আশ্রয়
হঠাৎ আসা প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তার উল্টো দিকের উঁচু ল্যাম্পপোস্টগুলোর উজ্জ্বল আলো কার্যত ঝাপসা। যেন ঘষাকাচের আড়ালে প্রদীপের আলো। কয়েকশ ফুট দূরেই আরবসাগর মুহুর্মুহু গর্জন করে আছড়ে পড়ছে নির্জন বোল্ডারগুলোর 'পরে। দোকানগুলো সব ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে। অদূরে কোলি গ্রামগুলোয় ঝুপসি অন্ধকার। এত অসহায় লাগছিল পার্বতীর! কে বলবে ঘন্টা দুয়েক আগেও সমুদ্রপাড়ের এই বাঁধানো চাতালটুকুতে মানুষের ঢল নেমেছিল। একটা বন্ধ দোকানের সামনে বাড়ানো অ্যাসবেসটাসের ফুট দুয়েক ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে ও বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। একটাও অটো নেই। হেঁটে গেলে বাসস্ট্যান্ড প্রায় পনেরো কুড়ি মিনিটের রাস্তা। কিন্তু এতো বৃষ্টিতে তারও উপায় নেই। আর রাত দশটার শেষ বাসটা চলে গেলে ও যে আজ কী করে বাড়ি ফিরবে!
গাড়িটা এসে ব্রেক কষেছিল ওর সামনে। কাচ একটু নামিয়ে ড্রাইভারের সিট থেকে চেঁচিয়ে প্রশ্ন আসে, কিধার যানা হ্যায়?
-- ইষ্ট মে। নগেন দাস পাড়া। পার্বতীকেও চেঁচিয়েই উত্তর দিতে হয়।
-- ম্যায় মুলিগাঁও তক যায়েগা। আ যাও। উধার সে শায়েদ অটো মিল যায়েগা। ততক্ষণে পার্বতীর সমস্ত শাড়ি ব্লাউজ এমনকি ব্রেসিয়ার-পেটিকোট পর্যন্ত ভিজে গেছে। সমুদ্রের ধারের প্রবল হাওয়ায় কাঁপুনি লাগছে। আগে এই নির্জন বীচ থেকে বেরিয়ে তো যাওয়া যাক। বিনা বাক্যব্যয়ে ও গাড়ির সামনের সীটে উঠে বসে। ড্রাইভার গাড়ির ভেতরের আলোটা জ্বালিয়ে ওর দিকে তাকায়। পার্বতীও ড্রাইভারের দিকে। পার্বতী বুঝতে পারে মানুষটা ড্রাইভার গোত্রেরই। শক্ত পেটানো চেহারা। চওড়া কব্জি। ধারালো চিবুক। গালে দুতিন দিনের না কাটা দাড়ি। পোশাক অপরিষ্কার। চোখ লালচে, বোধহয় ড্রিংক করেছে। ড্রাইভারও কয়েক মুহূর্ত পার্বতীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে লক্ষ করে তার কানের ঝুলন্ত ঝকমকে দুল, কপালের সোনালী বর্ডার দেওয়া লাল টিপ, চোখ থেকে গলে নামা পুরু আইলাইনার আর ঠোঁটের সস্তার লাল লিপস্টিক।
-- ধান্দা করতি হো?
পার্বতী চুপ করে থাকে।
-- কাস্টমার পেয়েছিলে? গাড়ির গিয়ার চেঞ্জ করতে করতে প্রশ্ন করে। হিন্দিতেই।
এবারও পার্বতী কোনো উত্তর দেয় না।
-- কত নাও?
-- কেন? আমাকে মুলিগাঁও থেকে একটা অটো ধরিয়ে দাও, আমি তোমাকে কুড়ি টাকা দেব। আমার কাছে বেশি টাকা নেই। অটো পেলেও এই বৃষ্টিতে আবার কত চাইবে কে জানে!
-- তুম কিতনা লেতে হো? একই প্রশ্ন করে আবার।
-- পাঁচশো। ঘর কা বন্দোবস্ত কাস্টমারকা জিম্মেদারি।
ততক্ষণে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে মুলিগাঁও নাকায়। জনশূন্য চৌরাস্তায় একটাও অটো নেই। রাস্তার দুদিকের বাংলোগুলোয় মৃদু আলো, বেশিটাই অন্ধকার। বোধহয় কারেন্ট চলে গেছে। একটু ঝড়বৃষ্টি হলেই এখানে ইলেকট্রিক চলে যায়।
-- তুম বাঙ্গালী হো? বাংলাদেশি?
