বেগুনি কলম
তিস্তা প্রত্যেকদিনের মতো বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিল। ওদের বাড়িটা ঢাকুরিয়া লেক থেকে ভেতরের রাস্তা দিয়ে হাঁটাপথে মাত্র দশ মিনিট। আজ বিকেলটা বেশ অন্যরকম, আকাশে কেমন গোলাপী গোলাপী মেঘ। এমন এক কনে দেখা আলো মাখা বিকেলে নয়নের সাথে তিস্তার প্রথম দেখা হয়েছিল। নয়ন তিস্তাকে সেই সময় কাজল বলে ডাকতো। এখনো বিয়ের পঁচিশ বছর বাদেও আবেগের মুহূর্তে নয়ন ওকে কাজল বলেই ডাকে। ভাবতে ভাবতে তিস্তার গালে আকাশের গোলাপী মেঘের ছোঁয়া লাগলো। কি দিন গেছে সেইসব, নয়নের একটা চাকরির জন্য দুজনেই প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে চাকরিতে উন্নতি করে সিনিয়র ম্যানেজার হয়েছে নয়ন। তিস্তা ভালো এবং মন্দ সময়ে দক্ষ সারথির এগিয়ে নিয়ে গেছে ওদের জীবন রথ। তবে অফিস নিয়ে আজকাল বড় ব্যস্ত থাকে নয়ন। ফিরতে ফিরতে প্রায়শই রাত নটা বেজে যায় ।
লেকের ধার ধরে দুপাক হাঁটতেই তিস্তার স্নিকারের ফিতেটা গেল খুলে। রাস্তার ধারের একটা পাথরে পা তুলে স্নিকারের ফিতেটা বাঁধতে যেতেই ওর চোখ আটকে গেল পাশের ঝোপে। ওটা কি, বেগুনি বেগুনি। আরে একটা কলম না! তিস্তা হাত বাড়িয়ে কলমটা তুলে নেয়। একটা হালকা বেগুনি রঙের সরু লম্বাটে কলম। কলমের খাপে অতি সূক্ষ্ম সোনালী ডিজাইন। এতো সুন্দর কলম তিস্তা কখনো দেখেনি। আর কি আশ্চর্য এটা একটা কালি কলম, কতদিন পরে ঝর্ণা কলম দেখলো সে। তিস্তা এদিক ওদিক তাকিয়ে কলমের মালিককে দেখতে না পেয়ে ওটাকে হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। নয়নকে কলমটা দেখাতে হবে। ছেলে পিলে তো নেই ওদের কাকেই বা দেখায় কলমটা। সন্তানহীনতা নিয়ে একটা মানসিক যন্ত্রণা থেকে গেছে ওর। নয়নের ও কি মন খারাপ নেই? কে জানে! নয়ন বড় চাপা কিছুতেই ধরা দেয়না। ওর শারীরিক সমস্যার কথা জেনেই নয়ন বিয়ে করেছে তিস্তাকে। তারপর থেকে আর কখনো পিতৃত্বের জন্য আফশোষ করেনি নয়ন।
বাড়ি এসে এটা ওটা টুকটাক কাজে কলমটার কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তিস্তার। রান্নার মেয়েকে তিপুকে ডিনারের কথা বলে মাসকাবারি ওষুধগুলো ব্যাগ থেকে বের করতে গিয়ে কলমটা হাতে পরলো ওর। বাইরের ঘরে বসে একটা কাগজ টেনে পেনটা ঠিক আছে কিনা চেক করার জন্য একটা দাগ টানতে গিয়ে দেখলো পেনটায় লেখা পড়ছে না, অথচ ভেতরে কালির শব্দ হচ্ছে। পেনটা বোধহয় জ্যাম হয়ে গেছে, ওটা একটু ঝেড়ে তিস্তা কাগজে কলমটা ছোঁয়াতেই তরতর করে লেখা হতে লাগলো। লেখা তো পরছে কিন্তু এসব কি লিখছে তিস্তা! তিস্তা শুধু কলমটা কাগজের ওপর ধরে আছে, কাগজে কলমের আঁচড়ে যে লেখা ফুটে উঠছে সে কথা তো তিস্তার নয়। তিস্তা দেখলো কাগজে ফুটে উঠেছে
" মৃত মানুষ প্রশ্নের উত্তর দেয়না জানি, তবু তোমার গেঞ্জির বুকের কাছটা খামছে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে কেন? কেন? কেন?"
