সৌমী আচার্য্য

মায়াজম
4

 ধূসর বিন্দুর গায়ে জ্যোৎস্না ফোঁটা





                     *নাবালক*

ভাই ইমু এখানে রোদের ভিতর আমি আলস্য নিয়ে ঝিমোই। মালিটা ওর ছোট চোখ দিয়ে সবকিছুকেই বড় দেখতে পায়। আমাকে ডাকে ছোটাসাব। আমাকে সাহেব সুবো ঠাওরানোর মত বোকামি যে করে তাকে একটু বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। বাগানটা এত্তো বড় যে তোদের আর রক্ষিতদের পুরো বাড়িটাই চু কিতকিত খেলতে পারবে। আমি রোজ নিজেকে আয়নায় দেখে অবাক হই। আয়নার পিছনে যে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তাকে দেখতে অনেকটা বাবার মতো। তবে রোগা। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল কাঁধ অবধি নামানো। মুখটা ভারী নরম। আমি যত বলি, 'কেমন আছো?' উত্তর দেয়না। উল্টে মন খারাপের গল্প বলে। আয়না দেখা বন্ধ করেছি গত দুদিন। জানিস ইমু গতকাল রঙ্গন গাছগুলোর লাল ঝোপের মাথায় হরেক রঙের প্রজাপতি উড়ছিল। আমি ওদের পিছন পিছন ছুটে বেরিয়েছি। ক্লান্ত হয়ে স্পাইডার লিলিদের পাশে মোরামের রাস্তায় হাত পা ছড়িয়ে যেই বসেছি, ওমনি নীল ডানাওয়ালা সেই ফড়িংটা আমার পাশে বসল। ওর মুখটা বহু পুরোনো একটা মেয়ের মতো। মেয়েটার চুলে আমার নামের রিবন। আঙুলে জড়িয়ে রিবন টানতে লাগল। আমি বললাম, 'ছিঁড়ো না আমার ব্যথা লাগবে।' কিছুতেই শুনলনা। ওর নাক দিয়ে ড্রাগনের মতো আগুন ঝরছিল। আমি কেঁদে উঠতেই মালির মেয়ে ছানতিন ছুটে এল।

-ছোটাসাব কী হয়েছে?

ওরা হিন্দিতে কথা বলে। আমি যদিও বেশ বুঝি। আচ্ছা ইমু এই যে আমি এতদিন এই পাহাড়ে পড়ে রয়েছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি গীতশ্রী দিদিমণি আমার কথা বলেন? আর চোখে পিচুটি নিয়ে কুচকাওয়াজের সময় যতীন মাস্টারমশাই আমায় খোঁজেন? কবে যে ক্লাসে যাব? বাবা কেন যে এখানে নিয়ে এল? পাহাড় আমার ভালো লাগেনা। বোঁটকা গন্ধে গা গোলায়। ছানতিন কে বলেছিলাম , 'তোমার নামটা বিকট।' ও ভারী কষ্ট পেয়ে বলল, 'আমার নামের মানে চাঁদ' সেই থেকে ওর বুকে আলো দেখতে পাই আর মুখে কলঙ্ক। তুই লক্ষ্য করছিস ইমু আমার ভাষায় বহ্নি দিদিমণির কেমন প্রভাব। এবার ফাইনালে ভালো নম্বর হবে দেখিস। কিন্তু এখান থেকে কবে যে বাড়ি ফিরব? মা রোজ বলে, 'এটাই তোমার বাড়ি কুশ। এখান থেকেই পরীক্ষা দেবে।' আমি এখানে কিছুতেই থাকতে চাইনা। মাকে বললাম, 'আমি বল্লভপুরেই যাব, এখানে থাকবনা' তবু শুনলনা। সেদিন রাতে জলের নীচে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলাম অথচ আমার কানের কাছে কতগুলো পরী ইনিয়ে বিনিয়ে বলে গেল, 'মরে গেছে ছেলেটা মরে গেছে।' আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ইমু। আমি আর বাড়ি যেতে পারলাম না। আমাদের ঝোপঝাড়, ফাঁকা জমি জিরেত, খালের জলের ছায়া ভেসে থাকা খেজুর গাছ আমায় চিৎকার করে ডাকছে ইমু। ঐ দূর থেকে রক্ষিতের লাল ভোঁকাটা ঘুড়িটা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ঝিল পেরিয়ে আমায় ডাকছে, সাদা ঘোড়ায় চরে বিটন সর্দার ডাকছে, সোনামণি হাঁসদা জমি নিড়তে নিড়তে ডাকছে। ইমু তুই তো আমায় ডাকলি না। আমায় কবে ডাকবি? কবে আমরা একসাথে রাত জেগে ঝুমুর গান শুনবো? কবে আবার কাঠির আগায় সজনেগাছের আঠা লাগিয়ে ফড়িং ধরবো? আমি কোনদিন বড়ো হবোনা ইমু, তোর সাথে চিরকাল সাইকেল চালিয়ে ওলাইচণ্ডীর থানে যাবো। শালপাতায় নারকেলের পাতা দিয়ে ঘুগনি খাবো। কে যায় ঐ অন্ধকার বাঁকে? তুই কি এসেছিলি  ইমু আজ সন্ধ্যায়? আমি যেন স্পষ্ট দেখলাম। 
 