-- হ্যাঁ, বাঙালি, কিন্তু বাংলাদেশি নয়। কী করে বুঝলে?
-- নগেন দাস পাড়ায় থাকো বললে, ওখানে তো নব্বইটাক্কা লোক বাঙ্গালী। দেখ, আমিই তোমাকে ওখানে ছেড়ে আসতে পারতাম, কিন্তু মাল খেয়ে আছি। আজকাল রাতে পাঠানকার মোড়ে নাকাবন্দি হয়, ধরলে ফালতু লাফড়া চালু হবে। ড্রাঙ্কড্রাইভিং-এর কেস ঠুকে আন্দর করে দেবে। তার চেয়ে আমার ওখানে চলো। আমি একাই থাকি। সকালে বৃষ্টি কমলে চলে যেও। কথাগুলো বলে আবার গাড়ির ভেতরের লাইটটা জ্বালায়। বোধহয় পার্বতীর মুখে প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। পার্বতীও তাকায় ওর চোখের দিকে, তারপর সম্মতিতে মাথা কাত করে।
-- কী করছিস বাইরে বসে? একটু কিছু খেতে দে আমায়। ঘরের ভেতর থেকে আসা মায়ের তীক্ষ্ণ স্বরে পার্বতীর হুঁস ফেরে।
-- সকালে তো চা-রুটি খেলে একবার, এর মধ্যেই আবার...।
-- ক্ষিধে পেলে কী করব?
-- আমাকে চিবিয়ে খাও, আর কী করবে! পার্বতী বিরক্ত হয়ে উচ্চস্বরে উত্তর দেয়। সেই আওয়াজে রাস্তার উল্টোদিকের মুখোমুখি ঘরের বউটা বেরিয়ে আসে। পার্বতীকে দেখিয়ে দোতলা থেকে পিচিক করে রাস্তার ওপরে থুতু ফেলে ঘরে ঢুকে পর্দা টেনে দেয়। ফুলছাপ সিনথেটিক কাপড়ের সস্তার পর্দা। পার্বতী নিজের ব্যালকনিতে বসে বরবটি কাটছিল। ব্যালকনি বলতে দোতলায় ওর ঘরের দরজার সামনে রাস্তার ওপর ঝুঁকে থাকা আড়াই বাই চারফুটের খোলা জায়গাটুকু। রাস্তা থেকে দেওয়াল ঘেষা লোহার সিঁড়ি দিয়ে যেখানে উঠে আসা যায়। আর রাস্তা বলতে সাত-আট ফুট চওড়া এক গলি। দুপাশে সারিবদ্ধ একতলা বা দোতলা মানুষের থাকার জায়গা। এখানে যাকে চওল বলে। মুখোমুখি ঘর সব। গা ঘেষাঘেষি ঘর। এই হলো নগেন দাস পাড়া। মুম্বাইয়ের উত্তর শহরতলির প্রান্তিক রেলওয়ে স্টেশনের পূর্ব দিকে গজিয়ে ওঠা এমন এক বস্তি যেখানে বেশিরভাগ মানুষই বাঙালি। বাঙালি মাছওয়ালা, বাঙালি ফুলওয়ালা, সবজিওয়ালা, সোনার কারিগর থেকে শুরু করে উঁচু আবাসনগুলোর ঠিকে কাজের লোক, এমনকি বাঙালি হিজরা, বাঙালি বেশ্যা পর্যন্ত। সবাই পাশাপাশি থাকে।
মোড়ের মাথায় সবজির দোকানে পনেরো টাকায় এক আঁটি বরবটি পেয়েছে। আর এক ফালি কুমড়ো। এখানে বলে ভোপলা। এক পাও, মানে আড়াইশো গ্রাম, দশ টাকা। সকালে মোট পঁচিশটাকার বাজার করে এনেছে। এই দিয়েই মাখামাখা তরকারি করে রাখবে। তাই দিয়েই মা মেয়ের দুবেলার ক্ষুন্নিবৃত্তি। ঘরের ভেতরে তিয়াত্তর বছরের মা, তক্তাপোসে শোয়া। দেখলে মনে হবে তিরানব্বইর বুড়ি।
পার্বতীর হাসি পায়। সামনের ঘরের বউটা পর্দা টেনে যে ঘর সংসার ওর চোখ থেকে আড়াল করছে, তা পার্বতীর ভালোই চেনা। ঐ ঘরের কোথায় কী আসবাব আছে, এমনকি ওর স্বামী কোথায় কনডোম রাখে তাও পার্বতী জানে। বউটা শেষ যে বার ডোমজুড়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিল, তখন ও দুদিন ওই ঘরে গেছে। টাকা দিয়ে খদ্দের যেখানে ডাকবে পার্বতী সেখানেই যাবে।
