ এক পাশে ঠেলে রেখে সেখানেই পাত পেড়ে বসে যেত ফকির। জুঁইফুলের মতো সাদা ভাত, কালো কলাই-এর ডাল, ঝাল ঝাল আলু কুমড়োর তরকারি আর শেষপাতে একটু আওটানো ঘন দুধের পায়েস। খিদের চেয়েও বেশি লোভ ছিলো তার, গিন্নী মায়ের টলটলে শীতল হাসিটিতে। কেমন হাসিমুখে তিনি বলতেন, “ খা ফকির! পেট পুরে খেয়ে নে!...”।
রাজ্যের এঁটো সকড়ি ধুয়ে সে নাইতে চলে যেত ময়ূরাক্ষীর পাড়ের বালির চরায়। এই হিলহিলে পথের শেষেই বালির চর। নাবাল পেরিয়ে চরে চরে হেঁটে গিয়ে ঐ দূরে এক হাঁটু ছুলছুলে জলে দাপাদাপি করেই বাল্যকালীন আশ মেটাত ফকির। ভরা বর্ষা ছাড়া ময়ূরাক্ষী বড়ই কৃপণা। তার পৃথুলা, বিবাগীনি বুকের পাঁজরে আগাছার মেলা তাকে আরো রুক্ষ্ম রূপ দিত গ্রীষ্মের খরখরে দিনগুলোয়। ফকিরের ঝাঁপাঝাঁপি মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেই আসরে নামত বাবা। বাবার শাসনের দমক কখনও কখনও নোনা রাত্তির বয়ে আনত ফকিরদের মেটে বাড়ির উত্তরকোণের ঘরে।
“কে হে তুমি? কোন দিকে যাবা? এমন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করচো কেনে?”
যেন এক ভুঁইফোঁড় মানুষ, নিজের মধ্যে ডুবে থাকা ফকিরের বেখেয়ালে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হেঁটো ধুতি আর ফতুয়া পরা লোকটাকে দেখে বড্ড লজ্জা পায় সে।
“এই তুমাদের গাঁয়েই যাবো কাকা...”
“অ তা আমি ভাবলাম পথ ভুলেচো বুজি! কাদের বাড়ি যাবা হে?”
“সিং বাড়ি কাকা......” বলতে বলতে বুকের ভিতর কাঁপন লাগে তার!
বর্ষার ঝিমঝিমে সন্ধেয় মাছের চপ, বেগুনি, চা সহ দীপনারায়ণ সিংহের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। সঙ্গে আছে সিং কত্তার বিলিতি লাল জলের মৌতাত। যারা এ রসে বঞ্চিত তাদের জন্য হুঁকো প্রস্তুত করাই থাকে। কারণ অতিথিদের অহবেলা দীপনারায়ণ সহ্য করতে পারেন না। এ ব্যাপারে তার যথেষ্ট সুনাম আছে। রোজকার মতো আজও এপাড়া ওপাড়া থেকে চক্কোত্তি খুড়ো ঘোষালবাবুরা ভিড় করেছে। উঠতি বড়লোক বলে এককালে দাঁতে দাঁত চেপে বড় অবজ্ঞা সয়েছেন তিনি । পাশের গঞ্জে তেলকলের পয়সা। আগে লোকে হাসত ‘কলুর কাজ’ বলে। এই অবজ্ঞা তাকে সাহস জুগিয়েছিল মহাজনী কারবার ফাঁদার। সেই থেকে গাঁয়ের গরীব গুরবো মানুষগুলোকে কায়দা করে জমি দখল করাটা তার কাছে এখন নতুন নেশার খেলা। বাবা, বাছা করে চওড়া সুদে টাকা ধারের টোপ গেলাতে পারলেই কেল্লা ফতে।
ঠিক ব্যাটারা ছটফটিয়ে জমি বন্ধক রেখে যায়। তা বলে উনি কারো ভিটে জবরদখল করেননি। ভিটেছাড়া করলে লোকগুলো তাকে রাজা বলে মানবেই বা কেন! তবে ব্যাতিক্রম দু একটা আছেই। এই যেমন মটরু পোটো। তার জমিজমা তেমন না থাকলেও বাড়িটা বড্ড ভালো জায়গায়। ময়ূরাক্ষীর চর বেয়ে উঠে আসা অস্থির হাওয়ারা নিকষ সবুজ সমুদ্রের ঢেউয়ে দুলে এক মেটে উপদ্বীপে মৃদু ঠোনা দেয় যেন! এরকম একটি জায়গায় বাগানবাড়ির বড্ড সাধ দীপনারায়ণের। সিংকত্তার মহাজনী হিসেবে স্বভাবতই মটরু একটু বেশিই লাই পায়।
আজ সিংকত্তার আড্ডার দমক শেষাবধি জাতপাতের আলোচনায় গিয়ে ঠেকলো। গেলাসে এক চুমুক দিয়ে ঘোষাল বলে উঠল,
“যাই বলো ভায়া! জাত নাই বেজাত নাই ঐ মটরু পোটোকে অত মাথায় তুলো নাকো!”
