অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

মায়াজম
0



রামায়ণে মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণের আধিপত্য



বাল্মীকির রামায়ণে বেশকিছু মুনিঋষিদের উপস্থিতি লক্ষ করি আমরা। এই মুনিঋষিরা শুধু রামায়ণেই আছেন, তা নয়। এঁরা মহাভারতে যেমন আছেন, তেমনই বিভিন্ন পুরাণেও আছেন। একই ব্যক্তি কী করে থাকেন যুগ থেকে যুগান্তরে ? তাহলে তো তাঁদের বয়স হাজার হাজার হওয়ার কথা। বার্ধক্য নিয়ে অমরত্ব বলেও কিছু হয় না। সেটা ভাবলে কি বাস্তবোচিত হয় ?  লক্ষ করবেন পাঠক, এইসব মুনিঋষিরা সকলেই একই সঙ্গে বয়োবৃদ্ধ, জ্ঞানবৃদ্ধ। অতএব বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ, অগস্ত্য প্রমুখ ব্যক্তি মনে হয় না কোনো একজন ব্যক্তি নন, একাধিক ব্যক্তির পদ (Designation)। এই ধরনের পদে একমাত্র বয়োবৃদ্ধ ও জ্ঞানবৃদ্ধ ব্যক্তিরাই উন্নীত হতে পারেন। যেমন আধুনিক সময়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপালের মতো পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা বয়োবৃদ্ধ ও জ্ঞানবৃদ্ধই হয়ে থাকেন। তাই ব্যক্তি না-থাকলেও পদ থেকে যায় যুগে যুগে। সেই পদে অন্য যোগ্যতম ব্যক্তি আসীন হন। বশিষ্ঠ, অগস্ত্য ইত্যাদি পদগুলি প্রাচীন যুগে ব্রাহ্মণদের সর্বোচ্চ পদ। অসীম ক্ষমতা ভোগ করতেন তাঁরা। শুধু মুনিঋষিরাই নয় – ব্রহ্মা, ইন্দ্র, শিব, মনু, বেদব্যাস, এমনকি পোপ, শঙ্করাচার্য, দলাইলামাও পদের নাম। কোনো একজন ব্যক্তি নয়।

বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ, অগস্ত্য, দ্রোণাচার্য, মার্কণ্ডেয় প্রমুখ মুনিঋষিরা ছিলেন প্রচণ্ড যু্দ্ধবাজ। এঁদের কাছে প্রচুর মারণাস্ত্র মজুত থাকত। এঁরা নির্জনে বসে আর্যদেবতাদের অস্ত্রাগার (সামরিক ঘাঁটি) পাহারা দিতেন। রামচন্দ্র বনবাসজীবনে এইসব মুনিঋষিদের ঘাঁটিতে গেছেন, আর প্রচুর মারণাস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। আশ্রম তো নয়, যেন এক-একটা কেল্লা। কোনো গল্পকথা নয়, এসব বিবরণ পুরাণেই স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে। এইসব অস্ত্রাগার লুঠ করার জন্যই নিশাচররা অতর্কিতে হামলা করতেন। নিজেদের নিরুপদ্রব রাখতেই অযোধ্যা থেকে বিশ্বামিত্র বয়ে এনেছিলেন রামচন্দ্রকে, নিশাচরদের হত্যা করার জন্য। হত্যা করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র বিশ্বামিত্রই দিয়েছিলেন। মুনি-ঋষিদের আশ্রমগুলোকে আমি ‘ঘাঁটি’ বলেছি। ঘাঁটি কেন বললাম ? আশ্রম বলা হয় লোকমুখে, এইসব আশ্রম মানে কোনো পর্ণকুটীর নয়। আশ্রম মানে শুধু ধ্যান করার নির্জন স্থান বোঝায় না। এখানে রীতিমত শ্রম দিতে হয়। আশ্রমগুলিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বলা যেতে পারে। এখানে এক বা একাধিক শিক্ষাগুরু থাকতেন। এখানকার শিক্ষার্থীদের শাস্ত্র, শস্ত্র, সাহিত্য, ব্যাকরণ, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা ইত্যাদি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হত। ছিল অস্ত্রাগার। মারাত্মক সব অস্ত্রের ভাণ্ডার ছিল আশ্রম। এই আশ্রমগুলোর ব্যয়ভার সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজা বহন করতেন। কিংবা রাজপ্রদত্ত ভূসম্পত্তি ও গোসম্পত্তি থেকে আহূত সম্পদের মাধ্যমে মেটানো হত। আসুন জেনে নিই কয়েকজন মুনিঋষিদের কাহিনি।

বিশ্বামিত্র : ঋগ্বেদ রচয়িতা হিসাবে এক ঋষি বিশ্বামিত্রের নাম পাওয়া যায়, যাকে মোট ১৮ সূক্তের একক ও ৬ সূক্তের রচয়িতা হিসাবে পেয়েছি। পরবর্তীকালে ভারতীয় সংস্কৃত পুরাণ ও সাহিত্যের কাহিনিতে এ নামে প্রচুর কল্পগাথা বর্ণিত হয়েছে। ইনি যেমন আছে ত্রেতাযুগের বাল্মীকির রামায়ণের বালকাণ্ড অধ্যায়ে, তেমনই আছে দ্বাপরযুগের কৃষ্ণদ্বৈপায়ণের মহাভারতের আদি পর্বেও। ব্রহ্মর্ষি বলেই তিনি খ্যাত। কারণ ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করেও কঠোর তপস্যাবলে ইনি ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন। ইনি সপ্তর্ষিদের তৃতীয় মণ্ডলের সমস্ত সূক্তের মন্ত্রগুলির অভিবক্তা। বিশ্বামিত্র কখনোই ব্রাহ্মণ্যধর্মকে অস্বীকার করেননি। বরং যজ্ঞ ও দক্ষিণার ব্যাপারে ক্ষত্রিয়দের ভাগীদার করতে চেয়েছিলেন। এই ইস্যুতে সমস্ত ক্ষত্রিয়দের নিয়ে জোট বেঁধেছিলেন তিনি। ব্রাহ্মণদের একা খেতে দিতে নারাজ ছিলেন তিনি। বারবার তিনি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন। হরিবংশ প্রভৃতি পুরাণে বিশ্বামিত্র পৌরব, কৌশিক, গাধিজ ও গাধিনন্দন প্রভৃতি নামে অভিহিত হয়েছেন। রাজা হরিশ্চন্দ্রের চণ্ডাসত্বপ্রাপ্তি ও রাজ্যনাশ, স্ত্রী-পুত্র বিক্রয় ইত্যাদি ঘটনার পিছনে বিশ্বামিত্রই দায়ী ছিলেন।

জানা যায় মহর্ষি বিশ্বামিত্র ছিলেন প্রাচীন ভারতে একজন রাজা ছিলেন। এছাড়া তিনি ‘কৌশিক’ নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি অসমসাহসী যোদ্ধা। ইনি ব্রহ্মার মানসপুত্র প্রজাপতি কুশ নামক এক রাজার প্রপৌত্র ও ধার্মিক কুশনাভ রাজার পুত্র গাধির সন্তান ছিলেন মহর্ষি বিশ্বামিত্র। বাল্মিকীর রামায়ণের বালকাণ্ডের ৫১ চরণে এ বিষয়ে লেখা আছে। গাধিরাজের মৃত্যুর পর বিশ্বামিত্র রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন এবং বীরবিক্রমে রাজ্যশাসন করতে থাকেন। তিনি অতুল ঐশ্বর্য ও বিপুল ধন-সম্পদের অধিকারী ছিলেন। এছাড়াও তাঁর শতাধিক পুত্র ও অসংখ্য সৈন্য ছিল জানা যায়। বিশ্বামিত্রের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের সঙ্গে বিরোধ। বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠের এই বিরোধের জল যে কতদূর গড়াতে পারে, তা বাল্মীকির রামায়ণেই প্রমাণ পেয়েছি। শুধু বাল্মীকির রাময়ণেই নয়, এই বিরোধের কথা ঋগ্বেদে অনেকবার উল্লিখিত হয়েছে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে যে আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব চলেছিল, তা রক্তপাত ও বিচ্ছেদেই শেষ হয়েছে। 