পার্বতীর গাটা এখন হঠাৎ ঘিনঘিন করে ওঠে। বৌটির স্বামীর মুখের গন্ধ মনে পড়ে যায়। বোধহয় পাউরিয়া আছে। তবে এত বাছবিচার করলে পার্বতীর চলে না। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি হয় রেলওয়ে স্টেশনের ওভারব্রিজে, অথবা সমুদ্রের ধারে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই পার্বতীর কপালে আর প্রতিদিন খদ্দেরও জোটে না। তার ওপর করোনা করোনা করে বাজার সত্যিই মন্দা। কাজেই কাউকেই আর না বলতে পারে না।
আজকাল পার্বতীর এই এক রোগ হয়েছে। কাজ করতে করতে পুরনো স্মৃতিতে ডুবে যাওয়া। স্মৃতি বলতেও তো সেই সবে ধন নীলমণি ঐ একখানা। বারো-তেরো বছর আগের সেই দিনটাকেই ও আঁকড়ে থাকতে চায়। এই যে হাজার হাজার পুরুষের সঙ্গে হাজার হাজার বার ওকে শুতে হয়েছে, শুতে শুতে যন্ত্রের মতো হয়ে গেছে, তবু যখনই কোনো কুৎসিত, দুর্গন্ধময় পুরুষের মুহূর্তমাত্রর সংগম থেকে শুরু করে দীর্ঘ বিকৃত লালসার সামনে দু পা ফাঁক করে শুয়ে থাকতে থাকতে অসহ্য লেগেছে, সেই রাতটার কথাই ও মনে করেছে। অ্যানাস্থিসিয়ার মতো যেন ওর সব ব্যথা-যন্ত্রণা লাঘব হয়ে গেছে মুহূর্তে।
ঘরে এসে একটা বাটিতে করে দুটো মুড়ি মায়ের হাতে দেয় পার্বতী। ওর মায়ের যত বয়েস বাড়ছে ততই যেন খাই-খাইভাব বেড়ে যাচ্ছে। অবশ্য কী-ই বা খায়! তারপর বাইরে থেকে কেটে রাখা বরবটি কুমড়ো তুলে এনে ঘরের দক্ষিণ কোনে রান্নার জায়গায় রাখে। একটা স্টিলের ছোটো হাঁড়িতে দেড় কাপ চাল ধুয়ে জল ভরে রাখে। সামান্যই রান্না, তাও নিয়ম করে ওকেই করতে হয়। সবজির চুবড়ি থেকে একটাই আলু নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে সরু সরু করে কেটে ফেলে। কড়াইয়ে সামান্য তেল গরম করে কাঁচালঙ্কা পাঁচফোড়ন দিয়ে ঢাকা দেয়। তারপর বরবটি, কুমড়ো, আলু ছেড়ে, নুন ছড়িয়ে, ঢাকা দিয়ে আঁচ সিমে করে দেয়।
একতলা ছোট্ট বাড়িটার সামনে কিছুটা জমি ছাড়া। সেখানে গাড়ি পার্ক করে দুজনেই প্রায় দৌড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল ওর সিমেন্ট বাঁধানো সিঁড়িতে। পকেট থেকে চাবি বের করে গ্রিলের দরজার তালা খুলতে খুলতে ড্রাইভার প্রশ্ন করে,
-- তোমার নাম কী? তখনও মুষলধারায় বৃষ্টি।
-- পার্বতী। মাথায় শাড়ির ভিজে আঁচলটা তুলে জল আটকানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে উত্তর দেয়।
-- হা হা হা। পার্বতী, 'পারো'। আর আমি দেবরাজ। দেবরাজ যাদভ। তোমার নাম তো চন্দ্রমুখী হওয়া উচিৎ ছিল।
পার্বতী খোলা দরজা দিয়ে অন্ধকার বারান্দায় উঠে দাঁড়ায়। প্রতিক্রিয়াহীন। বুঝে পায় না পার্বতীর নাম শুনে এত হাসির কী হল!
