সুনেত্রা সাধু

মায়াজম
0

                                                          

বঙ্কার বোধদয়





স্টেশনে নেমে সাত মাইল পুবে গেলেই মোহনপুর গাঁ। গাঁয়ের পুকুরভরা মাছ আছে , মাঠ ভরা ফসল আছে , গাছ ভরা ফল আছে। দুটো ইস্কুল আর ছোটখাটো একটা বাজারও আছে, প্রয়োজনের সবই মেলে। মানুষে মানুষে সদ্ভাব আছে, মোটকথা গাঁয়ে শান্তি আছে, তবে শুধুমাত্র একজনের দৌরাত্ম্যে সেই শান্তি প্রায়ই বিঘ্নিত হয়। বঙ্কা, ওই বঙ্কা… আওয়াজ পেলেই গাঁয়ের লোক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওই শুরু হল….
“কোথায় যে যায় ছেলেটা। এই ছেলের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমার অর্ধেক জীবন শেষ হয়ে গেল, মরণ হলে বাঁচি।”
বিজন মাষ্টারে বউ আশালতা এইভাবে দিনে অন্তত বার তিনেক ছেলের খোঁজে বের হয়। কখনো মাষ্টার পড়াতে এসে বসে থাকে, বঙ্কা উধাও, ছুট লাগাও খুঁজতে। কখনো ইস্কুল বসার সময় হয়ে আসে বঙ্কা নিপাত্তা, ধরে আনো বনবাদার থেকে । কখনো দুপুর গড়িয়ে যাবো যাবো, ভাতের থালা নিয়ে আশালতা বসে আছে বঙ্কার আর খেলা শেষ হয় না, নিয়ে এসো টানতে টানতে। আশালতা বুঝে গিয়েছে এ ছেলের লেখা পড়া কিচ্ছু হবে না, টো টো করে ঘুরে বেড়িয়েই কাটাবে জীবন। কোন মতে সাত কেলাস পাশ দিয়েছে। আর পারবে বলে মনে হয় না, বইয়ের সাথে সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
বঙ্কার বাবা হেডমাষ্টার, আর তার ছেলের কিনা এই হাল! এ নিয়ে পাড়া প্রতিবেশী কি কম কানাঘুঁষো করে! তাদের দৃঢ় ধারণা এ ছেলে নির্ঘাৎ হাসপাতালে বদলে গিয়েছে, নইলে ওই শান্তশিষ্ট মেধাবী বাপের ওই ছেলে হয়! শুনে আশালতা লুকিয়ে কাঁদে, যতই হোক পেটের ছেলে তো, কিন্তু বঙ্কাকে বুঝিয়ে পারা যায় না। আজ এর গাছে আম পাড়ছে, কাল ওর ক্ষেতে আখ ভাঙছে, পরশু অন্যের বাড়ির মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ছে, বাছুরের দড়ি খুলে দিচ্ছে, অভিযোগের পর অভিযোগ শুনে আশালতা ক্লান্ত। এদিকে বাড়িতে কমল মাষ্টার বসে আছে কতক্ষণ হয়ে গেল, ছেলের দেখা নেই।
“বঙ্কা ওই বঙ্কা গেলি কোথা? আজ পাই তোকে, পিঠের ছাল চামড়া না তুলেছি তো আমার নাম আশালতা নয়।”
-“ও বৌ, সাত সকালে কাকে গাল পাড়ছিস লা?”