বিশ্বামিত্র কোনো একদিন এক অক্ষৌহিণী সেনা (১০৯৩৫০ পদাতিক, ৬৫৬১০ ঘোড়া, ২১৮৭০ হাতি এবং ২১৮৭০ রথ) ও পুত্রদেরকে সঙ্গে নিয়ে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে উপস্থিত হলে বশিষ্ঠ মুনি কামধেনু নন্দিনীর (আর-এক নাম সবলা) সাহায্যে উপস্থিত সকলকে পূর্ণ তৃপ্তিসহকারে ভোজন করান। একটি সাধারণ আশ্রমে এত বিপুলসংখ্যক লোকের খাদ্য সরবরাহের বিষয়ে বিশ্বামিত্র আগ্রহী হয়ে কামধেনুর অবিশ্বাস্য গুণাবলি জেনে বশিষ্ঠের কাছে তা প্রার্থনা করেন। বশিষ্ঠ জানান যে, নন্দিনী হচ্ছে ইন্দ্রের কামধেনুর কন্যা, এর সাহায্যে যখন যা চাওয়া হয় তাই-ই পাওয়া যায়। বিশ্বামিত্র সবলাকে নিতে চাইলে বশিষ্ঠ কামধেনুকে দান করতে অস্বীকার করেন এবং উভয়ের মধ্যে তুমূল বাদানুবাদ ও তীব্র বিবাদের সৃষ্টি হয়। বিশ্বামিত্র তাঁর সুদক্ষ সৈনিকদের সহায়তায় বলপূর্বক কামধেনুকে কেড়ে নিতে উদ্যত হলে ঋষিবর সবলার সাহায্যে অসংখ্য সৈন্য সৃষ্টি করে রাজার সমস্ত সৈন্যদল ধ্বংস করে ফেলেন। এছাড়াও অন্যান্য রাজপুত্র বশিষ্ঠকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলে মহর্ষি ব্রহ্মতেজে বিশ্বামিত্রের শতপুত্রকে দগ্ধ করে মেরে ফেলেন। বিশ্বামিত্র এরূপে সৈন্যবিহীন অবস্থায় ও শতপুত্রশোকে কাতর হয়ে নিজ রাজধানীতে ফিরে এসে অবশিষ্ট এক পুত্রের কাঁধে রাজ্যের শাসনভার প্রদান করে বনে চলে যান এবং শিবের কঠোর তপস্যায় মনোনিবেশ করেন। শিব বিশ্বামিত্রের তপস্যায় অতি সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রদানে উপস্থিত হলে বিশ্বামিত্র তার কাছে মন্ত্রসহ সাঙ্গোপাঙ্গ ধনুর্বেদ সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে নেন। পরে তিনি মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে পুনরায় গিয়ে তপোবন নষ্ট করে ফেলেন এবং পরে ঋষিবরের উপর পুনরায় অস্ত্রবর্ষণ করেন। কিন্তু বশিষ্ঠ ব্রহ্মদণ্ড হাতে নিয়ে বিশ্বামিত্রের সমস্ত অস্ত্রের মোকাবিলা করেন। এরূপে হতমান ও হতদর্প হয়ে বিশ্বামিত্র অস্ত্রবলের চেয়ে ব্রহ্মবলের শ্রেষ্ঠত্ব উপলদ্ধি করেন এবং নিজে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। সেজন্য তিনি পত্নীসহ দক্ষিণে গমন করে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। এ সময়ে তাঁর আরও তিন পুত্রের জন্ম হয়। অনেক অনেক বছর পরে ব্রহ্মা স্বয়ং উপস্থিত হয়ে বিশ্বামিত্রকে রাজর্ষিত্ব প্রদান করেন। দীর্ঘকাল পরে ব্রহ্মা বিশ্বামিত্রের কাছে উপস্থিত হয়ে তাকে মহর্ষিত্ব প্রদান করেন। কিন্তু ব্রহ্মা তাকে বললেন, “তোমার সিদ্ধিলাভের বহু বিলম্ব আছে, কারণ তুমি এখনও ইন্দ্রিয় জয় করতে পারনি।” এ কথা শুনে মহর্ষি পুনরায় চূড়ান্ত তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন। এ সময়ে বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গ করার লক্ষ্যে দেবরাজের আদেশে স্বর্গবেশ্যা রম্ভা সমাগতা হলে মহর্ষি তাকে শাপ প্রদানে দীর্ঘকালের নিমিত্ত পাষাণে পরিণত করেন। উপরন্তু ক্রোধের কারণে তপস্যার ফল নষ্ট হয়েছিল। 

অতঃপর বিশ্বামিত্র পূর্বদিকে গিয়ে পুনরায় তপস্যা করতে লাগলেন। এর অনেক বছর পরে ব্রহ্মা তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হন এবং তাঁকে ব্রাহ্মণত্ব প্রদান করেন। বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণে কনভার্ট হলেন। বিশ্বামিত্র ব্রহ্মর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ পরমায়ু, চতুর্বেধ এবং ওঙ্কার লাভ করে মনোরথসিদ্ধি হওয়ায় আনন্দসাগরে ডুবে রইলেন। এইসময় ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা ত্রিশঙ্কু সশরীরে স্বর্গে গমন করার অভিলাষে বশিষ্ঠের শরণাপন্ন হন। কিন্তু বশিষ্ঠ ও তাঁর পুত্ররা তাঁকে সাহায্য করতে অসম্মত হন। এর ফলে রাজা ত্রিশঙ্কু বিশ্বামিত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিস্তারিত জানান। বিশ্বামিত্র নিজ পুণবলে ত্রিশঙ্কুকে সশরীরে স্বর্গে প্রেরণ করেন বটে, কিন্তু কোনো লাভ হয় না। কারণ ইন্দ্রাদি দেবগণ ক্রুব্দ হয়ে ত্রিশঙ্কুকে নতমস্তকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে ফেরত পাঠিয়ে দেন। ত্রিশঙ্কুর এহেন পতনে বিশ্বামিত্র ক্রুব্ধ হয়ে স্বীয় তপোবলে তাঁকে শূন্যে স্থাপন করে দ্বিতীয় স্বর্গ সৃষ্টি করতে আরম্ভ করে দিলেন। বিশ্বামিত্রের এই কাজে দেবতারা আধিপত্য খোয়ানোর ভয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং যথারীতি তারা থরহরিকম্পে বিশ্বামিত্রের শরণাপন্ন হন। অবশেষে এক ড্রিল হয় – আকাশে জ্যোতিশ্চক্রের বহির্দেশে অধঃশিরা ত্রিশঙ্কু দেবতুল্যরূপে অবস্থান করবেন এবং নক্ষত্রগণ তাঁর অনুসরণ করবে। 

