সোনালী মিত্র

মায়াজম
0

 সম্পাদকীয়


ধরং মধুরং বদনং মধুরং

নয়নং মধুরং হসিতং মধুরম |
হৃদয়ং মধুরং গমনং মধুরং
মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম || 


বর্ষাকাল আসছে।আকাশ আনন্দাশ্রু নিয়ে অপেক্ষা করছে।নভশ্চর-খ্যাত পাখিদের ডানা মেঘবৃষ্টির আকাশে উড়ছে তো উড়ছে।আকাশে কারণহীন উড়তে পারে একমাত্র পাখিরাই।সময়  নিজেকে নিজে কোনভাবেই জমাতে পারে না।কেন-না,সময় নিঃস্পৃহ।সময়কে জমানোর জন্য  উপলক্ষ্য লাগে,কেন-না উপলক্ষ্য ছাড়া সূর্যও ওঠে না।সময়কে জমানোর জন্যই যেন আকাশের উৎপত্তি,পাখির উৎপত্তি,বৃষ্টির উৎপত্তি।সময়ের ভেতরে বর্ষাকাল।আর বৃষ্টিকুঁচিতে ফুলের পরাগ,উড়ে উড়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে  অর্থঘেঁষা নগরজীবনকে।ধুলোদূষণহর্নে আর পাইসহোটেলের বাইরে যে অনিদ্রাগ্রস্ত বলয় আছে,সেখানে তখন সন্ধ্যা নামে নামে।চায়ের দোকানের মাটির ভাঁড়ে ফুরিয়ে যেতে থাকে ফুটন্ত ধোঁয়া।চক্করকাটা ক্যাবের বিহারী ড্রাইভার সওয়ারি নামিয়ে ছুটছে দ্বিতীয় জিপিএস সিগন্যালের দিকে।ঝলমলিয়ে বৃষ্টি মাখতে মাখতে  আলো জ্বলে ওঠে-ওঠে রাস্তার বাতিস্তম্ভে।

মানুষের ভেতরে নাকি আর একটা মানুষ আছে।প্রথম মানুষটা যখন দুধ খায় ভেতরের মানুষটা টানে সিগারেট।৪৫ ডিগ্রীর গরমে প্রথম মানুষটি হাঁসফাঁস করে যখন,ভেতরের মানুষটি ঘুরে আসে সাইবেরিয়া।কাজেকর্মের দিনে দেখা হয় না ভেতরের মানুষের সঙ্গে,তবু থাকে।একাকী রাতে,ভেন্ট্রিলোকুইস্ট ডাকে তার মায়াবী মানুষটাকে।যে কথা বলতে পারেনি কখনও সেই কথা বলে।মানুষের ভেতরের এই মানুষটাকে অল্প কিছু মানুষই দেখতে পায়। আসলে ভেতরের সেই মানুষ সহজে দেখা দিতে চায় না বাইরের মানুষটাকে।জন্ম সম্ভাবনার মধ্যেই মৃত্যু সম্ভাবনা নিয়ে প্রাণী জগতের উদ্ভব।বিশেষত মনুষ্য জগতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশি প্রযোজ্য।অনেকেই বলেন,মৃত্যুকে নাকি দেখা যায় না!ব্যাপারটা কী তাই?মৃত্যুরও সুস্পষ্ট রূপ আছে,বর্ণ আছে,গন্ধ আছে।যারা দেখতে চান,তারা দেখতে পারেন।দেখার জন্য অলৌকিক চোখের প্রয়োজন নেই। দরকার নেই ভুয়োদর্শী হবার দূরদর্শিতার।

মানুষকে নিয়ে মানুষের গর্বের শেষ নেই।অথচ মানুষেরা সম্মলিত একটা গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ।তাদের ক্রিয়াকলাপ ওই মানুষদের নিয়ে।তাদের সৃষ্টি এবং অনাসৃষ্টি ওইটুকু সীমার মধ্যে সংরক্ষিত।এর বাইরে কী আছে আর কী নেই,সেই ভাবনা পাগলদের।এই কারণেই পাগলদের অনেকে মানুষ ভাবে না।আর পাগলেরাও নিজেদেরকে মানুষ না-ভাবতেই বেশি পছন্দ করে।