-“কাকে আর পাড়বো খুড়ি নিজের কপালকে পাড়ছি।”
“বঙ্কাকে খুঁজছিস? কটা শাক তুলতে গেছিলুম, দেখলুম তোদের বাড়ির পিছনের পুকুরে ছিপ ফেলে বসে আছে, সাথে মালো পাড়ার দুটো ছেলেও আছে। সাতসকালে আর রাগ করিস নে বৌ, ছেলেমানুষ।” ফোকলা মুখে হাসি ফুটিয়ে খনখনে গলায় খুড়িমা আশালতা কে শান্ত করতে চেষ্টা করে।
-“যাই খুড়ি মা বলে পেছন ফিরে হন্তদন্ত করে হাঁটা লাগালো আশালতা। ”
-“ও বৌ,তোকে আজ বিকেলে বিধু গুনিনের কাছে নে যাবো৷ একটা মাদুলি দিলেই ছেলে বশ মানবে দেখিস।”
আশালতা হাত নেড়ে সম্মতি জানায়।তার আর দাঁড়াবার সময় নেই।
শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে এক মনে জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছে বঙ্কা, হাতে ছিপ। ঠিক যেন ধ্যানস্থ যোগী। পাশে দুটো চ্যালাও চুপচাপ বসে, তারা মাঝে মাঝে তারা উশখুশ করছে বটে, বঙ্কার চোখ রাঙানীতে আবার স্থির হয়ে বসছে৷ বঁড়শির চার পাশে ছোট ছোট বুদবুদ, এইবার বাছাধনকে ঠিক বঁড়শিতে গেঁথে ফেলবে বঙ্কা। কিন্তু বিধি বাম। ধড়াম করে একটা কিল পড়লো বঙ্কার পিঠে। আশালতার রুদ্র মূর্তি দেখে মালো পাড়ার ছেলে দুটো চোঁ চাঁ দৌড় মেরেছে।
ছিপ রইল পড়ে বঙ্কার মা বঙ্কাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে খিড়কি দোড় দিয়ে ঘরে ঢুকে বসিয়ে দিল কমল মাস্টারের সামনে।
“আজ কোথা গিয়েছিলি?” সাইকেলের চাবি দিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে কমল মাষ্টার জিজ্ঞেস করল বঙ্কাকে।
-“আজ মাছটা প্রায় ধরেই ফেলেছিলাম বুঝলেন স্যার, মা চলে এল। একটুর জন্য ফসকে গেল। ”
-“অন্যায়, ঘোর অন্যায় করেছে তোর মা। তা সে মাছ দিয়ে কি করতিস? তোর মা ঘরে ঢুকতে দিত সে মাছ?”
-“না স্যার, আমি কি আমার জন্য ধরছিলাম! ওই মালো পাড়ার হারু আর বগা কাল বিকেলে খেলতে গিয়ে বলছিল কত দিন মাছ খাইনি৷ আমিই বললাম চলে আয় সকালে, আমাদের পুকুরে রুই কাতলা কিলবিল করছে ধরে দেব।”
-“ও, সমাজসেবা? তা বড় হয়ে কি নেতা হবি নাকি?”
-“হব স্যার। ভোটের আগে হারাণ কাকা কেমন হুড খোলা জিপে হাতজোড় করে গাঁ ঘোরে দ্যাখেন না! তেমনি ঘুরবো। নেতা হতে গেলে কি কি পাশ দিতে হয় স্যার ?”