ব্রহ্মার ঋষিত্ব প্রদানে সন্তুষ্ট না-হয়ে বিশ্বামিত্র আরও উগ্রতর তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন। দেবতারা ভয় পেয়ে মহাসুন্দরী স্বর্গবেশ্যা মেনকাকে লেলিয়ে দিলেন বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভাঙতে। মুনি-ঋষি হলেও তাঁরা যে সর্বদাই কাম দ্বারা বশীভূত, সে-কথা তথাকথিত দেবতারাও জানতেন। যাই হোক, বিশ্বামিত্র যখন তপস্যায় প্রবৃ্ত্ত হলেন, তখন মেনকা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পুষ্করতীর্থে স্নান করতে থাকলেন। বিশ্বামিত্র তাঁর রূপে কামজ্বরে বিচলিত হয়ে পড়েন এবং টানা ১০ বছর সহবাস করেন। এই সহবাসের ফলে মেনকা গর্ভবতী হয়ে পড়েন। মেনকার গর্ভের সেই সন্তানই শকুন্তলা। এই কন্যাসন্তান শকুন্তলাকে জঙ্গলে পরিত্যক্ত করে মেনকা স্বর্গে ফিরে যান, আর বিশ্বামিত্র ওই স্থান ত্যাগ করে উত্তরদিকে হিমালয়ের কৌশকী নদীর তীরে আবার তপস্যায় বসেন এবং অবশেষে ব্রহ্মার বরে মহর্ষিত্ব প্রাপ্ত হন।

মার্কণ্ডেয় ও অন্যান্য পুরাণে আছে – হরিশ্চন্দ্রকে কেন্দ্র করেও একবার বশিষ্ঠ  বিশ্বামিত্রের উপর ক্ষুব্ধ হন। ফলে পরস্পর পরস্পরকে অভিশাপ দেন এবং সেই অভিশাপের ফলে দুজনেই পক্ষীতে পরিণত হয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। অতঃপর ব্রার মধ্যস্থতায় এঁদের বিরোধের অবসান ঘটে। ব্রাহ্মণকুলের প্রাণভোমরা “ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহিধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ।।” (বাংলা তর্জমা : আমরা সেই পরম সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করছি - যিনি যুদ্ধের শক্তিদায়ক, যিনি সমস্ত জ্ঞানের উৎসস্থল, যিনি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকাস্বরূপ। তিনি যেন আমাদেরকে প্রভূত বিচার বুদ্ধি শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতা দেন।) – এই প্রসিদ্ধ গায়ত্রী মন্ত্রটির  রচয়িতা ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র।

বিশ্বামিত্রের যজ্ঞনাশের জন্য রাক্ষসজাতিরা সর্বদা সচেষ্ট ছিল। রাক্ষসদের অত্যাচারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে অযোধ্যায় এসে রাজা দশরথের সঙ্গে দেখা করেন বিশ্বামিত্র এবং দশরথের অনুমতিগ্রহণপূর্বক তিনি রাম ও লক্ষ্মণকে দশ রাত্রির মেয়াদে নিজের আশ্রমে নিয়ে গিয়ে তাঁদের অবলা ও অতিবল মন্ত্র শিক্ষা দেন এবং দিব্যাস্ত্র সকল দান করেন। এর ফলে রাম ও লক্ষ্মণ তাড়কা রাক্ষুসী সহ অসংখ্য রাক্ষস হত্যা করেন। এরপর দুই ভাইকে নিয়ে বিশ্বামিত্র চললেন জনকপুরীতে। পথে অবশ্য গৌতম মুনির আশ্রমে রামকে দিয়ে অহল্যার পাষাণমুক্তির কাজটাও করিয়ে নেন বিশ্বামিত্র।

দশরথের কুলগুরু ছিলেন বশিষ্ঠ। তা সত্ত্বেও বিশ্বামিত্রের কাছেই রামকে দীক্ষিত করেছিলেন দশরথ । এই কাহিনির মধ্যে বিশ্বামিত্রের এইভাবেই আকস্মিক প্রবেশ ঘটেছে। বশিষ্ঠকে অগ্রাহ্য করে দশরথ বিশ্বামিত্রকে কতটা পাওয়ার দিয়েছিলেন, তা বোঝা যায়, দশরথের অজ্ঞাতসারে বিশ্বামিত্রের রামের বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্য দিয়ে। রামের বিবাহের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কে পিতা দশরথ নয়, গুরু বিশ্বামিত্র। বশিষ্ঠ কুলগুরু হওয়া সত্ত্বেও রাজা দশরথ ছিলেন বিশ্বামিত্রের সমর্থক। অবশ্য একথা বশিষ্ঠ যে বোঝেননি, তা নয়। তাই বিশ্বামিত্রের সঙ্গে রামকে পাঠানোর জন্য দশরথকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বশিষ্ঠ। কেন এত উদার হলেন বশিষ্ঠ ? বিশ্বামিত্র তো তাঁর মিত্র নন, বরং চরম শত্রু। তাঁর শতপুত্র হত্যাকারী বিশ্বামিত্রের সঙ্গে পাঠাতে দ্বিমত পোষণ করলেন না কেন ? হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এ বিষয়টা স্পষ্ট করে দিলেন – “রাম যেহেতু বিশ্বামিত্রের সমর্থক, রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে রামকে প্রেরণের ব্যাপারে বশিষ্ঠ তাই বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না। বালক রামের মরা-বাঁচা, মঙ্গল-অমঙ্গলের চিন্তা তাঁর মনে স্থান পেল না। সম্ভবত রামের প্রতিপক্ষ সিংহাসনের ন্য দাবিদার ভরতের ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক করার জন্যই বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রের প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেন।” কারণ বশিষ্ঠ ছিলেন ভরতের সমর্থক এবং রামের বিরোধী।

রাম বিশ্বামিত্রের একান্ত অনুগত। রাম এখন বিশ্বামিত্রের ছায়াসঙ্গী। হ্রস্বরোমনের পুত্র জনকরাজা সীরধ্বজ ঘোষণা দিয়েছেন – “যে ব্যক্তি এই হরকার্মুকে জ্যা আরোপণ করিতে পারিবেন আমি তাহাকেই এই কন্যা দিব।” এ ঘোষণা বিশ্বামিত্রের কানেও পৌঁছোয়। বিশ্বামিত্রের অগাধ বিশ্বাস, এ কাজ অপরিসীম বলশালী রামের পক্ষেই সম্ভব। অতএব রাম-লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বামিত্র মিথিলায় চললেন। রামচন্দ্র হরধনু ভঙ্গ করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং সীরধ্বজের কন্যা সীতার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। এখানে ভাবার বিষয়, বিশ্বামিত্র দশদিনের জন্য রাম-লক্ষ্মণকে অরণ্যে এনেছিলেন যজ্ঞ রক্ষার জন্য রাক্ষসদের শায়েস্তা করতে। তারপর কাজ মিটে গেল যথারীতি দশরথের কাছে রামকে প্রত্যপর্ণ করার কথা। অযোধ্যার রাজসভায় এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিশ্বামিত্র। কিন্তু তাই বলে বিয়ে ? এটা কি পুরোনো সেই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের বিরোধটাকে খুঁচিয়ে তোলা ? রামের বিবাহের ব্যাপারে দশরথ কোনো দায়িত্ব বিশ্বামিত্রে দেননি। এ দায়িত্ব নিয়ম অনুযায়ী পিতা হিসাবে দশরথের। কুল-পুরোহিত বামদেব বা কুলগুরু বশিষ্ঠের উপর সে দায়িত্ব অর্পণ হতে পারে। তবে কি সুযোগ বুঝে বশিষ্ঠকে এক হাত নিয়ে নেওয়া ? বুদ্ধিমানরা সুযোগই হাতছাড়া করেন না, তবে শেষরক্ষা না-হলে সব মাঠে মারা যায় ! ঘোড়া যেন আগেই ফুঁ না দিয়ে দেয় ! বিশ্বামিত্রেরও শেষরক্ষা হয়নি।

