সিলভিয়া ঘোষ - মায়াজম

Breaking

২৪ জুন, ২০২৩

সিলভিয়া ঘোষ

 আমাদের বাড়ি



জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে এসেছি আমরা যাকে বাসা বলি সেটা অন্যের বাড়ি। আমরা সেখানে নিজেদের ইচ্ছে মতো কোন জায়গায় পেরেক পুঁতে দিতে পারতাম না। অনুমতি নিতে হত। সেখানে দোলনা কিম্বা শৌখিন জিনিস লাগানোর মন মানসিকতা থাকলেও পকেটের ভারে আর জায়গার অভাবে তা করে উঠতে পারেননি আমার বাবা মা। একেই পরের বাড়ি তায় একটা মাত্র ঘর! তবে সেদিনগুলোই ভাল ছিল বলে আজ মনে হয়। একটা ঘরের মধ্যে আমরা যা মজা করেছি আজ ঘরের সংখ্যা বাড়লেও সেই আনন্দ উপভোগ করতে পারিনা। আসলে যা কিছু অতীত সেটিই খাঁটি সোনা।এরপর শুরু এক বাসা থেকে অন্য আরেক বাসাতে আমাদের বাসস্থান বদলের পালা, বদলে যাচ্ছে পরিবেশ। আমরা হলাম ছিন্নমূল পরিযয়ী বাসা বাঁধা পাখীর মতোন। এখানেও সেই একটি মাত্র ঘর। তখনও আমাদের নিয়ে গুরুজনদের অসুবিধা হয়নি কারণ আন্তর্জালের আবিষ্কার হয়নি আর শিশুর মুখে বুলি ফোটেনি। নিজস্ব ঘরের আবদারও তখন আসেনি। শিশুরা এটাই শিরোধার্য করে নিয়েছিল এইভাবেই থাকতে হবে সবার সঙ্গে মিলেমিশে। আধ খানা ডিমের স্বাদও তখন ছিল অমৃত। জীবন কিন্তু এতেই ভাল ছিল। দামী না হোক হাতে সেলাই করা কাঁথাতেই শীত মানত বেশ। এরপর ঘটে টানাটানির সংসারে এক অনন্য নিদর্শন। নিজেদের বাড়ি তৈরীতে রক্ত জল করতে থাকেন জন্মদাতা-দাত্রী। সে এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস। ঝড় জল পেরিয়ে একে অপরের জন্য খাবার নিয়ে ছুটছেন মাইল দেড়েক সঙ্গে লোক লৌকিকতার অভাব নেই। এভাবেই একদিন আমরা শাপমুক্ত হলাম অন্যের আদেশ নির্দেশের হাত থেকে। এক শুভ অক্ষয় তৃতীয়াতে গৃহ প্রবেশ ঘটেছিল আমাদের। সবচেয়ে বড় কথা হল এখানে এতদিনে দুটো ঘরের স্বাদ পেতে চলেছি আমরা। সঙ্গে উপরি পাওনা মাটির বারান্দা, শালের খুঁটি দেওয়া এডভেস্টার্সের ছাদ দেওয়া। ঘরের সঙ্গে লাগানো স্নানঘরও আকর্ষণীয়। তবে ছাদে ওঠার জন্য ছিলনা সিঁড়ি। ছিল বেশ খানিকটা বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গা। প্রথম প্রথম চারপাশে পাঁচিল তো দূর কচার বা ঢোল কলমির বেড়াও দেওয়া ছিলনা। সেই সময় গ্রীষ্মকালে বাড়ির জানালায় চোখ রাখলে সেই পথের পাঁচালীর অপু দুর্গার মতো রেলগাড়ী শব্দ সহ চেহারাটাও দেখা যেত দূর থেকে দু তিনটে পুকুর, ঝিল পেরিয়ে, নারকেল, সুপারী, খেজুর গাছের ফাঁক দিয়ে। তখন মাঝে মাঝে মনে হত এমন অসাধারণ দৃশ্য কেউ কি আর দেখেছে ! গ্রীষ্মের কালবৈশাখী অথবা বিকেলের জলীয়বাষ্প বয়ে আনত কাঁচা আমের গন্ধ। আশেপাশে তেমন বাড়ি ছিলনা। যে দু চারটে বাড়ি ছিল প্রত্যেকের বাড়িতে ছিল আম, কাঁঠাল, জামরুল, পেয়ারা, কলা গাছ। গৃহপ্রবেশের মঙ্গল ঘটে বসান নতুন কলাগাছ জন্মদিল আমাদের বাড়িতে প্রথম কাঁঠালি কলার। যদিও আকারে সে বাড়তে না পারলেও মিষ্টত্বে ও বীজ বহন করতে যথেষ্ট সক্ষম হয়েছিল। বাবার কাছে তাই যেন অমৃত। নিজের বাড়ির প্রথম ফল। এর আগে অবশ্য ফুলের পরিচর্যা হয়েছে। নাইনো ক্লক, গাঁদা, রজনী গন্ধা এরা সবাই স্থান পেয়েছে বাড়ির উঠানে। এর আগে রথের সময় আমাদের এখানে মেলা বসত। সেখান থেকে পাশের বাড়ির এক ভাই ১৯টা সুপারি গাছ নিয়ে এসে বেড়ার মতোন বাড়ির তিন দিকে লাগিয়ে দেয়। তারপর চলে কচার বেড়া ও তার দিয়ে বেঁধে তাকে যত্ন করা এর মধ্যে ফুলের মধু খেতে আসে রঙ বেরঙিন প্রজাপতির দল। মধু তো শুধু ফুলের বুকেই জমা হয়না, তা জমা হয় মানব মানবীর হৃদয়েও। ওলিরা গুণগুণ করে সেখানেও। ফুলের বুকে হাজারো ঝড় ওঠে, নতুন বসন্ত এসে যায় আবারও। বেড়ার জাল থেকে পাঁচিল এসে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় ফুলেদের নিরীহ প্রাণীদের থেকে বাঁচাতে। কৃষ্ণনগর হর্টিকালচার থেকে মা ও মামাতো দাদা নিয়ে এলেন দুটি গাছ হিম সাগর ও আম্রপালি আমগাছ। সযত্নে তাদের লাগান হল। গাছ বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকি ফ্রক পরা আমিও। আবারও বসন্তের দখিনা বাতাস আমের মুকুলের মধু গন্ধ বয়ে নিয়ে আসে অলস দুপুরে। বাড়িও পরিবর্তন হয়েছে খানিকটা। মাটির বারান্দা থেকে সিমেন্টের মেঝে সঙ্গে শাল খুঁটির পরিবর্তে লোহার দুটি দরজা ও গ্রিল, আর বারান্দার একপাশে রান্নাঘর। এতদিন একটি শোয়ার ঘরেই রান্নাঘর করে রাখা হয়েছিল একপাশে। ঘরের মেঝেও ইঁট বিছান থেকে সিমেন্ট করা হয়েছে। উঠানের সামনের খানিকটা অংশ সিমেন্ট করা হয়েছে বৃষ্টিতে কাদা যাতে না লাগে সেই কারণে। ঐ যে কবিতায় যাকে বলে 'নিজে হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা'।


