মানিক সাহা

মায়াজম
0

                                                 ব্রজবালা




ছোটবেলায়, আমার যতদূর ছোটবেলা মনে পড়ে, ঠাকুমার সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব ছিল। অন্য নাতি নাতনিদের থেকে আমাকেই একটু বেশিই ভালো বাসতো মনে হয়। ঘরে পাতা দই ঠাকুমার প্রিয় ছিল। দুপুরে আহারের পর দই থাকতোই। মাঝে মাঝেই আমাকে ডাক দিয়ে বলতো, "বিশ্বনাথ খাবি না কি এট্টু? দইটা খুব ভালো জমছে। "
আমি কালে ভদ্রে খেতাম। আমার খুব একটা ভালো লাগতো না। অথচ প্রতিদিনই ঠাকুমার কাছে সেদিনের দই অন্য দিনের থেকে অনেক বেশি ভালো মনে হত। আমার মনে হত দইয়ের স্বাদ বা গন্ধের কোন পার্থক্য হয়নি। ওটা ওর মনগড়া কথা। হয়তো আমাকে খাওয়াবে বলে অভিনয় করতো। বুড়ো মানুষেরা এমন অভিনয় করে৷ গল্প করার মধ্যেও অভিনয় থাকে। শুনে মনে হয় যে গল্প বলছে সে হয়তো চাক্ষুষ করেছে। বয়সের বিস্তৃতি আর গায়ের চামড়ার ভাঁজ, দাঁতহীন মুখগহ্বর, ঘোলাটে চোখ - এসব দেখে অবিশ্বাস করারও উপায় থাকে না। মনে হয় তারা সত্যি যেন সেই যুগ অতিক্রম করে এসেছে।
ঠাকুমা সুতো-বাঁধা চশমা পরে দুপুরে খাওয়ার পর চৈতন্যচরিতামৃত পাঠ করতো। সুর করে পড়ার ভঙ্গিমা দেখে মনে হত বর্ষার জলের উপর দিয়ে সাঁতরে যাওয়া সাপ মাথা উঁচু করে এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে। মগ্ন হয়ে শুনতাম। যদিও চৈতন্যচরতামৃত'র কথার চেয়ে পড়ার সুর আর ভঙ্গিমাটাই বেশি ভালো লাগতো। ঠাকুমার এই পাঠ যেন রূপকথার গল্প হয়ে আসতো আমার কাছে। তার ভেতর দিয়ে অজস্র দত্যি দানো, অজস্র অরণ্য জঙ্গল আর তাতে লুকিয়ে থাকা রাক্ষসের দলকে দত্যা করতে যাওয়ার রোমাঞ্চ খেলে যেত। যেদিন রামায়ণের মোটা বইটা নিয়ে বসতো নিজেকেই মনে হত কোন যোদ্ধা। হাতে বাঁশের ধণুক আর পাটকাঠির তীর। প্রতি রাতে স্বপ্নে এক্টা সাদা রঙের ঘোড়া এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেত। আমি মেঘের উপর দিয়ে যেতে যেতে স্কুলের কোন বান্ধবীকে বা পাড়ার কোন দিদিকে দেখতে পেতাম। রামায়ণের ছবিগুলি থেকে রাক্ষসগুলো জ্যান্ত হয়ে আসতো। তারপর ধুন্ধুমার!
একটু বড় হতে শুরু করলে ঠাকুমার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে৷ আর ঠাকুমার ঘরে গিয়ে যত রাজ্যের রহস্য ও বানানো ভূত-পেতনির ভালো লাগতো না। একটু একটু বুঝতে শুরু করেছি৷ তার উপর স্কুলের পড়া। খেলা। বন্ধু বান্ধব। কিন্তু দুপুরে খাওয়ার শেষে মাঝে মধ্যেই বিশ্বনাথ বলে ডাকটা শোনা যেত। অধিকাংশ দিনই উত্তর পেত না। আর মাঝে মধ্যে রাগ করে দু একটা চিৎকার ভেসে যেত ঠাকুমার দিকে৷ মন খারাপ করতো হয়তো৷ রাগ করতো। বিড় বিড় করে কিছু বলতো।