দশরথ কিংবা বামদেব কিংবা বশিষ্ঠের অনুমতির অপেক্ষা না-করেই জনকরাজা সীরধ্বজের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে দিলেন বিশ্বামিত্র। তাই বলে দশরথকে তিনি অন্ধকারেও রাখেননি। অতএব দূত প্রেরণ করে দশরথকে সংবাদ পাঠান – “আপনি মিথিলা রাজ্যে আগমন করিলে পুত্রদ্বয়েরই বিবাহ মহোৎসব উপভোগ করিতে পারিবেন। সংবাদ শুনে অনুযোগ তো দূরের কথা, উলটে খুবই আনন্দিত হয়ে দশরথ পাত্রমিত্র সমভিব্যাহারে মিথিলার পথে রওনা দিলেন। পরে অবশ্য বিনা নিমন্ত্রণে অনাহূতের মতো অযোধ্যায় বিবাহের আসরে হাজির ভরত-মাতুল যুধাজিৎ, ভরত, শত্রুঘ্ন, বশিষ্ঠ প্রমুখেরা। তাই জনককন্যা সীতা ও উর্মিলার সঙ্গে যথাক্রমে রাম লক্ষ্মণের বিবাহ হলেও বশিষ্ঠপন্থী কুশধ্বজের কন্যাদ্বয় মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তির সঙ্গে যথাক্রমে ভরত ও শত্রুঘ্নর বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যায়। এর ফলে বশিষ্ঠের সঙ্গে দ্বন্দ্বযু্দ্ধে বিশ্বামিত্রের হটে যাওয়া। হটে যাওয়া এখানেই শেষ নয়, শুরু। 

বশিষ্ঠকে পঙ্গা ! ভরতপন্থী বশিষ্ঠের পরাজয় হলে তো এতদিনের প্রয়াস সব ব্যর্থ হয়ে যাবে ! বিশ্বামিত্র যদি একটিবার রাম-লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে অযোধ্যায় পৌঁছে যেতে পারে তাহলে তো সব চক্রান্তে জল পড়ে যাবে। ভরতদের অযোধ্যায় এনে বিবাহ দিয়ে বশিষ্ঠ অনেকটাই সফল। এতটা এসে মাঝপথে নৌকা উল্টে যাবে ! অযোধ্যা পথে রওনা দেওয়ার সময় বিশ্বামিত্র হঠাৎই অন্তর্ধান হলেন। যাত্রার প্রাক্কালে বশিষ্ঠকে ন্যূনতম সৌজন্য পর্যন্ত দেখাননি বিশ্বামিত্র। রামায়ণকার জানালেন – “পরদিন প্রভাতে মহর্ষি বিশ্বামিত্র রাজা দশরথ ও জনককে সম্ভাষণপূর্বক হিমাচলে প্রস্থান করিলেন।” যিনি এত উদ্যোগ করে এত কিছু করলেন তাঁর হঠাৎ বৈরাগ এলো কেন? রহস্য কী ? বশিষ্ঠ-যুধাজিৎ-ভরতের থ্রেড ? কী এমন ভয়ংকর পরিণতি ঘটে গিয়েছিল যে, বিশ্বামিত্রকে অন্তর্হিত হতে হল ? গোটা রামায়ণে বিশ্বামিত্র আর ফিরে আসেননি। এমনকি রাম যখন রাজা হয়ে ব্রাহ্মণ পরিবৃ্ত্য সারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণরা যখন রামের রাজসভা অলংকৃত করে আছেন, তখনও বিশ্বামিত্র নেই। রামও বিশ্বামিত্রের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। রাম-সীতার বিবাহের মুখ্য যোগাযোগকারী বিশ্বামিত্র পরিশেষে মহাকাব্যে উপেক্ষিত হলেন কেন? এ ঘটনা কি রামচন্দ্রের অকৃতজ্ঞতাই প্রকটিত হয়নি ! রাজনীতিতে সব সম্ভব।

বশিষ্ঠ জানতেন, অতি সত্বর অযোধ্যায় ক্ষমতা হস্তান্তর হবে, এসময় বিশ্বামিত্রের উপস্থিতি মোটেই সুখকর হবে না। একথা নিশ্চিত, কোনোভাবে বিশ্বামিত্র অযোধায় পৌঁছোতে পারলে তাঁর প্রভাব খাঁটিয়ে দশরথের মৌনতাকে সরিয়ে দিয়ে রামের বনবাসে স্থগিত ঘটিয়ে রাজ্যভার রামের হাতে তুলে দিতেন। কারোর  কিছু বলার থাকত না। কারণ প্রথা অনুযায়ী রামই যোগ্যতম এবং প্রধান দাবিদার। এর ফলে দশরথের অকাল মৃত্যু হত না, সীতা অপহরণ ও সতীত্বহানি হত না, বালীর অনর্থক মৃত্যু ও সুগ্রীবের রাজ্যলাভ এবং বউদি-ভোগ হত না, রাম-রাবণের বিধ্বংসী যুদ্ধও হত না, বিভীষণের রাজ্যলাভ ও বউদি-ভোগ হত না। সবচেয়ে বড়ো কথা ভরতের এ জন্মে আর রাজা হওয়া হত না। বশিষ্ঠও কোণঠাসা হয়ে পড়ত। বিশ্বামিত্র অযোধ্যা ফিরলে অযোধ্যার যা পরিস্থিতি ছিল, তাতে রামায়ণ না-হয়ে আর-একটা মহাভারত হয়ে যেত। আরও একটি ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের মহাকাব্য রচিত হত। কারণ বশিষ্ঠ-ভরত-কেকয়-যুধাজিৎ-কৈকেয়ী বিনাযুদ্ধে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তেন না। ফলে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ সংঘটিত হত এবং সেই যুদ্ধে রাম অবশ্যই জয়লাভ করতেন। 

মিথিলায় বিশ্বামিত্রের অন্তর্ধানের ফলে সে ঘটনা ঘটতে পারেনি। ঠিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে বিশ্বামিত্রের অন্তর্ধান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের ঘটনাটা মনে পড়িয়ে দেয়। নেতাজিও অন্তর্হিত হয়েছিলেন ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রায় প্রাক্কালেই। নেতাজির প্রতিপক্ষ তখন নেহরু, গান্ধি, জিন্নাহ। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান কে হতেন, যদি নেতাজির অন্তর্ধান না-হতেন ? দেশভাগ হয়ে পাকিস্তানের জন্মও হয়তো সম্ভব হত না। 

বশিষ্ঠ : বশিষ্ঠ মুনিকে রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, বিভিন্ন পুরাণে সর্বত্র বিচরণ করতে দেখা যায়। যুগ থেকে যুগান্তরে এইসব মুনিঋষিদের যেন বয়সের কোনো গাছপাথর নেই। ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য যে কতটা তীব্র ছিল, তা মুনিঋষিদের দৌরাত্ম্য দেখেই অনুধাবন করা যায়। এতটাই দৌরাত্ম্য যে, কখনো কখনো দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্ষত্রিয়রাও পুতুলে পরিণত হয়ে যায়। বাল্মীকি রামায়ণেও তিনি সক্রিয় অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছেন।

বশিষ্ঠ মিত্রাবরুণের পুত্র, তাই বশিষ্ঠের অন্য নাম মৈত্রাবরুণি। অথর্ববেদের আধার মহর্ষি বশিষ্ঠ ছিলেন সূর্যবংশীয় অযোধ্যা-রাজগণের কুলগুরু। হরিবংশ মতে ইনি ব্রহ্মার মানসপুত্র। পুরাণান্তরে ইনি আবার সপ্তর্ষিগণের মধ্যেও একজন। জানা যায়, বশিষ্ঠের সহযোগিতায় অভিশাপে রাক্ষসযোনিপ্রাপ্ত ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা সৌদাস শাপমুক্ত হন। কোথাও উল্লেখ আছে, রামচন্দ্রের কাছে যে রামায়ণ কীর্তন করেন, তা ‘যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ’ বলে খ্যাত।