-“কিছুই না, যেমন চালাচ্ছিস চালিয়ে যা। তা নেতা হলে একটা ইস্কুল মাষ্টারী জুটিয়ে দিস আমাকে।”
-“হ্যাঁ স্যার, বাবার মতো আপনাকে গাঁয়ের ইসকুলের হেডস্যার করে দেব।”
আশালতা এককাপ চা আর দুটো বিস্কুট মাষ্টারের সামনে ঠকাস করে নামিয়ে দিয়ে যায়। বঙ্কুর মাকে দেখে কমল মাষ্টার গলা খাঁকারি দিয়ে বলে নে ইতিহাস বইটা বার কর আজ সিপাহি বিদ্রোহ পড়াবো।
যেমন ছাত্র, তার তেমন মাষ্টার, গপ্প ফাঁদতে ওস্তাদ। আশালতা গজগজ করতে করতে স্বামীর ভাত বাড়ে। বঙ্কুর বাবা বিজন বাঁড়ুজ্জে উঠোনের টিউকল থেকে সদ্য স্নান সেরে বারান্দায় ঝোলানো আয়না দেখে চুল আঁচড়াচ্ছিল। বলল তুমি বড় বেশি চিন্তা করো আশালতা, ছেলে আর একটু বড় হোক, ঠিক বুদ্ধি হবে, পড়বে।
তুমি থাকো ওই আশাতে, ও ছেলের কিচ্ছু হবে না,এই আমি বলে দিলাম। আজ খুড়িমা বিকেলে বিধু গুনিনের কাছে নিয়ে যাবে, তাবিজ কবজ ছাড়া এ ছেলেকে বাগে আনা কঠিন।
-“তোমার মন চাইলে তুমি গুনিনের কাছে যেতেই পারো আশালতা কিন্তু জেনো, এসবে কিচ্ছু হয়না।”
-“আমার হয়েছে যত জ্বালা, তুমি নিজে হেড মাষ্টার, ছেলেটাকে বকে ধমকে তো পড়াতে পারো৷ তা নয়।”
-“জোর করে কি কিছু হয়? ওর হবে, তুমি দেখো, ঠিক হবে।”
কমল মাষ্টার এক ঘণ্টা নম নম করে পড়িয়ে বিদায় নিয়েছে আর সেই ফাঁকতালে বঙ্কাও কেটে পড়েছে খেলার ধান্দায়৷ এদিকে ইসকুলে যাবার সময় হয়ে গেল, বঙ্কার মা আবার ছুটেছে ছেলের পিছনে, “বঙ্কা ওই বঙ্কা, শিগগির ঘরে ঢোক”....
ইস্কুল থেকে ফিরে খেতে বসেছে বঙ্কা, কাঁসার থালায় ভাত মেখে বড় বড় গরাস তুলে খাইয়ে দিচ্ছে মা। আজ বঙ্কার মা একখানা পাটভাঙা হলুদ রঙের শাড়ী পরেছে, মুখে কি যেন মেখেছে, কি সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে।বঙ্কা মায়ের কোল ঘেঁষে বসল। জিজ্ঞেস করল “আজ কোথাও বেড়াতে যাব মা?”
-“আজ তোকে বিধু গুনিনের কাছে নিয়ে যাব, দেখবি একটু ঝাড়ফুক করে দিয়ে একটা মাদুলি দিলে তোর উড়নচণ্ডী ভাবটা কেটে যাবে, পড়ায় মন হবে।”
অন্যদিন হলে বঙ্কা একছুটে পালিয়ে যেত কিন্তু আজ কিছুতেই মা কে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করল না। ভালো ছেলের মতো লালকালো চেককাটা জামা গায়ে দিয়ে পাট পাট করে চুল আঁচড়ে চড়ে বসল কানাই কাকার রিক্সায়। বঙ্কা বসেছে মায়ের কোলে, পাশে খুড়ি ঠাকমা। রিক্সা পেরিয়ে যাচ্ছে হাইস্কুলের মাঠ। বাতাবি লেবুর বল দিয়ে জোর ফুটবল খেলা চলছে আজ। বঙ্কার ইচ্ছে করে রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে পালায় খেলার মাঠে। কিন্তু কেন জানি মায়ের শান্ত সুন্দর মুখটা দেখতে খুব ভালো লাগছে বঙ্কার। এক এক দিন ফাঁক পেলেই পটুয়া পাড়ায় মূর্তি গড়া দেখতে ছোটে বঙ্কা, আজ মাকে ঠিক সেই রকম লাগছে।
