চন্দ্রাণী বসু - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

চন্দ্রাণী বসু

 

কে -আর টেকার





-কে আর নেবে? ওই বাচ্চাই হবে। গাছের যত ফুল সব ভোরে উঠে নিয়ে যায়।

- মাসিমা আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম। এই তো সবে উঠেছি। কখন নেব আপনার টবের ফুল ?

- অ ! ঘুমোচ্ছিলে ? এই শোনো সবাই শোনো ওকে রাতে পয়সা দিয়ে ঘুমোনোর জন্য রেখেছ না কি তোমরা ?

- না, না মাসিমা। এই ভোরের দিকে একটু চোখ লেগেছিল আর কী !

- কাল থেকে আর চোখ আর লাগিও না  বাপু… প্রতিদিন আমার ফুল কে নিয়ে যায় ?


প্রায় প্রতিদিন এইরকম কথোপকথনে আমাদের অনেকের ঘুম ভাঙে। আমাদের মানে ষোলো ঘর মানুষের । এই বাড়িতে ষোলোটা ফ্ল্যাট। আর এই কথোপকথন দোতলার সত্তরোর্ধ্ব মাসিমার আর আমাদের ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার পঞ্চাদার। পুরো নাম পঞ্চানন সাউ। নীচের কমন সিমেন্ট বাধানো উঠোনে মাসিমার কয়েকটা জবা আর অপরাজিতার গাছ আছে। সেই নিয়ে এই কান্ড প্রায় প্রতিদিন।


আমি এই ফ্ল্যাটে এসেছি তা মাস দু'য়েক হল। একটি প্রায় নতুন অব্যবহৃত সেকেন্ড হ্যান্ড দক্ষিণ খোলা ফ্ল্যাট বেশ কম টাকাতেই পেয়েছি। ছা-পোষা সরকারি কর্মচারি আমি। সঙ্গে আমার গিন্নি থাকেন। এক ছেলে সে মহারাষ্ট্রে পড়াশোনা করে। বছরে এখন এক বা দু-বার এসে থাকে।

রিটায়ারমেন্ট - এর আর বছর চার বাকি। পেশার সঙ্গে লেখালেখির নেশাও দীর্ঘ ত্রিশ বছরের। ছোট বড় সব পত্রিকায় অধমের লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পুরস্কার ও বেশ কয়েকটি ঝুলিতে আছে। ইদানীং অর্থও আসে বইয়ের রয়ালটি বা পত্রিকায় লেখা বাবদ। 

সামনেই পুজো। এই সময়টা আমার ভীষণ চাপ থাকে । এবার ১২ টা পূজিবার্ষিকীতে লেখা দিতে হয়েছে। তিনটি উপন্যাস তারমধ্যে। শেষ দু'মাসে এফ্ল্যাটে আসা অবধি কারও সঙ্গে সেভাবে আলাপ হয়নি। যে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তারা কেউ আমার এই নেশার কথা জানে বলে মনে হল না। এটা আমার একটা মহা স্বস্তির কারণ। বাসস্থানে বিখ্যাত হওয়া বড় চাপ মশাই। আগে যেখানে থাকতাম হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। 

যে কয়েকজন- এর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তারমধ্যে এই পঞ্চাদা মানে আমাদের কেয়ারটেকারকে বেশ ইন্টারেস্টিং চরিত্র বলে মনে হয়। 

প্রথম ধারণা যদিও মোটেই ভালো ছিল না। আমরা যেদিন এই ফ্ল্যাটে আসি পরদিন কমিটির সেক্রেটারী সহ জনা তিন মানুষ এলেন আলাপ জমাতে আমাদের ঘরে। প্রথমেই সাবধান করা হল পঞ্চা দা সম্পর্কে। বারংবার নানা অছিলায় তিনি টাকা চেয়ে বেড়ান‌। টাকা ধার নিলে শোধ দেন না। আমি যেন ফাঁদে না পড়ি। অযথা যেন ডাকাডাকি করে তাকে কোনও কাজ করতে না বলি। আর হাতটানও আছে বেশ - আমরা যেন ঘরেও না ঢুকতে দিই।

আমি সত্যিই ঘাবড়ে গিয়ে বললাম - তা এ হেন লোককে কেয়ার টেকার রেখেছেন কেন ?

