শ্যামলী আচার্য - মায়াজম

Breaking

২৪ জুন, ২০২৩

শ্যামলী আচার্য


মধুমেহ

ঢিস ঢিস করতে থাকা শরীরটা নিয়ে কী করবে বুঝতে পারে না রাণু। বিশেষ করে এই সকালের দিকে।
আরও রাগ হয় মায়ের দিকে তাকালে। বুড়ি ঝিম মেরে বসে থাকে। নড়ে না, চড়ে না। শুধু চুপ। সামনে চায়ের কাপ ধরে দাও, বিস্কুট দাও দু’একটা। হাত পেতে নেবে। ফুঁ দিয়ে চা খাবে। অথচ নড়বে না। এমন কী বয়স? একটু গতর নাড়াতে তো পারে। তাহলে রাণুর এত খাটনি হয় না।
সব সমান। যেমন ঘরে, তেমন বাইরে। ঘরের কাজ সেরে বাইরে ডিউটি। সেখানে মায়া মমতার জায়গা নেই। যা আছে শুধু খাটনি। তার বিনিময়ে পারিশ্রমিক। আর খাটনির কোটা অসম্পুর্ণ থাকলে পয়সা নেই। পড়ে থাকবে অভিযোগ। গালমন্দ।

ভারী হয়ে ওঠা শরীরে অবসাদ গ্রাস করে।

গতকাল ট্রেনে আলোমাসিমা খুব বকাবকি করল। “এইবার ক’দিন ছুটি নে রাণু”, রাণুর বলতে ইচ্ছে করে না ওর কোনও ছুটি নেই। চাকরি থেকে ছুটি দিলে সংসার সেই ফাঁকে জরজবরদস্তি ঢুকে পড়ে। একের পর এক ঝামেলা ঘাড়ে এসে পড়ে। তখন আর কথাই বলতে ইচ্ছে করে না। কেবল ঘুম পায়।

মজে যাওয়া পুকুরের ধারে যে বুড়োটা বসে থাকে, সে জুলজুল করে তাকায় রোজ। ওর একটা পা কাটা পড়েছে। রেলের হকার ছিল। বেকায়দায় পড়ে গেল একদিন। একটা পা চলে গেলে যে শরীরটা পড়ে থাকে, তার ডাকনাম নুলো, ভালো নাম পঙ্গু। তাকে আর কেউ কাজেকর্মে ডাকে না। বসে থাকতে থাকতে একদিন সে অথর্ব হয়ে পড়ে। তরতাজা টাটকা মানুষের ভিখিরি হয়ে যাওয়ার সেই শুরু।

ওকে দেখে আগে করুণা হত। কিন্তু করুণা বেশিদিন বয়ে চলা যায় না। ভার হয়ে চেপে বসে, কিছু না কিছু সুবিধে আদায় করে নেয়। প্রথম প্রথম যেমন টাকা দিত। চিকিৎসা করালে কাটা পায়ের জায়গায় নতুন পা গজিয়ে যাবে, এমন কল্পনা পাগলেও করে না। তবু দিত। হোক চিকিৎসা। একটু ওষুধ খাক, পথ্য পাক। ধীরে ধীরে টাকার হাত কমল। তখন মাঝেমধ্যে খাবার। ভালোমন্দ রান্না করলে অল্প দিয়ে আসা। এখন সব বন্ধ। কে যেন একদিন বলেছিল, “প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বসলে তো পারে”, শুনে অস্বস্তি হয় রাণুর। একটা জ্যান্ত লোক স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বসে থাকলে তার কষ্ট হবে না? যে লোক রোজ ছুটে ছুটে ট্রেনে উঠত, এক কামরা থেকে আর এক কামরা অক্লান্তভাবে যাওয়া আসা করত, কাকভোর থেকে মাঝরাত অবধি ফিরি করত হরেক মাল, সে চুপচাপ ইস্টিশনে বসে দেখবে সকলে ছুটছে...। কী আজব!

রাণু যেমন। পাঁচ মাসের ভরা শরীর তাকে ক্লান্ত করে দেয় তাড়াতাড়ি। অথচ এতকাল সে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটত।
রান্নার জায়গায় গিয়ে গা গোলায়। রান্নার গন্ধ, কাঁচা মাছের গন্ধ, পেঁয়াজ রসুনের ঝাঁজে তার গা গুলিয়ে আসে। এক টুকরো লেবু নাকের কাছে এনে শোঁকে, আর কাঁচা আনাজ মাছ রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে উদ্গত বমি চেপে সকলের খাবার ব্যবস্থা করে।
ট্রেনে গতকাল মীরাদি অদ্ভূত একটা কথা বলল। “এই সময় অনেকের ব্লাড শুগার ধরা পড়ে, একবার টেস্ট করিয়ে নিস,” আর রাণু শুনতে শুনতে ভাবছিল ওর তো কবে থেকেই...। ইনসুলিন নিত্যসঙ্গী। মীরাদি জানে না। এই রাস্তায় নতুন আলাপী। সব খুঁটিনাটি জানার বা জানানোর অবসর হয়নি। ম্লান হেসে ঘাড় কাত করে রাণু।
কত দেরি হয়ে গেল। এই গুষ্টির পিণ্ডি রান্না করে সব ভাগে ভাগে গুছিয়ে... মায়ের সকালের জলখাবার, বরের টিফিন, দুপুরে মা কী খাবে... মাত্র তিনটে লোকের সারাদিন ধরে এত রকম খাবারের বায়নাক্কা। রাণুর বর সকালেই বেরোয়। তাকে টিফিন গুছিয়ে, ঝোল-ভাত খাইয়ে কাজে পাঠাতে হয়। সে একটিবারের জন্যেও জিগ্যেস করে না, “তুমি নিজের টিফিন গুছিয়েছ? দুপুরে কী খাবে? তোমার ভাতের থালাটাও নাও না একসঙ্গে, দু’গাল খেয়ে নাও বরং...” দূর। এই সব আহ্লাদী জীবন রাণুর নয়। মা’কে এই সময় কাছে এনে রেখেই বা কী লাভ হল? তাকেই চারবেলা যত্নআত্তি করতে হচ্ছে। পাকা পেয়ারা কেটে বাক্সে গুছিয়ে, খই দুধ কলা সামনে সাজিয়ে, দুপুরের ভাতটাও পারলে বেড়ে রেখে দিয়ে যায় রাণু।
গা গুলিয়ে উঠলে অল্প জোয়ান গালে ফেলে রাণু। ছুট ছুট ছুট। ন’টা কুড়ির ট্রেনটা আজ পেলে হয়।
....................................................................................
কামরায় আজ একটা জানলার ধারে ওকে বসতে দিল মীরাদি। চোখমুখ দেখেই ডেকে নিল নিজের জায়গায়।
“আজও খাসনি কিছু, তাই না?”
“দূর, এত গা গোলায়...”
“যা ভালো লাগে, তাই খাবি, বেশি করে খাবি। আমি তো এই সময় শুধু আলুসেদ্ধ মাখা খেতাম। আমচুর দিয়ে মেখে। অবশ্য শাশুড়ি খুব যত্ন করেছেন, এটাসেটা মুখের সামনে তুলে ধরেছেন...”
রাণু ভাবে, মুখের সামনে তুলে ধরার লোক না থাকলেও চলে। মুখের সামনে তুলতে বললেই ও ধন্য হয়ে যেত। সেটুকুও কেউ ফিরে দেখে না...
“মধু নেবে গো, খাঁটি মধু, চাকভাঙা মধু... হাতের পাতায় নেবে, মুখে রাখবে, জীবনে বেঁচে থাকবে শুধু মিষ্টি...”
এই সময় যত হকার ওঠে, সবার নাম ধাম ওদের মুখস্থ। এ আবার কে?
শ্যামলা দোহারা চেহারা, আধময়লা ফতুয়া আর পাজামা। কাঁধে ঝোলাব্যাগ।
কামরায় সকলেই ফিরে তাকাচ্ছে। খালিহাতে একটা লোক মধুর গুণগান বর্ণনা করে চলেছে, হাসিটাও মিষ্টি।
“এভাবে নেবেন বাঁ হাতের পাতায়, এক চামচ। তারপর জিভ দিয়ে চেটে খাবেন। অনেকক্ষণ ধরে খেতে হবে। একবারে খপ করে মুখে ফেলে ঢক করে খেয়ে ফেলার বস্তু তো এ নয়। তাহলে উপকার পাবেন না। মধু খেলেন অথচ মধুর উপকার পেলেন না, তবে কিনলেন কেন? খেলেন কেন? আসুন মধু খান, মধু মাখান, মধু মাখুন...”
কানের কাছে ক্রমাগত মধুর গুণগান শুনতে শুনতে কেমন যেন অস্থির লাগে রাণুর। কীসের উপকার, অ্যাঁ? কাটা পা জোড়া লাগবে? ওর বুড়ি মায়ের আলস্য কাটবে? ওর বরের উদাসীনতা? প্রাইভেট কোম্পানির মালিকের মুখে হাসি? আর ওর একরাশ অবসাদ আর বিষণ্ণতা?
অনেকেই ডাকছে ওকে।

“ফুল যেমন আলাদা, তার মধুও আলাদা। মধু যেমন আলাদা, তার কাজকর্মও আলাদা...”
লোকটা বলেই যাচ্ছে।

মানুষও তো আলাদা। সমস্যাও। বাঁ হাতের পাতায় নিয়ে জিভ দিয়ে চেটে খেলে মিটবে তো? রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়েকমে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে কে জানে...
রাণু ডাকে, “এদিকে একবার আসবেন?”

৩টি মন্তব্য:

  1. শ্যামলী প্রতিবারের মতনই মুগ্ধ হলাম। ঠাকুরমা বলতেন গুনের রাধুনীর শাক ভাজাও লোকে চেটে খায়। তোমার লেখাও তেমনি। কতো ছোট্ট বিষয়ের উপর কি অসাধারণ লেখন❤️

    উত্তরমুছুন
  2. খুব ভালো শ্যামলী । কি সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে লেখা

    উত্তরমুছুন
  3. গল্প এগোতে এগোতে যখন মধু বিক্রির ভাষ্যে এসে পৌঁছল, তখন অন্যমাত্রা পেয়ে গেল। প্রথম থেকেই সুন্দর গতিময় ছিল। শেষে এসে গল্পটা দুর্দান্ত বাঁক নিল।

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র