তিস্তা শিউরে উঠে কলমটা রেখে দিলো। ভয়ে তার শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। তিস্তা কলমটা রেখে খানিকক্ষণ ভয়টা পরিপাক করে নিল। একটু পরে তার মনে হলো সত্যি সত্যি ভয় পাওয়ার কি কিছু আছে? সন্ধ্যে সাতটার কলকাতা শহর গমগম করছে। জানলা দিয়ে ভেসে আসছে গাড়ির হর্ন, দূরে কোথাও কোন রাজনৈতিক দলের বক্তৃতা চলছে… রান্নাঘর থেকে আসছে তিপুর রান্নার শব্দ। তিস্তার মাথার মধ্যে প্রশ্নেরা ঢেউয়ের মতো আছড়ে পরছে। কার কলম এটা? কে মারা গেছে? কি হয়েছিল? খানিকটা সময় বসে থেকে কলমটা খাতায় ছোঁয়ালো তিস্তা। ভয়কে কৌতুহল জয় করলো অবশেষে।
" যখন ফোনে তোমার এক্সিডেন্টের খবরটা পাই মাথা ঘুরে চোখে অন্ধকার দেখেছিলাম। তোমার ফোন থেকেই অচেনা কেউ ফোন করে বলেছিলেন
-হ্যালো হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন ? আপনার স্বামীর এক্সিডেন্ট হয়েছে আমরা ওনাকে রুবি নিয়ে যাচ্ছি। আপনি কাউকে নিয়ে এক্ষুনি রুবি চলে আসুন।
পাগলের মত ছুটে গিয়েছিলাম হসপিটালে। হয়তো তুমি নও হয়তো অন্য কেউ, হয়তো কোন ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে কোথাও। তবু একবার ও ভাবিনি তুমি আর নেই। উল্টোদিক থেকে আসা একটা ব্রেক ফেল করা ট্রাক তোমার গাড়ি আর তোমাকে পিষে দিয়ে গেছে। যে ভদ্রলোক ফোন করে খবরটা দিয়েছিলেন তিনি নেহাতই একজন পথচারী। তবু মৃত্যুর আগে তুমি তাঁকেই খবররটা দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলে। না ওই অবস্থাতে ও মানুষ চিনতে ভুল তোমার হয়নি। ভদ্রলোক খবরটা দিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, ফোনটা আমাকে হাতে হাতে দেবেন বলে। ফোনের পাস ওয়ার্ডটা উনি আমাকে একটা কাগজে লিখে দিয়েছিলেন, যাতে ভুলে না যাই। আমার তো তখন পাগলের মত অবস্থা, ভাগ্যিস পাশের বাড়ির একজন সাথে ছিলেন। তুমি তো দুমিনিট দেখেই একজনকে চিনে ফেললে। আমি কি এতো বছরেও তোমাকে চিনলাম না!
