মলয় চট্টোপাধ্যায়

মায়াজম
0

 দ্বৈরথ




 

 

প্রথমদিকে আয়েশ করে খাওয়া শুরু করলেও এখন খাওয়ার গতি বেড়েছে তার। যদিও এটা বেশ বুঝতে পারছে যে এই খাবার পুরোটা শেষ করতে পারবে না সে। তাকে খুঁজতে লোকগুলো লাঠি দা পটকা নিয়ে বের হবে একটু পরেই। চারদিন পেটে কিছু পড়েনি তার। চার চারটে দিন না খেয়ে আছে সে। চারদিন পরে খাবার জোগাড় করতে পারলেও তার দিকে তেড়ে আসবে গ্রামের লোকজন। আর কিছুক্ষণের ওয়াস্তা মাত্র। লোকগুলো শুধু ভোর হওয়ার অপেক্ষা করছে এখন। যদিও সে জানে যে তার সামনে একা দাঁড়ানোর হিম্মত ওই লোকগুলোর মধ্যে কারোরই নেই। তাই দলবেঁধেই আসবে ওরা। বেশি দেরি করলে চলবে না আর। অভুক্ত খাবারের দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে আবার নদীর দিকেই ফিরতে লাগলো সে।

 

***

 

লোকে বলে তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা। তিনকাল কাকে বলে তা যদিও জানে না মাধব মিস্ত্রি। শুধু জানে যে নিজের বয়সটা এখন চার কুড়ি ছুঁই ছুঁই চলছে। বয়সটা একটু বেশি হলে কি হয়, মাধব মিস্ত্রির হাত পাগুলো এখনো বেশ সচল। নদীর থেকে বড়জোর চারশো হাত আগে দুটো ঘর আর ঘরের সামনে একচিলতে বারান্দা। এই নিয়েই বেশ খুশি আছে সে। ঘরের পিছন দিকে দেড় বিঘে জমিও আছে। বলতে নেই, সে জমিতে যা চাষ হয়, তাই দিয়েই দিব্যি চলে যায় তার। ঘরদুটোও আগে টালির চালার থাকলেও এখন সে দুটো পাকা ছাত হয়ে গেছে। বারান্দাটাও আগে মাটির দাওয়া থাকলেও এখন আর তা নেই। ওই মাটির ওপরেই ইঁট বিছিয়ে সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়াতে সেটাও এখন পাকা। দুটো ঘরের একটাতে থাকে মাধবের ছেলের বউ। আরেকটা ঘরে নাতি কানাই থাকে বউ আর চারবছরের ছেলে নিয়ে। নাতির ঘরের পুতি, ওই চারবছরের ছেলেটা বড় ন্যাওটা মাধবের। পুতির নামও দিয়েছে নিজেই অনেক ভেবে মোহন। মাধব নিজে শোয় এই বারান্দাতেই। আগে অবশ্য একটা ঘরে থাকতো নিজের বউ সৌদামিনীকে নিয়ে। অন্য ঘরটায় ওর ছেলে গৌর থাকতো তার বউ ফুলারির সাথে। কিন্তু বিধি বাম। বছর বিশেক আগে ওর বউ সদু টাইফয়েডে মরলেও, তার বছর পাঁচেক পর ছেলে গৌর মরলো মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই। কানাইয়ের বয়স তখন সবে এগারো পেরিয়ে বারোয় পা দিয়েছে।

 

গৌর অবশ্য কোনো রোগে মরেনি। সে গিয়েছিল জঙ্গলে মধু আনতে। এমনিতে নদীতে জাল টেনে মাছ ধরেই সংসারটা চলতো। কিন্তু বোশেখ জষ্ঠি মাসে নদীতে মাছ ধরায় মানা। সে সময়টা অনেক মাছেদের মিলনের সময়। সেই সময় বনদপ্তর দেয় জঙ্গলে মধু আনতে যাওয়ার পারমিট। সেই পারমিট নিয়েই সব ঢুকতো গিয়ে জঙ্গলে। সে দুমাস জেলের দল হয়ে যেত মউলের দল।কাকসার ভাড়ানিতে নৌকা ঢুকিয়ে ঝিলার ফোড়ন বেয়ে মউ বাওয়ালিরা ঢুকতো জঙ্গলে। গৌরও ছিল সেই পাশি বাওয়ালিদের দলের একজন। সে দলে ছিল মোট সাতজন। দলের দোহাসি হিসাবে আর কারো নাম মাথাতেই আসেনি। দলের সবাই যেন জানতো যে দলে গৌর থাকা মানে দলের সাজুনি ওই হবে। রান্না সামলানোর জন্য সে দলে একজন থাকলেও দুজন কাটনি আর চারজন আড়ি বাওয়ালিও ছিল।