                         *বিষন্ন সঙ্গীত*

অস্মিকে আমার কিছু বলার নেই মেসোমশাই। ওর জায়গায় আমি থাকলেই বা কী করতাম তা কি জানি? ইদানিং ছানতিন কুশের দিকে টলেটলে এগিয়ে চলেছে। ছানতিনকে মনে আছে তো গত চিঠিতে লিখেছিলাম। আমাদের মালী সরজুর ছোটো মেয়ে। লাল লাল গালের উপর কালচে ফাটার ছোপ। ধর্ষিতা হয়েছে নিজের চেনা লোকেদের কাছে। পুলিশ কিছু করেনি। নেপাল থেকে এখানে এনেছে সরজু। আমাদের বাগানে চা পাতা তোলে আর সকাল রাতে কুশের চারপাশে  শান্তিজল ছেটায়। দুদিন আগে সুইমিং পুলের নীচ থেকে কুশকে ঐ টেনে তুলেছে। মেসোমশাই আপনাকে শ্রদ্ধা করি ভীষণ। কী করে পারেন এমন উদার মনটিকে জল সিঞ্চন করতে জানিনা। অস্মি আপনার মতো হলে আমরা আরো একটু ভালো থাকতাম হয়তো। না ভাববেন না দোষারোপ করছি। তবে যেখানে দাঁড়িয়ে ও পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করল সেখানে একটু ধৈর্য্য নিয়ে দাঁড়াতে পারত। ওর বরের সাথে যেটুকু স্মৃতি ছিল কাল ফেসবুকে দেখলাম কী নির্দয় ভাবে সবটা ছিন্ন করল। ওর পার্লারে যাওয়া ত্বক নিষ্ঠুর রকম ঝকঝকে। গোটা সিমলা পাহাড় যেন আলোয় সাজিয়ে দিয়েছে ওর নতুন পাঞ্জাবি হবু বর। আমাদের এই কালিম্পং এর মিম বস্তি চা বাগান এলাকায় খুব কারেন্ট যায়। অন্ধকার আমার ভালোই লাগে। আপনাকে একটা কথা বলি মেসোমশাই সেদিন রাতে ভয়ংকর দুর্ঘটনাটা না ঘটলেও অস্মি কিন্তু বাসা বদলাবে বলে পাখা মেলেই রেখেছিল। আর এসব যাবতীয়  ঘটনার উপসর্গ আগেই ছিল। আপনাকে এবার একটু কুশের কথা বলি। আমার নাবালক ভাই আজকাল বল্লভপুরের ওর প্রিয়বন্ধু ইমুকে দারুণ কাব্যিক ভাষায় চিঠি লেখে। যদিও ইমু পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে সেই কোন শৈশবে। আশ্চর্য লাগে কী সুন্দর করে নিজের গ্রামকে ও চিঠিতে মেলে রাখে। প্রতিটা অক্ষরের ভিতর সদ্য ফোটা বেলফুলের সুবাস। মন ভরে ওঠে। ওর দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। বয়সের ধাঁধাঁটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ঐ এক কথা ও বড়ো হবে না। আমি তো চিরকাল বেশি বোঝা মেয়ে মেসোমশাই। তাই হয়তো কোনো ছেলেকেই ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারলাম না। আপনি কুশের লেখা পড়বেন? আজ সকালেই মায়ের উপর রাগ করে ঘষঘষ করে কী লিখেছে আপনাকে দিচ্ছি দেখুন। ও লিখছে...