বিষ্ণুপুরাণ থেকে জানা যায় – রাজর্ষি নিমি একবার দীর্ঘ যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য বশিষ্ঠকে পুরোহিতরূপে বরণ করেন। কিন্তু তার আগেই বশিষ্ঠ ইন্দ্রের এক যজ্ঞে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন বলে নিমিকে অপেক্ষা করতে বলেন। বলেন – ইন্দ্রের যজ্ঞকার্য সম্পন্ন হলেই নিমির যজ্ঞে নিযুক্ত হবেন। বহু বছর বাদে ইন্দ্রের যজ্ঞ থেকে ফিরে এসে জানতে পান যে, নিমি ইতিমধ্যেই গৌতম মুনিকে দিয়ে যজ্ঞকর্ম সম্পন্ন করে নিয়েছেন। বশিষ্ঠ মুনি ক্রুদ্ধ হন। তারপর যা হয় – তেড়ে অভিশাপ – নিমির শরীর চেতনাবিহীন হবে। তবে নিমিই-বা ভড়কাবেন কেন ! ক্ষত্রিয় বলে কথা, তিনিও একটা অভিশাপ ঠেলে দিলেন বশিষ্ঠের শরীরে, বললেন – বশিষ্ঠও চেতনাবিহীন হবেন। যেই বলা সেই কাজ ! বশিষ্ঠ তখন অশরীরী হয়ে অন্য দেহ ধারণের জন্য ব্রহ্মার সাক্ষাতে যান। ব্রহ্মা যাতে একটি দেহ তাঁকে দান করেন, তাঁর জন্য প্রার্থনা করেন। ব্রহ্মা তখন তাঁকে মিত্রাবরুণের তেজে প্রবিষ্ট হয়ে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে বলেন। 

মার্কণ্ডেয় পুরাণেই বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের বিরোধের কাহিনি জানা যায়। বশিষ্ঠ মুনি রাজা হরিশ্চন্দ্রেরও কুলপুরোহিত ছিলেন। মহাভারতে রাজা হরিশ্চন্দ্রের চণ্ডাসত্বপ্রাপ্তি ও রাজ্যনাশ, স্ত্রী-পুত্র বিক্রয় ইত্যাদি ঘটনার জন্য বিশ্বামিত্রই দায়ী ছিলেন। এই সংবাদ জানতে পেরে বশিষ্ঠ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্রকে অভিশাপ দিয়ে বকপক্ষীতে পরিণত করেন। বিশ্বামিত্রও অভিশাপ দিয়ে বশিষ্ঠকেও অন্য এক পক্ষীতে পরিণত করে। তারপর শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ। অবশেষে ব্রহ্মার মধ্যস্থতায় দুজনেই পূর্বদেহ ফিরিয়ে দিয়ে দুজনের মধ্যে আপাত শান্তি স্থাপন হয়।

বাল্মীকির রামায়ণে দেখা যায়, বশিষ্ঠ সূর্যবংশ তথা ইক্ষ্বাকুবংশের কুলপুরোহিত ছিলেন। দশরথের পুত্রদের জাতকর্মাদিতে পৌরোহিত্য করেন। বশিষ্ঠ মূলত ভরত-সমর্থক ও রামচন্দ্র বিরোধী ছিলেন। কুলপুরোহিত হলেও বশিষ্ঠ মুনিকে দশরথ বিশেষ পছন্দ করতেন বলে কোনো নমুনা পাই না। নমুনা যা পাই তা এরকম – রামের যখন ১৬ বছর বয়স, তখন দশরথের রাজসভায় বিশ্বামিত্র উপস্থিত হলে দশরথ তাঁকে মহাসম্মান প্রদর্শন করেন। এ ঘটনাটি যখন ঘটে তখন মহর্ষি বশিষ্ঠ রাজসভায় উপবিষ্ট ছিলেন। শত্রুকে বড়ো আসন দেওয়াটা বশিষ্ঠের কাছে সন্মানের ছিল না। বিশ্বামিত্রের প্রতি দশরথের যদি নিছক সম্মান প্রদর্শনও হয়, তবুও বিষয়টি সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, দশরথ কিন্তু কুলগুরু বশিষ্ঠের কাছে রামচন্দ্রকে দীক্ষিত করেননি, রামচন্দ্র দীক্ষিত হয়েছিলেন বিশ্বামিত্রের কছে। রাম ও লক্ষ্মণের বিবাহের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ নয়। কিন্তু বশিষ্ঠ অনাহূত হয়ে অযোধ্যায় পৌঁছে ভরত ও শত্রুঘ্নকে বিবাহের ব্যবস্থা করেছিলেন বশিষ্ঠপন্থী কুশধ্বজের কন্যাদের সঙ্গে। কিন্তু ভরতপন্থী বশিষ্ঠ এখানেই থেমে থাকবেন কেন ? থেমে থাকলে তো নিজের লবির ভরতকে অযোধ্যার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা দুষ্কর হয়ে যাবে ! প্রাসাদ-বিপ্লবের পিছনে যে বশিষ্ঠেরও হাত আছে ! অতএব বিবাহের শেষে অযোধ্যায় ফেরার আগেই পথের কাঁটা বিশ্বামিত্রকে সরিয়ে দিতে বশিষ্ঠ সক্রিয় হলেন।

এরপর বশিষ্ঠ অযোধায় ফিরে এসে বিন্দুমাত্র সময় অতিবাহিত করেননি। অযোধ্যার রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে অতি দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটে গেল। দশরথের কাছ থেকে রামের বনবাস ও ভরতের রাজ্যলাভের বর চেয়ে নিলেন কৈকেয়ী, যদিও দশরথ ভরতকে রাজা করতে নারাজ। দশরথকে গৃহবন্দি করলেন কৈকেয়ী, রাম-লক্ষ্মণ-সীতা দণ্ডকারণ্যের গভীর জঙ্গলে চলে গেলেন, দশরথের অকালমৃ্ত্যু হল, ভরত অযোধ্যার রাজা হলেন। বশিষ্ঠ জানতেন দশরথ ভরতকে ত্যাজপুত্র করেছেন এবং ভরতকে অযোধ্যার রাজা হওয়ার কোনো অনুমতিই দেননি, ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি। তা সত্ত্বেও বশিষ্ঠ সমস্ত বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে ভরতকে অযোধ্যার সিংহাসনে বসিয়েছেন। দীর্ঘ ১৪ বছরের বেশি বশিষ্ঠের পৃষ্ঠপোষকতায় ভরত অযোধ্যায় রাজত্ব করে গেলেন। লঙ্কাযুদ্ধের শেষে সসৈন্যে রামচন্দ্র অযোধ্যায় পৌঁছোলে ভরত ভীত হয়ে রামের জন্য সিংহাসন ছেড়ে দেন। বশিষ্ঠও ভোল বদলে রামচন্দ্রের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকলেন।

দুর্বাসা : মহর্ষি অত্রির ঔরসে ও অনসূয়ার গর্ভে দুর্বাসার জন্ম হয়। তপঃপ্রভাবে ইনি তেজের আধার ছিলেন বটে, কোপনস্বভাব ছিলেন বলে অনেকেই তাঁর কোপানলে দগ্ধ হন। ঔর্বমুনির কন্যা কন্দলীকে দুর্বাসা বিবাহ করেন। দুর্বাসা এতটাই কোপনস্বভাবা ও অভিশাপপ্রিয় ছিলেন যে, দুর্বাসাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেওয়া হয়েছিল – স্ত্রীর শত অপরাধ পর্যন্ত তিনি মার্জনা করবেন। সেই অনুসারে শত অপরাধের পরের অপরাধে দুর্বাসা স্ত্রীকে অভিপাশ দিয়ে ভস্ম করে দেন। মনে পড়ে গেল মহাভারতের শিশুপালের কথা – শিশুপালকেও ১০০টি অপরাধের পর ১০১ নম্বর অপরাধে শ্রীকৃষ্ণ শিশুপালকে হত্যা করেন। কার্যক্রমে কী মিল !