 

সেবার ফোড়নে নৌকা ঢোকানোর পর একটা সুঁতিখাল টপকানোর পরেই দলের একজনের নজরে পড়ে ডানদিকে। দেখার সাথেসাথেই গৌরকে ছোট্ট একটা ঠেলা দিয়ে সে বলে ওঠে...

-- ওই দ্যাক কেনে গৌরা। বোঝাই মনে হতিছে না।

একবার দেখেই গৌরের অভিজ্ঞ চোখ বুঝে যায় যে সঙ্গী ঠিকই বলছে। চোখ চকচক করে ওঠে তার। বলে...

-- হ্যাঁ রে, ইডা খালিন নয়। ইডা বোঝাই ফিরতিছে বাসায়। চল চল, নৌকো লাগা। ইডারে ছাড়া যাবে নে।

ফুলের থেকে মধু খেয়ে পেটবোঝাই করে চাকের দিকে ফিরছে মৌমাছি। সব ক্ষেত্রে যা দস্তুর। ওই মৌমাছির ছোট্ট দলটাকে চোখের আড়াল করা যাবে না কিছুতেই। দ্রুত নৌকা পাড়ে ভিড়িয়ে মৌয়ালদের দল নেমে পড়ে কাদায়। কোনোক্রমে শুলো বাঁচিয়ে ছুটতে থাকে সে মৌমাছির দলের পিছন পিছন। বেশিদূর যেতেও হয় না। খানিক যাওয়ার পরই ওদের নজরে আসে এক বাইনের ডালে আছে সেই আকাঙ্খিত মৌচাক। যে সে জিনিস নয় একেবারে সূর্যপাতালি। এবার শুরু হয় হেঁতালের পাতার কারু বানিয়ে চাকের নীচে ধোঁয়া দেওয়ার কাজ। ধোঁয়ায় চাক ছেড়ে মৌমাছিরা উড়ে গেলেই বাঁশ আর বেতের তৈরি আড়ি ধরা হবে চাকের নীচে। তারপর গাছে উঠবে সাজুনি। গাছের ডালে যাতে দায়ের কোপ না পড়ে বা ডালে মধুর প্রলেপে যাতে কোনোভাবেই উঠে না যায়, সে সব দেখেশুনে অতি সন্তর্পনে চাক কেটে নামিয়ে আনবে সে।

 

বনে ঢুকলে সবাই সজাগ থাকেই। সামান্য অসতর্ক থাকলেই ঘটে যেতে পারে চরম বিপদ। তবে এই সময়টাতেই সবার নজর থাকে চাকের দিকে। এক ফোঁটা মধুও যাতে বাইরে পড়ে নষ্ট না হয় সেদিকেই সবার নজর থাকে বেশি। আর মধু আনতে যাওয়ার প্রথমদিনেই এত ভালো মধুর সন্ধান পাওয়াতে দলের সবার মধ্যেই ছিল একটা চাপা উল্লাস। সেই কারণেই বোধহয় কেউ বুঝতেই পারিনি যে সুঁতিখালের কাদায় পা রাখার সময় থেকেই জঙ্গলের ভিতর থেকে তাদের ওপর নজর রাখতে শুরু করেছে গনগনে একজোড়া জ্বলন্ত চোখ। গৌর যখন গাছে ওঠার তোড়জোড় শুরু করেছে, ঠিক তখনই জঙ্গলের আড়াল থেকে বিদ্যুৎগতিতে বের হয়ে আসে জঙ্গলের রাজা। নিজে রাজা বলেই সে বোধহয় জানতো যে দলের মধ্যমণি কে।বন থেকে বেরিয়েই এক লহমায় গৌরের ঘাড়ে কামড় বসায় সে। পুরো মৌয়াল দলের সবাই হাতের বাঁশ দা নিয়ে হইহই করে উঠে পাল্টা আক্রমণ করার চেষ্টা করতেই আরো ভয়ানক হিংস্র হয়ে ওঠে জঙ্গলের রাজা। জঙ্গলে পা রেখেছে এমন সবাই জানে যে এই ভয়াল হাড় হিম করে দেওয়া হিংস্র রূপের সামনে কেমন ভাবে অসহায় হয়ে পড়ে মানুষ। কয়েক মুহূর্তের আনাগোনা শুধু। বেড়াল যেমন তার ছানাকে মুখে করে নিয়ে দৌড়ায়, সেভাবেই সবার চোখের সামনে দিয়ে গৌরের ভারী দেহটা কামড়ে আবার জঙ্গলের ভিতরে হারিয়ে যায় জঙ্গলের রাজা।

 

পড়ি কি মরি করে বিহ্বল মৌয়ালের দলটা বেরিয়ে এসেছিল বন থেকে। মাথায় তখন একটাই চিন্তা সবার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খবর দিতে হবে কাকসার বনদপ্তরের অফিসে। যদিও সে পরিস্থিতিতে কাকসার ওপর দিয়ে যাওয়ার আর সাহস হয়নি কারো। নৌকা ঘুরিয়ে এনে গাড়াল বেয়ে সে দল পৌঁছেছিল বনদপ্তরের অফিসে। সব শুনে আর একমুহূর্তও দেরি করেনি ফরেস্টের বাবুরা। বন্দুক নিয়ে তাদের মোটরবোটে চেপে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা এসেছিল সেই অভিশপ্ত জায়গায়। হল্লা পার্টির সঙ্গে একইসাথে সার্চ পার্টি শুরু করেছিল কাজ। বেশি খুঁজতে হয়নি যদিও। গৌরকে ধরা হয়েছিল যেখান থেকে, তার তিনশো গজ দূরেই একটা গরান গাছের নিচেই পড়েছিল খুবলে খাওয়া দেহটা। সে দেহ নিয়ে ফেরার সময় দলের একজন শুধু সেই সুঁতিখালের সামনের একটা সুন্দরীর ডালে মাথায় পেঁচিয়ে রাখা গামছাটা বেঁধে দিয়েছিল চোখের জল ফেলতে ফেলতে।

 

ঘরের সামনের উঠোনে যখন ছোপ ছোপ রক্ত মাখা সাদা কাপড়ে মোড়া গৌরের নিষ্প্রাণ দেহটা বাঁশের চালির ওপর শুইয়ে নিয়ে এসে রাখা হলো তখন সদু আর ফুলারি কেঁদে আছাড়ি পিছাড়ি করলেও একফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি মাধব। মনের মাঝে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল শুধু। খালি ভাবছিল 'আমারে নে গেলি না ক্যানে রে তোরা? আমি থাকলি পরে তো এমনডা ঘটতো না। ওরে আমি যে তোদের মতো পাসি নই রে। আমি যে গুণীন বাওয়ালি।'

 

এ কথাটা ফেলনার নয় যদিও। মাধবকে সবাই এখন খুড়ো বলে ডাকলেও একসময় সবাই তার নাম নিত কপালে হাত ছুঁইয়ে। এ তল্লাতের সব চেয়ে নামজাদা গুণীন ছিল মাধব। সবাই বলতো যে বনে যদি মাধু গুণীন থাকে সাথে, তাহলে আর চিন্তা নেই। সে মধু আনাই হোক বা কাঠ কাটতে যাওয়াই হোক, অথবা গোলপাতা আনতে যাওয়াই হোক, মাধু গুণীন এমন চালান মন্ত্র পড়বে যে সাত মাইলের মধ্যে কোনো বিপদ আর আসতেই পারবে না। 

 

গুণীনবিদ্যায় মাধবের গুরু ছিল তোরাব মন্ডল। শোনা যায় যে সে এমন দাপুটে গুণীন ছিল পাল্টা ছুকে মন্ত্র দিয়ে স্বয়ং দক্ষিণরায় কে ডেকে আনতো বাড়ির দাওয়ায়। সে মন্ত্রের জোর নাকি থাকতো এতটাই যে জঙ্গলের রাজা পর্যন্ত তোরাবের বশ হয়ে থাকতো। তোরাব নাকি তাকে মাথায় আদর করে হাত বুলাতে বুলাতে মাছ খাওয়াতো। কিন্তু এহেন তোরাবও কিনা মরেছিল শেষে ওই দক্ষিণরায়ের হাতেই। ধুচনিখালিতে নিজের ছিটেবেড়ার ঘরের পিছনেই কবর দেওয়া হয়েছিল তোরাবকে। তবে কেউ না জানুক, মাধব জানতো যে তার গুরু মরেছে অভিশাপে।

 

বহু বছর আগে যখন গুণীন হওয়ার জন্য তোরাবের স্যাঙাত হয়ে থাকতো মাধব, সেই তখনই তোরাবের বড় ব্যাটার হয়েছিল পিলের অসুখ। কোনো হেকিম বদ্যিতেও আর সে অসুখ সারে না কিছুতেই। সেই সময় চারটে নৌকার বরাত একেবারে একসাথে পেয়েছিল তোরাব। জঙ্গলে মধু আনতে যাওয়ার আগে সবাই এসে ধরেছিল তোরাবকে। সবারই ছিল এক কথা। সঙ্গে তোরাব গুণীন থাকলে আর চিন্তা নেইকো মোটেই। ঘরে ছেলের অসুখ।হাতেও টাকা পয়সা নেই বিশেষ। একপ্রকার নিমরাজিই হয়ে গিয়েছিল তোরাব। সঙ্গে সাথী করেছিল মাধবকে। সেবার সুন্দরী গাছের গায়ে মাল করে জঙ্গলে ঢোকার পর সবাই যখন মধুর চাক খুঁজতে ব্যস্ত, তখন বাদার গদে নেমে বেশ খানিকটা হাঁটার পর ওদের দুজনের নজরে এসেছিল যে একটা গেঁঁওয়া গাছের আড়াল থেকে একটা থাবা শুধু নরম মাটির ওপর দেখা যাচ্ছে। একবার শুধু দেখেই বুঝেছিল তোরাব যে সে দেহে কোনো প্রাণ নেই। সামনে গিয়ে দেখে দুজনেই নিশ্চিত হয়েছিল যে তিন চার দিনের বাসি হয়ে গেছে জঙ্গলের রাজার মৃতদেহ। বয়স হয়েছিল, আর মারা গেছে নিশ্চয়ই গায়ে শুলো ফুটেই। সে দেহের থেকে তখন গন্ধ ছড়াতে শুরু করেই দিয়েছে। দৃশ্য দেখেই তোরাবের মাথায় এসেছিল ঠেংনা করার কথা। তাতে যদি ঘরে ফিরে ওর ছেলেকে সুস্থ করে তোলা যায়। গুরুর আদেশে মৃত রায়মণির জিভ কেটে এনেছিল মাধব। ঘরে ফেরার পর কলার ভিতরে সে জিভের টুকরো ঢুকিয়ে তারপর সবটা একসাথে পুড়িয়ে খাওয়ানো হয়েছিল তোরাবের বড় ব্যাটাকে। এর সাথে হরগোজ গাছের শিকড় পুড়িয়ে ঠেংনা করা হয়েছিল হাতে। দুদিনের মধ্যেই সুস্থ হতে শুরু করেছিল সে ছেলে।

 

কিন্তু এর কিছুদিন পর প্রথমে মরলো তোরাব, আর তার বছরদুয়েকের মধ্যে তোরাবের ওই বড় ব্যাটাও মরলো কিনা ওলাউঠায়। তখনই একটা ভয় ঢুকেছিল মাধবের মনে। তাহলে কি মৃত শরীরকে অপবিত্র করার জন্য এভাবেই প্রতিশোধ নিলো দক্ষিণরায়?

****

 

গ্রামে এখন বিপদ। নদী পেরিয়ে জঙ্গলের রাজা জঙ্গল ছেড়ে যখন তখন চলে আসছে গ্রামে। গ্রামের পুরুষরা সবাই মিলে চালু করেছে রাত পাহারা। মাধবের নাতি কানাইও আছে সেই দলে। প্রথমটায় একটু কিন্তু কিন্তু করলেও গ্রামের সব জোয়ান ছেলেরা আছে দেখে রাজি হয়ে গেল মাধব। ভেবে দেখলো যে এরা তো আর মুখোমুখি লড়াই করতে যাচ্ছে না। সে চিন্তা করাও বাতুলতা মাত্র। এরা বড়জোর পটকা ফাটিয়ে মুখে চিৎকার করে সাবধান করবে সবাইকে।

 

সেই কথামতো রাত পাহারা শুরু হলেও চতুর্থ রাতেই ঘটলো ছন্দপতন। তিনটে দলে ভাগ হয়ে রাতে গোটা গ্রাম ঘুরতো ছেলেরা। তিনটে দিন আর রাত ভালোভাবে কাটবার পর চতুর্থ রাতে একদলের ছেলেরা যখন ঘুরছে তিতুমীরের মজা খালের গা ঘেঁষে, তখন জলবিয়োগ করতে দাঁড়িয়েছিল কানাই। দলের আর সবাই এগিয়ে গেছে খানিকটা। শরীরটা হালকা করে সবে একটা বিড়ি ধরানোর জন্য লুঙ্গির গেঁজেতে রাখা দেশলাইটা বের করতে গেছে কানাই; ঠিক যেন এই অসতর্ক মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন মহারাজ। অন্ধকারের মধ্যে খালের ওপার থেকে চুপিসাড়ে খাল টপকে এসে অবিশ্বাস্য গতিতে নাবাল জমিটুকু পার করে সোজা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তিনি কানাইয়ের ওপর। অস্ফুটে একবার শুধু মা ডাক ছাড়তে পেরেছিল কানাই। ততক্ষণে কাঁধ আর পিঠে প্রকান্ড থাবার নখ বসে গেছে চামড়া মাংস ভেদ করে। আর ঘাড়ে পড়েছে কামড়। চার ইঞ্চি লম্বা দাঁত তখন ঘাড়ের মাংস ভেদ করে শ্বাসনালী ফুটো করে দিয়েছে কানাইয়ের। এই ঝাপটাঝাপটির আওয়াজ শুনে দলের বাকিরা ততক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো শুধু যে কানাইয়ের দেহটা ছটফট করতে করতে একবার ধনুকের মতো বেঁকে গিয়েই স্থির হয়ে গেল। প্রথমে হতচকিত হয়ে পড়লেও দা কুড়ুল বাঁশের লাঠি নিয়ে সে দল তখন ছুটে এসেছে এই অসম লড়াইয়ের মাঝে। বেগতিক দেখে কানাইয়ের নিষ্প্রাণ দেহটা ছেড়ে তখন পিছু হটছে দক্ষিণরায়। সেইভাবেই পিছু হটতে হটতে ভয়ানক গর্জনের সাথে খাল টপকে সে আবার ফিরে গেছে নদীর দিকে।

 

সেই রাতেই যখন কানাইয়ের দেহ নিয়ে আসা হলো মাধবের বাড়ির দাওয়ায় তখন ফুলারি আর কানাইয়ের বউ কেঁদে ভাসালেও চুপ হয়ে গিয়েছিল মাধব। মনে পড়ছিল নাতির মতো ঠিক এভাবেই একদিন ছেলের মৃতদেহটাও এনে রাখা হয়েছিল এখানেই। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠছিল বুক। মনের মধ্যে শুরু হয়েছিল তোলপাড়। তবে কি রায়মণির অভিশাপ ফলতে শুরু করলো এভাবেই? পরদিন সকালেই গ্রামের ছেলেরা যখন রাঙাবেলিয়ার হাসপাতালে নিয়ে কানাইয়ের দেহটা, তার কিছু পরেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো মাধব।

 

কারো কাছে হাত পাততে হয়নি। একটা পুরোনো রংচটা কৌটোর মধ্যে সামান্য কিছু টাকা রাখাই থাকতো। খুঁজেপেতে সে টাকার থেকেই দশ কুড়ি পঞ্চাশ মিলিয়ে তিনশো টাকা নিয়ে বেরিয়েছে মাধব। ঘরে এখন সবারই আলুথালু অবস্থা। তাই কাউকে কিছু না বলে আমানি দিয়ে আধপো মুড়িই চালান করেছে পেটে। যেখানে যাচ্ছে, সেখানে গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা কত হবে কে জানে। ঠিক করেই নিয়েছে যে ফিরবে আবার আগামীকাল সেই সন্ধ্যার মুখে।

 

পথ তো কম নয়। আগে যেতে হবে দ্বীপের মুড়োয়। সেখান থেকে নদী পেরিয়ে প্রথমে হেঁতালবাড়ি। তারপর ছোটমোল্লাখালি রোড ধরে আসতে হবে ছোটমোল্লাখালি বাজার। সেখান থেকে সারষা নদীকে ডানহাতে রেখেতারপর ছোটমোল্লাখালি রোড ধরে আসতে হবে ছোটমোল্লাখালি বাজার। সেখান থেকে সারষা নদীকে ডানহাতে রেখে আসতে হবে দুই নদী যেখানে হাত ধরাধরি করে মিশেছে সেইখানে। এইখানে চুনাখালির দিক দিয়ে এসেছে সারষা আর জয়গোপালপুরের দিক দিয়ে এসেছে দুর্গমণ্ডপ নদী। এইখানে আবার নদী পেরিয়ে মনিপুর হয়ে তবেই যেতে হবে ধুচনিখালি। ওখানেই মাটির নিচে শুয়ে আছে মাধবের গুরু তোরাব মন্ডল।

 

ঠিক বেঠিক যাই করুক। তোরাব গুরু বলে কথা। যে কাজে হাত দিতে যাচ্ছে মাধব, সে কাজের আগে গুরুকে পেন্নাম তো করতেই হবে। সে কারণেই এত হ্যাপা পুইয়ে আসা গুরুর কবরের কাছে। একবার ম্যাজিক গাড়িতে বাবা বাছা করে উঠেছে, তো আর একবার উঠেছে সবজি বোঝাই ম্যাটাডোরে। মাধবের বয়স দেখে কেউ আর না বলেনি ওকে। টাকাপয়সাও তাই খরচ হয়নি বিশেষ।

 

তোরাবের ঘরে বহু বছর পর আসলেও ঘরের সবাই চেনে মাধবকে। সন্ধ্যার একটু আগে যখন পৌঁছাল মাধব, তখন তোরাবের ছোট ছেলের নাতি আর নাতবৌ ভারী যত্ন করেই ঘরে বসালো ওকে। চা জল দেওয়ার পর যখন তারা জিজ্ঞাসা করলো যে রাতের খাবারে ঘরে পালা মুরগির মাংস আর ভাত করবে কিনা, তখন আঁতকে উঠলো মাধব। মাথা নেড়ে বললো...

-- না রে বেটি। মাংস, নয়। মাংস নয়। আর মুরগি তো এক্কেরে নয়। পারলি বরং ওই মুরগিটা আমায় দে। যে কাজে হাত দিতি যাতিছি তাতে তো মুরগি লাগবেই। আর গুরুবাড়ির মুরগি হলি পর সিডা তো সবথিক্যি ভ্যালা হবে রে বেটি।

 

রাতে শুধু দুটো রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাট পেটে দিয়ে উঠলো মাধব। তোরাবের নাতিকে বলে আগেই আনিয়ে রেখেছে চৌদ্দটা মোমবাতি। মাধব হিন্দু। কবরের সামনে বসে কিভাবে জিয়ারত করতে হয় তা জানে না মাধব। তবে এটা জানে আজ রাতে গুরুর আশীর্ব্বাদ তার চাইই চাই। মোমবাতিগুলো আনিয়েছে সেই কারণেই। আজ রাতে গুরুর কবরের সামনে বসে শরীরের প্রধান চৌদ্দটা নাড়ির জন্য এক এক করে জ্বালাবে চৌদ্দটা মোমবাতি। তার সাথে সাথেই গুরুর নাম স্মরণ করে ডাকবে মা বনবিবিকে। গুরুর আশীর্ব্বাদ আর মা বনবিবির কৃপা, দুটোরই যে এখন বড় প্রয়োজন মাধবের।

 

সেইমতোই কাজ শুরু করলো মাধব। প্রথমেই মুরগিটার পায়ে দড়ি বেঁধে রাখলো তোরাবের কবরের পাশে। তারপর গুরুর নাম নিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে সেটা বসালো কবরের ওপর। তারপর অনেক বছরের অনভ্যাস কাটিয়ে একমনে ডাকতে শুরু করলো মা বনবিবিকে...

দাড়ি মাঝিগণে ধোনা কহে ফজরেতে

কেদোখালি যাব ডিঙা ছাড় সেতাবিতে।

হুকুম পাইয়া দাড়ি মাঝি যত ছিল

কেদোখালি তরফেতে রওয়ানা হইলো।

সাত ডিঙা বাহিয়া চলিল লোক জনে

দেখিয়া দক্ষিণা দেও বলে মনে মনে।

ধোনা মৌলে আসিতেছে সহদ লইতে

বনে আমি যাই হাট মধু বসাইতে।

কেদোখালি বিচে দেও আসিয়া পৌঁছিল

যত মৌমাছি তরে হুকুম করিল।

লক্ষ লক্ষ মৌমাছি হুকুমে দেওয়ের

বসাইল হাট মধু ভিতরে বোনের।

গো মা। কিন্তু আমার মোহনডারে তুমি বাঁচাও মা। আমার বংশডারে তুমিই রক্ষে করো মা।"

 

****

 

বাড়ি ফিরে এসেছে মাধব। ধুচনিখালি থেকে সকালেই সামান্য কিছু খেয়ে আবার বাড়ির পথে রওয়ানা দিয়েছিল। পৌঁছেছে সন্ধ্যার কিছু আগে। আসার সময় হাতে করে নিয়ে এসেছে গুরুর ঘর থেকে পাওয়া সেই মুরগি। আর তোরাবের কবরের মাটি। আজ আর কিছু করা যাবে না। বরং কাল ভোরবেলাতে যেতে হবে গ্রামের রাস্তার ধারে থাকা আমলকী গাছের কাছে। সে গাছের পূর্বপাশের কাণ্ডে একেবারে সকালের রোদ যখন পড়বে, তখন নিচের দিক দিয়ে টেনে তুলতে হবে সে গাছের ওই পুবপাশের দিকের কাণ্ডের ছাল। এরপর ঘরে ফিরে এসে গুরুর কবরের মাটি আর এই আমলকী গাছের ছাল মিশিয়ে মন্ত্র পড়ে তৈরি করতে হবে মাদুলি। তারপর সে মাদুলির মুখ মোম দিয়ে এঁটে ধারণ করতে হবে গলায়। তবেই না গিয়ে দাঁড়াতে পারবে রায়মণির সামনে।

 

আজ ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্দশী। তৃতীয়া ছেড়ে চতুর্দশী লেগেছে বিকাল বেলাতেই। কানাই মরেছে দুদিন আগে। তাই এমনিতেও বাড়ির কেউ মাথায় গায়ে তেল সাবান মাখছে না। রান্নাও হয়নি, তাই শুকনো লঙ্কা খাওয়ার পাটও নেই আর চুলোর ছাই ফেলার ঝামেলাও নেই।

 

রাত একটু গড়ালে কানাইয়ের ঘরে গিয়ে প্রথমে মোহনের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলো মাধব। এই পুতিটাই এখন শেষ সম্বল এই বংশের। তারপর গুরু আর মা বনবিবিকে স্মরণ করে গলায় পরে নিলো মন্ত্রপূত মাদুলি। সবসময়েই লুঙ্গির মতো করে পরা খেটো ধুতিটাকে পরলো মালকোঁচা মেরে। এরপর দড়িতে বাঁধা মুরগিটা হাতে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো মাধব।

 

কানাইয়ের মরার পর থেকেই গোটা গ্রামটা গিয়েছে একেবারে থম মেরে। সবাই নিজের নিজের বাড়িতে দরজায় আগল দিয়ে ঘরের ভিতরেই কাঁপছে অজানা আশঙ্কায়। গ্রামের গরু ছাগল গুলোও যেন চুপ করে গেছে ঘটনার ঘনঘটায়।

নদীর চড়ায় এসে দাঁড়িয়ে প্রথমেই চারধারটা ঠাহর করতে চেষ্টা করলো মাধব। সময়টা যদিও শুক্লা চতুর্দশীর রাত, কিন্তু আকাশে মাঝে মাঝেই ছেঁড়া মেঘের কারণে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা নদীর পাড় যেন আলো আঁধারিতে খেলা করছে ক্রমাগত। মাধব জানে যে সে আসবে। তাকে আসতে হবেই।

 

প্রথমেই মুরগিটার পায়ের থেকে দড়ি খুলে মা বনবিবির নামে উৎসর্গ করে সেটাকে ছেড়ে দিল মাধব। তারপর বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করলো চালান মন্ত্র...

বিসমিল্লাহি রহমানের রহিম

মালেক আবদালী হাছেনা স্রোতা মোস্তাকিয়া

একদিন আমার আলী সাহেব জঙ্গলেতে যায়

পাইয়া দুধের বালক সাহেব কোলেতে তুলে লায়...

 

রাতের তৃতীয় প্রহর পেরিয়ে চতুর্থ প্রহর শুরু হয়ে গেছে। আর বেশ কিছু সময় পরেই সূর্যের নরম আলো ফুটে ভোর হবে। চতুর্দশীর গোণমুখ চলছে এখন নদীতে। ভাটার টান শুরু হয়েছে কিছু আগেই। মেঘ সরে গিয়ে চতুর্দশীর চাঁদ এখন আলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছে নদী আর পাড়। ঠিক এই সময়ই জলের থেকে একটু একটু করে বার হয়ে আসতে লাগলো প্রকান্ড শরীরটা।

 

ঝিলার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গাড়াল নদী সাঁতরে পার করে আবার গ্রামে হানা দিয়েছে জঙ্গলের রাজা। দুদিন আগেই শিকার হাতছাড়া হয়েছে তার। রাগে উন্মত্ত হয়ে ফুঁসছে সে। আজ কিছুতেই খালি হাতে ফিরবে না সে।

 

দুজনেই দেখলো দুজনকে। চার কুড়ি বয়সের ভার কে অগ্রাহ্য করে ন্যুব্জ দেহটাকে টানটান করে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালো মাধব।

 

শিকারের দিকে তাক করে লাফ মারার ঠিক আগের মুহূর্তে গুঁড়ি মেরে বসলো রায়মণি।

দুজনের মধ্যে ব্যবধান এখন মাত্র বিশ হাতের।

 

মাধব অস্ফুটে আবার বলতে শুরু করলো চালান মন্ত্র...

পালন করিয়ে নাম রাখিলেন হানিফ জিন্দাপীর

এই বনের বাঘা বাঘিনী, দানব দৈত্য, ভূত পেত্নী, না হস স্থির।

চলে যায়রে বাঘা বাঘিনী, ভূত পেত্নী, যায়রে অনেক দূর

আল্লা হানিফার বানেতে যাবি কুহালং-লংকাপুর।

 

প্রকান্ড হুঙ্কার দিয়ে উঠলো রায়মণি... ঘ্রাউউউউউম

 

শুরু হলো দ্বৈরথ।

 

 গল্পে বর্ণিত ঘটনাক্রমকিছু স্থান  চরিত্র সম্পূর্ণভাবেই লেখকের কল্পনাপ্রসূত। বাস্তবের সাথে অকস্মাৎ কোনো মিল পাওয়া গেলে তা একেবারেই কাকতলীয় হিসাবে গণ্য হবে।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)