            "আমার বুকের ভিতর তোমার করুণা
যদি নামিয়ে দাও, সোপান বেয়ে উঠে আসবে
মরা দোয়েলের মতো ফ্যাকাশে ইচ্ছেরা
এইসব মহান পাথরের গায়ে টাঙিয়ে রেখো
এক কিশোরের অপমৃত্যুর এপিটাফ, কিছুটা
ছাই রেখো আমার শৈশবের ভিটায়
রাত নামলে যেখানে কালপেঁচা ষড়যন্ত্র করে,
ভোর নামায় খেয়ালি চঞ্চল মেঠো হাওয়া
দু পাঁচটা খড়িওঠা মুখে সরলতার খেলা
এসব ছাড়িয়ে গেলে আমি আর আমি থাকিনা
পড়ে থাকে খোলসের মতো ঝাপসা শ্বাস"

আমি জানি আপনি খুশি হচ্ছেন কুশ লিখছে বলে। এই আরামটুকু ভালো লাগারই কথা। তবু বলবো এই দীর্ঘ কালো ছায়ার মতো দিনে অযথা বেশি ভরসা করবেন না। শরীর সহজে আয়নায় নিজেকে খুঁজে পায় মেসোমশাই কিন্তু মন! তার হদিশ আমরা কেউই রাখিনা। রাখতে চাইও না হয়ত। আমাদের বাড়ি আজকাল সকাল সন্ধ্যে বেহালা বাজে এটাই আমাদের অবলম্বন।


                     *অকপট*

প্লিজ বাবা তোমার এই দীর্ঘ মেসেজগুলো আমায় বড্ড ক্লান্ত করে, তুমি কথাগুলো ফোনেই বলতে পারো। কাল থেকে যতবার ফোন করছি ফোন ধরছো না। এসবের কোনো মানে হয়না। তোমার এই যে ধারণা লিখতে গেলে মানুষ মিথ‍্যে সাজাতে পারেনা, এসব খুবই ভুল। যাইহোক যে সব কথা আমায় লিখে পাঠিয়েছ তাতে আমার গিল্ট ফিল হবার কোনো কারণ আমি অন্তত খুঁজে পাচ্ছিনা। নিজেকে সুখী দেখাটা আমি অন্তত পাপ ভাবিনা। আমি দেশোদ্ধারে নামিনি যে নিজেকে বিসর্জন দেব পরের স্বার্থে। তোমার এক্স জামাই কতটা ভালো তা এখন অপ্রাসঙ্গিক। আসলে তুমি কোনোদিন বুঝতে চাওনি সমস্যাটা। তোমায় আজ পরিস্কার করে বলি বাবা, আমার একজন জীবন সঙ্গী দরকার ছিল, কল্পনার ফানুস নয়। আমার খুব আশ্চর্য লাগে তোমরা ওকে এত ভালো করে দেখেও বোঝোনি ওর জগৎ আমার জগৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন? তুমি জানো ফুলশয্যার রাতে ও আমায় কী বলেছিল? মাকে বহুবার কথাটা বলেছি , মা বোধহয় তোমায় বলেনি। আমায় ড্যাবড্যাব করে দেখে বলেছিল, 'তুমি এত সুন্দর যে তোমার ভেতরটাও দেখতে ইচ্ছা করছে। তুমি জানো মানুষের ভিতর কী করে দেখা যায়?' বাবা ধোঁয়ার মতো জমে থাকা যার স্বভাব তার সাথে এগোনো যায় না। আমার মনে হত ও বোধহয় আমায় চিরে ফেলবে। কী দেখতে চাইত আমার ভিতর জানিনা। তাছাড়া সবটাই তো অসঙ্গতি। সেই কোন অতীতে ছেড়ে আসা বাড়িঘর মানুষজন ওর ভেতর শিকড় ছড়িয়ে রয়ে গিয়েছে। একা হলেই কারো সাথে কথা বলছে। যেদিন ওদের অফিসের পার্টিতে গেলাম সেদিন অবাক হয়ে গেলাম। অতবড়ো চা বাগানের মালিকের ইঞ্জিনিয়ার ছেলে আসলে সবার কাছে উপহাসের পাত্র। আমাকে ওর জুনিয়াররা কী প্রশ্ন করেছিল জানো? 