“ঠিক বলেছ বিভাস! ওদের আবার জাত আছে নাকি! ও শালারা হিঁদুও নয় আবার ঠিক করে মোসলমানও নয়!” হুঁকোর ধোঁয়া ছেড়ে চক্কোত্তি খুড়ো তাল মেলান। সবার দিকে চেয়ে দীপনারায়ণ মৃদু হেসে উত্তর করেন,
“ও ব্যাটাকে আমি আমার ঘরের বারান্দাতেও উঠতে দিইনা। ঐ উঠোনেই ওদের যা কেরামতি।“
মনে মনে ভাবেন আহা! বাগানবাড়িটা যদি করে ফেলা যেত তো আড্ডা আরও জমে উঠত। ঘরের লাগোয়া বারবাড়িতে বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা বসালে ভিতর বাড়িতে মাঝে মধ্যে বড় অসুবিধা হয়! তাছাড়া হাজার একটা সুবিধা অসুবিধায় মটরুই যে ভরসা!
ওদিকে মটরুর মেটে উপদ্বীপে তখন ক্ষুদ্র বিরক্তির ঢেউয়ের আনাগোনা।
“ছেলেটার নেহাত ঝ্যানর ঘ্যানর নাইকো...... নাহলে এই জোলো হাওয়ায় রেত-বিরেতে সিং বাড়িতে চললেন উনি...।“ মটরুর বউ এর ঝংকারে অদূরেই বজ্রপাত সঙ্গত করে। বউকে ঠান্ডা করতে বউ-এর কাছে ঘন হয়ে মটরু বলে,
“হুজুর বেপদে পড়েই না ডাকছে!... ই গাজলে পুকুরে বাঁদ না দিলের সব মাচ ভেসে যাবে যি...!”
##
এই এক মানুষ মটরু। বাবা-মা, ছেলে বৌ নিয়ে ময়ূরাক্ষীর ধার ঘেঁষা গ্রামে তার বাস। সিংবাড়ির সঙ্গে আনাগোনা দুগগা মন্দির লেপাপোঁছা, রঙ করা, আলপনা আঁকার সূত্র ধরে। এরা জাত পটুয়া। শিল্পধারা রক্তগত তাই। মাত্র দু তিনটি উজ্জ্বল রঙের চালনায় অনায়াস দক্ষতায় কিভাবে এঁকে ফেলা যায় জীবন্ত চরিত্র মটরুর বাবা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রথগাত্রে চিত্রাঙ্কণের পাশাপাশি মহরমের তাজিয়া নির্মাণেরও বরাত পেতো মটরুর বাবা। এরা শিল্পী কিন্তু বংশ পরম্পরায় কেউই পট কাঁধে পেটের খিদে মেটায়নি।
তার মাথার উপর ছাদ আছে, সেই মটরুর গর্ব। এক-দু বিঘে জমির ধান আর রঙ তুলি তার বছরকার খোরাকির জোগান দিয়েই থাকে। কখনও টান পড়লে সিং বাড়ির গিন্নিমাই ভরসা। নরম পলির মতো ঝুরঝুরে মন মানুষটার। মনে হাওয়া বাতাস খেলে। তাই গিন্নিমার মুখ চেয়ে মুনিবের কথা ফেলতে পারে না মটরু।
##
সেদিন রাত শেষে বৃষ্টি ঝরে ঝরে আকাশের আস্তরণ ছিঁড়ে সদ্য ভূমিষ্ঠ ঘোলাটে আলো ফুটে উঠেছে। তবে ভোর হওয়ার তখনও বাকি। মটরু এসে দীপনারায়ণ বাবুর বারবাড়ির বৈঠকখানার কড়া নাড়ল। বিনিদ্র রজনী আর বর্ষার সোহাগে কুঁচফলের মতো লাল চোখে মাছের ঝুড়িটা সামনে ধরল সে।
“সাবাস মটরু! এই না হলে তুই পোটোর বাচ্চা!” সোল্লাসে কত্তা প্রায় ঝুঁকে আসে মটরুর দিকে।
“পুকুরের জল ছেঁচে বাঁদ দিয়ে দিইচি কত্তা । আর মাচ পালাবে না!”