একটা মাথা,দু'টো চোখ,একটা নাক, দু'টো কান,দু'টো হাত,দু'টো পা ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কিছু অঙ্গের অধিকার পেয়েছে জন্ম সৌভাগ্যে।এতকিছু একসঙ্গে পেয়ে হকচকিয়েগিয়েছে।এতগুলি অঙ্গের ব্যবহার কীভাবে করবে ভাবতে ভাবতে একদিন ফুরিয়েও গিয়েছে।ফুরোতে ফুরোতে ভেবেছে,কেনই-বা এসেছিলাম,আর কেনই-বা ফিরে যাচ্ছি,তাই তো জানা হল না।এই অবাক বিস্ময়ের জন্যই নাকি মৃত্যুর সময় মানুষের চোখ বন্ধ হয় না।


এই তো খগেন ঘোষের মেয়ে ভারি বর্ষা মাথায় নিয়ে মধুর সন্ধানে সেই যে ঘর ছাড়লো পাক্কা পনেরোদিন পরে তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো বুড়িগঙ্গার চরে। অবশ্য খগেন ঘোষের তাতে কিছু যায় আসেনি, কমলকলির নরম বুকে মুখ ডুবিয়ে ঘাম ঝরাতে ঝরাতে বলেছিলো, অমৃতভান্ড আছে রে তোর বুকে, দে ভিজিরে দে রে। কেবল মামাগী আছারি-বাছারি করে কেঁদে মরেছিলো কোল খালি হওয়ার সন্তাপে। জীবন খুড়তে গিয়ে মধুর কলস কখন গড়িয়ে পরে কে জানে!

কুঞ্জবুড়ি রাধাঘাটে বসে হরিনাম করেন। যাওয়া - আসার পথে কেউ কেউ ছুঁড়ে দেন দু - চার খুচরো মুদ্রা।'মায়ের আশীর্বাদ' খোদাই করা টিনের থালা বেঁকে থাকে বুড়ির পিঠের মতো। কৃষ্ণ নামের মধুফল বুড়ি রাধাঘাটে বসে ছড়ান। কিছুদূরেই মধুশালা, সহস্র রোশনাই নিয়ে জ্বলে ওঠে দমকে। ভেসে আসে দুকলি, " যাওব তুঝ অভিসারে, তুঁহুঁ মম প্রিয়তম, কি ফল বিচারে--ভয়বাধা সব অভয় মুরতি ধরি,পন্থ দেখায়ব মোর।" কোথায় যেন মুদ্রার দুই পিঠ এক হয়ে গড়িয়ে যায় শ্রীকৃষ্ণ মধুজলে।

জীবন মানে একটা কাঙ্ক্ষিত আকাঙ্ক্ষা।মানুষ শুধু খুঁজছে।কী খুঁজছে জানে না। খোঁজার এই অন্বেষণ বাঁচিয়ে রাখে প্রাণকে।খোঁজাখুঁজির প্রাণকেন্দ্রের নাম যদি আমরা মধু দিই,সেটা অমৃত কিংবা বিষ দুটোই হতে পারে।কেউ সেই বিষ খেয়ে মরে যেতে পারে,কেউ-বা হয়ে যায় নীলকণ্ঠ।

সম্পাদকীয় আর দীর্ঘায়িত করব না। যারা যারা এই মধু সংখ্যায় লেখা দিয়েছেন সবাইকে স্বাগত।মায়াজমের পাঠকদের আমন্ত্রণ জানাই এবারের সংখ্যা পড়ার জন্য।শেষ করার আগে শুধু এইটুকু বলে যাব-  সময় শেষ হ'য়ে আসবে তবু আকাশের বৃষ্টির মৃত্যু হবে না।ভালো থাকার বিশেষণ মানুষকেই খুঁজতে হবে অনন্তকাল ধরে ... 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)