বিধু গুনিন নিতান্ত ঘরোয়া লোক। এমনি দিনে মাঠে চাষ আবাদ করে, সন্ধ্যেবেলায় চায়ের দোকানের মাচায় বসে বিড়ি ফোঁকে, গালগল্প করে, লোকের নিন্দেমন্দ করে, হাঁড়ির খবর সংগ্রহ করে, তার হাত গোনার কাজে এসব খবর কাজে লাগে। যেমন বামুন পাড়ার হারান চক্কোত্তির মেয়েকে সুবল দাসের ছেলের সাথে কেউ প্রেম করতে দেখল, খবর গেল বিধুর কানে, তারপর যদি জয় মা বলে হারান চক্কোত্তির বউ এর সাথে দেখা হয়ে গেল তখন বিধু শুরু করে আসল খেলা।
“বৌদি বাড়িতে সব ভাল তো? আপনার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারছি আপনার সময় একেবারেই ভাল যাচ্ছে না, মঙ্গলের ঘরে রাহু, সন্তান নিয়ে দুর্ভাবনা।”
এরপর আর কিছু বলতে হয় না। হারান চক্কোত্তির বউ গরগর করে দুখের কাহিনী বলে যায়। তার কাছে ঠিক হাজির হয় তাবিজ কবজের আশায়। এটা বিধুর মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজি। নয় নয় করে লোক ভালই হয়। শনি মঙ্গলবার সন্ধ্যাবেলা লাল রঙের ধুতি আর চাদর পরে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা কেটে বিধু সাধু বনে যায়।
আজ বাড়ি উঠোন ইতিমধ্যেই ভরে উঠেছে, বেশ কিছু লোক নানা সমস্যা নিয়ে হাজির। বঙ্কারা তিনজনে এসে দাঁড়ালো উঠোনে, বিধু গুনীন ব্যোমকালী বলে হুঙ্কার ছেড়ে বলল "মা, ছেলে নিয়ে তোর জ্বালা আমি বুঝি রে, আমার কাছে না এলে এ ছেলে বড় হয়ে ডাকাত হত, আয় ঝেড়ে ফুঁকে দিই, দেখিস কেমন শান্ত হয়।”
বঙ্কা মনে মনে ভাবে ডাকাত হবে! দাঁড়া কালই যদি তোর গোয়ালের সব গরু বাছুরের দড়ি না খুলে দিই তো আমার নাম বঙ্কা নয়। যাইহোক প্রিভিলেজড কাস্টমার বলে একটা কথা হয়, আশালতাকে অপেক্ষা করতে হল না। বঙ্কাকে বসানো হল আসনে, বিধু গুনিন একটা চামর নিয়ে বুলিয়ে দিল বঙ্কার মাথায়, তারপর বিড়বিড় করে মন্ত্র বলে তিনবার ফুঁ দিল। মন্ত্রপূত জল খাইয়ে ঝাড়াঝুড়ির পর্ব মিটলো। একটা মাদুলী বেঁধে দেওয়া হল বঙ্কার বাজুতে। আশালতা বেশ ভাল রকম দক্ষিণেই দিল, বিধু খুশ।
বলল “দেখিস মা এ ছেলে যদি শান্ত না হয় তুই আমার নামে কুকুর পুষবি।” আশালতা আশার আলো দেখল। ফেরার সময় শিবু ময়রার দোকান থেকে তেলেভাজা আর জিলিপি কিনল, খুড়িকেও কিনে দিল। রিক্সা যখন বাড়ি পৌঁছলো তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেছে।