সন্ধ্যাকালীন পানাবেশের লেগে থাকা ঘোরে দীপনারায়ণবাবু বলে ওঠেন, “ তুই আমার জন্য এত কষ্ট করিস! তোকে আমার দুবিঘা জমি লিখে দোব কাল। মাঝে মধ্যে আমার কাছে যা ধার কর্জ করিস, তা আর করতে হবে না!”
ঘরে ফিরেই আদরে সোহাগে বউকে একরকম অস্থির করে তোলে মটরু পোটো...... “জানো! সিংকত্তা দুবিঘে জমি লিখে দেবে বলেচে...“
বউ অবাক হয়ে ঝেঁঝে ওঠে, “পাগল হইছ নাকি!”
“না রে ফকিরের মা! আমাদের কষ্ট দেখে গিন্নিমা কত্তারে কইচে মন করি!” গভীর বিশ্বাসে মটরু বলে।
কথা রাখতে কয়েকদিনের মধ্যেই কত্তামশাই সব কাগজ পত্তর তৈরি করে অক্ষরজ্ঞানহীন, সহজ, সরল মটরুর আঙুলের ছাপে তার ভবিষ্যৎলিপি রচনা করেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে লিপির নির্দেশে বৌ বাচ্চা নিয়ে ভিটেছাড়া হতে হয় মটরুকে। আজ বছর পনের ষোলো আগের দগদগে স্মৃতি সেসব। ময়ূরাক্ষীর থেকে অনেক দূরে ছিটেবেড়ার একচালা ঘরে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মটরু । ফকিরকে কিছুতেই আটকাতে পারল না সে। পাশ থেকে বউ বলে ওঠে,
“এয়া হওয়ারই ছিলো। উ টান যে সে টান লয়! ভিটে জমির টান । ......”
“সিং বাড়ি যাবা তা ইদিক পানে কি করচ!” আর খানিকটা গেলেই যে ময়ূরাক্ষীর ভরা যৌবন তার ইঙ্গিত দেয় মানুষটা।
“উল্টো পথে সিং বাড়ি , লয় কাকা?”
সম্মতিসূচক উত্তরে মানুষটার হাঁটা পথের দৃষ্টিরেখায় আবার রংবাহারি সবুজের ঢেউয়ে খেই হারিয়ে ফেলে ফকিরচাঁদ। এই সবুজ দুহাতে মেখে পটের রেখায় জীবন্ত করে না রাখলে জীবন বৃথা। এসময় দাদুর কথা বড্ড মনে পড়ে ফকিরের। দাদুর বুলি ছিলো, “হাত হাতি ঘোড়া/ তিন টিপন্যার গোড়া।।“ ভিটেমাটিহীন বাবা নতুন জায়গায় এসে লোকের জমি জিরেতে জুতে গেলো। জমির কাজ না থাকা দিনগুলোতে বেরিয়ে পরত পট কাঁধে। দিনরাত মুখে রক্ত তুলে সবার অন্ন জোটানো বাবার মেজাজ থাকত সপ্তমে। এই সবের মাঝে ছিটেবেড়ার বাড়ির পিছনপানের রুক্ষ্ম মাটির ঢালে খড়ি আর রঙ দিয়ে একমনে এঁকে চলত এক বালক। দাদুই তার শিক্ষক। সাথে কথারা গুনগুনিয়ে গান বুনত সেখানে,
“অ দাদু, পট কাঁদে গেরামে গেরামে বেড়ানো খুব ছোটো কাজ?”