এসবের মধ্যে আমার পড়াশোনার গণ্ডী ইস্কুল ছাড়িয়ে সবে কলেজে পড়েছে আর আমের মুকুল থেকে মধু ঝরে পড়ে যায় সিমেন্টের বুকে। মাছি ভনভন করে। আমি যদিও পাকা আম খুব একটা ভাল বাসিনা তবুও আমের মুকুলের মধুর গন্ধ আমাকে পাগল করতে থাকে। তখনই বুঝতে পারি যে মধু জমেছে আমের বুকে সে মধু আমার বুকের গভীরে জমে আছে , সঠিক পাত্রে তাকে দান করা না হলে বুকের গভীরে ব্যথা জমতে থাকবে। ভালবাসা কী কেবল নিতেই চায়! সে যে দিতেও চায় তার অনন্ত সুধা বুভুক্ষু পিপাসা সিক্ত ভিক্ষুক কে। আম গাছের মুকুল আসতে দেরী হল যেবার আমার গায়ে হলুদ লাগতে দেরী হলনা সেবার। বিয়ের পর আম গাছ থেকে প্রতি বছর আম এসেছে ও বাড়ি থেকে ব্যাগ ভর্তি করে। যদিও আমি পাকা আম খাই কম তবুও বাড়ির ফলের মূল্যই আলাদা। যার আকার ও প্রকার দুই উচ্চমানের।
পাড়ায় জন বসতি বাড়তে থাকল। সকলেই পাহাড়া দেয় বসন্তের ঐ দুটো আম গাছ কে। একটা ডালে তিনটে, চারটে করে আম হয়। ঝড় হলে ক্ষতি হয়, শিলাবৃষ্টিতে একবার কত আম নষ্ট হয়ে গেল। পাড়ার লোকেদের মন খারাপ। প্রায় তেইশ বছর বিয়ের পর আমরা আম কম কিনে খেয়েছি। এরপর আসে নতুন অধ্যায়। সেই কাঁচা ঘরটি এবার বাজারে নিজেকে প্রমাণ করে দেয় এখনও তার মূল্য সোনার চেয়েও বেশি। ঠাকুরের কথায় 'টাকা মাটি / মাটি টাকা'। অতএব আবারও নতুন ঠিকানায় গন্তব্য স্থির হল। ঠিকানার নাম নিজস্ব কারপেট এরিয়া... ফ্লাট বাড়ি। এখানে অবশ্য আম গাছ নেই তবে টবে তুলসী, অপরাজিতা, স্থল পদ্ম কিছু সিজিনাল ফুল ফোটে।


আমার সঙ্গে ফেলে আসা আমাদের 'কাঁচা ঘর খাসা' র সম্পর্ক খুব যে নিবিড় ছিল তা নয়। তবুও এই মধুমাসে দখিনা বাতাস বারেবারে আমের মধুর কথা মনে করিয়ে দেয় আমাকে।

জীবনের সাতাশটা বছর অন্যের বাড়িতেই সময় দিয়েছি , দিতে হয়েছে। এখানে আম গাছ নেই। কচার বেড়া নেই, রজনী গন্ধার গাছ মাটিতে লাগানো নেই। এখানে তিন তলার ছাদে জবা, টগর, শিউলি, বেল, কাঁঠালি চাঁপা আরও অন্য রকম গাছ আছে। এখানে আমের মুকুলের থেকে মধু পড়েনা মাটিতে তাই মাছিরাও ভনভন করেনা। শুধু চন্দ্র মল্লিকা, গোলাপেরা ফুটলে মধুর লোভ দেখিয়ে দখিনা বাতাসকে দূত করে ভ্রমরদের আকর্ষিত করতে থাকে। সুধা যে সেও দিতে চায় বুভুক্ষু ভ্রমর কে।


২টি মন্তব্য:

  1. একেবারেই জমে নি। নকল মধু।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. মতামত পেয়ে বুঝলাম আপনি সত্যিই একজন সাহিত্য প্রেমী😍😍

      মুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র