মহাভারতে পাণ্ডবজননী কুন্তী যখন কুন্তীভোজের গৃহে ছিলেন, তখন তাঁর সেবায় তুষ্ট হয়ে দুর্বাসা তাঁকে ‘আহ্বান মন্ত্র’ দান করেন। যার ফলে সূর্য, ধর্ম, পবন, ইন্দ্র প্রভৃতি উর্বর রাজাকে আহ্বান করে কুন্তী বিয়ের আগের কর্ণ এবংবিয়ের পরে যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনকে জন্ম দেন।

একবার দুর্বাসা ভ্রমণ করতে করতে এক অপ্সরার হাত থেকে ‘সন্তানক’ নামে পুষ্পমাল্য লাভ করেন। ওই মালা তিনি ইন্দ্রের ঐরাবতের মাথায় স্থাপন করলে ঐরাবত সেই মালা ছিন্নভিন্ন করে মাটিতে ফেলে দেয়। এই কারণে দুর্বাসা ইন্দ্রকেই অভিশাপ দিয়ে শ্রীভ্রষ্ট করেন। অতিথির আপ্যায়নে উদাসীন হওয়ায় ইনি শকুন্তলাকে অভিশাপ দিলে দুষ্মন্ত কর্তৃক পরিত্যক্ত হন। দুর্বাসার অভিশাপেই শাম্ব যদুবংশনাশক মুষল প্রসব করেন। এর ফলে যদুবংশ ধ্বংস হয়।

এহেন মুনি দুবার্সা মহাভারতের যুগে অভিশাপ-টভিশাপ দিয়ে দাপটের সঙ্গে সবাইকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছিলেন। কিন্তু গোটা রামায়ণে দুর্বাসার দেখা পাওয়া যায়নি। দেখা পাওয়া গেল উত্তরকাণ্ডে এসে, রামের শাসনামলে। দ্বাররক্ষীর মতো ‘নিকৃষ্ট’ কাজে লক্ষ্মণকে নিয়োগ করলেন রাজা রাম। দ্বাররক্ষী আগেই ছিল, তাকে অপসারণ করে লক্ষ্মণকে নিয়োগ করা হল। দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব দিয়ে রাম লক্ষ্মণকে এটাও জানিয়ে দিলেন – “স্বয়ং দ্বারে দণ্ডায়মান থাকো। এই ঋষি ও আমার নির্জনে যাহা কথাবার্তা হইবে যদি কেহ তাহা দেখে বা শুনে সে আমার বধ্য হইবে।” লক্ষ্মণ যখন দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব পালন করছিলেন, ঠিক তখনই হাজির সেই ভয়াল ভয়ংকর ক্রোধী এই ব্রাহ্মণ-পুরুষ, তিনি দুর্বাসা। রাজদ্বারে এসে লক্ষ্মণকে দুর্বাসা বললেন – “তুমি শীঘ্রই রামের সহিত আমার দেখা করাইয়া দাও।” লক্ষ্মণ জানালেন -- রাম এখন রাজকার্যে ব্যস্ত আছেন। দেখা করা সম্ভব নয়। 

একথা শুনে দুর্বাসা স্বভাবদোষে ক্ষিপ্ত হলেন এবং বললেন – “আমি সবংশে তোমাদের চার ভ্রাতার উপর এবং গ্রাম নগর সকলেরই অভিসম্পাত করিব।” দ্বাররক্ষী হিসাবে আত্মরক্ষার কোনো জায়গা নেই লক্ষ্মণের। ওটা অনৈতিক, অশাস্ত্রীয় ! রামের অনুমোদনের জন্য লক্ষ্মণের প্রবেশ করা মানে মৃত্যুদণ্ডকে বরণ করে নেওয়া। যদি অনুমোদনের জন্য লক্ষ্মণ রামের কাছে নাও যান এবং দুর্বাশা যদি রামের সঙ্গে দেখা করতে এসে বিমুখ হয়ে ফিরে গেলেও সর্বনাশ। অতএব মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এ যেন হিংস্র বাঘের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া ! লক্ষ্মণ রামের আলোচনাকক্ষে ঢুকে দুর্বাসা আগমনবার্তা দিলেন রামকে। অতিবলের দূতকে বিদায় দুর্বাসাকে অভিবাদন জানালেন রাজা রাম।

রামের সত্যপালনের স্বার্থে লক্ষ্মণের হত্যা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল। লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের বধ্য। আদতে রাজা রাম সত্যনিষ্ঠ থাকতে পারেননি। লক্ষ্মণকে হত্যা করেননি, বর্জন করলেন। ব্রাহ্মণ-পুরুষ বশিষ্ঠ নিদান দিয়েছেন – “আপনার জনের পক্ষে ত্যাগ বা বধ উভয়ই সাধুগণের চক্ষে সমান।” অতএব আর দেরি কেন ! এক্ষণকে লক্ষ্মণকে পরিত্যাগ করো। আজীবন অনুচর লক্ষ্মণকে রাজা রাম বর্জন করলেন। এতে লক্ষ্মণ আত্মহত্যা করেন তো অতি উত্তম। লক্ষ্মণ আত্মহত্যাই করবেন। দুর্বাসা সব জেনেশুনে লক্ষ্মণ বর্জন ও লক্ষ্মণের আত্মহননের প্ররোচনায় অংশীদারী হলেন। আআসলে দুর্বাসা সম্প্রদায় অতীব নিষ্ঠুর। এঁরা অত্যাচারী মুনিবেশী সেনা। এই সম্প্রদায়কে অমান্য করা মানে সমূলে নির্বংশ হওয়া। দুর্বাসা অতিবলের দূতের পিছনে পিছনে এসেছিল বদমাইসি করার জন্যে। উদ্দেশ্য, লক্ষ্মণকে মন্ত্রণা কক্ষে পাঠিয়ে রামের প্রতিজ্ঞা অনুসারে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করা। দুর্বাসা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা বড়োই সাংঘাতিক। এঁরা চুলমাত্র অসম্মানিত বোধ করলেই বিনামেঘে বজ্রপাত ডেকে আনতেন !

অগস্ত্য : অগস্ত্য সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে যা জানা যায়, আগে সেটুকু বলে নিতে পারি। সর্বজনভাবে জানা যায়, ইনি বেদের একজন মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। ঋকবেদে বলা হয়েছে, ইনি মিত্র (সূর্য) ও বরুণের পুত্র। আদিত্য-যজ্ঞে মিত্র ও বরুণ স্বর্গবেশ্যা উর্বশীকে দেখে যজ্ঞকুম্ভের মধ্যেই বীর্যপাত করে ফেললেন। সেই কুম্ভেই সেই বীর্য থেকেই বশিষ্ঠ ও অগস্ত্যের জন্ম হয়। ভাগবতে অগস্ত্যকে পুলস্তের পুত্র বলা হয়। কুম্ভে জন্মেছেন বলে অগস্ত্যের অন্য নামগুলি হল – কলসীসূত, কুম্ভসম্ভব, ঘটোৎভব, কুম্ভযোনী। মিত্র ও বরুণের পুত্র বলে নাম হয় মৈত্রাবরুণি। সমু্দ্র পান করেছিলেন বলে নাম হল পীতাব্ধি। বাতাপিকে ধ্বংস করেছিলেন বলে নাম হয় বাতাপিদ্বীট। বিন্ধ্যপর্বতকে শাসন করেছেন বলে বিন্ধ্যকূট। 

