যুগান্তর মিত্র - মায়াজম

Breaking

২৪ জুন, ২০২৩

যুগান্তর মিত্র

           গড়িয়ে পড়ছে মধু  





বিকেলটা হেলান দিয়েছে সন্ধ্যার গায়ে। পার্কের সামনের দিকে ঘাসের ওপর অপূর্ব এক আলো শুয়ে আছে যেন। সেই মায়াময় আলোর থেকে খানিকটা দূরে নিমতলার নীচে আমি একলা বসেছিলাম। হঠাৎই চোখ পড়েছিল বিপুলদার দিকে। কিছু-একটা ভাবতে ভাবতে আপন মনে হেঁটে চলেছে। অন্যসময় হলে আমি বিপুলদাকে ডাকতাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে ডাকতে ইচ্ছে করল না। তবে আমি দেখতে পাছিলাম একটা কলসের গা চুঁইয়ে মধু গড়িয়ে পড়ছে, স্পর্শ করছে মাটি।
মধু গড়িয়ে পড়ার কথাটা বিপুলদারই। বছর দুয়েক আগে এইরকম এক বিকেলে ঠিক এই জায়গাতেই বসেছিলাম আমি আর বিপুলদা। সন্ধ্যার স্বপ্নমাখা আলোয় ভরে যাচ্ছিল আশপাশ। সেইসময় বিপুলদা বলে উঠেছিল, ‘ঐ দ্যাখ মধু গড়াইতাসে। এইবার মাটিতে পড়ব। কিন্তু সেই মধু মাছি আর পিঁপড়া ছাড়া কেউ খাইব না।’
বিপুলদার কথায় ঘুরে তাকিয়েছিলাম রাস্তার দিকে। দেখেছিলাম সাত্যকি আর তনুশ্রী পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই গায়ে গা ঠেকছে। দৃশ্যটা সত্যিই সুন্দর! আমাদেরই অনুজ-অনুজা ওরা। ফলে ওদের পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া দেখতে ভালো লাগারই কথা। কিন্তু বিপুলদার কথার মধ্যে অন্যরকম ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। বিপুলদা যখনই কোনও ঘটনার কথা বলে, তার মধ্যে যদি তেমন কোনও গল্প লুকিয়ে থাকে, তখনই মধু গড়ানোর কথাটা বলে। আমরা যারা বিপুলদাকে চিনি, তারা জানি, এইবার বিপুলদা গল্পের ভেরতের কোনও গল্প বলবে। এইরকম সময় নড়েচড়ে বসি আমরা, মানে যারা বিপুলদার কাছাকাছি থাকি। তাই সাত্যকি-তনুশ্রীর মধুর প্রেমের দৃশ্যের সঙ্গে মধু গড়ানোর সম্পর্ক আছে বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু সেই মধু গড়িয়ে মাটিতে পড়বে আর সেটা পিঁপড়ে আর মাছি ছাড়া কেউ খাবে না, মানে কী? অথচ সেদিন বিপুলদা নিজের কোনও ‘সিরিয়াস’ কথা বলার জন্যই আমাকে ডেকেছিল! কিন্তু সে তখন ভাবলেশহীন তাকিয়ে আছে অন্যদিকে, যেন কিছুই বলেনি কোনও ব্যাপারে। কিংবা নিমতলার নীচের বেদিতে বসে বিকেলের মৃদুমন্দ হাওয়া উপভোগ করছে।
সাত্যকি আমার ভাইয়ের বন্ধু। আমাদের বাড়িতে একসময় খুব আসত। ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ব্যাঙ্গালুরুতে চলে যাওয়ার পরে আর আসেনি। তবে দেখা হয় পথেঘাটে। মুখোমুখি হলে বা চোখে চোখ পড়লে হাসি বিনিময় হয়। এটুকুই যা যোগাযোগ আছে ওর সঙ্গে। অন্যদিকে তনুশ্রী, যার ডাকনাম তনু, তাকেও ভালোমতোই চিনি। আমাদের পাড়াতেই ওদের বাড়ি। চম্পকদার মেয়ে। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদে চাকরি করত চম্পকদা, হয়তো সেজন্যই একটু অহংকারও ছিল। কাউকে পাত্তা দিতে চাইত না। তাই আমরা ওনাকে এড়িয়ে চলতাম বরাবরই। তবে তনু পড়াশোনায় ভালো আর খুব সুন্দর গান করে বলে ওর প্রতি আলাদা স্নেহ আছে আমার মতো অনেকেরই।
এক পাড়ার ছেলেমেয়েদের অনেক সময়ই প্রেম জমে ওঠে। সেই প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় অনেকেরই। আবার ভেঙেও যায় নানা কারণে। বিপুলদার ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছিল। অন্যদিকে প্রেমের ব্যাপারে আমি বরাবরই আনাড়ি। ফলে কোনও সম্পর্কই গড়ে তুলতে পারিনি; পাড়ায় বা বেপাড়ায়। ফলে বিয়ে করাও হয়ে ওঠেনি। দাদা-বউদি আর একমাত্র ভাইপোর সংসারে নিজেকে দিব্যি গুঁজে দিয়েছি।
আমার বুকের হাওয়ায় বিপুলদার কথাগুলো নড়েচড়ে বেড়াচ্ছিল। তাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘মধু গড়াচ্ছে তো বুঝলাম। কিন্তু মাটিতে পড়ছে মানে কী?’