থানা পুলিশ, পোস্টমর্টেম ইত্যাদির ধাক্কা সামলিয়ে তোমাকে দাহ করে সাত দিন বাদে ফোনটা নিয়ে বসলাম। তোমার অফিসের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে হবে, শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণ করতে হবে। ওনারা পাশে না দাঁড়ালে আমি পুরো ধকলটা সামলাতে পারতাম না। চার্জ দিয়ে ফোনটা খুলেই প্রথমেই তোমার হাসি হাসি মুখটা দেখে হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম আমি। এই কটা দিন তোমার থেঁতলে যাওয়া মুখটাই আমার ঘুমের ওষুধ খাওয়া ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমে ফিরে ফিরে এসেছে। কিন্তু কতক্ষণই বা কাঁদা যায়! একসময় কান্নার বেগ সামলে আবার ফোনটা খুললাম। কত কত মিসড কল, মেসেজ, হোয়াটস অ্যাপ। ফোনটা ভেসে যাচ্ছে যেন। একটু সময় দিয়ে তোমার বন্ধু আর সহকর্মীদের নম্বর একটা খাতায় নোট করতে গিয়ে দেখলাম লিলি বলে সেভ করা একজন কেউ বহুবার ফোন করেছেন। যাইহোক দরকারি ফোনগুলো করতে করতেই আবার লিলির ফোন এলো।
ফোন যখন রাখলাম বিশ্বাস অবিশ্বাসের টানাপোড়েনে পাগল পাগল লাগছিল আমার। প্রথমে তোমার মৃত্যু সংবাদ শুনে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো ও প্রান্তের মেয়েটা। যেন নিজের কান্নার শব্দেরই প্রতিধ্বনি। কান্নার বেগ একটু কমলে মেয়েটা যা বললো তাতে আমার কানে কে যেন আগুন ঢেলে দিল মনে হল। লিলি নাকি তোমার প্রেমিকা! প্রথমে ভাবলাম কোন ফ্রডের পাল্লায় পড়েছি নির্ঘাত। কিন্তু লিলি বললো হোয়াটস অ্যাপ চেক করে ওকে আবার কল করতে। হোয়াটস অ্যাপ চেক করে তুমি সম্পূর্ণ নতুন রূপে আমার সামনে এসে দাঁড়ালে। ঘৃণায় রাগে আমার সারাটা শরীর জ্বলে যাচ্ছিলো। তোমার প্রেমিকাকে ফোন করবো কি, বাথরুমে ওয়্যাক তুলে বমি করলাম অনেকটা। শাওয়ার চালিয়ে চান করে ভিজে গা মাথায় কিভাবে যে নিজেকে বিছানায় টেনে এনেছিলাম কে জানে! আত্মীয় স্বজনরা এই কদিন আমার সাথে ছিল, আমি একটু সাব্যস্ত হতে আজ সকালেই যে যার বাড়ি চলে গেছে। সবারই তো কাজ থাকে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল আমার, তোমার লিলিকে ফোন করে যাতা গালাগালি দিলাম। মেয়েটা চুপচাপ শুনলো কিছু বললো না!
কটা ঘুমের ওষুধ মুখে পুরে শুয়ে পড়েছিলাম পরদিন ঘুম ভাঙলো অনেকটা বেলায়। মাথায় অসহ্য ব্যাথা। কে যেন খুব জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। কাজের মেয়েটা আমাকে দেখে নিশ্চিন্ত হলো, বোধহয় ভেবেছিল বৌদি ও মারা গেছে! কড়া দুকাপ কফি খেয়ে তোমার ফোনটা আবার হাতে নিলাম। ফোনটা থানায় নিয়ে যেতে বলেছে, যদি জমা নিয়ে নেয়? ফোনটা দেখা দরকার। লিলির হোয়াটস অ্যাপ মেসেজগুলো দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম বারবার বুবু বলে একটা বাচ্চার কথা আসছে। প্রেমিকার বাচ্চার প্রতি এতো মায়া? যাইহোক খুব বেশী মেসেজ নেই। মেসেজগুলো উড়িয়ে দিতে মধ্যে মধ্যে, তাইনা? তবে একটা কথা বুঝলাম লিলির সাথে তোমার পরিচয় অনেক দিনের।