- না না, এমনিতে আর কোনও দোষ নেই। যেমন কোনও বাজে নেশা নেই।ফ্যামিলিতে কেউ নেই। তাই ছুটি নেবার কোনও তাল করে না। এখানেই নীচের ঘরে একা থাকে। ওর খাওয়া দাওয়াও সেক্রেটারির দায়িত্ব থাকে এবং কমিটির ফান্ড থেকেই তা দেওয়া হয়। আর টাকাও অন্যদের তুলনায় অনেক কম।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন সেক্রেটারী সৌমেন ঘোষাল।

সবই তো বুঝলাম। কিন্তু ভাবতে লাগলাম নেশা নেই, ফ্যামিলি নেই, খাবার থাকার খরচ নেই তো টাকা পায়। তারপরও হাতটান কেন ? কী করে ! অদ্ভুত একটা প্রশ্ন চিহ্ন থেকেই গেছে প্রথম দিন থেকে।

পঞ্চাদার বয়স আমারই কাছাকাছি হবে। মাথায় চুল নেই। রোগা বেটেখাটো চেহারা। চোখে বেশ ভারী পাওয়ার-এর চশমা। সবসময় গেঞ্জি পরেন। শার্ট পরতে দেখিনি এখনও অবধি। সদা হাস্যময় মুখ। আমায় দেখলেই হাসিটা সবসময় চওড়া হয়। কেন জানি না, তবে অস্বস্তি হয়। আমি তো একেবারেই নতুন, এমন ভাবে হাসে যেন কতদিনের পরিচয়।

আমাদের গ্রাউন্ডফ্লোরে পঞ্চাদার একটা ঘর আছে। কোনওদিনই সে ঘরের দরজা খোলা দেখি না। লিফটের সামনে একটা চৌকি পাতা থাকে আর একটা চেয়ার। সেখানেই সারাদিন কাটে। দুপুরে দু- একবার দেখেছি ওই চৌকিতেই ঘুমায়। আর রাতে ১১ টা অবধি তো এই চৌকিতেই বসে থাকে। তারপর হয়ত ঘরে যায়, দেখিনি কখনও।আর সবে দু-মাস হল এসেছি। পুজোয় লেখার চাপও প্রবল ছিল। এরবেশি খেয়াল করতে পারিনি যদিও।


ঘটনাচক্রে আমি আসার পরপর যথারীতি একদিন টাকা চেয়ে বসল - পঞ্চা দা। আমিও হ্যাঁ- না করতে করতে দিয়েই ফেললাম ১০০ টাকা। কিন্তু খটকা যায় না - টাকা নিয়ে পঞ্চাদা করেটা কী ?

একদিন গল্প করতেও বসেছিলাম।তেমন কোনও খবর বের করতে পারিনি। সত্যিই তার কোনও কূলে কেউ নেই। মা - বাবা ছোটোতেই মারা গেছেন। বিয়ে থা করেননি। মামাবাড়িতে বড় হয়েছে। পড়াশোনা সেভেন অবধি করতে পেরেছিল তারপর কাজে লেগে পড়তে হয়। নামখানায় থাকত। একাজ সেকাজ করতে করতে এখন এইখানে চারবছর আছে। 

নাহ ! কোনও নতুন তথ্য পেলাম না বলে, আর কথা বাড়ালাম না। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছিল কিছু একটা আছে এই লোকটার ভিতরে যা টানে আমায়। যা দেখা যায়,তার আড়ালে কিছু... 


একদিন সকালে দেখলাম পঞ্চাদাকে দেখা যাচ্ছে না। সারা সকাল দেখলাম না। সন্ধ্যা থেকে আবার সহাস্য বদনে নিজের জায়গায়। জানতে চাইলে বলল - 'এই একটা দিন একবেলা মাসে ছুটি নিই স্যার। একটু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই।'


পুজোর লেখাগুলো সময়ে সেরে ফেলতে পেরেছি।  তারপরের কয়েকটাদিন বেশ আনন্দের হয়। কিছু  অর্থ পকেটে আসে লেখার সাম্মানিক হিসেবে। আরও একটা ব্যাপার আমার জন্মদিনও এই সময়ের মধ্যেই পড়ে প্রতিবার, যদি না পুজো খুব আগে হয়ে যায়। বারোই সেপ্টেম্বর । এখন কোনও না কোনও সংস্থা ডেকে পাঠায়, বা প্রকাশকেরা। ভালোই লাগে অনেক পাঠক পাঠিকা ভিড় করে চারপাশে। সঙ্গে গিন্নিও থাকেন এই একটা দিন। কোনও পত্রিকা বা আমার নিজের বই প্রকাশ করতেই হয় এইদিনে, গত কয়েকবছর ধরে। 

এবারও একটি পত্রিকা প্রকাশের কথা আছে। পত্রিকা দপ্তর থেকে আমন্ত্রণ এসেছে সপরিবার।

এক পাঠিকা আবার ভালোবেসে একটি পাঞ্জাবি উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে। ওইটি পরেই জন্মদিনে যেতে হবে প্রকাশনা দপ্তরে। 


জন্মদিনের সারাটাদিন বেশ ভালোয় ভালোয় কাটল। উপহারও জুটেছে বেশ কয়েকটি। পাঠক-পাঠিকার ভিড় বেশ বেশিই ছিল। ফেরার পথে গিন্নির আবদারে একটু-আধটু শপিংও করা হল।

বাড়ি যখন ফিরছি তখন রাত আটটা হবে। আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরেই গাড়ি গ্যারেজ। যখন গাড়ি গ্যারেজে রেখে লিফটে উঠব সেই সময় দেখি পঞ্চাদা সহাস্য বদনে বলছে, - স্যার একটা কথা ছিল।

আমি ভাবলাম আবার বুঝি টাকা চাইবে। বললাম, - কী দরকার বল।

- স্যার বৌদিকে নিয়ে একবার আমার ঘরে আসবেন।

একটু অবাক হলাম। ঘরে আবার কেন ! এখানে কী বলা যাচ্ছে না ! বেশি টাকা ! গিন্নি পাশ থেকে বলে উঠল,- বলছে যখন চলোই না।

আসলে নারী কৌতূহল আর কী ! পঞ্চাদার ঘর কেউ কখনো দেখেনি। সে সুযোগ বোধহয় তার ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। অগত্যা পায়ে পায়ে এগোলাম।

গ্রাউন্ড ফ্লোরে এই একটাই ছোটো ঘর। আর সবার ব্যবহারের একটা বাথরুম আছে। ওটাই পঞ্চাদা ব্যবহার করে।আর বাকি অংশ গাড়ি গ্যারেজ।


পঞ্চা দা ঘরের দরজা খুলল। আমাদের দুজনের তখন চক্ষু চড়ক গাছ ! একে তো বেলুন দিয়ে ঘর সাজিয়ে কেক এনেছে। তার মানে ও জানত আমার জন্মদিন। তার থেকেও অবাক হওয়ার আরও কারণ ছিল। দশফুট বাই দশফুট ঘরে একটা চৌকি আর একটা টেবিল রয়েছে। একটা আয়না দেওয়ালে টানানো আর একটি পুরোনো ছবি। বাকি মেঝে, খাটের উপর , টেবিলের উপর যা রয়েছে তা হল গাদা গাদা বই। যে কোনো পাড়ার ছোটো লাইব্রেরিকে হার মানিয়ে দেবে।

যে সমস্ত বই রয়েছে তার অনেকগুলোই দুষ্প্রাপ্য। আমি স্তম্ভিত। মুখ থেকে বেড়িয়ে এল, - তুমি পড় ? 

পঞ্চাদা হাত কচলাতে কচলাতে বলল, -ওই একটিই তো নেশা স্যার। ওরজন্যই নিজের পয়সা সব চলে যায়। রাত জাগি তো ওই বই পড়ে পড়েই।   আর কী বা কাজ আমার সারাদিন ! 

- তুমি জানতে আমি লিখি ?

- ওই দিকে দেখুন স্যার।

ওর অঙ্গুলি নির্দেশ অনুযায়ী তাকিয়ে দেখি আমার বেশ কয়েকটি বই। এরপর সেইসব লেখার বিদগ্ধ আলোচনা যা পঞ্চাদা করল তা দেখনদারি পাঠক সমাজে খুব কম পেয়েছি। শুধু আমার বই নয়, বাংলা সাহিত্যের এতটা জ্ঞানও আমার কমই দেখা আছে। আমি জানি না, এমন কতকিছুই পঞ্চা দা জানে। কেক তো কাটলাম। গিন্নি ছবিও তুলে দিল। নিজের মধ্যে এত আনন্দ আর লজ্জাবোধ একসঙ্গে এর আগে কখনো অনুভব করিনি।

সব শেষে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার সময় পঞ্চাদা আবার সহাস্যে জানাল, - স্যার এই ঘরের কথা কাউকে জানাবেন না। এটাই আমার নিজের সংসার। এখানে নির্জনতাই আমার পছন্দ। আমার সংসারে আমি একাই থাকতে চাই। 

চুপ করে গেলাম। বলার কিছু ছিল না। মনে পড়ে গেল চারটে ছটা বই কিনেই ফেসবুকে পোষ্ট দিই আমরা, বইয়ের আলমারি বানিয়ে তার সামনে বসে লাইভ করি। নিজেকে জাহির করার কিছুই কি বাকি রাখি,  অথচ ... 


পরদিন সকালে আবার ঘুম ভাঙল ফুল মাসিমার চিৎকারে। আমার গিন্নি এই নামেই তাকে ডাকে।

- কে আর নেবে তুই ছাড়া ফুল ? তোর বন্ধ ঘর কি আমি দেকিচি। ওখানেই রাখিস নিশ্চয় ... তুই ছাড়া কে আর নেবে ?

আমি গিন্নিকে বললাম, - আজ আবার ? 

গিন্নি হাসতে হাসতে বলল, - হ্যাঁ। সত্যিই তো ফুল কে আর নেবে ! শুরু হয়ে গেছে ফুল মাসিমার কে-আর -টেকার মর্নিং এপিসোড।

২টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র