আমাদের ভিন্ন হাড়ির এক উঠোনের বাড়ি। জেঠতুতো খুড়তুতো মিলিয়ে তখন বারোটি বাচ্চা। ঠাকুমা প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম দিয়েছিল। দেবদেবীর নামে নাম। কেউ পদ্মা, কেউ কমলা, কেউ বিশ্বনাথ কেউ গুপিনাথ ইত্যাদি। ঠাকুমা যখন সেই নাম ধরে ডাকতো তখন নিজেকে ঠাকুর মনে হত৷ মাটির তৈরি। অথচ আমি নড়তে চড়তে পারি৷ ভোগ আরতির সময় আমার সামনেই ধুপ ধুনো দেওয়া হয়। চিনির পায়েস যার উপর তুলতুলে মালভোগ কলা আর সাদা ফুল। গড়ুরের পিঠে চেপে উড়ে বেড়াচ্ছি। সম্বৎসর দোল পূর্ণিমার দিন হরি পূজা হত। আমার জন্মের পর, ঠাকুমার কাছে শুনেছি, ঠাকুমা স্বপ্নে হরি ঠাকুরের নতুন রূপ দেখলো - গড়ুরের পিঠে বসে আছেন শ্রীহরি বিষ্ণু। সেবার স্বপ্নে পাওয়া রূপেই পূজা হয়। তারপর বহুদিন এই গড়ুরের পিঠেবসা শ্রীহরির মূর্তি পূজা হত। তার আগে ছিল লক্ষ্মী নারায়ণের মূর্তি। পরে অবশ্য সেই মূর্তি আবার কোন এক অজ্ঞাত কারণে ফিরে আসে।
ছোটবেলায় সাপ খোপের সঙ্গে আমাদের ছিল নিত্যদিনের দেখাসাক্ষাৎ। বিরাট একটা ঘরে ঠাকুমা একা ঘুমোত। সেখানে অন্য কারো ঘুমনোর অধিকার ছিলনা। একবার বর্ষার রাত। মাঝারি চৌকি হলেও তা ভর্তি ছিল বইপত্র, কাপড়ের পুটুলি, কাঁথা আর কোন গোপন সম্পদে। একটা মাঝারি সাইজের টিনের তোরঙ্গ ছিল। তাতে ছিল নতুন কাপড়, খুচরো পয়সার কৌটো, ঠাকুরদার লেখার খাতা, আর দু তিনটি গোপন বই যা আমাদের হাত দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল । এতকিছু রাখার ফলে ঠাকুমার শোয়ার জায়গাটিই কেবল অবশিষ্ট থাকতো। তার বেশি জায়গা হত না।
একদিন ঠাকুমা সকাল বেলায় ডেকে নিয়ে সে রাতের অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করলো যার মর্মার্থ এরকমঃ
বাইরে ঝিমঝিম বৃষ্টি।( বাড়িতে তখনও ইলেক্ট্রিক ঢোকেনি। রাতে ঘুমনোর সময় একটা টিমটিমে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা হয়।) ঠাকুমা হঠাৎ শুনলেন কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে আর ডাকছে। শুনতে পারছে অথচ ওঠার ক্ষমতা নেই। ঠাকুমা ভাবলো - 'আমারে বুঝি নিশিতে ডাকতাছে। শুনতাছি, তয় উঠ্যা পারতাছিনা।'
অনেক কষ্ট করে ঠাকুমা পাশ ফিরলো। আর তার হাত গিয়ে পড়ল ঠান্ডা কিছুর উপর। বুঝতে বাকি রইল না যে সেটা একটা সাপ। এবার ওর মনে হল যে এই সাপটাই হয়তো মায়ামন্ত্র করে এসব ঘটাচ্ছে। এসব ভাবনা তখনকার দিনে খুব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে সাপটা বিষাক্ত ছিলনা এবং ঠাকুমার হাতের ছোঁয়া তাকে খুব একটা বিরক্তও করেনি। ফলে এ যাত্রায় বেঁচে গেল।
সকালে যখন ঠাকুমা আমাকে এসব বলল আমি জিজ্ঞেস করলাম,' রাতে ডাক দিলা না ক্যান?'
ঠাকুমা হেসে উত্তর দিল - 'এরা কিছু করে না রে! ঘরের সাপ। ঘরগিন্নী নাইলে দাড়াইশ টাড়াইশ হবে। বাড়ির সাপ। আমাদের চিনে, কিছু করবো না।' আমি অবাক হয়ে গেলাম কথা শুনে।
তখন কলেজে পড়ি। ঠাকুমা এখন আর অত ডাকাডাকি করে না। বুঝে গেছে নাতি নাতনি বড় হয়ে গেলে তাদের সঙ্গ আর পাওয়া যায় না। একা থাকাটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে। এক শুক্লা দ্বাদশীর দিন আমাকে ডেকে বললো, 'ভাই, কাইল রাইতে একটা স্বপন দ্যাখলাম। মনে অইল ব্রজ ব্রজ বইলা কে যেন ডাকতাছে। ঘুমের মইধ্যেই দ্যাখলাম আমার বাবা। তহন তো নেত্রকোনায় থাহি, বিয়া হয়নাই, ছোট এক্কেরে, বাবা ডাকতাছে। আমি বাবার পিছন পিছন যায়া দেহি এই বাড়ির উঠান। উঠানের ভিতর দিয়া একটা নদী। আর গাবুর মাইয়ার নাখান জোছনা সারা উঠানে। কওয়ার মতো না।'