-ম্যাডাম স্যার কি জানে বিছানায় আপনার মতো সুন্দরীকে কেমন করে তৃপ্ত করতে হয়? নাকি আপনাকে পরী ভেবে ডানা খুঁজে বেরায়?

ভাবতে পারছো বাবা আমার মনের অবস্হা? ইচ্ছে করছিল মরে যাই। একা বসে ছিলাম বাগানের চেয়ারে। দেখছিলাম সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে আর ও বোকার মতো দাঁত বের করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব ডিপ্রেসড ছিলাম। তখন এগিয়ে আসে সবরজিৎ। স্মার্ট, হ্যাণ্ডসাম, ইন্টিলিজেন্ট মানুষ। ওর সাথে থাকতে গিয়ে প্রথম বুঝি জীবন কত সুন্দর। ছোট থেকে কনভেন্টের কড়া শাসনে থেকে তারপর নিজের জীবনকে উপভোগ করার আগেই পড়া শেষ হতেই বিয়ে দিয়ে দিলে। জানি আমার খরচ চালাতে পারছিলেনা তুমি। আমায় দু তিনটে বছর সময় দিলেই ঠিক কাজ জুটিয়ে নিতাম। কিন্তু তোমরা আমার ভাগ্য বেঁধে দিলে। তখন আমি সব মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু জীবন যখন আমায় নতুন সুযোগ দিল আমি আর কিছু ভাবতে চাইনি বাবা। সেদিন রাতে ওদের বাড়ি সবাই নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল আমি অসুস্থ হবার কারণ দেখিয়ে যাইনি। কিন্তু আকস্মিক ভাবে ও যে বাড়ি ফিরে আসবে আমি ভাবিনি। আমি তখন সবরজিৎ এর সাথে ভীষণ সুখ আর তৃপ্তির স্বাদ নিচ্ছিলাম। ওর কাছে ধরা পড়েছি বলে আমার কোনো আফশোষ ছিল না। আমি চলেই যাচ্ছিলাম সবরজিৎ এর সাথে। ও এমন ন্যাকামি শুরু করল। সিঁড়ির মুখে আমাদের পথ আটকে, কেঁদেকেটে। সবরজিৎ সামাণ্য একটু ধাক্কা দিতেই ও যে পড়ে যাবে আমরা ভাবিনি। দ্রুত পরিস্হিতি গুছিয়ে, সবরজিৎ চলে যেতেই ওর বাড়ির লোককে ফোন করে ডেকে নিয়েছিলাম। এই ঘটনাটুকুই এতদিন তোমাদের বলিনি। হ্যাঁ সবরজিৎ কে আমি অনেক আগে থেকেই চিনতাম। তোমাদের কেবল জানাইনি যদিও আমি বুঝতে পারছি রূপকথাদি তোমায় জানিয়েছে যে আমার কারো সাথে সম্পর্ক ছিল ডিভোর্সের আগে থেকেই। একমাত্র ওর চোখকেই বোধহয় ফাঁকি দিতে পারিনি। রোজই তো কত মানুষের ডিভোর্স হয় বাবা এ আর এমন কী? তাছাড়া আমাকে অসহ্য মনে হলে তুমি আমার সাথে সম্পর্ক রেখোনা, কিন্তু প্লিজ এসব লিখিত উত্তর আমার কাছে চেওনা।