চিরকৃতদার থাকবেন বলে অগস্ত্য প্রতিজ্ঞা করে বসলেও পিতৃপুরুষদের কষ্ট সহ্য করতে না-পেরে লোপামুদ্রাকে বিবাহ করলেন। বিবাহের ফলে তিনি দৃড়স্যু নামে এক শক্তিশালী পুত্রের পিতা হলেন। পুত্রের জন্মের পর অগস্ত্য কিছুদিন আশ্রমে বাস করে দেহত্যাগ করেন। জনশ্রুতি আছে, অগস্ত্য দক্ষিণাকাশে নক্ষত্ররূপে চির-উজ্জ্বল হয়ে আছেন। মানুষ বিশ্বাস করেন, তিনি শরৎকালের প্রথমে দক্ষিণাপথে গিয়েছিলেন বলে ভাদ্রের ১৭ বা ১৮ তারিখে আকাশে নক্ষত্ররূপে তাঁর আবির্ভাব ঘটে থাকে। কারণ অগস্ত্য আর্যদেবতাদের প্রতিনিধি হয়ে বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করে দক্ষিণ ভারতে পাড়ি দিয়েছিলেন সাম্রাজ্য বিস্তার করতে। কেউ কেউ বলেন, দক্ষিণ ভারত থেকে তিনি আর ফিরে আসেননি। অনেকে মনে করেন, পণ্ডিত ও প্রাজ্ঞ মানুষ পেয়ে দক্ষিণ ভারতের অনার্য মানুষরা তাঁকে বন্দি করে রাখেন এবং শাস্ত্রজ্ঞান অর্জন করেন। দক্ষিণ ভারতে আর্য উপনিবেশ স্থাপনে অগস্ত্যই ছিলেন মুখ্য রূপকার। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন – “অগস্ত্য কোনো এক ব্যক্তিবিশেষের নাম ছিল না। সেকালে ‘অগস্তি’ নামে একটি বিশেষ সম্প্রদায় ছিল। সেইসম্প্রদায় থেকে যে একাধিক কীর্তিমান পুরুষের আবির্ভাব ঘটে এবং তাঁরাই ‘অগস্ত্য’ হিসাবে সম্মানিত হন।” প্রথম অগস্ত্যকে আমরা পাই খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকের সময়কালে। ঋগবেদেও আর-এক অগস্ত্যের কথা জানতে পারি, আগেই বলছি তিনি এখানে মিত্রা ও বরুণের পু্ত্র, উর্বশী তাঁর মা। স্কন্দপুরাণে যে অগস্ত্যের কথা জানতে পাই, তিনি কাবের কন্যা কাবেরীকে বিয়ে করে ‘কুতমুনি’ নাম নিয়ে সেখানেই থেকে যান। কুতক থেকেই কুতমুনি, কুতক কুর্গদেশের  প্রাচীন নাম। অন্য এক অগস্ত্য সর্বপ্রথম বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করে বিদর্ভ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন যাদব রাজা বিদর্ভের সাহায্যে। অগস্ত্যের কাছে তামিলরা খুবই কৃতজ্ঞ। তামিলে অগস্ত্যের গুণপনার স্বীকৃতি আছে। অসংখ্য অগস্ত্যের মধ্যে কেউ গ্রন্থকার অগস্ত্য, কেউ-বা তামিল ব্যাকরণ-প্রণেতা, কেউ পূর্তবিদ্যাবিদ, যন্ত্রবিদ্, কেউ-বা সমরদক্ষ। এক অগস্ত্য বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট তো, অন্যজন শৈবধর্মে। গ্রন্থপ্রণেতা অগস্ত্য প্রণীত গ্রন্থগুলি হল – অগস্ত্যসংহিতা, অগস্ত্যগীতা, সকলাধিকারিকা প্রভৃতি।

বনবাসকালে লক্ষ্মণ যখন অগস্ত্যের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তখন বুঝলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করা অত সহজ ব্যাপার নয়। অগস্ত্যের আস্তানা কঠোর ও কড়া সামরিক প্রহরায় মোড়া ছিল। দ্বাররক্ষীর অনুমতি ছাড়া অগস্ত্যের দর্শন পাওয়া সম্ভব নয়। দশরথপুত্র রাম এসেছেন এই সংবাদ প্রেরণ করলে অবশেষে অনুমতি মিলল এবং রক্ষীরা সসম্মানে অগস্ত্যের কাছে নিয়ে গেলেন। সারি সারি সজ্জিত প্রাসাদ দর্শন করতে করতে ব্রহ্মাস্থান, রুদ্রস্থান, ইন্দ্রস্থান, সূর্যস্থান ইত্যাদি সর্বশেষে ধর্মস্থান পেরিয়ে রামচন্দ্র পৌঁছে গেলেন গন্তব্যস্থলে। রামায়ণে অগস্ত্যের আবাসস্থলটি ছিল গোদাবরী নদীতীরে নাসিক থেকে ২৪ মাইল দূরে। 

নিখুঁত এক সামরিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা অগস্ত্যের এই ডেরা। দণ্ডকারণ্যের বিশাল অঞ্চল জুড়ে তাঁর এই সুশৃঙ্খল সামরিক ঘাঁটি।তাই অগস্ত্যের এলাকাভুক্ত অরণ্য সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত। যতদূর পর্যন্ত অগস্ত্যের প্রভাব প্রসারিত ততদূর পর্যন্ত নিরাপদ। এখানে ব্রাহ্মণ ও আর্যদেবতারা নিশ্চিন্ত অবস্থান করেন।  

রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অগস্ত্য বাছাই করা প্রচুর মারাত্মক সব মারণাস্ত্র প্রদান করলেন, ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। না, কোনো সাধনভজনে আধ্যাত্মিক উপদেশ-পরামর্শ তিনি রামকে দেননি। যুদ্ধবাজ ব্যক্তি যুদ্ধাস্ত্রই প্রদান করবেন এতে আর অস্বাভাবিকতা কী ! সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে এত অস্ত্র কেন ? কী করতেন ভয়ানক সব অস্ত্র দিয়ে ? রাক্ষসদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে ? মুনিঋষিদের রাক্ষসরা অত্যাচার করতেন একথা সর্ব্বৈ সত্য নয়। সুতীক্ষ্ন মুনি নিজেই স্বীকার করেছেন, তাঁর আশ্রমে রাক্ষসরা হামলা করেন না। শুধুমাত্র শত শত নির্ভয় হরিণের উপদ্রব ছাড়া আশ্রমে আর কোনো উপদ্রব নেই। তা সত্ত্বেও সুতীক্ষ্ন মুনির আশ্রমে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মজুত ছিল। তিনি রাম-লক্ষ্মণকে তূণ, ধনুক, খড়্গাদি দিয়েছিলেন।অগস্ত্যের আশ্রমেও রাক্ষসরা উপদ্রব করতেন না। তা সত্ত্বেও অগস্ত্যেরও বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার।