একটু থেমে আবার বললো, 'ভাই, আমারে মনে কয়, নিয়া যাইতে চায়।'
কদিন পর থেকে ঠাকুমা দুর্বল হতে শুরু করে। আমাকে ডেকে বলে, ' ভাই, কী যে হইচে, চোখ বুন্দলেই নদীর শব্দ পাই৷ রাত হইলে একদিন তোর ঠাকুর্দা আসে আর একদিন আমার বাপ। ব্রজ ব্রজ বইলা ডাকে৷'
ঠাকুমার চোখে জল চিকচিক করে। কান্নায় না কি আনন্দ বোঝা যায় না। ' তুই আর অহন আমার কাছে আসিস না ক্যা রে? প্রতিদিন দই রাইখ্যা দেই। ভাবি তুই যদি আবার ছোট হয়া যাইস, আবার আইসা টুক কইরা এট্টু দই খাইতে চাস! ভুইলা যাই, বড় হয়া গেছিস ভাই৷'
ঠাকুমা দইমাখা ভাত কিছুটা রাখতো একটা কুকুরের জন্য আর কিছুটা ছড়িয়ে দিত উঠোনে। এক ঝাঁক চড়ুই আর কয়েকটা কাক এসে হুটোপুটি করে খেত। পাখি আর কুকুর ঠাকুমার প্রিয় সঙ্গী। ঠাকুমা ওদের সাথেই কথা। গল্প শোনায়। নেত্রকোনার শৈশবের গল্প। গল্পের মধ্য দিয়ে আবার পৌঁছে যায় তার অতীত জীবনে। আবার সেই ছোট্ট মেয়েটি হয়ে বেনী দুলিয়ে, মাঠ, পুকুর, বাগানের ভেওত্র দিয়ে দৌড়ে বেড়ায়। দেখা মনে হল, মানুষ দূরে সরে গেলে প্রকৃতি নিকটবর্তী হয়।
ঠাকুমা কোনকিছুই ফেলে দিতে চাইত না। ঘরের ভেতর পুরনো দিনের গন্ধ, ব্যক্তিগত ইতিহাসের অলিখিত কাহিনি আর ফেলে আসা দেশের ধানক্ষেত, পাটক্ষেত, ফিরিঙ্গি নামা ঘাট, নয়া পয়সার বিস্কুট, পালকিতে চড়া নতুন বউয়ের মুখ - বারবার ভেসে আসতো। জাগতিক বস্তুর সঙ্গে হয়তো একটা ভালো বোঝাপড়া ছিল তার। তাই এইসব ছেড়ে যেতে কষ্ট হত। আবার বাবা এবং স্বামীর ডাককেও এড়াতে পারতো না। এর ফলে যা হওয়ার তা-ই হল।
বেশ কয়েকমাস বিছানাই হল আশ্রয়। তবে একেবারে শয্যাশায়ী যাকে বলে তা নয়। নিজের কাজ নিজে করে নিতে পারত। লোকে বলত, বুড়ি মায়া কাটাতে পারেনা, তাই এত ভোগান্তি।
তারপর এক ভোররাতে জ্যোৎস্নায় সারা উঠোন যখন ধবধব করছে নীলচে সাদা থানের মতো, ঠাকুমা শুনতে পেল রাস উৎসবের কীর্তন। দেখল, উঠোন দিয়ে বয়ে চলেছে এক নদী। তার ধারে ধারে কত যে গোপিনী। আর গোপিনীবল্লভকে খুঁজতে খুঁজতে ঠাকুমা হারিয়ে গেল। সেই চৈতন্যচরিতামৃত, যা ঠাকুমার প্রিয় গ্রন্থ ছিল, আর খুঁজে পেলাম না। হয়ত কেউ আগেই সরিয়ে ফেলেছে। নয়তো ঠাকুমাই হয়তো নিজের কাছ ছাড়া করতে চাইনি।
পরদিন ভোরে ঠাকুমার ঘর থেকে কালো রঙের সাদা ডোরাকাটা সাপ বের হয়ে চলে গেল । শুক্লা পঞ্চমীর ভোরের মিঠে আলোয় তাকে আবছা মতো দেখা গেল আর মুহূর্তে মিলিয়েও গেল ভোজবাজীর মতো। ঠাকুমার দেহ উঠোনে এনে রাখা হল। আমরা পরিবার পরিজন সব তার পাশে৷ দেখতে দেখতে সেই কুকুর যাকে ঠাকুমা রোজ খেতে দিত, উঠোনের একপাশে চুপ করে বসে আছে৷ চড়ুই আর কাকগুলিও চুপচাপ তাকিয়ে আছে ঠাকুমার দিকে৷ কেউ ডাকছে না। ডানা ঝাপটাচ্ছেনা।
সৎকার করে এসে দেখি কুকুরটা ওখানেই বসে আছে, যেখানে সকালে বসে ছিল। ঠাকুমার ঘরে ঢুকি। ঠাকুমার ঘরে পাথরে বাটিতে ধবধবে সাদা দই জমেছে আর তার চারপাশে কালো পিঁপড়ের দল সাড় বেঁধে হেঁটে চলেছে


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)