—ওদের সম্পর্কে তুই বোধহয় কিছুই জানিস না! অবশ্য জানার কথাও না। আশপাশেরও কেউই তেমন জানে না। চেপেচুপে থাকে পুরো পরিবারই। আরে বাবা, পাশাপাশি হাঁটলেই কি সম্পর্ক ভালো হয়? বাড়িতে নিত্য লাঠালাঠি করে ওরা। পথে লোকদেখানো মিলমিশ দেখাচ্ছে!
আমি একটু বিস্মিতই হয়েছিলাম কথাটা শুনে। ওদের প্রেমের দিনগুলো বেশ মনে আছে। সাত্যকি-তনুশ্রীর গভীর প্রেম সেইসময় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। এমনকি তনু তো বাবার অনুমতি পায়নি বলে রাগারাগি করে ঘরও ছেড়েছিল। তারপর সেই রাতেই বুঝিয়ে-শুনিয়ে মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছিলেন চম্পকদা আর বৌদি। মধ্যস্থতা করেছিল পাড়ার সবুজ সঙ্ঘ। ক্লাবের ছেলেদের চম্পকদা কথা দিয়েছিলেন মেয়ের বিয়ে দেবেন সাত্যকির সঙ্গে।
জাতপাত মেনে নিতে পারে না বলে ছেলে বা মেয়ের বিয়েতে আপত্তি জানাতে শুনেছি। কিংবা বেকার ছেলের হাতে মেয়েকে দেবে না বলে বেঁকে বসার কথাও শুনেছি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরে হয়ে রাজ্য সরকারি কর্মী ছেলের হাতে মেয়ে দেবেন না, এমন গোঁ ধরে-থাকা শুনিনি। অন্য কেউ শুনেছে বলেও মনে হয় না। অথচ সাত্যকি বেশ বড়সড় পদে চাকরি করে। ফলে এই নিয়ে তখন জমজমাট আলোচনা হত নানা জায়গায়। মনে থাকার মতোই ঘটনা। আমার মতোই সকলেই চম্পকদাকে দুষেছিল। সেই প্রেম এত তাড়াতাড়ি হাওয়ায় মিশে গেল? ভাঙনের ঢেউ এসে লাগল? অবাক না-হয়ে পারিনি। বিপুলদাকে অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। কেননা বিপুলদা বানিয়ে বলার মানুষ নয়। তাছাড়া ওদের বাড়ির পাশেই থাকে সাত্যকিরা। তাই ভুল খবর হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। ব্যাপারটা ঠিক কীরকম পর্যায়ে আছে জানার জন্য কৌতূহল ভাসিয়ে দিয়েছিলাম বিপুলদার দিকে, ‘ঘটনাটা কী শুনি।’
—কী আবার হবে? তোদের ঐ স্যোসাল মিডিয়াই যত নষ্টের গোড়া। সব ব্যাটা ফেসবুকে বাড়তি কথা লেখে আর অন্যরা মনে করে বিরাট কিছু তালেবর যেন!