এরপর তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যায় রামশিবিরে। যুদ্ধ করেছেন। তারপর পাওয়া যায় এক্কেবারে উত্তরকাণ্ডে এসে। এসময় রাম অযোধ্যার রাজা। রাজার কাছে প্রচুর ক্ষীর-মধু, সেই ক্ষীর-মধুর প্রাপ্তির আশায় ভারত উপমহাদেশের তাবড় তাবড় পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্রাহ্মণের দল অযোধ্যায় এসে ভীড় করেছেন। জল ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না, তেমনই রাজা ছাড়া ব্রাহ্মণরা বাঁচেন না, ব্রাহ্মণ ছাড়াও রাজার কীর্তি ছড়ায় না। যে যার মতো করে গুণকীর্তন করতে থাকেন। রাজাও গদগদ হয়ে লোভনীয় পদ থেকে মণি-কাঞ্চন সবই অকাতরে দান করতে থাকেন তাঁদের। এ পর্যায়ে সমস্ত ব্রাহ্মণকে টপকে গেছেন অগস্ত্য। অগস্ত্য রামমাহাত্ম্য শুনিয়েছেন। রাজা রাম প্রশ্ন করছেন, আর অগস্ত্য এক কাহিনি থেকে আর-এক কাহিনিতে অবাধে চলে গেছেন। রামকে স্বয়ং বিষ্ণু হিসাবে ঘোষণা করে দিলেন। শুধু তাই-ই নয়, বনবাস ও যুদ্ধকালীন রাম যে অন্যায়গুলি করেছেন সেগুলি থেকে কলঙ্কমুক্ত করতে বা মাহাত্ম্য দিতে রাবণকেও ভগবান বানিয়েছেন। রাবণ ও অন্যান্য লঙ্কা-নায়করা অভিশাপের ফলেই এই রাক্ষস-জন্ম। আর রাক্ষস-জন্মে রাবণ ভয়ংকর অপরাধী, কামুক, অহংকারী, ধর্ষক। এহেন মানুষকে হত্যা করে ‘ভগবান’ রাম উচিত কাজই করেছেন। শুধু উচিত কাজই করেননি, তিনি রাবণকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন এবং পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে অনাচার থেকে রক্ষা করেছেন। 

জাস্টিফাই। ব্যস, সাতখুন মাফ ! সাতখুন মাফ করতে গিয়ে রাম হয়েছেন নিমিত্তমাত্র, যা হয়েছে যা করেছে সবই বিষ্ণু তথা আর্যদেবতারা করেছেন। তাই নানা উদ্ভট ও অতিকল্পনার কাহিনি সংবলিত করে বানরাও দেবতা, হনুমানও দেবতা, এমনকি সমগ্র রাক্ষসদেরও দেবতা বলে ঘোষণা করতে হয়েছে। যা হয়েছে তা সমাজকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য হয়েছে, রামকাণ্ড সবই ভগবান-দেবতাদের গটআপ গেম । অরণ্যকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড, লঙ্কাকাণ্ডে রামকে প্রায় কিছুই করতে হয়নি, সবই নেপথ্য থেকে রামকে সামনে রেখে আর্যদেবতারাই করেছেন। অগস্ত্য তাঁর বক্তব্যে এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে তাঁরা জগতকে শিক্ষা দিতে লীলা করেছেন এবং স্বর্গে রওনা দিয়েছেন। যুদ্ধের আগ পর্যন্ত রাম নিপাট নিরীহ অতি সাধারণ মানুষই ছিলেন, রাজা হওয়ার পর রাম ভগবান হলেন। রামের সব অপরাধ স্খলিত হল, আমরা সবাই রামভক্ত হলাম ! উত্তরকাণ্ডে অগস্ত্যের আবির্ভাব না-ঘটলে রামেরও ভগবান হওয়া হত না, রামায়ণ ধর্মগ্রন্থও হতে পারত না।

আসলে রামকে ‘ভগবান’ বলে ঘোষণা করে নতুন কিছুই করেননি অগস্ত্য। রামকে যখন অগস্ত্য বলছেন, রাম তখন রাজা – অযোধ্যার রাজা। রাজা তো ভগবানই। রাম একা নন, যে যুগে সব রাজাই ভগবান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যাঁরা ছাত্র তাঁরা জানেন রাষ্ট্রর উৎপত্তির বিষয়ে ঐশ্বরিক মতবাদ। 

মনুর বলছেন রাজা কে ? রাজশূন্য এই জগতকে রক্ষার জন্য ইন্দ্র, বায়ু, যম, সূর্য, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র এবং কুবের – এই দেবতার সারভূত অংশ নিয়ে পরমেশ্বর রাজাকে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু এই শ্রেষ্ঠ দেবগণের অংশ থেকে রাজার সৃষ্টি হয়েছিল সেইজন্য তিনি সকল জীবকে তেজে অভিভূত করেন।(অরাজকে হি লোকেঽস্মিন্ সর্বতো বিদ্রুতে ভয়াৎ।/রক্ষার্থমস্য সর্বস্য রাজানমসৃজৎ প্রভুঃ।।/ইন্দ্রানিলযমার্কাণামগ্নেশ্চ বরুণস্য চ।/চন্দ্রবিত্তেশয়োশ্চৈব মাত্রা নির্হৃত্য শাশ্বতীঃ।।/যস্মাদেষাং সুরেন্দ্রাণাং মাত্রাভ্যো নির্মিতো নৃপঃ।/তস্মাদভিভবত্যেষ সর্বভূতানি তেজসা”।।(মনুসংহিতা, সপ্তম অধ্যায়, শ্লোক ৩-৪-৫) রাজা কী ? মনু বলছেন – (১) তিনি সূর্যের মতো চোখ ও মন সন্তপ্ত করেন। পৃথিবীতে কেউ তাঁকে মুখোমুখি অবলোকন করতে পারে না। (২) বালক হলেও রাজাকে মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ইনি মানুষের রূপে মহান দেবতা। (৩) অতি নিকটে গেলে আগুন একমাত্র সেটাই দগ্ধ করে, কিন্তু রাজারূপ আগুন বংশ-পশু-সম্পত্তি সহ দগ্ধ করে। (৪) রাজার অনুগ্রহে বিশাল সম্পত্তি লাভ হয়, যাঁর বীরত্বে জয়লাভ হয়, যাঁর ক্রোধে মৃত্যু বাস করে, তিনি প্রকৃতই সর্বতেজোময়। ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজার নিষ্কণ্টক সিংহাসনও পাক্কা। 

যবদ্বীপে (বর্তমানে জাভা। জাভা ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপ। এটি ইন্দোনেশিয়ার একটি অংশ। প্রাচীনকালে জাভা নিকটবর্তী অঞ্চলগুলির মতো হিন্দু রাজাদের অধীনে ছিল) ঋষি অগস্ত্যের খুব নাম-ডাক। দক্ষিণ ভারতে তামিল দেশেও অগস্ত্যের পুজো হয়। অগস্ত্য ঋষিকে কোথাও কোথাও শিবের অভিন্ন রূপে কল্পনা করা হয়। বস্তুত দক্ষিণ ভারত থেকেই যবদ্বীপে অগস্ত্যপুজো প্রচারিত হয়েছিল বলে মনে করেন ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। প্রাচীন যবদ্বীপে অষ্টম-নবম শতকে কয়েকটি তারিখ দেওয়া শিলালেখ পাওয়া যায়। সেইসব শিলালেখে অগস্ত্যের কথা উল্লেখ আছে।

[অংশটি ‘যুক্তিবাদীর চোখে রাম ও রামায়ণ’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।]

সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা : (১) বাল্মীকি রামায়ণম্ – পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত (২) কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ, (৩) চন্দ্রাবতীর রামায়ণ (৪) বিষ্ণুপুরী রামায়ণ – শঙ্কর কবিচন্দ্র (৫) বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, (৬) রামায়ণ ও মহাভারত : নব সমীক্ষা – শ্রীমনোনীত সেন, (৭) বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা – সুকুমারী ভট্টাচার্য, (৮) প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য, (৯) তুলনামূলক আলোচনায় রামায়ণ ও মহাভারত – ড. বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, (১০) বাংলা সাহিত্য ও বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে রামায়ণ – লেখক অজ্ঞাত (১১) বাল্মীকি রামায়ণে রাম আদিবাসী রামায়ণে রাম – বিপ্লব মাজী, (১২) রামায়ণের উৎস কৃষি – জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, (১৩) রামায়ণের প্রকৃত কথা – শ্রীসতীশচন্দ্র দে, (১৪) রামায়ণের সমাজ – কেদারনাথ মজুমদার, (১৫) রামায়ণ খোলা চোখে – হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)