“কাজের কোনো ছোটো বড় নাইকো। ভালো কাজই মানুষকে সগগে নিয়ে যায়...”
“তাইলে বাপ অতো রেগে থাকে কেনে?”
“পেট বড় জ্বালা ফকিরবাবা! নাইলে রঙ তুলি যে ধরে সেই শিল্পী! সারাজীবন সৎ মানুষ থাকলির পেটের অভাব হবে নাকো। বিবেককে সাদা রেখো বাবা! কালদূত, কৃষ্ণদূতকে বিবেকের দরজায় দাঁইড়ে রেকো!”
তারা দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার বংশধর। স্বয়ং জগন্নাথদেবের আশীর্বাদ আছে তাদের উপর এরকম আরও কত কথা , উপকথারা দাদুর হাত ধরে বিনবিনে মায়াজাল বুনত, যার অনেক কিছুই বালক ফকিরের মনে ঠাঁই পায় না সেসময়। শুধু শেষে দাদুর গুনগুনিয়ে ওঠা “যা খাবেন যা বিলোবেন এইতো ভবে সার।/ হরির নামে ধরা থাকবে হবে বৈকুণ্ঠ পার.........” মনে গেঁথে গিয়েছিলো! পটুয়ার ছেলেদের পাপ পূণ্যের ভয় যে রাখতেই হয়!
দশ এগারোতে পা রাখতে না রাখতেই বাবা তাকে সঙ্গী করে। সে শিল্পী , শিল্পীরা সাধকের নামান্তর ওসব কথা তখন পানসে। বাবার আজীবনের সংস্কার, চাট্টি ভাতের জোগাড়ের নেশায় লোকের দুয়োরে হাত পেতে দাঁড়ালো। যে মহল্লায় মটরু এসে জুটেছিলো, সেটা সে গাঁয়ের পোটোপাড়া। এখানে পোটোদের জাত কি, তারা হিন্দু না মুসলমান সে নিয়ে কেউ বদ রসিকতা করে না! পট দেখিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিই এদের জীবিকা। তাই মটরুর পট কাঁধে ছেলেকে নিয়ে দুয়োরে দুয়োরে হাত পাততে কোনো অসুবিধা হয়নি। ফকিরের মা আপত্তি করেছিলো। কিন্তু মটরুর এক জেদ, শিল্পী হওয়ার মতো আজেবাজে নেশা ছেড়ে ভুখ মেটাতে ভিখারি সাজাই ভালো।
প্রথম প্রথম ফকিরের এই ঘুরে বেড়ানোতে বেশ আনন্দই ছিলো। পাড়ার পোটোরা কেমন অজানাকে সঙ্গী করে দূরদূরান্তরের পথে পাড়ি দেয়। দু-দশদিন পরে নিরুদ্দেশের ঠিকানা থেকে কোঁচড়ে কিছু পয়সা গুঁজে বর্ষা সন্ধের চাতকের মতো বাড়ি ফেরে। আর কি বিচিত্র তাদের পটের বিষয়! কোথাও বিশ্বামিত্র রামলক্ষণের সাথে অনন্ত যাত্রায় বেরিয়েছেন। কোথাও বা কৃষ্ণার প্রেমাষ্পদ হওয়াই অর্জুনের একমাত্র লক্ষ্য, যে কৃষ্ণাকে জগতজনের কাছে অধোবদনে দাঁড়াতে হয় তাঁর অবিমিশ্র অপমানের দিনে। শুভ অশুভের দীন লড়াইয়ে বৈকুন্ঠ থেকে স্বয়ং ভগবান মানুষের বেশে ধরায় অবগাহন করেন পাপ-পূণ্যের স্রোতে। কিন্তু আজকাল নাকি এইসব নীতিকথার কদর নেই। তাই বেশিরভাগ পোটো সস্তাদরের প্রাসঙ্গিক আখ্যানে সুর ভাসিয়ে পেটের ভাত জোটায়।
এসব দীনতা ফকিরচাঁদকে যন্ত্রণা দিত। তার বাপের সমস্ত পটের শেষে পটজোড়া অন্তর্ভেদী দৃষ্টির কাছে মাথা নত করে ফুঁপিয়ে উঠত বালক মন। আর তখনই ফকিরচাঁদের চেতন অচেতন সীমানার বাধা ঘুচিয়ে তাকে ঘুরে ঘুরে মটরু পোটোর একটানা অলৌকিক সুরে কথারা আবর্ত রচনা করত—
“জগন্নাথের পথে যেতে বেউড় বাঁশের কাঁটা।
কুবীরের তোড়ানি খাবেন আর হাঁড়ির খাবেন ঝাঁটা”
পট হাতে ধরে জগন্নাথের কাছে গিয়ে ফকিরের আঙুল স্তব্ধ হয়ে যেত। টলটলে পাহাড়ি নদী নামত চোখের নরম পাতায়। কাজে মন বসত না তার। মটরু গান থামিয়ে পট গুটিয়ে নিত। বড় চিন্তা তার এই ছেলেকে নিয়ে। সে যে বাপ। কিকরে পেটের ভাত জুটবে ছেলেটার কে জানে!
অবশেষে একদিনের ঘটনায় মটরুর দুশ্চিন্তার অবসান ঘটল। সেদিন ছিলো রথের দিন। চারদিকে জমজমাটি মেলা খেলার ভীড়ে ফকিরের বড় সাধ হলো রথ বের করবে। বাপের রাগ, দাদুর স্নেহের তরলে গলে গেলো। পোটোপাড়ার ছেলে রথ বের করেছে। ছোটো চৌকোনা কাঠের সে রথ। মধ্যস্থানে জগন্নাথদেব অধিষ্ঠিত। টকটকে আগুনে লালের সমতলে কালো গোলাকার অভেদ্য আবর্ত। ভিতরের মণিটি আশ্চর্য রকমের সাদা। জগৎজোড়া স্বচ্ছ্ব দৃষ্টির আধার এক। দুপাশের নীল, লাল, সবুজ, হলুদের ফুল লতাপাতার গাঢ়ত্বে কৃষ্ণদূত দাঁড়িয়েছেন জগন্নাথের বেশে। চোখের কাকচক্ষু কালো জলে ভবসিন্ধুর সারাৎসার। সেদিন যেন অধরচাঁদ এসে ফকিরের হাত ধরেছেন। সমস্ত ব্যস্ততা ভুলে নীল বাড়ি, লাল রাস্তা পেরিয়ে মায়াঘেরা ছায়া পথে জগতপ্রভু চলেছেন। সম্মোহিত ফকির অপলক দ্যাখে। দ্যাখে আশেপাশের জনসমাগমও।
এই ঘটনার পর ফকিরের প্রথম ডাক পড়েছিল বামুনপাড়ার রথচিত্রণে। মজুরিও মিলেছিল। তারপর তাকে আর পট কাঁধে লোকের দুয়োরে হাত পাততে হয়নি। প্রতিমা ও প্রতিমার চালচিত্র নির্মাণ, পুতুল তৈরি, মহরমের তাজিয়া, জগন্নাথের রথে চড়ে ফকির পৌঁছে যায় মানুষের ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, গাঁয়ে- গঞ্জে। মন্দির – মসজিদ সেজে ওঠে ফকিরের তুলির রঙিন টানে, ফুল, লতাপাতায়। ভরে ওঠে মটরুর সংসারের বুভুক্ষু পেট।
উত্তর পশ্চিমের নিশানা ধরে পা চালিয়ে ফকির এসে দাঁড়ালো ঝোপ জঙ্গল আকীর্ণ ভাঙাচোরা প্রাসাদোপম অট্টালিকার সামনে। মহাকাল কৃষ্ণকায় শ্যাম শৈবালরূপে অট্টালিকার হৃদয় মাঝে নিশানা রেখে গেছে। শরতের লুকোচুরি খেলা মেঘ তখন ডেকে এনেছে একরাশ ঘোলাটে কালো অস্তিত্বকে, যেন সুদূর অতীত কৃষ্ণপক্ষ বিস্তার করে ঢেকে দিয়েছে বর্তমানের শ্বাস প্রশ্বাসকে।