ওদের সম্পর্ক ভাঙনের মুখে এসে পড়ার সঙ্গে স্যোসাল মিডিয়ার কী ধরনের যোগসাজশ আছে বুঝতে পারছিলাম না। তাই চোখেমুখে জিজ্ঞাসা ঝুলিয়ে রেখেছিলাম, যার অর্থ, ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলো তো!
বিপুলদা একটা বিড়ি ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ধীরে ধীরে জানিয়েছিল নেপথ্য কাহিনী। সাত্যকির সঙ্গে ফেসবুকে আলাপ হয়েছিল এক মহিলার। কোন এক স্কুলের দিদিমণি। সেও বিবাহিতা। তার সঙ্গে প্রেম জমে গেছে। সেটা আবার তনুশ্রীর কাছে ধরাও পড়ে গেছে। এই নিয়েই নিত্য তুমুল ঝামেলা। এমনকি এ-ওর গায়েও হাত তোলে। সাত্যকি আর তনুশ্রীর বাড়ির লোকও নাকি জড়িয়ে গেছে এর মধ্যে।
কথাগুলো শুনে ভাবছিলাম, বিপুলদার ক্ষেত্রে তো স্যোসাল মিডিয়া পাঁচিল হয়ে দাঁড়ায়নি! তাও তো অনিমাদির সঙ্গে সম্পর্ক টিকল না! আমার ভাবনার মধ্যেই বিপুলদা বলে উঠেছিল, ‘ওদের সম্পর্কটা টিকবে না বেশিদিন, মিলিয়ে নিস।’
—সবকিছু মিটমাট হয়েও যেতে পারে। এইসব ইনফ্যাচুরেশন কেটে যেতে একটু সময় লাগে ঠিকই, কিন্তু মিটেও যায়। আমি মৃদুস্বরে বলেছিলাম।
—ছাড় ওদের কথা! তোকে যেজন্য ডেকেছি, সেটা শোন।
মধু গড়ানোর ঘটনাটা থেমে গেল বলে একটু হতাশ হলেও বিপুলদার প্রসঙ্গ শোনার জন্য আগ্রহী হয়েছিলাম। সেদিন সকালেই বাজারে যাওয়ার পথে বিপুরদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেইসময় প্রায় ফিসফিস করে বলেছিল, ‘বিকালে একবার নিমতলায় আসিস তো, কথা আছে। আমার ব্যাপারেই। অন্য কাউরে তো আর কইতে পারি না এইসব, তোরেই কওয়া যায়।’
বিপুলদা যখন কোনও গভীর বিষয় বলে, তখন কেন জানি না বাঙাল ভাষায় চলে যায়। এমনকি মধু গড়ানোর কথাটাও বাঙাল ভাষাতেই উচ্চারণ করে। আমি বলেছিলাম, ‘অবশ্যই যাব। তোমার সঙ্গে অনেকদিন আড্ডাও হয় না। কখন যেতে হবে বলো!’
—সাড়ে পাঁচটা কি ছটায় আয়। তবে এটা কিন্তু সিরিয়াস ব্যাপার। মনে রাখিস।
নিমতলায় আসতে আসতে পৌনে ছটা হয়ে গিয়েছিল আমার। দূর থেকেই দেখেছিলাম বিপুলদা বসে আছে।
বিবেকানন্দ পার্ক হল আমাদের এলাকার সবচেয়ে বড় পার্ক। অনেকেই ভোরে হাঁটতে আসে এই পার্কে। বিকেলে আবার প্রেমিক-প্রেমিকাদেরই ভিড় বেশি হয়। বেপাড়ার প্রেমিক-প্রেমিকার পাশাপাশি পাড়ার কেউ কেউও আসে। আবার স্বামী-স্ত্রীরাও আসে। পার্কের পেছনের দিকের দেয়াল ঘেঁষে একটা বড়সড় নিমগাছ আছে। পুরসভা থেকে তার নীচটা গোল করে বেদি বানিয়ে দিয়েছে। সেই বেদিতে যদিও আমি আর বিপুলদা ছাড়া তেমন কেউ বসে গল্পটল্প করেনি কখনও। ফলে এটা ছিল আমাদেরই আড্ডার জায়গা।
যথাসময়ে গিয়ে বেদিতে বসার সঙ্গে সঙ্গেই সাত্যকিদের প্রসঙ্গটা এসেছিল। তারপর চলে এসেছিল নিজের প্রসঙ্গে।
—তুই তো সবই জানিস বাপ্পা আমার আর অনিমার ব্যাপারে। যে অভিযোগে অনিমা আমাকে ছেড়ে চলে গেল, সেটা ভুল ছিল। একেবারে প্রমাণিত।
—মানে? প্রমাণ পেলে কী করে? আমি ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম।
বিপুলদা মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ নীরব থেকেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই চুপ করে ছিলাম।
—ওই দ্যাখ ঘটিগরম যাচ্ছে। দুটো ঘটিগরম নিই। খাবি তো?