একতলা কোঠা বাড়ি বঙ্কাদের, পিছনে পুকুর একপাশে আমবাগান, সামনে বড় উঠোন আর কলতলা নিয়ে বেশ স্বচ্ছল অবস্থা৷ আমবাগানের গা ঘেঁষে যে ঘরখানা সেই ঘরে এখন একাই থাকে বঙ্কা। পাশের ঘরে মা বাবা৷ সাত কেলাস পাশ দিয়েছে, বঙ্কা বুঝি বড় হয়নি? তবে রাতের বেলা আমবাগানের দিকে তাকালে যে গা ছমছম করে না তা নয়। ভূত বলে মনে হয় কিছু নেই, থাকলে বঙ্কা এতদিনে দেখা পেত না? তবে এ ধারণা অচিরেই ভুল প্রমানিত হল।
তখন মাঝরাত সবে পেরিয়েছে, সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, অন্যদিন বঙ্কারও এক ঘুমেই সকাল হয় আজ মনে হল কে যেন পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ঘুম চোখে উঠে কারো দেখা মিলল না। খানিক ক্ষণ ঝিম ধরে বিছানায় বসে রইল, ততক্ষণে আঁধারে চোখ সয়ে এসেছে। ঠিক চোখের সামনে রোগা কালো, হাড়জিরজিরে খাটো ধুতি পরা লোক দেখে ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল বঙ্কার, মা বলে চেঁচাতে গেল কিন্তু আওয়াজ বেরোল না। লোকটা খোনা খোনা গলায় বলল“ ভঁয় পাঁসনি বঁঙ্কা, এঁকটা জঁরুরি কঁথা ছিঁল তাঁই আঁসা।” ভূত! বঙ্কা কাঠ হয়ে বসে আছে।
ভূতটা বলল, “আঁমি নেঁতাই , এঁই তোঁদের আঁমবাঁগানেই থাঁকি। কিঁন্তু আঁজকাল তোঁর মায়ের চিঁৎকারে তোঁ দিঁনের বেঁলা আঁমার ঘুঁমনো দাঁয় হঁয়েছে রেঁ, রাঁতের বেঁলা ঢুঁলুনি আঁসে, কাঁজ কাঁম কঁত্তে পাঁরিনা। তুঁই দৌঁরাত্ম্য এঁকটু কঁম কঁরে পঁড়াশোনা কঁরলেই সঁব ঝাঁমেলা মিঁটে যাঁয়। আঁজ থেঁকে তুঁই তাঁই কঁরবি। যঁদি দেঁখেছি পঁড়া ফেঁলে উঁঠে উঁড়নচণ্ডীপনা কঁরতে ঘাঁড় মঁটকে দেঁব।
উঁঠে পঁর ভোঁর হঁতে চঁলল, পঁড়তে বঁস। পুঁকুর পাঁড়ের ওঁই বেঁটে আঁমগাঁছে আঁমি থাঁকি, ওঁই গাঁছে বঁসে সঁব দেঁখছি, মঁনে রাঁখবি। বেঁচাল দেঁখলে প্রঁথমে জাঁনলায় ঢিঁল মাঁরবো আঁর তাঁরপরেও যঁদি বেঁগড়বাই দেঁখি সোঁজা ঘাঁড় মঁটকানি। মঁনে থাঁকে যেঁন।”
কোন রকমে উঠে বঙ্কা ঘরের আলোটা জ্বালাতে পেরেছে। ঘরে কেউ নেই, বিশ্বাস কি বাবা কখন ভূত আসে, তার চেয়ে পড়তে বসাই ভালো। ইতিহাস বইটা নিয়ে জোরে জোরে সিপাহি বিদ্রোহের কথা পড়তে শুরু করে বঙ্কা। তখন সবে রাঙা হয়েছে পুব আকাশ। ভোরে ওঠা আশালতার বরাবরের অভ্যেস। কিন্তু ভোরবেলা গুন গুন শব্দ আসে কোত্থেকে? শব্দ খুঁজতে খুঁজতে বঙ্কার ঘরে ঢুকে আশালতা অবাক! ভোরে উঠে বঙ্কা পড়ছে! ছুটে পাশের ঘরে গিয়ে বিজনকে ধাক্কা দেয় আশালতা। “ওগো শুনছ? বঙ্কা পড়ছে! দেখেছ বিধু গুনিনের মাদুলির জোর!”
“বাঃ ভালো তো,” বলে পাশ ফিরে আবার ঘুমে ডুবে যায় বঙ্কার বাবা।
ইতিহাসের পর বিজ্ঞান পড়েছে বঙ্কা, তারপর অঙ্ক কষেছে। মা দুধ বিস্কুট দিয়ে গেছে, পড়ার টেবিলে বসেই খেয়েছে একটুও ফাঁকি দেয়নি। কমল মাষ্টার পড়াতে এসে পড়ার টেবিলে বঙ্কাকে দেখে দুবার চোখ কচলে নিয়েছে। হোমটাস্কের খাতা আজ ভর্তি। কমল মাষ্টার কে আজ লুচি আলুরদম খেতে দিয়েছে আশালতা, তার আজ খুশির সীমা নেই। বঙ্কা সময়ে স্কুলে গিয়েছে, ফিরে খেলা করে সুবোধ বালকের মত সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে পড়তে বসেছে। বঙ্কার এ হেন পরিবর্তনে বঙ্কার মা ঘন ঘন কপালে হাত দিয়ে প্রণাম করছে।
ভোর রাতে ভূত নেতাই আবার হাজির। সুড়সুড়ি দিয়ে আজও উঠিয়ে দিয়েছে বঙ্কাকে। “বুঁঝলি আঁজ জোঁর ঘুঁম দিঁয়েছি দিঁনের বেঁলা। তোঁর মাঁয়ের বঁঙ্কা বঁঙ্কা চিঁৎকারে কাঁক চিঁল বঁসতে পেঁত নাঁ। আঁজ সারাদিন সেঁ চিঁৎকার নেঁই। তুঁই ভাঁলো ছেঁলে হঁলি আঁমি ভূঁত হঁয়েও বাঁচলাম রেঁ। লেঁগে থাঁক তোঁর পঁড়াশোনা হঁবে, রোঁজ আঁমি ভোঁর বেঁলা ডেঁকে দেঁব, ফাঁকি দিলেই মঁটাৎ কঁরে ঘাঁড়টি ভাঁঙব। মঁনে থাঁকে যেঁন।”
বঙ্কা আজ একটু কম ভয় পেল, নেতাই মুখে যাই বলুক খুব একটা খারাপ ভূত নয় মনে হয়, আর একটু ঘুমিয়ে নেবে ভেবে বালিশে মাথা ঠেকাতেই খটাঙ্ করে ঢিল পড়ল জানলায়। বঙ্কা তড়িঘড়ি উঠে পড়তে বসল। সালোকসংশ্লেষ কাকে বলে? জোরে জোরে মুখস্থ করতে লাগলো সে।
বঙ্কার এ হেন পরিবর্তনে গাঁয়ের লোক যারপরনাই অবাক। হলটা কি? পুকুরঘাট, চন্ডীমন্ডপ, ছেলেপুলের আড্ডা, চায়ের দোকান সর্বত্র বঙ্কার চর্চা। বিধু গুনিনের উপর গাঁয়ের লোকের বিশ্বাস বাড়লো চড়চড় করে। আজকাল তার চাষ আবাদের ফুরসত নেই, বাড়ির সামনে একটা বোর্ড লাগিয়েছে, "শ্রী শ্রী আচার্য বিধুবিনোদানন্দন, শ্রাস্ত্রজ্ঞ জ্যোতিষি" আশালতার যেন অর্ধেক কাজ কমে গিয়েছে, সেই কবে একটা আসন সেলাই করতে শুরু করেছিল শেষ করা হয়নি, সেইটা বার করে সেলাই করে সন্ধ্যে বেলা। বঙ্কা পড়ে, মাঝে মাঝে বাবার কাছে পড়া দেখিয়ে নেয়। বিকেল ছাড়া বন্ধুরা আর তাকে পায় না, জানলা দিয়ে উঁকি ঝুঁকি মেরে বঙ্কাকে অসময়ে বিরক্ত করলে কে যেন ঢেলা মারে। পড়ার নেশা যাকে ধরে সে আর বেরোতে পারেনা সেই নেশা ছেড়ে, বঙ্কার সেই অবস্থা। ভোররাতে নেতাই এর ডাকে ঘুম ভাঙে, গল্প হয় অল্পস্বল্প। নেতাই বলেছে আমবাগানে ভূতের কমতি নেই, তবে সবাই নেতাই এর মতো দেহ ধরতে পারে না। ভূতেরও সৎ অসৎ ভাগ আছে। নেতাই এর পরামর্শে কবেই মাদুলিখানা খুলে পুকুরে ছুঁড়ে দিয়েছে বঙ্কা, মা টের পায়নি।
বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে দেখা গেল বঙ্কা সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে ক্লাসে প্রথম হয়ে। স্যারেরা আভাস পাচ্ছিলই কিন্তু প্রথম হবে সে আশা করেনি, এমনও হয়! সবথেকে করুণ অবস্থা বরাবরের প্রথম ছাত্র পরিমল ভট্টাচার্যের। সে নিজের চোখ কান কিছুকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখের জলে শার্ট ভিজিয়ে ফেলেছে। বঙ্কার অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে। ছুটি হলে প্রোগেস রিপোর্টটা নিয়ে ছুট্টে আমবাগানে ঢোকে সে , পুকুর পাড়ে বেঁটে আমগাছটার ডালে উঠে ডাকে নেতাই কাকা, ও নেতাই কাকা দেখো আমি ফার্স্ট হয়েছি। বঙ্কা সারা পায় না, এমনকি ঢিল মেরেও কেউ জানান দেয় না উপস্থিতি। বঙ্কার একটু মন খারাপ হয়, নেমে আসে গাছ থেকে। হটাৎ কানের পাশ দিয়ে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়, ফিসফিসিয়ে কানের কাছে নেতাই বলে “আঁজ আঁমার মুঁক্তিরে বঁঙ্কা আঁর আঁসব নাঁ, এঁগারো কেঁলাসে যঁখন পঁড়তাম তঁখন খুঁব জ্বঁর হোঁল জাঁনিস মঁরে গেঁলাম, পঁরীক্ষা দেঁওয়া হঁল নাঁ। ছিঁলাম তোঁর মঁতোই দুঁরন্ত, কিঁন্তু বঁড় আঁশা ছিঁল পঁড়া কঁরতে বিঁলেত যাঁব। তোঁর মঁধ্যে আঁমি নিঁজেকে খুঁজে পাঁই। আঁমি জাঁনি আঁমি পাঁরিনি, তু্ঁই পাঁরবি। তঁবে আঁমি তোঁর কাঁকা নঁই, পুঁরনো অ্যাঁলবাম খুঁজিস আঁমায় পাঁবি।” শুকনো আমপাতায় ঘুর্ণি তুলে ঠান্ডা বাতাস মিলিয়ে যায়।
রেজাল্ট নিয়ে ঘরে ঢুকলে আশালতা জড়িয়ে ধরে ছেলেকে, বঙ্কার বাবা বিজন বাড়ুজ্জে বুক ফুলিয়ে বলে “কার ছেলে দেখতে হবে তো! আমি জানি বাপ ঠাকুর্দ্দার নাম রাখবে আমার ছেলে।”
বঙ্কা বলে “মা আমায় পুরনো অ্যালবামটা দেখতে দেবে একবার?”
আশালতা একটু অবাক হয় তার পর তোরঙ্গ খুলে বের করে দেয় পুরনো অ্যালবাম। হলুদ হয়ে আসা ছবি গুলো খুঁজতে খুঁজতে একটা ছবিতে চোখ আটকে কে যায় বঙ্কার, দাদুর পাশে দাঁড়িয়ে তার ছোট ভাই, যাকে এই কমাস রোজ ভোররাতে দেখেছে বঙ্কা। বাবাকে জিজ্ঞেস করে বাবা দাদুর ছোট ভাইয়ের ডাক নাম কি নেতাই ছিল? বিজন আর আশালতা একসাথে বলে ওঠে তুই কি করে জানলি???

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)