বছর পনেরো আগের দাপুটে সিংদরজায় জং ধরেছে। আগাছা ডালপালা বিস্তার করে হাওয়ায় দুলছে। চমক লাগে ফকিরের। এই অতল ক্ষুধার্ত ইঁট পাথরের স্তুপের পাশে ক্ষয়ে যাওয়া নড়বড়ে দরজার ওপার থেকে কি দেখা যাবে ছায়াঘেরা শান্ত মলিন দৃষ্টি! একটা লালপেড়ে ঘিয়া খোলের জমিতে জড়ানো উজ্জ্বল হাসি ফকিরকে কি ডেকে নেবে ...’আয় বাছা বলে......’।
“তুই মটরুর ছেলে ফকির তো! ঝাঁপধরা ঘন আওয়াজে চমক ভেঙে স্মৃতি চোখ মেলে চায়। সরু পাড়ের ফরসা ধুতি আর ছাই রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি ।কাঁচাপাকা চুল, মোটা ফ্রেমের চশমা আভিজাত্যের ফেলে যাওয়া শেষ রেশটুকু টেনে রেখেছে। তবু কোথায় সেই দাপট। এ যেন অন্য মানুষ! অজান্তেই হাত জোড়া বুকের কাছে উঠে আসে ফকিরের। নির্ভীক গলায় সে বলে,
“আপনি খবর পাঠালেন বলেই এলাম কত্তা! গিন্নিমা ভালো আছেন তো!”
দীপনারায়ণ হেসে ওঠেন। ভরদুপুরের তাজা হাসিতেও এক অচিন বিষাদ খেলা করে যা নাড়া দেয় ফকিরকে।
“চল ফকির, ঠাকুর দালানে তোর গিন্নিমা তোর জন্য অপেক্ষা করছে...”
তড়িঘড়ি পা চালিয়ে আসে অস্থির ফকির। ঠাকুর দালানে সপরিবার মা দুগগা সাজসজ্জায় ব্যস্ত। কুমোর বড় যত্নে ঠোঁট রাঙাচ্ছেন মায়ের। মুখখানি অবিকল যেন গিন্নিমা। ফকির অস্ফুটে বিড়বিড় করে... গিন্নিমা!... গিন্নিমা!
“হ্যাঁ রে ফকির তোর গিন্নিমাই তোকে ডেকেছেন! যা , মায়ের ঘর সাজিয়ে দে! “
ভরদুপুরের হা হা বাতাসে কান্না ঘুলিয়ে ওঠে প্রৌঢ় দীপনারায়ণের গলায়,
“আমি তো ছিনিয়ে নিয়েছি শুধুই ! বিলাইনি কিছু কোনোদিন! তাই তোদের গিন্নিমাকে ভগবান ছিনিয়ে নিলে আমার থেকে! আমি দীপনারায়ণ সিং! আমারও জেদ, তোদের গিন্নিমার কাছে যাবো বলে বিলাতে বসেছি। তোরা আবার তোদের ভিটেজমিতে এসে বস রে ফকির!”
বিষাদের সুরেও মনটা ভরে ওঠে ফকিরের। সিং বাড়ির দুর্গা দালানে টকটকে লাল, গভীর কালো, নিপাট সাদার হিল্লোল তুলে লোহার ভারী কপাট সরিয়ে চালচিত্র আঁকে সে। যেখানে আছে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, শঙ্কর-শঙ্করী কৃষ্ণসখা কৃষ্ণা আর কালদূতের আধারে জ্বলজ্বলে সাদা চোখের মণি...... যা গিন্নিমার লাল পেড়ে সাদা খোলের জমির মতোই নির্মল, তীব্র, সতেজ... ফকিরচাঁদ রঙ নিয়ে খেলতে থাকে...... আঁকতে থাকে...... আর তার চোখে দুলে ওঠে একটি মেটে উপদ্বীপের পট......যাকে সযত্নে ঘিরে রেখেছে সবজেটে নীল কৃষ্ণ সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন