মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

  মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অভিজিত পাল




অভিজিত :—জানলা দিয়ে কি দেখছেন ? বৃষ্টি ? বর্ষা ?

মলয়:—না, না, বর্ষাকাল উপভোগ করতে হয়  বৃষ্টিতে ভিজতে -ভিজতে নদীগুলোয় । দিনের বেশ, মতন বৃষ্ট ভিজ । শহরে বৃষ্টির শব্দ বেশ ভালগার আর, ধানখেতে বা জঙ্গলে বৃষ্টি তার নিজের শব্দকে নষ্ট হতে দেয় না, ভারজিন শব্দ শুনতে পাওয়া যায় ।

অভিজিত:—তাহলে ?

মলয়:—না, দেখছি সামনের ওই গাছটা একবছরেই শুকিয়ে মরে গেল ।

অভিজিত :—তার জন্য কষ্ট ?

মলয় :—কষ্ট ? নাহ । বৃষ্টিও তো দিনকতক হল পড়ছে না । বর্ষাকাল বলে গাছটার শব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । ছাল-চামড়া উঠে গেছে । গাছটা আমার জন্যেই মরে গেল ।

অভিজিত:—আপনার জন্যে ? বিষ দিয়েছিলেন নাকি ? গাছ মারার তো মাফিয়া আছে । কর্পোরেশানের আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকেদের টাকা খাওয়ায়, তা সে তো কোনো হোর্ডিঙের বা ব্যানারের বিজ্ঞাপনকে যদি আড়াল করে, তাহলে ; কিংবা কোনো বড়ো দোকানের শোরুমের সামনে থাকলে। এই গাছ তো আপনাদের আবাসনের চৌহদ্দিতে রয়েছে, কোনো বিজ্ঞাপনের ফলাও করা নিয়নসাইনও নেই , আপনাদের বিলডিঙের তলায় মোটরগাড়ির বা মহিলাদের পোশাকের শোকেসও নেই । 

মলয়:—এই গাছটা কোনো জংলি গাছ, নাম জানি না ; গোলাপি রঙের ফুল হতো বসন্তকালে, থোকা-থোকা, দেখতে সুন্দর, কিন্তু সেই ফুলগুলো থেকে প্রচুর পরাগ উড়তো একটু হাওয়া দিলেই, আর আমার হাঁপানি, সব জানলা-দরোজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও, বেড়ে যেতো, দুবেলা ফোরমোস্ট ফোর হানড্রেড ইনহেল করতে হতো । বছর পঞ্চাশ আগে এটা জঙ্গল ছিল, শহর এগিয়ে এসে দখল করে ফেলেছে ।

অভিজিত:—তাই গাছটার মৃত্যু চাইছিলেন ?

মলয়—আমি চাইনি তো । আমার সঙ্গে শত্রুতা করলেই, কেবল মানুষ নয়, গাছপালা আর প্রাণীরাও মারা যায় । অথচ আমি কারোর সঙ্গে কখনও শত্রুতা করিনি । আমি চাইনি গাছটা মরে যাক । শত্রু বলা বোধহয় উচিত হল না, ইনটিমেট এনিমিজ বললে ভালো হয় ।

অভিজিত:—তাহলে ছয় তলায় দাঁড়িয়ে জানলা দিয়ে কি দেখছিলেন, ওই মরা গাছ ? ওটা তো বছরখানেক হল মরে গেছে বলছেন ।

মলয়:—গাছটা মারা যাবার দরুণ পায়রাদের সঙ্গমের সুবিধা হয়ে গেছে ।

অভিজিত:—পায়রাদের সঙ্গম দেখছিলেন ?

মলয়:—ঠিক সঙ্গম নয়, দেখছিলুম যে পুরুষ পায়রা প্রতিবার সঙ্গম করছে আর ডালের এধার থেকে ওধার পর্যন্ত নেচে আসছে, গর্বের সঙ্গে ঘাড় নাড়াচ্ছে । মাদি পায়রাটাও একটু খেলিয়ে নিচ্ছে । মানুষ অমন করে না, তার কারণ পুরুষ মানুষের অমন পায়রাক্ষমতা নেই, একবারেই কেলিয়ে পড়ে, তারপর আবার দম নিয়ে পায়রাবাজি করতে হয় । মানুষকে কেন এমন দুর্বল করে দেয়া হয়েছে, তা এখনকার গণধর্ষণ, সোলোধর্ষণ, গ্রুপধর্ষণ, মেঠোধর্ষণ, মাচাধর্ষণ  ইত্যাদি দুঃসংবাদ থেকে আঁচ করতে পারি । মানুষকে সিংহের ক্ষমতা দিলে তারা ওই কাজকেই শিল্প বলে চালাতো । শিল্প নামের ভাঁওতাটাকে মানুষ বড়ো ভালোবাসে । 

অভিজিত:—সিংহের কথা বলছিলেন যে ?

মলয়:—হ্যাঁ, সিংহেরা পনেরো মিনিট অন্তর করে । ইম্যাজিন, পনেরো মিনিট অন্তর !

অভিজিত:—আপনার আপশোষ হচ্ছে যে অমন সিংহত্ব আপনি পাননি । আপনি তো সিংহরাশি !

মলয়:—যখন যোয়ান ছিলুম তখন হতো বটে ; এখন তো বুড়িয়ে গেছি । এমনিতেই হাঁপানি হয়, পনেরো মিনিট অন্তরের ব্যাপার হলে ফুসফুস গলার কাছে উঠে আসতো ; অবশ্য ছোটোবেলায় বাবা যদি সুন্নৎ করিয়ে দিতেন, তাহলে মনে হয় এলেমটা সময় বাড়িয়ে দিতে পারতো । যাকগে, পায়রাদের কথায় আসুন । পায়রা হল এই শহরের প্রাণী, যে পাড়াতেই যান, ঝাঁক-ঝাঁক পায়রা দেখতে পাবেন । অন্য ভারতীয়  শহরে এমন গোলা পায়রার পপুলেশান পাবেন না । সব শহরেরই নিজস্ব প্রাণী থাকে, সেখানকার মানুষেরা সেই প্রাণিদের চরিত্র পায়, প্রাণী না বলে রাজ্যেশ্বর-রাজ্যেশ্বরীও বলতে পারেন । এখানকার কবি আর ছবি আঁকিয়েদের দেখুন, পায়রা । ঝাঁকের মধ্যে জোড়ায়-জোড়ায় ; পায়রার তো সিংহদের মতন আলফা মেল নেই । দুটো পুংপায়রা গুঁতোগুঁতি করে ডিসাইড করে মাদি পায়রাটাকে কে পাবে; মাদি পায়রাটা আবার পরের গুঁতোগুঁতিতে জেতা পুংপায়রার সোহাগ খেতে ঢলে পড়ে । কবিতার চরিত্রও পায়রাদের মতন, দেখে বুঝতে পারবেন না কোন পায়রাটাকে সকালে সঙ্গম করতে দেখেছিলেন ।

অভিজিত:—পায়রা ছাড়াও ইঁদুর তো প্রচুর এই শহরে ? বেরালের সঙ্গে তারা যুঝে যায়, এমন তাদের সাইজ ।

মলয়:—হ্যাঁ, এই ইঁদুরগুলো পায়রাদের আক্রমণ করে, খায় । কর্পোরেশানের ইঁদুর মারার কর্মচারী আছে । এই বছর তারা নাকি প্রায় তিন লাখ ইঁদুর মেরেছে ; বর্ষায় ইঁদুরগুলোর জন্যে লেপ্টোস্পিরোসিসে প্রতিবছর শতখানেক লোক মারা যায় । ইঁদুরকেও প্রতিনিধিত্বকারী দেবী-দেবতার সিংহাসন দেয়া যায় পায়রাদের পাশাপাশি । জৈন আর গুজরাতি দোকানদাররা ইঁদুরগুলোকে মারে না ; তার ওপর প্রতিদিন আট হাজার টন জঞ্জাল খেয়ে ইঁদুরগুলোর সাইজ বেড়েই চলেছে, এই শহরের বৈভবশালীদের মতন ।

অভিজিত:—পায়রাগুলো ঘরের ভেতরে যাতে না ঢুকতে পারে, ঘরের ভেতরে পিজনসেক্স করতে না পারে, তাই জানলায় গ্রিলমেশ লাগিয়েছেন ? পায়রাদের কারণে অ্যালার্জি হচ্ছিল বলে ? কিন্তু পায়রা তো শান্তির প্রতীক। 

মলয়:—গ্রিলমেশ বিল্ডারের বসানো । শান্তির প্রতীক ছিল হয়তো এককালে ; এখন স্হানীয় লোকেরা অসৎ কাজকে বলে ‘ফাকতা ওড়ানো’ বা পায়রা ওড়ানো ; সম্ভবত মাগিবাজি করা থেকে এসেছে উক্তিটা । তবে পায়রা ঘরে ঢুকে পড়লে হয়তো নিজেই বসাতুম । তা ওদের সঙ্গমে বাগড়া দিতে নয় । ওরা তো দুই ইঞ্চ জায়গা পেলেও চট করে সেক্স সেরে নিতে পারে । হাঁপানিতে কাহিল হয়ে গেছি ।

অভিজিত:—আপনি কি নিজেকে কখনও প্রশ্ন করে দেখেছেন যে আপনার শরীরের যাবতীয় রোগের, ইনক্লুডিং হাঁপানি, আসলে যৌবনে বেহিসাবি জীবনযাপনের কারণে ঘটেছে । যে সমস্ত মাদক নিতেন তা তো শ্বাসকে প্রভাবিত করে দেহের ভেতরে পৌঁছে প্রতিক্রিয়া ঘটানোর জন্য । নয়কি ? তখনকার বেলেল্লাপনার মাশুল দিচ্ছেন বলে মনে হয় না ?

মলয়:—বলা কঠিন । হাঁপানির ডাক্তারকে বলেছিলুম আমার মাদকপ্রিয় যৌবনের কথা । উনি বললেন,  ধোঁয়ার কারণে আমার ফুসফুস আর হার্ট প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে । আমার হাঁপানির কারণ, ওনার মতে, সুগন্ধ । আমার শরীর সুগন্ধ সহ্য করতে পারে না । উনি ফুল শুঁকতে, যে ফুলেরা পরাগ ছড়ায় তাদের কাছে যেতে, সুগন্ধি সাবান আর পাউডার মাখতে, দেহে আর পোশাকে পারফিউম লাগাতে, রুম ডেওডোরেন্ট ব্যবহার করতে,  বারণ করেছেন । এমনকি রান্নার সময়ে ফোড়নের গন্ধ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন । ফুসফুস ভালোই আছে, অকসিজেন ইনটেক চেক করিয়ে দেখেছি । দ্বিতীয়ত আমার গা থেকে হরমোনের তিতকুটে গন্ধ বেরোয়না বলে আমায় পারফিউম ব্যবহার করতে হয় না । লিফটে অনেকসময়ে যুবতীদের গা থেকে একই সঙ্গে তিতকুটে হরমোনের দুর্গন্ধ, আর তার ওপর চাপানো বডি ডিওডেরেন্টের সুগন্ধ আমায় হাঁচিয়ে-হাঁচিয়ে কাহিল করে দেয় বেশ ; তরুণী দেখলে এড়িয়ে গিয়ে বলি, আপনি যান, আমি পরে যাবো । এই জন্যে কাঠমাণ্ডুতে হিপিনীদের আমার ভালো লাগতো ; ওরা দিনের পর দিন স্নান করতো না, গা থেকে স্বাভাবিক নারীগন্ধ পেতুম ।

অভিজিত:—একটু আগে বলছিলেন, আপনার সঙ্গে যারা ইনটিমেট শত্রুতা করে তারা মরে যায় ? আপনি কি তার জন্য অনুতপ্ত বোধ করেন ?

মলয়:—নাহ, করি না । কারণ যারা মারা যায় তারা নিজের দোষেই মরে, আমার উপস্হিতি তাদের জীবনে আপনি  পাবেন না । যেমন এই গাছটা । আমি কিছুই করিনি, অথচ মরে গেল । গাছটাকে সারা বছর পছন্দ করতুম ওর সবুজের কারণে, কতোরকম সবুজ ছিল গাছটার স্টকে, প্রচণ্ড বৃষ্টি হলে বাফারের কাজ করতো, সামুদ্রিক ঝড়গুলোকে সামলাতো । কিন্তু বাধ সাধল ওর অত্যাকর্ষক ফুল আর তার সুগন্ধজনিত পরাগ ।

অভিজিত:—আরও উদাহরণ আছে ?

মলয়:—হ্যাঁ, ইনটিমেট বন্ধুবান্ধব যারা শত্রুতা করেছিল, এমনকি অগ্রজ সাহিত্যিকরা, তারাও একে-একে মারা গেল । অনেক সময়ে পরিচিত  ইনটিমেট কেউ মারা গেলে, অমি দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই, ভাবি যে, ইনি কি আমার সঙ্গে শত্রুতা করেছিলেন, যে মারা গেলেন ? ব্যাপারটা অদ্ভুত, কেননা আমি তো শত্রুতা করিনি, করছি না, কারোর সঙ্গে, কেনই বা করব । তারা করছে, তারা মারা পড়ছে । আমি প্রথম যে চাকরিটার ইনটারভিউ দিতে যাচ্ছিলুম, তা ছিল লেকচারারের । যাবার সময় একটা কাক গাছ থেকে হেগে দিয়েছিল আমার শার্টে ; উড়ে যেতে গিয়ে কাকটা ইলেকট্রিকের তারে ঠেকে গিয়ে ছিটকে পড়ল রাস্তার ওপর , অথচ কাকেরা সাধারণত ইলেকট্রিকের তার এড়িয়ে ওড়ে। তারপর থেকে আমি লেকচারারের আর স্কুল শিক্ষকের জন্য আর দরখাস্ত দিইনি ।

অভিজিত:—আপনার মস্তিষ্কে এই দুর্ভাবনা এলো কোথ্থেকে ?

মলয়:—আমি একবার গোরখপুরে ট্যুরে গিয়েছিলুম । সহযোগী আর স্হানীয় হোস্ট নিয়ে গেলেন গোরখনাথ মন্দিরে, ওই যেখানে পূণ্যার্থীরা ত্রিশূল দেয় পুজোয় । সেখানের চত্তরে একজন নোংরা জটাধারী সাধু হঠাৎ আমায় জড়িয়ে ধরে, মুখে দাড়ি ঘষে বলেছিল, “তোর সঙ্গে যে শত্রুতা করবে সে তোর আগে মরে যাবে।”

অভিজিত:—আপনি এই সব কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন ?

মলয়:—করি না, তবে মৃত্যুর ব্যাপারে দেখছি, এই ব্যাপারটা হ্যারি পটারীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

অভিজিত:—মৃত্যু নিয়ে কবিতা লেখেননি কেন এখনও ?

মলয়:—যাঁরা জানেন যে তাঁরা কালক্রমে অমর হবেন, তাঁরা সাধারণত লেখেন । খ্রিস্টধর্মীদের মধ্যে এপিটাফ লেখার চল আছে । সেই দেখাদেখি হয়তো আমাদের কবিরা মৃত্যুবোধ এনেছেন । আমি তো জানি আমি নশ্বর, তাই লিখিনি । তবে শবযাত্রা নিয়ে লিখেছি । একটা কবিতা লেখার ইচ্ছে আছে, সেটাও আমার শব নিয়ে । আমার অনুমান যে আমি এই ফ্ল্যাটটায় মরে পড়ে থাকবো, লোকে পচা গন্ধ পেয়ে পুলিশে খবর দেবে, পুলিশ এসে দরোজা ভেঙে দেখতে পাবে যে শবেতে ম্যাগটস ধরে গেছে আর তারা আমার পচা মাংস খেয়ে কিলবিল করছে । মানে, আমার মৃতদেহ থেকেও প্রাণের উদ্ভব সম্ভব । 

অভিজিত:—তা লিখে ফেললেন না কেন ?

মলয়:—ম্যাগটের সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাইনি এখনও ।

অভিজিত:—সব শহরের নিজস্ব প্রাণী থাকে বলছিলেন, আর সেই প্রাণীরা সেই শহরের চরিত্র নির্ণয় করে, সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির ঝোঁক গড়ে তোলে, কবি-শিল্পীরা তাদের চরিত্র পায়, মুম্বাইয়ের অভিনেতা-শিল্পী-কবিরা যেমন ইঁদুর আর পায়রার চরিত্র পেয়েছে, বলছিলেন । আপনার শৈশবের ইমলিতলায় কোন প্রাণী ছিল ?

মলয়:—বিহারের পাটনা শহরের কথা বলছেন ? ইমলিতলার বাড়িতে বাঁদর আসতো, লালমুখো-লালপোঁদ বাঁদর, যাদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মানুষ, ওষুধ আর রোগের কারণ-নিদান আবিষ্কার করে । বাঁদরদের ব্যবহার করা হয়, মেরে ফেলা হয়, রোগে ভোগানো হয়, যাতে মানুষেরা ভালোভাবে বাঁচতে পারে । তারা অনেকটা কবিতার মতন রক্ত ঝরায়, কান্নাকাটি করে, ব্যথার সময়ে নিরাময়ের অভয় দেয়, দাঙ্গা আর যুদ্ধের সময়ে কাজে লাগে, তাদের পেট চিরে স্লোগান বের করা যায় ; তারা নিজেদের সমাজে সামাজিক প্রাণী, একে আরেকজনকে চুমু খায়, উকুন বেছে দেয় ; তারা একে আরেকজনকে বড়ো একটা খুন করে না যদি না তা দুজন আলফা মেলের জিজান লড়াই হয়, একপাল মাদি বাঁদর দখলের জন্যে । ওখানকার রাজনীতিকদের দেখুন, মেলাতে পারবেন । এক জাতের বাঁদরের সঙ্গে আরেক জাতের বাঁদরের তফাত বজায় রাখার চেষ্টা করে যায় তার আলফা গোষ্ঠীপতি ।

অভিজিত:—কিন্তু আপনি যা বলছেন তা তো অন্য রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোয্য ।

মলয়:—ওই যে বললুম, বাঁদর নানা জাতের হয় । ভারতে নাকি সাত রকমের বাঁদর আর ছয় রকমের হনুমান হয় । বাঁদরগুলো আপনি জানেন নিশ্চয়ই : রেসাস ম্যাকাক, বনেট ম্যাকাক, আসাম ম্যাকাক, অরুণাচল ম্যাকাক, বেঁটেলেজ ম্যাকাক, সিংহলেজ ম্যাকাক আর শুয়োরলেজ ম্যাকাক । আপনি খুঁজলেই এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ভারতীয় রাজ্যগুলোর মানুষে পাবেন । এদের নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাধারা আছে । আপনি একে ঠাট্টা-ইয়ার্কি বলে মনে করবেন না ।

অভিজিত:—যারা আলফা হতে পারে না সেই সব বাঁদরেরা কি স্বমেহন করে ?

মলয়:—হ্যাঁ, এছাড়া আর উপায় কি বলুন ? স্বমেহন ছাড়া পুংবাঁদেরেরা পরস্পরকে ধর্ষণ করে, যাতে পরবর্তীকালে আলফা হয়ে উঠলে যন্তরটা অকেজো না হয়ে পড়ে ।

অভিজিত:—বাঁদরদের কি নাইটফল হয় ?

মলয়:—হয় না বলেই তো জানি । কিন্তু হওয়া তো উচিত । পুরুষমানুষের নাইটফল হয় শুক্রকীটগুলো মরে গেলে তাদের জেটআউট করার জন্য, স্টকে নতুন শুক্রকীট আনার জন্য । মানুষের যখন হয় তখন প্রাইমেটদেরও হওয়া উচিত ।

অভিজিত:—নাইটফল নিয়ে কবিতা লেখেননি ?

মলয়:—না, লেখা হয়নি । প্রেমিকার জন্য প্রেমের কবিতা লেখার দিকে খেয়াল যেতো । তবে আমার এক পাঠিকা, যিনি ‘মায়াজম’ নামে একটি ওয়েব পত্রিকা চালান, তিনি নাইটফল নিয়ে একটা অসাধারণ কবিতা লিখেছেন । তাঁর নাম সোনালী মিত্র । কবিতাটার নাম ‘নাইটফল অথবা সমুদ্রযাত্রা’ । পড়ে দেখুন :

 

তখন রাতগুলো পরী-ভালোবাসায় ভরপুর

হরিদার চায়ের দোকানে সন্ধ্যায় ফেলে আসা

মিঠু বউদি আর ঝিলিক সেনের দুই চাঁদ

রাতে নাড়িয়ে দিলে গো । ঘুম, ঘুম  আসে না

অস্হির, বুকের ভিতরের হ্যাংলা কুকুরটা বনেদি নয়

ঠিক, ঠিক যেন ভাদ্রের মতো অবস্হান

আর কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল মিঠু না ঝিলিক সেনের বুকে

বুঝলাম না……

আর নাভি খাচ্ছে, আর কোমর ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে দাঁতে

দরদর ঘাম ভিজে উঠছে গা

থামবে না, এ-খাওয়া থামবে না

সমস্ত বেডকভার ড্রেনড্রাইট চটচটে, আহা মায়াবী আঠা

ক্রমশ কুকুরের গা-মোচড়ানো শিথিল হয়ে ওঠে

ঘুম, ঘুম, ঘুম

সকালে ভুলে যায় আস্ত একটা কুকুর নিয়ে আমার রাতের সংসার

 

কেননা তখন আমাদের রাত্রির বুকে অবিবাহিতকলা

কেননা তখন পায়জামার অন্ধকারে হাজার ওয়াট

তখন আমার নিজস্ব রাতের নাম ছিল

নাইটফল মেমারি

 

অভিজিত:—তরুণীরা এই ধরণের কবিতা লিখতে পারছেন । আপনার কি মনে হয় যে আপনারা, মানে হাংরি আন্দোলনকারীরা,  ততোটা বোল্ড হতে পারেননি, যতোটা এখনকার যুবক-যুবতীরা পারছেন ।

মলয়: —প্রতিদিনের জীবনযাপন আমার ভিন্ন ছিল । আমি তো আদপে একজন কালচারাল বাস্টার্ড । এখনকার তরুণ-তরুণীরা কবিতা লেখার সঙ্গে আমার মতন খোট্টাই জীবনযাপনকে মেলাতে চান না কিংবা হয়তো পারেন না । ইমলিতলায় বসবাসের ফলে আমার চরিত্রে বহু অবাঙালি বৈশিষ্ট্য বাসা বেঁধে ছিল, যাকে কেউ বলত বোহেমিয়ান, কেউ বলত ভ্যাগর‌্যান্ট ইত্যাদি । আমার বাল্যস্মৃতি “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” পড়লে বুঝতে পারবেন । আমি বাড়ি থেকে কয়েকবার পালিয়ে গিয়েছিলুম স্কুলে পড়ার সময় ।

অভিজিত:—আপনার বইগুলোয় এই “ছোটোলোক” শব্দটা জুড়ে দেন কেন ?

মলয়:—ইমলিতলা পাড়াটাকে স্হানীয় বাঙালিরা বলতেন ছোটোলোকদের পাড়া ; তাঁরা সাধারণত আমাদের বাড়িতে আসতেন না, এমনকি আমার স্কুলের বন্ধুরাও আসতো না, বলতো, শালা, তুই ওই ছোটোলোকদের পাড়ায় ক্রিমিনালদের সঙ্গে থাকিস ? পরে বাবা দরিয়াপুরে বাড়ি করলে আমাদের গা থেকে ছোটোলোক খেতাবটা খসে । কিন্তু মগজের ভেতরের ছোটোলোকটা তার ছোটোলোকমি নিয়ে রয়ে গেছে ।

অভিজিত:—আমার ধারণা ছিল নিজের যৌবলাম্পট্যকে তুলে ধরার জন্য ছোটোলোক শব্দটার প্রয়োগ ।

মলয়:—যৌবলাম্পট্য বলতে যা বোঝাতে চাইছেন, তেমনভাবে যৌবন কাটাইনি আমি । আমি লম্পট ছিলুম না কখনও, যদিও আমার এক প্রেমিকা আমাকে লেচার বলে ঘোষণা করেছিলেন । অথচ সে নিজেই আমাকে লাথি মেরে চলে গিয়েছিল ।

অভিজিত:—তারপর ?

মলয়:—তারপরও আমি কখনও ফার্স্ট মুভ করিনি । প্রেমিকারা করেছিল ।

অভিজিত:—প্রেমে টেকেননি তার মানে ?

মলয়:—অনেক কারণে ছাড়াছাড়ি হয়েছে । আমিও ছেড়েছি, ঠিকই, একজনকে তার সুগন্ধ বিলাসীতার জন্য, আমার হাঁপানি রোগের দিকে তার খেয়াল ছিল না, সে নিজেকে এতো ভালোবাসতো যে নিজেতেই আটক থেকে গেল । বিদেশিনীও ডাক দিয়েছিলেন, আমি নিজে থেকে যাইনি । একজন অবাঙালি তরুণী হাত আঁকড়ে বলেছিল, “চলুন পালাই” । আমি পালাইনি বলে তিনি আত্মহত্যা করেন । যৌবলাম্পট্য থাকলে তাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে, ব্যবহার করে, ফেলে চলে আসা যেতো । আমি সবকিছু ছেড়ে দিতে পেরেছি, যখন ইচ্ছা হয়েছে, তখন । এমনকি, কবিতা লেখাও দেড় দশক ছেড়ে দিয়েছিলুম ।

অভিজিত:—সোনাগাছি ?

মলয়:—বন্ধুদের সঙ্গে গেছি, কিন্তু তা মূলত এলাকাটা সম্পর্কে অভিজ্ঞতার জন্যে । আমি কখনও কোনো যৌনকর্মীর সঙ্গে শুইনি । যৌনরোগ সম্পর্কে আমার প্রচণ্ড ভীতি আছে । আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে আমি লিখেছি ব্যাপারটা । বাসুদেব দাশগুপ্তকে নিয়ে লিখতে বলেছিল ‘বাঘের বাচ্চা’ পত্রিকা, তাতেও একটা ঘটনা লিখেছি । ডেভিড নামে একজন বিদেশী এসেছিল ষাটের দশকে ; সে বললে বাঙালি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে চায় ; কয়েক দিনের মধ্যে তো প্রেমিকা পাওয়া সম্ভব নয়, তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । 

অভিজিত:—এই আলোচনাকে বিরতি দেয়া যাক । এবার বলুন, পশ্চিমবঙ্গের প্রাণীদেবতা আইডেনটিফাই করতে পেরেছেন ।

মলয়:—ওটা তো সেল্ফডিক্লেয়ার্ড প্রাণীদেবতা ।

অভিজিত:—কোন প্রাণী ?

মলয়: —কেন ? বিড়াল, ষষ্ঠীর বাহন ।

অভিজিত: —একটু বুঝিয়ে বলুন প্লিজ ।

মলয়:—টি এস এলিয়ট বলেছেন বিড়ালেরা স্বভাবে খুঁতখুঁতে, ব্যস্ততার ভানকারী, আর দলবদলু । রয়াল ভেটেরিনারি কলেজের অধ্যাপক ডক্টর অ্যালান উইলসন পঞ্চাশটা বিড়ালকে জিপিএস আর কলার ক্যাম বেঁধে যে তথ্য যোগাড় করেছেন তা থেকে জানা যায় যে বিড়ালেরা অত্যন্ত চতুর আর বিশ্বাসঘাতক । যে পুষেছে তার কোলে বসে যেমন আদর খেতে-খেতে এপিগ্লোটিস-ল্যারিংস ব্যবহার করে আরামের গরগরানি ওগারায়, তেমনই ওগরাবে অন্য কেউ কোলে তুলে নিলে ; অন্যের আদর আর খাবার পেয়ে ততোটাই খুশি হয়, যতোটা মালিকের । মালিক যদি টেবিলের ওপরে মাছ আর দুধ রেখে নিজের পোষা বিড়ালকে খেতে বারণ করে বাইরে বেরোয়, তবুও খেয়ে নেবে । আজ্ঞাবাহক পোষা কুকুরের বিপরীত চরিত্র ।

অভিজিত:—এগুলো বাঙালির চরিত্রে পাওয়া যায় বলছেন ?

মলয়:—দেখুন না, শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে গেল কেন ? ডিসলয়ালটির কারণে । চটকলগুলো লাটে তুলে দিলে বিড়াল-শ্রমিকনেতারা । নতুন দল সিংহাসনে বসতেই লুমপেনরা লাল থেকে সবুজে চলে গেল কেন ? শুধু লুমপেনরা নয়, কবি-লেখক-নাট্যকার-অভিনেতারাও । স্লোগানের গরগরানিতে কোনো পরিবর্তন নেই । গরিবের রাখা মাছ-দুধ খেতে কোনো আপত্তি নেই বিড়ালদের, পনজি স্কিমগুলোর কর্তাদের কাজকারবারের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন । পশ্চিমবঙ্গের সমাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে লুমপেনদের পিরামিড ।

অভিজিত:—কিন্তু কুকুরেরা কি অন্যের দেয়ালে গিয়ে মোতে না ? মুতে-মুতে এলাকা চিহ্ণিত করে, রাজনৈতিক দলগুলোর মতন । দেয়ালে স্লোগান লেখার জন্য আগাম হুঁশিয়ারি বলতে পারেন একে ।

মলয়:—করে কিন্তু তারা নিজের মালিকের প্রতি লয়াল থাকে । বিড়ালের মতন দলবদলু নয় ।

অভিজিত:—আপনি তো পশ্চিমবঙ্গের, আপনার মধ্যেও তাহলে বিড়ালের বৈশিষ্ট্য আছে ?

মলয়:—একটু আগেই বলেছি যে আমি হাইব্রিড, বর্ণসংকর, কালচারাল বাস্টার্ড । আমার মধ্যে সবরকম প্রাণীর বৈশিষ্ট্য পাবেন । বাঘ সিংহ হাতি গণ্ডার জিরাফ জেব্রা জাগুয়ার চিতা হায়েনা অক্টোপাস অ্যানাকোণ্ডা প্যাঁচা উটপাখি চিল শকুন, সমস্ত প্রাণীর ।

অভিজিত:—হাতি ? হাতির মতন লিঙ্গ পেয়েছেন তাহলে । মাটিতে ঠেকেছে কি কখনও ?

মলয়:—তাহলে একটা ঘটনা বলি আপনাকে । হাংরি আন্দোলনের সময়ে একজন বিদেশি এসেছিলেন, আমাকে আগেই জানিয়েছিলেন । আমি তা সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষকে জানিয়ে ওদের বললুম যে চলে এসো হোটেলটায় । টাইম ম্যাগাজিনে আমাদের সংবাদ প্রকাশিত হবার পর বিদেশি কবিলেখকরা প্রায়ই আসতেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে । সেসময়ে তো স্নানের অসুবিধা ছিল আমার, কেননা কলকাতায় মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না । কখনও সুবিমল বসাকের জ্যাঠামশায়ের স্যাকরার দোকানে থাকতুম, কখনও হারাধন ধাড়ার হাওড়ার বস্তিবাড়িতে, আবার কখনও আমাদের উত্তরপাড়ার আদিবাড়ির খণ্ডহরে । হোটেলটায় বাথরুমটা বেশ বড়ো ছিল । আমি পোশাক ছেড়ে উলঙ্গ ঢুকে পড়লুম ; আমার পেছন-পেছন, সেই বিদেশি ছাড়া, সবাই পোশাক ফেলে উলঙ্গ ঢুকে এলো । ভালো সাবান শ্যাম্পু ছিল, একে আরেকজনকে মাখিয়ে হুল্লোড় করে স্নান করা হলো । সবাই স্বীকার করল যে আমার লিঙ্গই মাপে সবার চেয়ে বড়ো । সুভাষ ঘোষের লিঙ্গের দিকে তাকিয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত বলেছিল, “যাক সুভাষের লিঙ্গ আমার চেয়ে ছোটো”, তার জবাবে সুভাষ বলেছিল, “আমি এখনও ভার্জিন, বুঝলে, এখনও ফুল খোলেনি, একবার খুলে যাক, তারপর সবাইকে দেখিয়ে দেবো”।

অভিজিত:—তাহলে তো স্বীকার করতে হয় যে কবিতা, কল্লোল, কৃত্তিবাস, ধ্রুপদি, শতভিষার কবিদের থেকে আপনারা একেবারেই আলাদা । ওই দশকগুলোর কবিরা অমন চিন্তা করলেও আঁৎকে অজ্ঞান হয়ে যেতেন । সরকার যে আপনাদের আলাদা করে চিহ্ণিত করেছিল, তা অন্তত চিহ্ণিত করার ব্যাপারে ভুল করেনি ।

মলয়:—আরেকবার, সুবো আচার্যের বাড়ি গিয়েছিলুম, বিষ্ণুপুরে, আমি, ত্রিদিব মিত্র আর সুবিমল বসাক । আমরা হাঁটতে-হাঁটতে বেরিয়ে পড়লুম, ধানখেতের মধ্যে দিয়ে, একটা নদী এলো, নাম ভুলে গেছি, কোমর পর্যন্ত জল, প্যাণ্ট-শার্ট-গেঞ্জি খুলে উলঙ্গ পার হলুম নদী, পেরিয়ে একটা গাছতলায় বসে পাতা ফোঁকা হলো । তখনও ওরা স্বীকার করেছিল যে আমার সাইজ বড়ো ।

অভিজিত :—ভাগ্যিস নিজেদের নিয়ে ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ টাইপের উপন্যাস লেখেননি । অভিনেতাদের উলঙ্গ হয়ে অভিনয় করতে হতো । 

মলয়:—আমার মনে হয়, আপনি পরের প্রজন্মগুলোতেও আমাদের মতন চরিত্র পাবেন না । স্বমেহন-মুখমেহন প্রসঙ্গ তাঁদের লেখায় আসে বটে, কিন্তু নিজেরা করেছেন কিনা জানতে দেন না । জোট বেঁধে উলঙ্গ হুটোপাটিও করেননি বা করেন না বলেই মনে হয় ।

অভিজিত:—আপনি ম্যাস্টারবেট করেছেন ?

মলয়:—অবশ্যই করেছি । নিজেকে ভালোবাসবার কায়দাটা বাৎসায়ন শিখিয়ে দিয়ে গেছেন । খ্রিস্টধর্মাবলম্বী আর ইসলামধর্মাবলম্বীরা আসার পর স্বমেহন “খারাপ কাজ”-এর তকমা পেয়ে গেল । আমরা বলতুম “হাত-মারা” । এখন তো হাত-মারার সুবিধের জন্য বাজারে গোপনে সিনথেটিক নারী-অঙ্গ বিক্রি হয় ; পকেটে নিয়ে ঘোরা যায় । মেয়েদের জন্য ডিলডো আর ভাইব্রেটর বিক্রি হয় । যদিও আইনি পথে ওগুলোর আমদানি নিষিদ্ধ । জেমস জয়েসের সময়ে বাজারে এলে ‘ইউলিসিস’-এ উনি হাত-মারার দৃশ্যটায় প্রয়োগ করতেন হয়তো ।

অভিজিত:—শুরুর দিকের কথায় আসি । সেসময়ে আপনার যেমন বিরোধীতা হয়েছিল তেমন কি এখনও হয় ?

মলয়:—হয় বৈকি । তবে সারেপটিশাসলি । যাঁরা বিরোধীতা করেন তাঁরা দেখছেন যে বিবিসি থেকে, ইতালি থেকে, জার্মানি থেকে, আমেরিকা থেকে সাংবাদিক আর গবেষকরা আমাদের খোঁজে আমার কাছে আসছেন, অন্য গোষ্ঠীদের কাছে যাচ্ছেন না, তাই বিরোধীতাটা সাবডিউড ? অনেকে আবার তাঁদের মনগড়া ইমেজের সঙ্গে আমাকে মেলাতে না পেরে বিরোধীতা করেন ; তাঁরা ফেসবুকে নিজেদের মগজ থেকে গোবর বের করে আমার দেয়ালে সুযোগ পেলেই ঘুঁটে দিয়ে যান ।

অভিজিত:—যেমন ?

মলয়:—কয়েক মাস আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় শৈলেন সরকার নামে এক ছোকরালোচক প্রতিভাস থেকে প্রকাশিত আর প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “হাংরি সাহিত্য আন্দোলন, তত্ব, তথ্য, ইতিহাস” বইটা রিভিউ করার সময়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে শিরোনাম দিলেন, “তিনিও কি সুবিধাবাদের প্রশ্রয় নেননি” । শৈলেন সরকারের বক্তব্য ছিল যে, “তিনি জানতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর রচিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার’ কবিতাটিকে পছন্দ করেননি এবং সব জেনেও কেন মলয়বাবু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মিথ্যে করে তাঁর খারাপ লাগা কবিতাটিকে বিচারকের সামনে ভালো বলে শংসাদানে অনুরোধ করেছিলেন ? নিজে বাঁচার জন্য বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে অন্যকে মিথ্যে সাক্ষী দিতে বলাটা কি কম সুবিধাবাদ ?” ছোকরালোচক শৈলেন সরকার ওই বইতেই আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠিটা ( পৃষ্ঠা ১৪৭ ) পড়ে দ্যাখেনি যেখানে সুনীল বলছেন যে কবিতাটি উনি প্রথম পড়লেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে । তার আগে তিনি কবিতাটি পড়েননি ।

অভিজিত:—প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার ? কুঠার নাকি ! কবিতার শিরোনাম তো প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ।

মলয়:—শৈলেন সরকার বারবার কবিতাটাকে প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার বলে উল্লেখ করেছেন । কিছুদিন পরে নদীয়া থেকে একজন পাঠক প্রতিবাদ করে সম্পাদকের চিঠিতে লেখেন যে কবিতাটার শিরোনাম প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার । প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার নয় । ছোকরালোচক শৈলেন সরকার যে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই । এই কবিতাটির নাম জানেন না এমন  কবিতা পাঠক নেই বলেই মনে হয় ।

অভিজিত:—এমনও তো হতে পারে যে পাঁচশো পৃষ্ঠার বই পড়ার মতন সময় ছিল না ওনার হাতে । 

মলয়:—তা ঠিক । উনি বইটা পড়েনইনি । কেননা বইতে স্পষ্ট লেখা আছে যে ‘হাংরি’ শব্দটা আমি পেয়েছিলুম জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে । ছোকরালোচক শৈলেন সরকার লিখে দিলেন যে, “ইতিহাসের দার্শনিক স্পেংলারের এই বইয়ের একটি লাইন ‘ইন দ্য সাওয়ার হাংরি টাইম’ থেকেই পাটনার মলয় রায়চৌধুরী তাঁদের আন্দোলনের নাম ঠিক করেন ‘হাংরি জেনারেশন’ ।” আমরা ১৯৬১ সালে ঘোষণা করেছিলুম “শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা রচনার প্রথম শর্ত” ; ছোকরালোচক শৈলেন সরকার তার দু দশক পরে প্রকাশিত ল্যারি সিনারের ‘দ্য মডার্ন সিস্টেম অব আর্ট’ বইতে আমাদের ঘোষণার সমর্থন যোগাড় করেছেন, কেন জানি না ।

অভিজিত:—আরও উদাহরণ ?

মলয়:—এই কয়েকদিন আগে আবীর মুখোপাধ্যায় নামে জনৈক ছোকরালোচক শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখতে গিয়ে, ওই সংবাদপত্রেই, লিখে ফেলল যে হাংরি ম্যানিফেস্টোগুলো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ! ছোকরালোচক অ্যালেন গিন্সবার্গকেও হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে দিলেন ।

অভিজিত:—রিয়ালি ? কেউ কেউ আপনার সম্পর্কে ইমেজ গড়ে ফেলে আপনার আচরণের সঙ্গে তাকে মেলাতে পারছেন না বলছিলেন যে ? মগজের গোবর দিয়ে ঘুঁটে মারার কথা ?

মলয়:—আমার বই তো এতোকাল পাঠকের হাতে পৌঁছোতোই না । বাংলাদেশে এই সবে পৌঁছোতে আরম্ভ করেছে, তাও কেবল ঢাকায়, আমি ফেসবুকে আমার বইয়ের প্রচার চালাবার পর । কলকাতায় ধ্যানবিন্দুর দরুণ পাঠকদের হাতে পৌঁছোচ্ছে, মফসসলে এখনও পৌঁছোয়নি । যেহেতু আমি আমার বইগুলোর প্রচার করি তাই তাঁরা চটা । তাঁরা বুঝতে পারেন না যে আমার সঙ্গে কলকেতিয়া মধ্যবিত্ত কবি-লেখকদের  তুলনা হতে পারে না । আমার বাবা-মা কখনও স্কুলে পড়েননি, কার্ল মার্কসের একটা ছবি প্রথমবার দেখে বাবা জিগ্যেস করেছিলেন, “এই বুড়োটা আবার কে রে ?” কুড়ি জনের সংসারে বাবা ছিলেন প্রধান রোজগেরে ; বড়োজ্যাঠা জীবন আরম্ভ করেছিলেন ক্লাস ফোর স্টাফ হিসাবে । ইমলিতলা থেকে আমি মধ্যবিত্ত বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে বেরোইনি । বেশ হাতপা ছুঁড়ে ফুঁড়ে বেরোতে হয়েছে সেখান থেকে ।

অভিজিত:—উনি সোভিয়েত দেশের সংবাদ রাখতেন না ?

মলয়:—উনি রাশিয়ার কথা জানতেন, সোভিয়েত দেশ বলে যে কিছু আছে তা-ই জানতেন না । বাবার দৌলতে বা দলের দৌলতে আমি রাশিয়া-চিন-কিউবা যাইনি, বিদেশীদের টাকায় কোথাও যাইনি ।    

অভিজিত:–এখন তো আর আপনার বিরোধীতা হয় না । আপনার লেখার একটা পাঠকসমাজ গড়ে উঠেছে ।

মলয়:–কে বললে হয় না ! ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা কবিতা চেয়েছিল ; আমি এই কবিতাটা পাঠিয়েছিলুম, ওনারা রিজেক্ট করে দিলেন । শুনুন, কবিতাটার শিরোনাম ‘আমার ঠাকুমাকে যেন বলবেন না’ ।

 

উনি আমাকে পছন্দ করতে বারণ করেছিলেন

আপনি কেন করছেন, নীরা ?

আমি আজো শুঁয়োপোকা-ঠাশা ঈশান মেঘে চিৎসাঁতার দিই

উনি পঞ্চাশ বছর আমার কাছে কবিতা চাননি

আপনি কেন চাইছেন, নীরা ?

আমি আজো জলের দশপা গভীরে দাঁড়িয়ে বরফের লাঠি চালাই

উনি আমার সাবজুডিস মামলায় সম্পাদকীয় লিখেছিলেন

আপনি সম্পাদক হয়ে কেন লেখা চাইছেন, নীরা ?

আমি আজো স্মোকড পেংগুইনের চর্বির পরোটা খেতে ভালোবাসি

উনি আমার কবিতার বইয়ের প্রকাশক হয়েও স্বীকার করেননি

আপনি কেন স্বীকৃতি দিচ্ছেন, নীরা ?

আমি আজো দুপুর গেরস্হের হাঁমুখে সেঁদিয়ে ফ্যামিলিপ্যাক হাই তুলি

উনি আমার নাম উচ্চারণ করতে চাইতেন না

আপনি কেন তরুণদের কাছে করছেন, নীরা ?

আমি আজো রক্তঘোলা জলে টাইগার শার্কদের সঙ্গে বলিউডি নাচে গান গাই

উনি বলেছিলেন ওর মধ্যে সত্যিকারের লেখকের কোনো ব্যাপার নেই

আপনি কেন মনে করছেন আছে, নীরা ?

আমি ইমলিতলায় জানতুম কাঠকয়লা ছাড়া ইঁদুরপোড়ায় স্বাদ হয় না

উনি বলেছিলেন ওর কোনো ক্রিয়েটিভ দিক নেই

আপনি কেন মনে করছেন আছে, নীরা ?

আমি অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যাঙ্কনোট পুড়িয়ে মড়ার গন্ধ পেয়েছি

উনি বলেছিলেন ওর দ্বারা কোনোদিন কবিতা লেখা হবে না

আপনি কেন মনে করছেন হয়েছে, নীরা ?

আমি আমস্টারডমের খালপাড়ে দাঁড়িয়ে হাঁকরা বুড়োদের লিরিক শুনেছি

উনি সেসময়ে দুঃখ থেকে রাগ আর রাগ থেকে বিতৃষ্ণায় উঠছেন

আপনি এত উদার কেন, নীরা ?

আমার ঠাকুমাকে যেন প্লিজ বলবেন না ।

 

অভিজিত:—এটা তো রিজেকশান নয় ; এটা চ্যালেঞ্জ ছিল, ওনারা অ্যাকসেপ্ট করতে ভয় পেয়েছিলেন । আদারওয়াইজ, সুরজিত সেন যেমন আপনাকে বলেছিলেন, ‘এই সময়’ সংবাদপত্রের জন্য আপনার একটা হিরোমার্কা ফোটো দিতে, এই কারণে যে পাঠকদের চেয়ে আপনার নাকি পাঠিকার সংখ্যা বেশি, দুই বাংলাতেই । ‘কবিতীর্থ’ সম্পাদক উৎপল ভট্টাচার্যও বলছিলেন যে বই মেলায় আপনার বই কিনতে ওনার স্টলে পাঠিকা-ক্রেতাই বেশি আসেন । 

মলয়:—শুনেছি ।

অভিজিত:—আপনি এই বয়সেও ফ্লার্ট করেন ?

মলয়: —তা করি, ভালো লাগে, রিডিমিং মনে হয় ।

অভিজিত:—ওপার বাঙালির তরুণীদের সঙ্গেও ?

মলয়:—হ্যাঁ, ওপার বাংলায় সুন্দরী পাঠিকাদের সংখ্যা বেশি । যৌবনে যদি ওপার বাংলায় যেতুম তাহলে আমিও বোধহয় কবীর মলয় হয়ে ন্যাড়া মাথায় ফিরতুম । প্রথমত সুন্দরী আর দ্বিতীয়ত ওনারা রাঁধেন ভালো ।

অভিজিত:—আপনি কি পেটুক ?

মলয় :—এককালে ছিলুম, এখন দেখে লোভ হয় কিন্তু শরীরের দরুণ ডাক্তারের নানা বিধিনিষেধের কারণে কুরে-কুরে খেয়ে সন্তুষ্ট হতে হয় । ভূমেন্দ্র গুহ অবশ্য বলেছেন যে এক-আধ বার খাওয়া চলে ; তাই খেয়ে নিই । ইউরোপে গিয়ে সব রকমের মদ আর বিয়ার খেয়ে এসেছি । 

অভিজিত:—আপনারা দল বেঁধে খালাসিটোলায় যেতেন, মাতাল হতেন কি ?

মলয়:—আমি কখনও মদ খেয়ে মাতাল হইনি । একবার শুধু অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলুম বেনারসে, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় গাঁজা-চরস-আফিমের কনককশান তৈরি করে ফুঁকিয়েছিল, তখন । তাছাড়া আমি কখনও নেশা করে পোঁদ উল্টে পড়িনি, সুভাষ ঘোষ যেমন পড়ত । আটের দশক পর্যন্ত গাঁজা-চরস-আফিম সরকারি দোকানে পাওয়া যেতো, সত্যমেব জয়তে ছাপ মারা । আমেরিকার চাপে বেআইনি হয়ে গেল । কুম্ভ মেলায় কিন্তু যতো ইচ্ছে কিনতে পাওয়া যায় ।

অভিজিত:—আপনার কোন নেশা ভালো লাগে ? মদ না গাঁজা-চরস-আফিম ইত্যাদি ?

মলয়:—এগুলোকে নেশা বলা ভুল । এই জিনিসগুলো মগজে ঢুকে মধ্যবিত্ত রাবীন্দ্রিক ভাষার একচেটেপনাকে ভেঙে দিতে পারে , এমনিতেই কালচারাল বাস্টার্ড হবার দরুণ ভাষার মনোপলি আমার ওপরে তেমন কাজ করে না । এখন শুধু সিংগল মল্ট খাই, কিন্তু মাদকের ব্যাপারে এককালে আমার প্রিয় ছিল গাঁজা আর চরসের মিক্সচারের ধোঁয়া । যাবতীয় সামাজিক মনোপলিকে মগজের মধ্যে ভেঙে ফেলতে পারে ওটা । ধোঁয়া ফুঁকে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ান, মিছিল দেখলে মনে হবে ভেড়াদের চরাতে নিয়ে যাচ্ছে তাদের মালিক, এটাই মাদকের ক্রিয়েটিভ দিক ; বহু মানুষের মুখকে মনে হবে কুমিরের হাঁ-করা মুখ, ভাষণকে মনে হবে হায়েনার ডাক ।

অভিজিত:—মাদকের অভ্যাস কেমন করে হয়েছিল ?

মলয়:—কেন ? ইমলিতলা পাড়ায় । কেউই ব্যাপারটাকে খারাপ মনে করত না । পাড়ার অগ্রজরা তাড়ি সোমরস গাঁজা ভাঙ সবই শেয়ার করতে চাইতেন । এমনকি বিয়ের বরযাত্রিদেরও তাড়ি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো । দোলের দিন তো সমস্ত সীমা ভেঙে পড়ত । সেই দিনগুলো দারুন ছিল ।

অভিজিত:—ছাড়লেন কেন ?

মলয়:—মাদক নিয়ে সিরিয়াসলি লেখালিখি করা যায় না । এমনকি সিংগল মল্ট খেয়েও লিখতে ব্যাঘাত হয় ।

অভিজিত:—ভাষার মনোপলির কথা বলছেন । সংবাদপত্রগুলো আর কমার্শিয়াল পত্রপত্রিকারা ভাষাকে মনোপলাইজ করে ফেলেছে, সাধারণ মানুষের ভাবনাচিন্তাকেও ওই ভাষা দিয়ে দখল করে নিচ্ছে । তাই না ? 

মলয়:—আমি তাই সংবাদপত্র আর কমার্শিয়াল পত্রিকা পড়ি না । তিরিশ বছরের বেশি হয়ে গেল । কোনো কিছু জানাবার থাকলে কলকাতা থেকে কোনো পাঠক বা সম্পাদক কাটিং পাঠিয়ে দেন । 

অভিজিত:—টিভি দেখেন না ?

মলয়:—অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট, ডিসকভারি, ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক ইত্যাদি দেখি ।


অভিজিত:—ফিল্ম দেখেন না ? এক্সপেরিমেন্টাল কবি-লেখকরা তো ফিল্ম টেকনিকের সাহায্য নেন ।

মলয়:—না, আমি ফিল্ম বড়ো একটা দেখি না । বই পড়ার সময় যেমন কোনো চিন্তাভাবনা এলে মুড়ে রেখে চিন্তাটার প্রসার ঘটাতে থাকা যায় মগজে, ফিল্মে তেমন হয় না । ফিল্ম আমি দেখেছি যৌবনে, মূলত নায়িকাদের যৌন আকর্ষণের কারণে । সুতরাং ফিল্মের কোনো টেকনিক আমার লেখায় প্রয়োগ করার প্রশ্নই নেই । 

অভিজিত—আপনার লেখার আঙ্গিকে যথেচ্ছাচার তাহলে আনেন কী করে ?

মলয়:—যা মনে আসে তাই করি, আর তার জন্য কোনো যুক্তি খাড়া করার দরকার আছে বলে মনে করি না । অনেকসময় ওটা আপনা থেকে মাথায় চলে আসে, যেমন “নখদন্ত” বা “ঔরস” ফিকশানে, কিংবা “টাপোরি”, “ইচ্ছাপত্র”, “গুমরাহীবাঈ-এর সন্ধ্যা” আর “ব্লাড লিরিক” কবিতায়।

অভিজিত:—কোন অভিজ্ঞতায় আপনি সবচেয়ে বেশি থ্রিলড ?

মলয়:—গুলি চালানোয় । আমি এনসিসিতে থ্রিনটথ্রি, বারো বোর আর স্টেনগান চালিয়েছি । তখন এখনকার মতন রেসট্রিকশান ছিল না । প্রতিদিন চালানো যেতো । বিন্দেশ্বরী প্রসাদ নামে এক বিহারি বন্ধুর গ্রামে গিয়ে ডাবল ব্যারেল গান আর পিস্তল চালিয়েছি । 

অভিজিত:—আপনি নাকি বেহালা বাজাতেও শিখেছিলেন ?

মলয়:—হ্যাঁ, বেহালা শিখছিলুম, প্রেমে পড়ে সব গোলমাল হয়ে গেল । তার চেয়ে গিটার বাজাতে শিখলে ততো দিনে শিখে ফেলতুম । 

অভিজিত:—কিন্তু আপনার বাবা ওনার বন্ধুদের নাকি বলতেন যে কুসঙ্গে পড়ে আপনি বেহালা বাজানো ছেড়ে দিয়েছিলেন ।

মলয়:—বাবা কুসঙ্গ বলতে নমিতাদির কথা বলেছেন, নমিতা চক্রবর্তী, যিনি আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে সুমিতাদি । মা মনে করতেন যে আমার কুসঙ্গ হল বিহারি বন্ধুরা, যাদের ফোটো আপনি দেখতে পাবেন বিবিসি রেডিও প্রোগ্রামের ফোটোটায় ; তাদের প্রায় সকলের গ্রামে গাঁজা আর পোস্তর গাছ ছিল, সহজেই পাওয়া যেতো ভালো কোয়ালিটির গাঁজা আর আফিম । এরা সকলেই হাইকোর্টের জজ, অধ্যাপক, আই এ এস, আই পি এস, ডাক্তার, ইনজিনিয়ার, গবেষক ইত্যাদি হয়ে অবসর নিয়েছে ; আমার স্নাতকোত্তর রেজাল্ট কিন্তু ওদের সবায়ের চেয়ে ভালো ছিল । আসলে আমার কোনো উচ্চাকাঙ্খা ছিল না । আমি কবিতার কুসঙ্গে পড়ে গিয়েছিলুম, ওরা পড়েনি । উল্টোটাও হয়েছে, ফালগুনী রায়ের দিদি এসে আমার মাকে বলে গিয়েছিলেন যে আমার কুসঙ্গে পড়ে ফালগুনী রায় খারাপ হয়ে যাচ্ছে ।

অভিজিত:—আচ্ছা, কবিতা বললে আপনার মনে কোন ছবি ভেসে ওঠে ?

মলয়:—এটা ভালো প্রশ্ন । কবিতা বললেই একটা ঘটনা মনে পড়ে । হাংরি আন্দোলনের সময়ে কবিতা ভবনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরোজায় রিং দিয়েছি । বুদ্ধদেব বসু দরোজা খুলতেই আমি বললুম, আমার নাম মলয় রায়চৌধুরী, উনি সঙ্গে-সঙ্গে দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিলেন । আমি ভাবলুম হয়তো খুলবেন, প্রায় মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে রইলুম, খুললেন না । ওনার সঙ্গে ওটাই আমার প্রথম আর শেষ দেখা । অথচ তার আগে উনি বদল্যার সম্পর্কে বই লিখে ফেলেছেন, বিট আন্দোলন সম্পর্কে লিখেছেন বাঙালি পাঠকদের জন্য ।

অভিজিত:—বদল্যার, ভেরলেন, র‌্যাঁবোও যদি ওনার কবিতাভবনের দরোজায় অমন আনইনভাইটেড টোকা দিতো, তাহলেও হয়তো ওই ভাবেই তাদের বিদায় করতেন ।

মলয়:—হয়তো । নিজেকে প্রস্তুত করে উনি বোধহয় ওনাদের মুখোমুখি হতেন । চরিত্রের দিক থেকে বিদেশি ছিলেন ভদ্রলোক, আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে তারপর দেখা করতেন । তাছাড়া, তখন তো প্রতিদিন স্নান করতুম না, জামাও পালটাতুম না ।

অভিজিত:—এরকম অভিজ্ঞতা আরও হয়েছে ?

মলয়:—মিছিলে উৎপল দত্তের হাতে একটা হাংরি বুলেটিন দিয়ে নিজের নাম বলতেই উনি আঁৎকে উঠে বুলেটনটা রাস্তায় ফেলে দিয়ে বলে উঠলেন, “হাংড়ি জিন্নাড়েশন !” তারপর হনহনিয়ে মিছিলে এগিয়ে গেলেন ।

অভিজিত:—আর ?

মলয়:—আবু সয়ীদ আইয়ুবের বাড়ি গিয়েছিলুম । তখন জানতুম না যে পুলিশে যারা কমপ্লেন করেছেন উনি তাঁদের অন্যতম । উনি আমাদের আন্দোলন নিয়ে বিশেষ আলোচনা করতে চাইলেন না ; ভারতের মুসলমানদের প্রসঙ্গে আমাদের মতামত জানতে চাইলেন । আমি কুলসুম আপার সঙ্গে আমার শৈসবে যে ঘটনা ঘটেছিল সেটা বলতে গম্ভীর হয়ে গেলেন । 

অভিজিত:—এগুলো আপনাকে প্রভাবিত করেনি ?

মলয়:—এর চেয়ে বরং এক ন্যুড মডেল অ্যাপ্রুভ করার জন্য সমীর রায়ের সঙ্গে গিয়ে প্রভাবিত বোধ করেছিলুম। বয়স পঁছিশ-ছাব্বিশ হবে । একজন আর্টিস্ট তার স্তনে সবুজ রঙ করে দিয়েছিল । মনে হচ্ছিল খাবার মতন হিমসাগর । 

অভিজিত:—আপনি তো সেক্সিস্ট বুল, দেখেই আপনার দাঁড়িয়ে গিয়ে থাকবে ?

মলয়:—হ্যাঁ, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দাড়িয়ে গেল, বুঝতে পারলুম যে আমার দ্বারা পেইনটিঙ সম্ভব হতো না । একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল অনিল করঞ্জাইয়ের বেনারসের স্টুডিওয় এক নিউড বিদেশিনীকে দেখে । এই বিদেশিনীকে আপনি পাবেন আমার “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসে । 

অভিজিত:—ওটা তো অলমোস্ট পরনোগ্রাফি ।

মলয়:—অনেকে তাই বলেন বটে । ওতে একটা প্যারা ছিল লাবিয়া ম্যাজোরায় হিরের মাকড়ি পরানো সম্পর্কে ; তা বাদ দিয়ে দিই কেননা ওটা তাহলে খোলার ঘটনা বর্ণনা করতে হতো । উপন্যাসটা লিখতে বসে, তখন হাতে লিখতুম, কমপিউটারে নয়, আমি দৈহিক আনন্দ উপভো্গ করছিলুম । ঠিকই বলেছেন, সেস্কিস্ট বুল হয়ে গিয়েছিলুম লিখতে বসে । হিমসাগর স্তনের যুবতীকে নিয়ে একটা লেখা ঘুরছে মাথায় ।

অভিজিত:—আপনার রেপ করতে ইচ্ছে হয় না ?

মলয়:—না, না । আমি অত্যন্ত ডেলিকেট আর সেনসিটিভ; যার তার সঙ্গে শুতে পারি না । ফার্স্ট মুভ আমি কখনই করিনি । রেপ ব্যাপারটা শরীরের দিক থেকে নোংরা । আজকাল দিকে-দিকে এতো রেপিস্ট গজাচ্ছে শরীর নোংরা হবার দরুণ । নোংরা শরীরে ভরে গেছে সমাজ । পুরুষ মানুষ ভুলেই গেছে যে শরীর একটা ইন্দ্রজালের ওয়র্কশপ । বেশিরভাগ দম্পতি মিশনারি পোজের বাইরে কিছুই জানে না । 

অভিজিত:—আপনি হাংরি আন্দোলনের আগে ফাক, শিট, আসহোল, সান অফ এ বিচ, মাদারফাকার, কান্ট, ডিকসাকার ইত্যাদি গালাগাল দিতেন বন্ধুদের ?

মলয়:—হ্যাঁ দিতুম । তবে ইমলিতলায় গ্রুমিঙের কারণে হিন্দি গালাগালই বেশি প্রয়োগ করতুম । সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করতুম “চুতিয়া” আর “ভোঁসড়িকে জনা” । আমি কখনও রাগিনি, তাই রেগে গিয়ে গালপাড়ার স্তরে উঠিনি কখনও । বন্ধুরা রাজসাক্ষী হয়ে গেলেও ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চেয়েছিলুম, ওরাই পালিয়ে গিয়ে দল বেঁধে ওদের পত্রিকা থেকে আমাকে বাদ দিয়ে দিলে । আমার পাশাপাশি সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র আর দেবী রায়কেও বাদ দিয়ে দিলে । অথচ সম্পাদক বাসুদেব দাশগুপ্ত ঘোষণা করেছিল “আমার ক্ষুধা ছিল মানুষের সার্বিক মুক্তির ক্ষুধা”। সার্বিক মুক্তি কেমন করে সম্ভব কে জানে যখন আপনি নিজের বন্ধুদেরই আপনার পত্রিকায় ল্যাঙ মেরে বের করে দিচ্ছেন । হাংরি আন্দোলন তো কাউকে বাদ দেবার আন্দোলন ছিল না ।

অভিজিত:—আপনার কি মনে হয় ওনাদের এই বিভাজন প্রচেষ্টা হাংরি আন্দোলনের ক্ষতি করেছে ?

মলয়:—নিশ্চয়ই, অনেকে এটাকেই আলোচনার বিষয়বস্তু বানিয়ে ফ্যালে । যাকগে, বিষয়ান্তরে যাওয়া যাক ।

অভিজিত:—আপনি হোমোসেক্সুয়ালিটিতে আকর্ষিত হয়েছেন ? বিহারে তো লৌণ্ডাবাজির জন্য বিখ্যাত ।

মলয়:—না, হইনি । কম বয়সেই নারীসঙ্গের কারণে ওই দিকটা অবহেলিত থেকে গেছে । লৌণ্ডাগুলোও তো বিটকেল দেখতে লাগতো । স্কুলে আর কলেজে লৌণ্ডাটাইপ ছিল না কোনো সহপাঠী ; থাকলে হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারতুম । তবে শুনতুম বটে যে অমুক হোস্টেলে দুজন ছাত্র মশারির ভেতরে ওয়ার্ডেনের হাতে  ধরা পড়েছে । প্রাইমারি স্তর থেকেই কোএজুকেশান ছিল, খুকি থেকে তরুণীরা স্কুল-কলেজে আশেপাশে ছিলই, ছাত্রও খারাপ ছিলুম না, কুসঙ্গ সত্ত্বেও । দেখতেও মন্দ ছিলুম না । গরিব বলে পোশাক একটু বেখাপ্পা থাকতো, এই যা । 

অভিজিত:—অনুবাদের জন্য সাহিত্য অকাদেমির পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন কেন ?

মলয়:—আমি কোনো পুরস্কার নিই না, লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কারও নয় ; কোনো সম্বর্ধনা নিই না, কোনো সাহিত্য সভায় গিয়ে বক্তিমে ঝাড়ি না । আমার মনে হয় অন্যের নোংরামি আমার ওপরও চেপে বসবে, তাদের মূল্যবোধে আটকে পড়ব । দেখুন না, কতো সাহিত্যিক, নাট্যকার, আঁকিয়ে কেমন নোংরামিতে আটকে পড়েছেন । পনজি স্কিমে গরিবের টাকা মেরে দেবার খেলা চলছে তা তাঁরা টের পেলেন না কেমন করে ? 

অভিজিত:—উপায় ?

মলয়:—উপড়ে ফেলতে হবে ; পুরো এসট্যাবলিশমেন্টকে উপড়ে ফেলতে হবে, আর তা করার জন্যে বাইরে থেকেই চাড় দিতে হবে, থুতু ছেটাতে হবে, মুতে দিতে হবে, হেগে দিতে হবে মাথায়, যারা তেল দিতে একত্র হয়েছে, পুরস্কারের জন্য লালা ঝরাচ্ছে তাদের ছিঁড়ে বাঘের খাঁচায় ফেলে দিতে হবে, বামপন্হা-দক্ষিণপন্হা সবই তো দেখা হল, এগুলো চলবে না, নতুন কোনো ব্যবস্হার কথা ভাবতে হবে, অসৎদের ঝোলাতে হবে, অনেক-অনেক কাজ করতে হবে, তবে যদি মানুষের কিছু হয় । আবার ট্রাইবাল হয়ে যেতে হবে, যেমন আদিবাসীরা থাকেন ।


২টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র