আবার ফোন করলাম লিলিকে, গতকাল বড্ড খারাপ করে কথা বলেছি। যাইহোক লিলি মিথ্যে কথা বলেনি। লিলি এবার আমাকে ওর ফ্ল্যাটে একবার আসতে বললো, ওর নাকি অনেক কিছু বলার আছে। খানিকটা দ্বিধায় ভুগে পরের দিন লিলির বাড়ি যাওয়াই স্থির করলাম। ভবানীপুরের কাছে একটা ওয়ান বিএইচকে ফ্ল্যাট। যে মেয়েটা দরজা খুলল তাকে আদতে বোধহয় দেখতে ভালোই কিন্তু এই মুহূর্তে মুখ চোখে কালি মেরে আছে। বয়েস বছর পঁয়ত্রিশ হবে, আমার থেকে বছর দশেকের ছোট। কামিজ ধরে দাঁড়িয়ে আছে বছর চারেকের একটা রোগা বাচ্চা মেয়ে। লিলির সাথে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম ও ঠিক তোমার প্রেমিকা নয় বরং বলা যেতে পারে মিস্ট্রেস। বছর পাঁচেক আগে তোমার সাথে এই মেয়েটার পরিচয়। আমি কি অন্ধ ছিলাম না বোকা কিচ্ছু টের পাইনি! একবার খুব বর্ষার একটা রাতে তুমি নাকি ওকে লিফট দিয়েছিলে। ও তখন একটা বারে গান গাইতো। তুমি আমায় কিছু বলোনি কিন্তু লিলি আমায় সব বলেছে। কিন্তু আরেকটা কথা যেটা ও বলেছে সেটা আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নিয়েছে। বাচ্চাটা নাকি তোমার! তুমি নাকি কিছুতেই বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে দাওনি, উল্টে ওদের সম্পূর্ণ ভরণপোষণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলে। লিলির ইচ্ছা বুবুকে আমি নিয়ে আসি। ওকে তো আবার রোজগারের ধান্দায় নামতে হবে। সেক্ষেত্রে বুবুকে নিজের কাছে রাখতে চায়না ও। হ্যাঁ গো সত্যিই বাচ্চাটা তোমার, বিশ্বাস করবো কিনা বুঝতে পারছি না। বার বার তোমার ফোনে কল করছি, তোমার ফোনটা সাইলেন্ট মোডে আমার সামনেই বেজে যাচ্ছে। একবার যদি ফোনটা তুলতে। এতো প্রশ্নে ডুবে যাচ্ছি , কেন? কেন? করে তোমাকে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।"
এই অব্দি লিখে আর লেখা পড়েনা পেনটা থেকে। তিস্তা কলমটা ঝেড়ে ঝাঁকিয়ে দেখলো একটু কালি ও আর কলমটায় নেই। তিস্তা ভাবলো কোথাও থেকে পেনের কালি জোগাড় করতেই হবে। মেয়েটার কি হলো? বুবুর কি হলো জানার ইচ্ছায় মরে যাচ্ছে তিস্তা। কলমটা নাড়তে নাড়তে তিস্তা বুঝতে পারলো আশ্চর্জনক ভাবে কালি ভরার কোন উপায়ই নেই কলমটায়।
তিস্তা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বেশ রাত হয়েছে প্রায় সাড়ে নটা বাজে। এখনো নয়ন ফিরলো না তো! হঠাৎ তিস্তার তন্ময়তা ভেঙে ওর ফোন বেজে উঠলো। নয়নের ফোন, নিশ্চয়ই কোন বন্ধুর সাথে আড্ডায় জমে গেছে বাবু। ভাবতে ভাবতে ফোনটা ধরে তিস্তা। ফোনের অপরপ্রান্তে অচেনা পুরুষ কণ্ঠ বলে
"হ্যালো হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন ? আপনার স্বামীর এক্সিডেন্ট হয়েছে আমরা ওনাকে রুবি নিয়ে যাচ্ছি। আপনি কাউকে নিয়ে এক্ষুনি রুবি চলে আসুন।"
সুচিন্তিত মতামত দিন