-- শরৎচন্দ পড়নি? দেবদাস? সিনেমাটাও দেখনি? বারান্দা থেকে মূল ঘরে ঢুকে ইনভার্টারের আলো জ্বালিয়ে দেবরাজ প্রশ্ন করে।
একটা মাঝারি মাপের সাধারণ ঘর। একপাশে একটা খাট। একটা স্টিলের আলমারি। আর একটা দেওয়াল ঘেঁষে দুটো প্লাস্টিকের হাতলওয়ালা চেয়ার। একটা সেন্টার টেবিল। কমদামি আসবাব সব। ঘর থেকে একটা সরু প্যাসেজ চলে গেছে ভেতর দিকে। যার ডান দিকে রান্নাঘর, বাঁদিকে পাশাপাশি দুটো দরজা। বাথরুম ও পায়খানার। চারদিক দেখে নিয়ে বিরক্তির সঙ্গে পার্বতী উত্তর দেয়, গ্রামে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছিলাম, তারপর আমার আর পড়াশোনার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
আলমারি খুলে একটা টি-শার্ট আর পায়জামা বের করে দিয়ে দেবরাজ বলেছিল, কাপড়া গিলা হো গ্যায়া, চেঞ্জ কর লো।
চেঞ্জ করে এসে খাটে বসেছিল পার্বতী। দেবরাজের অপেক্ষায়। কিন্তু তার যেন কোনো তাড়া নেই বিছানায় আসার।
-- ভুখ লাগা? দেবরাজ প্রশ্ন করে।
-- কী আছে? পার্বতী পাল্টা প্রশ্ন করে। তার লজ্জা করলে চলে না, এই ক্ষিধে মেটাবার জন্যই তো ধান্দায় আসা।
-- আমি তো বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। ঘরেও তেমন কিছু নেই। দুটো পাও আর দুচারটে কলা বোধহয় আছে। কিচেনে। যাও খেয়ে এস।
নামেই কিচেন। একটা গ্যাস ওভেন, দু চারটে বাসন ছড়ানো প্লাটফর্মে। ছোটো ছোটো প্লাস্টিকের কৌটো। তাতে দু চার রকমের মশলা, চায়ের পাতা আর চিনি।
পার্বতী পাওয়ের সঙ্গে কলা দুটো খেয়ে ঢকঢক করে একপেট জল খেয়ে এসে দেখে দেবরাজ একটা গ্লাসে মদ ঢেলে আরাম করে চেয়ারে বসেছে।
-- তোমাকে দেখে খুব টায়ার্ড লাগছে, শুয়ে পড়ো। আমি পরে শোবো। দেবরাজ বলে। পার্বতী কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ে। একটাই বালিশ। পাশে রেখে দেয়। আর শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লান্তিতে যেন ওর চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমে।
ঘুম ভাঙে ভোররাতে অনাস্বাদিতপূর্ব এক শরীরী আশ্লেষে। এমন মমতায় কোন পুরুষ তার শরীরকে আগে কখনো ভালবাসেনি। কী পরম ধৈর্যে, কী কোমল অনুসন্ধিৎসায় তার শরীরের প্রতিটি বাঁক থেকে দুই ঠোঁট দিয়ে যেন অমূল্য কিছু খুঁটে নিচ্ছিল দেবরাজ। আর তারপর...। না প্রায় এক যুগ আগের কথা। আজও সম্পূর্ণ ভুলতে পারেনি পার্বতী। পাঁচশ টাকা দিয়েছিল দেবরাজ। সেই প্রথম কারো কাছ থেকে টাকা নিতে ইচ্ছে করছিল না পার্বতীর। তবু নিয়েছিল। সকালে বাড়ির সামনে থেকে অটোতেও তুলে দিয়েছিল দেবরাজ। তারপর অনেকদিন আর যোগাযোগ করেনি। প্রায় মাস চারেক বাদে হঠাৎ একদিন পার্বতী নিজেই চলে গিয়েছিল ওর বাড়ি। সন্ধ্যায়। গ্রিলের দরজা বন্ধ। বাইরের জমিটুকুতে আগাছা বেড়েছে। দেবরাজ কি অন্য কোথাও চলে গেছে! এখানে বাড়িগুলো গা ঘেষাঘেষি নয়। সব বাড়ির সঙ্গেই আছে নিজস্ব জমি। পার্বতীকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উল্টোদিকের কোনাকুনি বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসেন একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। তার কাছেই জানতে পারে, দেবরাজের আসা যাওয়ার কিছু ঠিক থাকে না। গাড়ি নিয়ে দূরে ভাড়া খাটতে গেলে মাঝেমধ্যে দুচার দিন ফেরেই না হয়তো। বেশ কয়েকমাস পরে আবার এক সন্ধ্যায় গিয়েছিল, সেদিন দেখেছিল বাইরের জমিটুকু পরিষ্কার। ঘরের জানলা খোলা, আলো জ্বলছে। বারান্দায় শুকোচ্ছে কাচা জামা কাপড়, নাইটি, পেটিকোট। তারপর ওদিকে আর কোনোদিন যায়নি পার্বতী।
-- কী রাঁধছিস আজ? পার্বতীর মা প্রশ্ন করে।
-- বরবটির তরকারি। আলু কুমড়ো দিয়ে। সম্বিৎ ফিরে তাড়াতাড়ি ঢাকনা সরিয়ে কড়াইয়ে সামান্য জল ও একটু চিনি দিয়ে নাড়াতে থাকে।
-- একটু আলু আর বড়ি দিয়ে ঝালের ঝোল বানাবি? খুব খেতে ইচ্ছে করছে।
-- বড়ি নেই। বড়ি এক প্যাকেট নব্বই টাকা। কোথা থেকে আসবে শুনি? এত খাই খাই করো কেন? পার্বতী খিঁচিয়ে ওঠে। আজকাল সবসময় একটা বিরক্তি ও অবসাদ যেন ওকে কুরে কুরে খায়। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে চোখে পড়ে তখনই নিচের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সেই আলাভোলা ছেলেটা। গাল ভরতি দাড়ি, টিকালো নাক, উঁচু কপাল, পুরু ঠোঁট। গায়ে বোতামখোলা পাঞ্জাবি। এ পাড়ায় বোধহয় নতুন এসেছে। বাঙালি। বয়সে পার্বতীর চেয়ে অনেকটা ছোটো হবে।
গত সপ্তাহে ওভারব্রিজে পুলিশ লাঠি নিয়ে তাড়া করাতে, ওখান থেকে পালাতে হয়েছিল। লাইনের অন্য মেয়েগুলো কেউ কেউ বাজারের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়। পার্বতী একটা বাস ধরে চলে আসে বিচে। ইদানিং সমুদ্রের ধারে বোল্ডার ফেলে আরো অনেকটা লম্বা জায়গা বাঁধানো হয়েছে। দোকানপাটও অনেক বেড়ে গেছে। লুকিয়ে চুরিয়ে মদও বিক্রি হয় সেসব দোকানে। শুক্র, শনি, রবিবার সন্ধ্যা থেকে বেশ ভিড় হয়। সমুদ্রের ধার দিয়ে অন্ধকারে একটু হাঁটাহাঁটি করলে কেউ না কেউ এগিয়ে আসে। এই ছেলেটাকে দুদিন দেখেছে ওখানে। একা বোল্ডারের ওপরে বসে থাকতে।একদিন আবার গান গাইছিল। পুষ্প বনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে...। সুন্দর গানের গলা। তবে গানটা পার্বতীর অচেনা। এককালে লেডিস বারে কাজ করার সময়ে ও অনেক গান শুনেছে, কিন্তু সেসব হিন্দি সিনেমার গান। এ গান ও কখনও শোনেনি। দূরে দাঁড়িয়ে ও শুনেছিল কিছুক্ষণ। চেষ্টা করেছিল ছেলেটার নজর আকৃষ্ট করার। কিন্তু ছেলেটা ওর দিকে একবার তাকানোর পরে আর দ্বিতীয়বার তাকায়নি। পার্বতী তাড়াতাড়ি এসে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। কিন্তু আজও তাই, ছেলেটা রাস্তাটা পেরিয়ে গেল একবারও ওপরের দিকে না তাকিয়ে। ছেলেটা খুব সুন্দর গান করে। কদিন আগেই খুব ভোরে মোড়ের মাথার টগর গাছটা থেকে কটা ফুল তুলে ছেলেটা যে চালিতে ভাড়া থাকে তার সামনে দিয়ে ফিরে আসার সময় গলা সাধার আওয়াজ পেয়েছে। খুব সুন্দর গলার আওয়াজ। সিনেমার যারা গান করে তাদের মতোই।
ফ্যান গালতে ভাতের হাঁড়ি উপুড় করে, তরকারি নামিয়ে, আবার বাইরে এসে বসে পার্বতী। সারাটাদিন এভাবেই গড়িমসি করে কাটে। আর সন্ধ্যা হলে সেজেগুজে বেরিয়ে যায়। আজকাল একেক সময় বসে বসে নিজের জীবনটার কথা ভাবে। কোন ছোটবেলায় মা ওকে নিয়ে চলে এসেছিল বম্বে। তখন ওর এগারো বারো বছর বয়স। নিজের বাবার কোন স্মৃতিও নেই ওর। কামারথুবায় এক অবস্থাপন্ন কৃষকের বাড়িতে আশ্রিতা ছিল ওরা। দূর সম্পর্কের আত্মীয় কেউ। মা সেই সংসারে কাজ করত রাতদিন। এখন বোঝে আসলে মা রক্ষিতাই ছিল সেই মানুষটার। কিন্তু একদিন ঐ লোকটার নজর পড়ে পার্বতীর এগারো বারো বছরের কিশোরী শরীরটার ওপরেও। পাশের বাড়ির বলাই কাকু, যে বম্বেতে জুয়েলারির কাজ করত। সেই বলাইকাকুর সঙ্গে মা ওকে নিয়ে চলে এসেছিল বম্বে। আয়ার কাজ জোগাড় করে দেবে বলেছিল বলাইকাকু। কিন্তু এখানে এসেও মাকে সেই বলাইকাকুর রক্ষিতা হয়েই থাকতে হয়েছিল ক'বছর। তারপর সেই আশ্রয়ও চলে গেলে শেষমেশ ধান্দাতেই নামতে হয় ওর মাকে। কিন্তু মা চেয়েছিল যে করেই হোক পার্বতীকে এই লাইন থেকে দূরে রাখতে। কিন্তু চাইলেই কি আর রাখা যায়! বিশেষ করে যে মহিলার গায়ে রেন্ডির ছাপ পড়ে যায় তার মেয়েকে কেউ বিশ্বাস করে ঘরের কাজের জন্যও রাখে না। তাও যতদিন লেডিস বারগুলো চালু ছিল, শুধু টেবিলে টেবিলে ঘুরে কাস্টমারদের গ্লাসে মদ ঢেলে দেওয়ার কাজ করে পেট চালাতে পারতো। অনেক কাস্টমারই ছুঁকছুঁক করলেও, শোয়ার প্রস্তাব দিলেও এড়িয়ে যেতে পারতো। কিন্তু মহারাষ্ট্র সরকার লেডিসবারগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পরে ওর সামনে আর কোন রাস্তাই খোলা ছিল না। এই পনেরো ষোলো বছরে হাজার হাজার পুরুষের সঙ্গে শুতে হয়েছে ওকে। একেকজন খদ্দেরের একেক রকম চাহিদা। কম হুজ্জতি সহ্য করতে হয় না ওকে। খদ্দেরের। পুলিশেরও। এখন অলস অবসরে বসে বসে সেসব কথা ভাবে। দেবরাজের মতো দু-এক জনের কথা মনে রয়ে গেছে। সেসব স্মৃতি নাড়াচাড়া করে। আজকাল খদ্দেরও আসে তেমন! নিজের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রেট কম করতে হয়েছে, প্রতি বছরই নতুন নতুন অল্পবয়সী মেয়েদের আমদানি হচ্ছে এই ধান্দায়। যারা স্টেশন ও বাজারের আশেপাশের চত্বরের দখল নিয়েছে। পার্বতী তাই ওখানে ভিড় না বাড়িয়ে প্রথম থেকেই বাস ধরে সন্ধ্যার মুখে চলে আসত সমুদ্রের ধারে। এখন সমুদ্রের ধারে ধারে গজিয়ে উঠেছে টেম্পোরারি গেস্ট হাউস। খদ্দেররা ঘন্টা হিসেবে যেখানে বিছানা ভাড়া পায়। মধ্যবয়স্ক থেকে প্রৌঢ়, অটোওয়ালা, মাছওয়ালা, সবজিওয়ালা থেকে শুরু করে নিম্নমধ্যবিত্ত গৃহস্থ, যেমন খদ্দেরই আসুক পার্বতী আর বাছবিচার করে না। তার টাকা চাই। শুধু কোনো খদ্দের যখন তার শরীরের উপর হামলে পড়ে নিজের প্রয়োজনটুকু মেটানোর জন্য, পার্বতী সারা জীবনের স্মৃতিসঞ্চয় থেকে খুঁজে নেয় একটা মুখ, কিছু ভুলতে না পারা মুহূর্তের কথা। তবে সময়ের সাথে সাথে সেই মুখও আবছা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। পার্বতীর মনে হয় যেন আশ্রয় হারিয়ে ফেলছে। ঐ স্মৃতিটুকুই ওকে আশ্রয় দিয়ে এসেছে এতগুলো বছরের আবেগহীন সংগমের নিত্যনৈমিত্তিকতায়। প্রতিটি পছন্দের খদ্দেরের মধ্যে ও তাই খোঁজে এমন নতুন আশ্রয়। কিন্তু পছন্দের কাস্টমার জোটে কোথায়!
পার্বতীর খারাপ লাগে ওর মায়ের কথা ভেবে। সামান্য আলু বড়ির ঝালের ঝোল খেতে চেয়েছিল, সেটুকুও আজ খাওয়াতে পারল না। গত দুদিন কোন কাস্টমার আসেনি, হাতে কাঁচা টাকার টানাটানি। আজ রাতে ফেরার সময় এক প্যাকেট বড়ি কিনে নিয়ে যেতে হবে মায়ের জন্য।
সন্ধ্যায় সমুদ্রের ধারে হাঁটাহাঁটি করছিল পার্বতী। একবার উত্তরপ্রান্ত থেকে দক্ষিণ প্রান্ত, আবার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে উত্তরে। আরো দুচারজন রেন্ডি ঘুরছে ওরই মতো। বগলে গোটানো মাদুর আর হাতে তেলের শিশি ঝুলিয়ে ঘুরছে লুঙ্গি পরা মালিশওয়ালা। উটের পিঠে বাচ্চাদের বসিয়ে দড়ি ধরে হেঁটে নিয়ে যাচ্ছে উটওয়ালা। পেছন পেছন হেঁটে যাচ্ছে সুখী-সুখী মুখের বাবা মায়েরা। মোবাইলে উটের পিঠে আসীন নিজেদের সন্তানের ফটো তুলছে তারা। আজ শুক্রবার। ভালোই ভিড়।
পার্বতী পরেছে টাইট একটা সালোয়ার কামিজ। বেগুনি রঙের। ভেতরে প্যাডেড কালো ব্রেসিয়ার। সাদার ওপর সলমা-চুমকির কাজ করা নাইলনের ওড়না। সূর্য অস্ত গেছে কিছুক্ষণ আগেই। চাঁদ এখনো ওঠেনি। তবু সমুদ্রের ধারে দিনের শেষ আলো হালকা সরের মত লেগে আছে। বাঁধানো পাড়ে উঁচু ল্যাম্পপোস্টগুলো ভেপার লাইট জ্বলে উঠেছে। হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিণের নির্জন প্রান্তে এসে ও দেখতে পায় বোল্ডারের ওপর একজন বসে আছে। একা। নগেন দাস পাড়ার সেই নতুন ছেলেটির মতো অবয়ব। পার্বতী এগিয়ে যায় মানুষটার দিকে। হ্যাঁ, সে-ই। ছেলেটিও ওকে ইশারায় ডাকে।
-- জায়গার ব্যবস্থা আছে? পার্বতী ছেলেটির সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে।
-- কত নেন? ছেলেটি মলিন হেসে প্রশ্ন করে। এদিকে আলো কম। ছেলেটির মুখও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
-- এখানেই? ওপর ওপর? একশ। হাত দিয়ে করে দেব। আর মুখে নিলে দুশো।
ছেলেটি উঠে দাঁড়ায়। পার্বতীর মুখোমুখি। নিজের দুটো হাত রাখে পার্বতীর কাঁধে। কাঁধ থেকে ওড়নাটা তুলে নেয়। পার্বতী কিছু বোঝার আগেই সেই ওড়না বিছিয়ে দেয় দুজনের মাথার ওপর দিয়ে। আর তারপর পকেট থেকে বের করে সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই। ঠোঁটে একটা সিগারেট ঝুলিয়ে ফস করে দেশলাই জ্বালায়। সেই আলোয় বিস্ফারিত চোখে পার্বতী তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে। ছেলেটিও তাকায় পূর্ণ দৃষ্টিতে। কী মায়াবী চোখ!
ওড়নাটা যত্ন করে যথাস্থানে রাখতে রাখতে, একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে, ছেলেটি বলে, এত হাওয়া এখানে, সিগারেট ধরাতে পারছিলাম না। তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দেয় পার্বতীর দিকে।
-- এতে হবে, না পুরো দুশোই দিতে হবে?
-- আর কিছু করবেন না? পার্বতী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
-- না। আপনি তো আমাদের পাড়াতেই থাকেন, তাই না? কী নাম আপনার? স্মিতমুখে প্রশ্ন করে ছেলেটি।
-- পার্বতী। আপনি চেনেন আমাকে! বিস্মিত পার্বতী টাকাটা ভাঁজ করে ব্রায়ের ভেতরে গুঁজতে গুঁজতে বিড়বিড় করে উত্তর দেয়। একটু আগেই শুভদৃষ্টির মতো যে ঘটনাটা ঘটে গেল তার অভিঘাত ওকে যেন ক্রমশ একটা ঘোরের মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
-- আপনার নাম কী? বিবশ স্বরে পার্বতী প্রশ্ন করে।
-- শুদ্ধ। শুদ্ধ বন্দোপাধ্যায়।
-- কী করেন? গাড়ি চালান? ড্রাইভারি?
-- না না, আমিও এখানে লড়াই করতে এসেছি। প্লেব্যাক সিঙ্গার হওয়ার লড়াই। আর তার জন্য আমাকেও দুবার শুতে হয়েছে। তাও আবার একজন পুরুষ ডাইরেক্টরের সঙ্গে। আসলে আমরা দুজনেই সৈনিক। শুধু যুদ্ধটা আলাদা।
আরবসাগর পারের সান্ধ্য হাওয়া আর ঢেউয়ের আওয়াজের এক অলৌকিক মিশ্র রাগিনীর মধ্যে দিয়ে এসে সেই উচ্চারণ পার্বতীর বুকের মধ্যে গেঁথে যায়। ব্রায়ের ভেতরে যেখানে টাকাটা রেখেছে, তার চেয়েও আরো অনেক গভীরে। পার্বতী বুঝতে পারে যে আজ, একটু আগে ও আবার এমন একটা মুহূর্ত পেয়ে গেছে যাকে আশ্রয় করেই ওর বেশ্যাজন্মের যেটুকু বাকি আছে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারবে।
অপূর্ব অপূর্ব ! ভোরের শুদ্ধ রাগিনি... দুই সৈনিকের মুখ... শরতের মাদকতাময় ছাতিম... কী উপহার দিলে হে আমার স্বদেশ !
উত্তরমুছুনচন্দ্রনাথ শেঠ
উত্তরমুছুনবর্মের ভেতরের সৈণীক দুইয়ের গভীর মনের হদিশ পাঠক মনকে অবশ্যই আবেগঘন দীর্ঘশ্বাসে নিমজ্জিত করবে ও করছেও ...
উত্তরমুছুনঅপূর্ব লাগলো...
Thank you... Chandranath da..., Arghya
উত্তরমুছুন