প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষা না-করে হাঁক পেড়ে ঘটিগরমওয়ালাকে ডেকেছিল বিপুলদা। দুটো ঘটিগরম বানাতে বলে পার্কের দিকে তাকিয়ে বসে থেকেছিল অনেকক্ষণ। আমি অদ্ভুত কায়দায় ঘটিগরম বানানোর কৌশল দেখতে দেখতে ভাবছিলাম বিপুলদা আর অনিমাদির কথা।
এক পাড়াতেই থাকত দুজন। অনিমাদি আমার ছোটপিসির ক্লাশফ্রেন্ড হলেও আমি প্রথম থেকেই অনিমাদি ডাকতাম। এক পাড়াতে থাকত বলেই শুধু নয়, অনিমাদির ভাই আমার বন্ধু বলেও। আমি আর অনিমাদির ভাই অন্তু একই স্যারের বেচে পড়তাম। দুজনের স্কুল আলাদা হলেও এক ব্যাচের বলে বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল। সেই সুবাদে আমার যাতায়াত ছিল ওদের বাড়িতে। বিপুলদার সঙ্গে অনিমাদির প্রেমের সূচনা থেকেই আমি জানতাম। বিপুলদা আমার থেকে বয়সে বেশ বড় হলেও অনেক সময়ই বিপুলদা আর অনিমাদির চিঠি চালাচালি করেছি আমি। বিপুলদা ভালো মানুষ। তাছাড়া মোটামুটি ভালো চাকরি করে বলে বিয়েতে বাধা আসেনি। যদিও সেই বিয়ে বছর সাতেক পরে ভেঙে যায়। দুজনের কেউই আর বিয়ে করেনি। সেইসময় বিপুলদা আর অনিমাদিকে একদিন ডেকে নিয়ে গিয়েছিলাম খানিকটা দূরের এক কাফেটেরিয়ায়, যাতে আমাদের আলোচনায় কোনও ব্যাঘাত না-ঘটে, পরিচিত লোকজন আলোচনার কোনও সংলাপ-টুকরো শুনে না-ফেলে।
—দ্যাখো বিপুলদা, ছেলেপিলে অনেকেরই হয় না শুনি। তা বলে এই নিয়ে নিজেদের সম্পর্ক ভেঙে দিতে হবে? আমি সরাসরি বলেছিলাম কথাটা।
—আমি তো ভাঙতে চাই না! তোর অনিমাদিকে বল।
একের পর এক নানা যুক্তি দিয়েছিলাম সেদিন। অনিমাদি সব শুনেছিল। চোখ ছিল মাটির দিকে। বিপুলদা একবার আমাকে, একবার অনিমাদিকে দেখে যাচ্ছিল নিশ্চুপে। অনিমাদি কিছুক্ষণ থম মেরে বসেছিল উল্টোদিকের চেয়ারে। তারপর খুব গম্ভীরভাবে বলেছিল, ‘তোর সব কথাই শুনলাম বাপ্পা। তোর যুক্তিগুলো মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল। একবার ভাবলাম ঠিকই বলছিস। পরেই বুঝলাম যুক্তিগুলো বড্ড খেলো। যে ভুক্তভোগী, তার পক্ষে বেমানান। তুই বুঝবি না এসব। তাই আর কথা বাড়াতে চাই না।’
অনিমাদি আর-একবারও আমার বা বিপুলদার দিকে চোখ রাখেনি। হনহন করে হেঁটে চলে গিয়েছিল। পরে শুনেছি সেই রাতটুকু প্রায় নির্ঘুম কাটিয়েছিল দুজনেই। এর দিন দুয়েক পরে, প্রায় সারারাত না-ঘুমিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়েছে অনিমাদি। অ্যালবামের ছবি বের করে বেছে বেছে নিয়ে গেছে, যেখানে অনিমাদি একা বা বিপুলদা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে আছে। সোফায় গা-এলিয়ে সামান্য একটু জিরিয়ে নিয়েছিল। ভোর হতেই কোনও ভূমিকা ছাড়াই চলে গেছে নিজেদের বাড়িতে। বিপুলদা সবই আমাকে বলেছিল একে একে।
সন্তানের জন্য কম চেষ্টা করেনি অনিমাদি বা বিপুলদা। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে। সব ক্ষেত্রেই রিপোর্ট ছিল পজিটিভ। কারও কোনও দোষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ কিছুতেই বাচ্চা এল না! অনিমাদির নিজের রিপোর্ট নিয়ে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু বিশ্বাস করেনি বিপুলদার কথা। ডাক্তারকে ম্যানেজ করে ভুল রিপোর্ট করিয়েছে বলে মনে করত। এই নিয়েই অশান্তি। একসময় সম্পর্ক যখন ভাঙনের মুখে, তখনই আমি চেষ্টা করেছিলাম ভাঙন রোধ করতে। পারিনি। সব ছেড়েছুড়ে অনিমাদি চলেই গেল বাপের বাড়িতে। দুজনের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। তবে আমি বেশ বুঝতে পারি, বিপুলদার টান আছে অনিমাদির প্রতি। অনিমাদিরও টান আছে কিনা বুঝতে পারি না। ওদের বাড়িতে গেলে আমাকে এড়িয়েই চলে অনিমাদি। তাই তার মনের হদিশ পাইনি সেভাবে।
চুপচাপ ঘটিগরম খেয়ে যাচ্ছে দেখে অধৈর্য হয়ে বলেছিলাম, ‘চুপচাপ বসে আছো কেন? প্রমাণের ব্যাপারটা একটু খুলে বলো তো!’
যেন আমার প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিল, এমনভাবে জবাব শুরু করেছিল, ‘তুই আমার মাসতুতো দিদি শ্রেয়সীকে চিনিস না? ডাকনাম বুলি। একবার তোকে নিয়ে গেছিলাম ওদের বাড়িতে। বালিগঞ্জে। আমাদের এখানেও অনেকবার এসেছে। মনে পড়ছে?’
—হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে। জব্বলপুর না কোথায় যেন বিয়ে হয়েছে।
—ঠিক বলেছিস। সেই বুলিদির বরটা মারা গেছে মাস দুয়েক হল।
কথাটা বলেই আবার চুপ করে গিয়েছিল বিপুলদা। আমি আরও অবাক হয়েছিলাম। এইসব খবরের সঙ্গে প্রমাণের কী সম্পর্ক বুঝতে পারিনি। তাই চোখ সরু করে দেখছিলাম বিপুলদার মুখটা। তারপর নিমতলার বেদিতে নখ দিয়ে আঁকিবুকি কেটেছিলাম খানিকটা। আসলে বিপুলদাকে সময় দিচ্ছিলাম। একসময় বিপুলদা বলে উঠেছিল, ‘বুলিদির একটা মেয়ে আছে। সতেরো বছর বয়স। সেই মেয়েটা আসলে আমারও। বুলিদি বলল।’
—মানে? বুলিদির মেয়েটাই তোমার মেয়ে? কী বলছ এসব?
—হ্যাঁ রে। বুলিদি যখন রিপনদার সঙ্গে প্রেম করত, তার আগে থেকেই আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক হয়। আমার থেকে চার বছরের বড় বুলিদি। আশুতোষ কলেজে পড়ার সময় প্রায়ই যেতাম ওদের বাড়িতে। মাসি-মেসো দুজনেই চাকরি করত বলে ঘরে থাকত না। আমরা সেই সুযোগটাই নিতাম। রিপনদাও মাঝে মাঝে আসত ওবাড়ি। এর মধ্যেই বুলিদি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেল। আর তড়িঘড়ি রিপনদা বিয়ে করে নিল। রিপনদার পৈত্রিক বাড়ি জব্বলপুরে। কলকাতায় চাকরি করত। সেখান থেকেই পরিচয়। বিয়ের পরে ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেল দিল্লি। বিয়ের কয়েকমাস পরে বাচ্চা জন্মালে পাড়াপ্রতিবেশী কী বলবে, এই ভেবেই দিল্লিতে চলে গেছিল।
—সে তো বুঝলাম। কিন্তু মেয়েটা যে তোমারই, সেটা কী করে শিওর হচ্ছ তুমি?