                    *অলৌকিক*

মেঘমা তোর শ্বশুরালের উঠোন থেকে শুনেছি এভারেস্ট দেখা যায়। আমাদের এখানে আকাশে জেগে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। ইচ্ছে আছে একবার যাব তোর বাড়ি। আমার জীবন এখন গোলক ধাঁধাঁয় ঘুরছে। তবু যেন মনে হয় ভালো আছি। ছোটেসাবকে তোর মনে আছে? আমাদের টি এস্টেটের ছোটেসাব? সেই ঝকঝকে মানুষটা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেল কোলকাতায় আর যখন ফিরল বিলকুল অন্য আদমি। শুনলাম কলেজের হোস্টেলে কিছু উচনীচ হয়েছে, র‍্যাগিং না কী যেন। ছোটেসাব বিলকুল বেওকুফ হয়ে গেল যেন। তবু বড়াসাহেবের পহচান ছিল বলে ভালো নোকরি হল ঠিকই কিন্তু মানুষটা সুর ভুলতে লাগল। অনেক আশা করে শাদি দিলেন বড়াসাব কিন্তু কপাল ভালো না হলে কিছুই ভালো হয়না বোধহয়। ছোটেসাব সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলেন মাথার খুলি ফেটে গেল। ডাক্তার বলেছিল অনেক দেরি করে হাসপাতালে নেওয়ায় কীসব গড়বড় হয়ে গেছে ছোটেসাবের। কদিন আগে ছোটাসাবের শ্বশুর এসেছিলেন এখানে, পুলিশ ডাকার কথা বললেন। ছোটেসাবকে নাকি তার বউ আর আরেকটা লোক মিলে ফেলে মারতে চেয়েছিল। বড়াসাব চুপ করে থাকলেন। ওনার চোখে জল ছিল। অনেকের চোখে পাগল ছোটেসাব এখন ডিভোর্সি কিন্তু আমি বুঝি উনি পাগল না। বাচ্চাও না। কিশোর যেন। সারা বাগান জুড়ে ঘুরে বেড়ান। কাউকে কল্পনা করে গল্প করেন। আমার সাথে খুব ভাব। আমিও ওর সাথে থাকতে পছন্দ করি। আমার মনে হয় উনি রোজ একটু একটু করে বড়ো হচ্ছেন। যেদিন সুইমিং পুলের ভেতরে ওনাকে ডুবে থাকতে দেখে তুলে আনলাম, আমায় বললেন, 'তুমি আমায় সোনারকাঠি ছুঁইয়ে দিলে? তোমায় ইমুর সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাব বল্লভপুরে। যাবে?' 

আমি রোজ ডাকি, 'ছোটেসাব খাবেন না?' ভারী মিষ্টি করে হেসে বলেন, 'এই যে মেয়ে আমার এত খোঁজে তোমার কী?' আমায় একটা চিঠি দিয়েছেন সাথে হাইডেনজিয়ার শুকনো ঝরা ফুল। চিঠির কথা বুঝতে পারিনি। পূর্ণিমার রাতে ছোটাসাব যখন বাংলোর বারান্দায় একা বসে ছিলেন তখন চুপিচুপি গিয়ে বলেছি, 'ছোটেসাব আমি তো বাংলা পড়তে পারিনা।'

-তুমি আমায় পড়তে পারোতো ছানতিন? দেখ তুমি যেই এলে চাঁদের আলো কমে গেল এখন সবচে উজ্জ্বল আলো আমার পায়ের কাছে। তুমি কি করে এমন ডাকো বলতো, ছোটেসাব? 

মেঘমা আমি বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছি ছোটেসাবকে। বছরখানেক আগেও উনি স্কুল জীবনে ছিলেন আর গতকাল রাতে আমায় বলেছেন, ওনার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া খতম হলেই আর কোলকাতায় যাবেন না। এখানেই থাকবেন পাহাড়ের কাছে। উনি এখন পাহাড় ভালোবাসেন। আর আমাকে?


