অর্ঘ্য রায় চৌধুরী - মায়াজম

Breaking

২২ অক্টো, ২০২০

অর্ঘ্য রায় চৌধুরী

                                                    প্রেতবস্তু






কাজের সূত্রে কিছুদিন একটা মফঃস্বলে থাকতে হয়েছিল।যে বাড়িতে থাকতাম তার চারপাশে ফাঁকা মাঠ, অনেকটা উঠোন পেরিয়ে পাঁচিল।পাঁচিলের ওপাশে জঙ্গল।বাড়ির ঠিক গা ঘেঁষেই ছিল একটা তাল গাছ, তারপর একটু দূরে পরপর দুটো বেল আর শ্যাওড়া গাছ।

সন্ধে হতে না হতেই চারিদিক নিঃঝুম হয়ে যেত।কিছু করার থাকতো না বলে অনেক রাত ওবধি কোন না কোন বই পড়তাম বা ভালো হলিউড মুভি দেখতাম।বই আর ভালো সিনেমার নেশা আমার বহুদিনের।তারপর শুয়ে পড়তাম।

ওখানে খাবার জলের খুব অভাব ছিল বলে স্বপন বলে একটা লোককে রেখেছিলাম।সে রোজ সন্ধেবেলা এসে দুটো ড্রাম ভর্তি করে জল দিয়ে যেত, স্বপনের ঝাঁকড়া চুল, লম্বা, দড়ির মত পাকানো চেহারা, মোটা গোঁফ, ওরকম বিশ্বস্ত লোক পরে আমার আর কখনও চোখে পড়েনি।

প্রথম কটা দিন ভালোভাবে কাটলেও, কিছুদিন পর থেকে চোরের উৎপাত শুরু হল।প্রায়ই মাঝরাতে দেখতাম জানলার ধারে দাঁড়িয়ে একটা ছায়ামূর্তি ভেতরে হাত ঢোকানোর চেষ্টা করছে, বা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।ভয় আমি খুব একটা পাই না।কারন ছোট থেকেই বহু বিচিত্র জিনিস দেখে আমার অভ্যেস হয়ে গেছে।

ভালো করে লক্ষ্য করলাম ওটা একটা কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে।ভেতরে ঢুকতে পারবে না জেনেই নিশ্চিন্ত থাকতাম।

কিন্তু যেদিন ও পাঁচিল টপকে উঠোনে নেমে পড়ল, সেদিন আমাকেও ভেতর থেকে আওয়াজ দিতে হল।ছেলেটা ওই আওয়াজ শুনেই পালিয়ে গেছিল।

পরের দিন স্বপনকে ঘটনাটা বললাম।স্বপন সব শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে বলেছিল " আপনি আবার যখন বাড়ি যাবেন, আমাকে বলবেন, আমি রাতে এসে এমন একটা জিনিস করে দিয়ে যাবো, যে বাড়িতে আর চোর কেন? ডাকাতও আসতে পারবে না।" শুনে নিশ্চিন্ত হলাম।

সোমবার আমার ছুটি থাকত, রোববার বিকেলে অফিস করে তাই বাড়িতে চলে আসতাম।আবার ফিরতাম মঙ্গলবার সকালে।

রোববার বিকেলে স্বপনকে বাড়ির একটা ডুপ্লিকেট চাবি বুঝিয়ে দিলাম।জিজ্ঞেস করলাম "কী করবে?" স্বপন একটা মোটা আর লম্বা পেরেক লুঙ্গির ভাঁজ থেকে বের করে দেখালো।আর একটা আধময়লা পুঁটুলির ভেতর অন্যকিছু একটা ছিল।বলল ওটা নৌকার পেরেক, ওটা যদি দেওয়ালে হাতুড়ির এক আঘাতে গেঁথে দেওয়া যায় তাহলে বাড়িটা বাঁধা হয়ে যাবে, আর ওই পুঁটুলির ভিতর এমন একটা কিছু আছে যেটা ও আমার বাড়ির কোন এক নির্জন কোনে পুঁতে দিয়ে যাবে।ওটা ও আমাকে বলবে না।যার কাছ থেকে এটা ও শিখেছে সে ওই বিশেষ বস্তুটার কথা কাউকে বলতে না করেছে।তবে ওই বস্তুটাই বাড়ি পাহারা দেবে।

আমি আর জানতে চাইনি।জানতাম এসব ব্ল্যাক ম্যাজিকের অনেক গোপনীয়তা থাকে।বিকেলের ট্রেন ধরে বাড়ি চলে এলাম।
মঙ্গলবার ফিরে গিয়ে দেখি উঠোনের একপাশে রান্নাঘর আর শোওয়ার ঘরের মাঝের দেওয়ালে পেরেকটা প্রায় অর্ধেকেরও বেশি করে গাঁথা হয়ে আছে, কিন্তু ওই বিশেষ রহস্যময় জিনিসটা ও কোথায় পুঁতেছে সেটা বোঝা গেল না।আমিও স্বপনকে আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

সেদিন থেকে এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, আমার বাড়িতে কুকুর, বিড়াল আর পাখিদের আসা বন্ধ হয়ে গেল।টবে কিছু ফুলগাছ ছিল, সেগুলো জল দেওয়া সত্বেও শুকিয়ে যেতে লাগলো।রাত হলে মনে হত উঠোনে যেন কিছু একটা হেঁটে বেড়াচ্ছে।আমি খুব একটা পাত্তা দিইনি।ভেবেছিলাম এগুলো জেনেছি বলেই হয়ত অবচেতনে কোন প্রতিক্রিয়া হয়েছে।আসলে কিছুই না।কিন্তু দেখলাম চোর আসাটা সত্যি সত্যি বন্ধ হয়ে গেল।

সেবার দুসপ্তাহ পর আবার বাড়িতে এসেছি, নটা নাগাদ স্বপনের ফোন, "বাবু আজ রাতটা আপনার বাড়িতে একটু থাকবো, এদিকে এসেছিলাম একটা কাজে, কাজটা মিটতে মিটতে রাত হয়ে যাবে।জানেনই তো আমার সেই গ্রামের ভিতরে বাড়ি।অত রাতে আর ও পথে যেতে সাহস হয় না।" বললাম "ঠিক আছে থাকো, ডুপ্লিকেট চাবি তো তোমার কাছে আছেই।" স্বপন খুব খুশি হল।

মঙ্গলবার ফিরে এসে দেখলাম দরজায় তালা দেওয়া, সব ঠিকঠাক আছে।সন্ধেবেলা টিভিটা চালিয়ে খবর শুনতে বসেছি, এমন সময় স্বপন এল।"বাবু এ ঘর ছেড়ে দিন।"আমি অবাক হয়ে বললাম "কেন?" বলল "না না এ ঘরে আর থাকবেন না, এই ঘরে দানো লেগেছে।" আমি বললাম "কী বলছ এসব কথা?" বলল "বিশ্বাস না হলে রাত এগারোটার পর এই বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করে দেখবেন, মারা পড়ে যাবেন।" বললাম "কী হয়েছে ঘটনাটা তো খুলে বল।"

ও যা বলল সেরকম ঘটনা আমি তার আগে জীবনে কখনও শুনিনি।

স্বপন বলেছিল, সেদিন রাত্রে ওর আসতে আসতে বেশ রাতই হয়ে যায়, বেশ রাত মানে এগারোটা, ওসব জায়গাতে এগারোটা মানে ভালোই রাত।ও বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখে ছাদের ওপর একটা লোক বসে আছে, খালি গা, নির্লোম শরীর, মুখের গড়ন বালকের মতো, কিন্তু গোটা মুখটাতে প্রচন্ড হিংস্রতা মাখানো।লোকটার পা দুটো ছাদ থেকে নেমে এসে প্রায় মাটি ছুঁয়েছে।
ওই জিনিস দেখে স্বপন আর এগোতে পারেনি।কোনওরকমে বাড়ি ফিরে গেছিল।

পরদিন এই ঘটনাটা ওর গুরুকে বলাতে সে বলেছিল, ওই রহস্যময় জিনিসটা যেখানে পোঁতার কথা ছিল সেখানে সেটা না হয়ে অন্যদিকে হয়ে গেছে।এবার যে ওই বাড়ি পাহারা দিতে এসেছে, সৎ উদ্দেশ্যেও কেউ যদি কখনও একটু রাত করে ওই বাড়িতে ঢুকতে যায় সে তাকে মেরে ফেলবে।

আমি স্বপনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "ওই পুঁটুলির মধ্যের জিনিসটা কী ছিল?"

অনেক দোনোমোনো করে স্বপন বলেছিল কালো বিড়ালের হাড়।আর এ নাকী এমনই জিনিস, যে একবার মাটিতে পুঁতলে সেটা আর পরে ওখানে পাওয়া যায় না।ওটা মাটির নীচে স্হানপরিবর্তন করে।আর একবার এটা মাটিতে পোঁতা হয়ে গেলে কোন গুণীনের সাধ্য নেই এর স্হানপরিবর্তনকে আটকায়।

আমি স্বপনকে বলেছিলাম এসব ছেড়ে দিতে, আমি যতটুকু জানি এসব জিনিস যে শেখে, কোন না কোন সময় কোন অসাবধানী মূহুর্তে এই জিনিসগুলোই তার মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়ায়।স্বপন বলেছিল ছেড়ে দেবে।

তারপরেই ওই বাড়ি আমি পালটে ফেলি।অনেক পরে আবার একবার একদিনের জন্য ওখানে গেছিলাম।স্বপনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।শুনলাম তারপর থেকে তখনও পর্যন্ত ওই বাড়িতে আর কেউ এসে থাকতে পারেনি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র