—বুলিদি বলেছে। বাচ্চা কার সেটা মায়ের চেয়ে ভালো কেউ জানে না বাপ্পা!
—বুলিদি বললেই সেটা ধ্রুব সত্য, তা নাও তো হতে পারে! ডিএনএ টেস্ট না-করিয়ে…
—টেস্ট টেস্ট টেস্ট! সারাজীবন আর কত টেস্ট দেব বলতে পারিস? বুলিদিকে আমি বিশ্বাস করি। তবু এই ব্যাপারটা ঠিক মানতে পারছিলাম না আমিও। পরে যখন ওর বরের ডাইরি দেখাল, তখন বিশ্বাস না-করে উপায় নেই বাপ্পা।
—ডাইরিতে কী লেখা ছিল?
—ওর বর লিখেছে তার সন্তান জন্মানোর ক্ষমতা ছিল না। কী কারণে যেন ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হয়েছিল, তখনই ব্যাপারটা ধরা পড়েছিল। তবে মেয়ের বাবা কে না-জানলেও মেয়েকে মেনে নিয়েছে। যার জন্যই হোক, মেয়ে যে তার মতো অক্ষম কাউকে বাবা বলে ডাকে, সেই ডাকটুকুর জন্য অজানা বাপকে কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছে লোকটা।
—হুম। সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তুমিই যে বাবা, তার কোনও প্রমাণ কিন্তু নেই।
—দ্যাখ বাপ্পা, বারবার একই কথা বলিস না! আমি তো বললাম বুলিদিকে বিশ্বাস করি। তাছাড়া বুলিদি কি সেইরকম মেয়ে যে অনেকের সঙ্গে শুয়ে বেড়িয়েছে? স্পষ্টতই বিপুলদার চোখমুখ থেকে আগুন বেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম। তাই আর কথা বাড়াইনি। শুধু অনেকক্ষণ বাদে বলেছিলাম, ‘আমি কি অনিমাদিকে বলব ব্যাপারটা? তোমাদের তো ডিভোর্স হয়নি। হয়তো সব শুনে ফিরেও আসতে পারে। ভুল বোঝা থেকে তুমিও মুক্তি পাবে বিপুলদা!’
চোখ বড় বড় করে বিপুলদা জবাব দিয়েছিল, ‘তোর কি মাথা খারাপ! এই ঘটনার কথা তোর অনিমাদি জানলে কী মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে বুঝিস না? কোনও বউ কি মেনে নিতে পারে তার স্বামীর বিয়ের আগের বা পরের শারীরিক সম্পর্কের কথা! কোনও বউও কি বরের এইরকম ঘটনা মেনে নিতে পারে? এসব সিনেমায় হয়, বাস্তবে হয় না!
—বুলিদির বর তো পেরেছিল! পারেনি?
—সবাই এতটা বড় হৃদয়ের হয় না রে বাপ্পা। এইসব শুধু অনিমাকেই না, আর কাউকে বলিস না, প্লিজ! তাহলে আমাকে…
কথা অপূর্ণ রেখেই নিঃশব্দে বিপুলদা চলে গিয়েছিল। আর আমি দেখছিলাম মধু গড়িয়ে পড়ছে। পড়েই চলেছে। দু-হাত দিয়ে অনেক চেষ্টা করেছিলাম মাটিতে গড়িয়ে পড়া ঠেকাতে। কিন্তু পারিনি! আজও যখনই বিপুলদাকে দেখি, মধু গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য ভেসে ওঠে।

২টি মন্তব্য:

  1. মানব-সম্পর্কের অপূর্ব একটা দিক , আজ দেখালেন ভাই। চরৈবেতি।
    . চন্দ্রনাথ শেঠ।
    বাঁশবেড়িয়া, হগলি।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব ভালো লাগলো, তপন।
    সমরেন্দ্র বিশ্বাস, ভিলাই।

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র