                   *ভোরের ফুল*

জানি তুমি মেসেজ পড়তে ভালোবাসো না। তবু লিখছি আজ তিনবছর পর। তুমি বোধহয় এখন লাসভেগাসের টাউন স্কোয়ারে থাকো। আমি এখনো এই নির্জন মিম চা বস্তিতেই আছি। আমার মাথার ভিতরের জটগুলো আস্তে আস্তে খুলছে তবে এখনো ঠিক চৌখশ হয়ে উঠিনি। কবিতা লিখি তোমার বাবা জোর করে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। বেরোয় দু একটা লেখা। বাবার কাছে মন দিয়ে চা বাগান সামলানোর কাজ শিখছি আর ছানতিনের সাথে শনিবার করে হাইকিংএ বেরিয়ে পড়ছি। এগুলো তোমাকে জানানোর দরকার নেই অস্মি। এত সাধারণ জীবনের ভোঁকাট্টা গল্প কে শুনতে চায়‌? তবে কী জানো মানুষের পাশে কেবল মানুষ হয়ে দাঁড়ানোটাই ম‍্যাজিকের মতো সব বদলে দেয়। আমি জানি আমার ফেলে আসা দিন আমায় এখনো টেনে রেখেছে কিন্তু একটা অল্প শিক্ষিত পাহাড়ি মেয়ে পরম মমতায় আমার হাত ধরে নিয়ে যায় সেই পথে। আবার ফিরে আসার পথ খুঁজে দেয়। আমার যাতায়াত তাই সহজ। আমার মা, বাবা, দিদি এমনকি তোমার বাবাও চান আমি ওকে স্বীকৃতি দিই। ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ও আমায় বিয়ে করবে কিনা! পায়ের কাছে রঙ্গিত হেসে গড়িয়ে পড়ছে, পাহাড়ের গায়ে সবুজ চাদর আমার হাতে ছানতিনের হাত। দূরে কোথাও ঘন্টা বেজে উঠল। ছানতিন বলল, 'ছোটেসাব আমি কিন্তু বিয়ের পরেও আমার কাজ ছাড়ব না। একটা চা বাগানের শ্রমিককে আপনি বউ বলতে লজ্জা পাবেন নাতো?' আজ ভোরে অনেকগুলো ফুল কুড়িয়ে ওকে দিতে গিয়েছিলাম অস্মি! দেখলাম ইমু গেটের পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। আমায় বলল, 'এ্যাই কুশ এমন সুন্দর ফুল যত্নে রাখিস। তোর মাঠ, পাহাড়, নদী, বিল সবকিছুর ছায়া এর গায়ে লেগে রয়েছে।' সেই থেকে ভারী আরামে ঘুমিয়ে আছি। ভালো থেকো ভালো হোক সবার। আমার ধোঁয়াটে জীবনের বাঁকে চাঁদ ঝরিয়ে যাক তার নরম আলো। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

  1. ****
    মনস্তত্বের উপলভূমি জুড়ে এক ভালোবাসার নিসর্গ আঁকা হয়েছে এ গল্পে। সে উপলভূমিতে এক সবুজ একলা গাছ! এ ভালোবাসার রঙরেখ মনে আর প্রকৃতিতে! মনে আর মনেও! ভালোবেসে সেই উপলভূমির নির্জনতার হাত ধরে এক নারী! নিজের জ্যোৎস্না ধরে রেখেও! ঝর্ণার উদ্দাম প্রাণময় বিস্ফারে উপলভূমি বেয়ে নিজের গতিতে পথ করে নিয়েছে আরও এক নারী! এই টানাপোড়েনে গল্পের চমৎকার বুনুনি! আর হ্যাঁ, বর্ণনায় প্রাকৃতিক অনুপুঙ্খে কোথাও কোথাও কবিতার স্পন্দন! এ গল্পের গদ্যে আলপনার মতো! রঙের বাহুল্য নেই! নমনীয় বক্রতায় প্রাণের সম্মিলন আছে। খুব ভালো লাগল।

    উত্তরমুছুন
  2. আমার আন্তরিক ধন‍্যবাদ জানবেন

    উত্তরমুছুন
  3. ভিন্ন ধরণের গদ্য। সযতনে নির্মিত ভিন্ন স্টাইল। সাব হেডিং এর আড়ালে অনবদ্য সৃজন। কবিতাংশ টি কার?

    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন