ঘর ভাঙার খেলা
গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ আরতির নজরে পড়ল জিনিসটা - প্রথমে ওটা যে কী তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না – ছোটো লম্বাটে মতো - গায়ে বিজিবিজ করছে অনেক পোকা – গা’টা গুলিয়ে উঠেছিল। বুড়োটা গা বেয়ে উঠলে যেমন হয় ঠিক তেমনি একটা ভাব যেন - গোটা পেটটা পাকিয়ে গুলিয়ে উঠছিল।
গ্রিলের বারান্দা দিয়ে বাইরে দেখা অবশ্য একটা মাত্র সরু লাইনের মধ্যে দিয়ে। মাঝে মাঝে রং উঠে যাওয়া খেঁসটানি নীল রঙের মোটা পর্দা দিয়ে গোটা বারান্দাটা ঘেরা। এক একটা পর্দার জোড়ার জায়গার মাঝে এক চিলতে সরু ফাঁক। তার মধ্যে দিয়ে একচোখ গলিয়ে বাইরের পৃথিবীটাকে একটুখানি দেখতে পাওয়া।
বুড়ো বাড়ি থাকলে তাও বেশিক্ষণ দাঁড়াবার জো নেই, বুড়োটা রাগ করে, খামচায়, যেখানে সেখানে হাত গলিয়ে দেয় রাত দিনের মাসি বাসন্তীর সামনেই।
নোংরা হাসি হেসে বলে, " শ্লা, যৌবনকালে নতুন বিয়ে করেও এত সুড়সুড়ি হয়নি মাইরি, তোর একটা জাদু আছে জানিস! বলে না কথায়, মরা হাতি লাখ টাকা, তা আমার এই মরা জং পড়া অস্তরটা এখন বল্লমের ফলা হয়ে উঠছে মাইরি! চল ঘরে চল, খাড়া থাকতে থাকতে একদান খেলে নিই!"
বুড়োটার কাজকম্ম কী করে তা আরতির জানা নেই, তবে শুনেছে তার নাকি অনেক ব্যবসা। জেনেছে বুড়োটার কাছ থেকেই প্রথমে। ওই ব্যবসার টেন্ডার পেতেই তো...
বাসন্তীও বলেছে, খুব নাকি পয়সা বুড়োটার, মস্ত বড় ব্যবসা। নিউ আলিপুর না কোথায় যেন মস্ত বড় বাড়ি, দু তিনখানা গাড়ি।
“একেনে আসে যে কেউ জানে না, ডেরাইভার খুব বিশ্বেসী, আর আমি...বুজি না বাপু, তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেচে, কোথায় ধম্মকম্ম করবি, নাতি পুতি নিয়ে আহ্লাদ করবি, তা নয়...বলে না পুরুষ মানুষের রস চিতেয় না উঠলে মরে না! এ হচ্চে গিয়ে তাই!”
সপ্তার মধ্যে বেশ কটা দিনই বুড়োটা দিনের বেলা কাটায় এ বাড়িতেই, একটু আধটু বেরোলেই আবার ফিরে আসে। দুপুরের দিকটা ধামসাধামসির পর যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখনই একটুখানি বাইরের দুনিয়াটা দেখতে পাওয়া যায়। নয়ত একটা বারান্দা, একটা ঘর আর রান্নাঘর, এই জেলখানায় বন্দি জীবন।
অবশ্য বাইরের দুনিয়াটাও অন্ধকারই আরতির। বড্ড ঠকিয়ে দিয়েছে ওই আলো ঝলমলে রঙিন পৃথিবীটা! লোকে সেখানে হাঁটছে, গল্প করছে,সা মনের চায়ের দোকানের বাচ্চা ছেলেটা ডাঁই ডাঁই কাপ ডিস্ ধুচ্ছে-বাস যাচ্ছে, রাস্তায় অটো, ট্যাক্সি- বাচ্চার হাত ধরে মা ফিরছে- কত রকম গল্প তৈরি হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে ওই বাইরেটায় - একচোখে দেখে আর ভাবে আরতি- তার জীবনটা এমন নরক হয়ে গেল কেন?
ভাবতে না চাইলেও তখন রন্টুদার কথা মনে পড়ে।
এ বাড়িতে প্রথম চোখ মেলে বিছনায় নিজেকে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসেছিল আরতি। চিৎকার করে ডাকছিল, “রন্টুদা! রন্টুদা!”
বাসা ঠিক করবে বলেই তো বেরিয়েছিল রন্টুদা। হোটেলে ছিল দুদিন কালিঘাটে গিয়ে বিয়ে করার পর। ভাল শাড়ি কিনে দিয়েছিল দুটো। সায়া ব্লাউজ। সাজের জিনিস। তারপর ভাড়াবাড়িতে যাবে বলে সুটকেস নিয়ে একটা সাদা গাড়িতে উঠেছিল ওরা- রন্টুদা বলেছিল গাড়িটা নাকি ওর বন্ধুর।
তারপর আর কিছু মনে নেই আরতির।
খাট থেকে তাড়াতাড়ি নামতেই ঘরে ঢুকেছিল বুড়োটা।
"উঠে পড়েছ? বেশ বেশ!" বলেই ওর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল বুড়োটা। আরতির কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল।
“রন্টুদা কই? আপনি কে?”
“আমি? আমিই তো এখন তোমার সব গো সুন্দরী!”
গা দিয়ে কেমন ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছিল আরতির! সব কিছু কেমন গোলমেলে, ধোঁয়াশা!
আবার ও বলে উঠেছিল, "রন্টুদা কই?"
"কে তোমার দাদা? হে হে! নাগরদোলা দেখেছ কখনো?"
আচমকা এই প্রশ্নে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেছিল আরতি।
কিছু না বুঝে ঘাড় হেলিয়েছিল-
“নাগরদোলা যেমন একবার নিচে একবার ওপরে ওঠে, তেমনি তোমার নাগর বদলে গেছে গো! তোমার রসিক দাদা তোমার ওপর থেকে নেমেছে, এবার আমার ওঠার পালা!"
আরতি ভয়ে দরজা দিয়ে পালাতে যেতেই বুড়োটা এক ঝটকায় কোমরটা ধরে বিছানায় ফেলে দিয়েছিল।
"ছেনালিপনা অনেক দেখেছি রে! তোর নাগর এখন অনেক দূরে। অনেক দুয়ে নিয়েছে!"
"ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন আমাকে, আমি বাড়ি যাব, আপনি আমার বাবার মতো!"
অনুনয় করেছিল আরতি!
বুড়োটা হাসতে হাসতে একটানে শাড়িটা খুলে দিয়ে এক হাতের বেড়ে আরতিকে শক্ত করে ধরে সায়ার দড়ি খুলতে খুলতে বলেছিল, "তোর খোকার বাবার মতো বল! তবে হ্যাঁ ও সব ধান্দায় নেই বাপু, আজ থেকে ওষুধ খাবি---আজ যা করব টুপি পরেই! হ্যা হ্যা হ্যা!"
সারা শরীরের সব শক্তি দিয়ে ধাক্কা মেরেছিল আরতি- ফল অবশ্য কিছু হয়নি- পরমুহূর্তেই যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছিল।
তবে শরীর না মন কোনটার ব্যথা বেশি ছিল তখন আরতির?
মনে পড়ে না এখন, এই ক’সপ্তায় অনুভূতিগুলো কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গেছে-
রন্টুদা! আরতিদের পাড়ার রেশন দোকানের মালিক নন্দকাকুর ছেলে রন্টুদা, পড়াশোনায় পাড়ায় সবচেয়ে ভালো ছিল, কলকাতার কলেজে পড়ত, পাশ করে গ্রামে ফিরে এল যখন আরতি তখন মাধ্যমিক দিয়েছে- ইলেভেনের ফর্ম তুলে স্কুল থেকে ফিরছে, পথে রন্টুদার সঙ্গে দেখা।
"এত বড় কবে হলি আতু, কী সুন্দর হয়েছিস তুই! নতুকা, কাকি সব ভালো আছে?”
খুব লজ্জা করছিল আরতির, মুখে কিছু না বলে আলতো হেসে ঘাড় কাত করে দিয়েছিল।
তারপর মাঝে মাঝেই এদিকে ওদিকে আড়ালে আবডালে দেখা শোনা- তারপর রন্টুদা শহরে ফিরে গেল, নাকি মস্ত চাকরি পেয়েছে।
প্রথম প্রথম খুব ফোন না হয় মেসেজ করত রন্টুদা, কত ভালো ভালো কথা –
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর আর কলেজে পড়া হল না আরতির- বাড়িতে বাবা তখন অসুস্থ, চোখে কম দেখে - ভাইটা নাইনে উঠেছে। মা বড়ি, আচার বানাচ্ছে আর টুকটাক এটা সেটা কাজ করে আরতি যতটা পারে সামাল দিচ্ছে।
আস্তে আস্তে রন্টুদার মেসেজ কমে এসেছিল। আরতি জানাতো তখন মাঝে মাঝেই নানারকম অসুবিধার কথা, উত্তর না পেয়ে ভাবত হয়ত রন্টুদা বিরক্ত হয় রোজ তার ঘ্যানঘ্যানানি শুনে।
তাই যোগাযোগ একরকম বন্ধই হয়ে গেছিল।
বছর দুয়েক পর পুজোর সময় বাড়ি ফিরল রন্টুদা। নতুন বাইকে চড়ে এসেছে, হাতে নতুন মোবাইল, চোখে দামি সানগ্লাস!
পুজোয় রন্টুদার মায়ের পরনে নতুন গরদ, নতুন কানের দুল, সবাইকে বলছে ছেলে নাকি চাকরি ছেড়ে এখন মস্ত ব্যবসা করছে, বিরাট সব লোকের সঙ্গে ওঠাবসা। জনে জনে বলছে, “এবার ছেলের বিয়ে দেব- ভালো পাত্রী থাকলে বলবেন তো!"
আরতি নিজেই কথা বলেছিল।
প্যান্ডেলের পেছনে দাঁড়িয়েছিল, দূর থেকে রন্টুকে আস্তে আস্তে চারদিক দেখে এগিয়ে গিয়ে বলেছিল, "কেমন আছো রন্টুদা?"
রন্তু একটু পাশ কাটিয়ে চলে যাবার উপক্রম করতে মরিয়া আরতি বলে উঠেছিল, "তোমার তো মস্ত ব্যবসা রন্টুদা, আমায় একটা কাজ দেবে? বাড়ির যা অবস্থা, ভাইটা যদি একটু দাঁড়ানো অবধি.. শহরে গিয়ে রান্নার কাজ বা বাসন মাজার কাজও করব, তুমি শুধু একটা ভালো বাড়ি দেখে দাও। চিনি না তো কাউকে, ভয় ভয় করে...”
বেশ মনে আছে আরতির - রন্টুদা হঠাৎ ফিসফিস করে কাছে ঘেঁষটে এসেছিল। বুকের ভেতরটা ভরা নদীর মতো ছলাৎ ছলাৎ করে উঠেছিল। এখন মনে পড়লে ওই বুকের ওই ভেতরটা উপড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে...
"এখানে কেউ দেখে ফেলবে আতু, আমি তোকে মেসেজ করব - তোর সেই আগের নম্বরটাই আছে তো, অনেকদিন যোগাযোগ করতে পারিনি রে- রাগ করিস না! এত ব্যস্ত জীবন, নাওয়া খাওয়া ঘুমই ঠিকমতো করতে পারি না রে!”
আরতির চোখ ছলছল করে উঠেছিল, উদয়াস্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম, অভাবের সংসারের নিত্য অশান্তি সবেতেই কে যেন চন্দনের প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছিল।
দড়াম করে দরজায় আওয়াজ হল একটা। তাড়াতাড়ি পরদা থেকে সরে এল আরতি- বুড়োটা একটু বেরিয়েছিল – ফিরে এল বোধহয় -
না বাসন্তী। পান আনতে গেছিল। বুড়ো বলেছে একমিনিটও আরতিকে চোখের আড়াল না করতে- তাও বাসন্তী বাইরে যায় - পান খেতে। বুড়ো যদি এসে জানতে পারে ওকে একা রেখে বাসন্তী পান খেতে যায়, দেবে একেবারে। তার মানে বুড়ো এক্ষুনি আসবে না, তবে বাসন্তী তালা মেরে যায় বাইরে থেকে।
তবে শুধু বাড়ি থেকে পালাবার জন্যে নয়, ইহলোক থেকেও যাতে পালাতে না পারে আরতি তার জন্যেই বাসন্তীকে রেখেছে বুড়োটা।
সেই প্রথম দিনটাতে যখন বুঝতে পেরেছিল যে পালাবার সব রাস্তা বন্ধ, মরতে চেয়েছিল আরতি- মা বাবা ভাই সবার মুখটা মনে পড়ছিল- কিন্তু সব থেকেও কেউ নেই তার- আর কোন মুখে দাঁড়াবে সেখানে গিয়ে- সারারাত কেঁদে কেঁদে সকালে রান্নাঘরে একটার পর একটা দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে যাচ্ছিল।
মরা আসলে অত সোজা নয়, এটা সেদিন এক একটা কাঠির জ্বলা নেভার মধ্যেকার সময়টাতে বেশ বুঝতে পারছিল আরতি- মনে তখন জাগছিল প্রতিহিংসার জ্বালা!
ঠিক এই সময় বুড়োটা এসে গেছিল, টেনে একটা চড় কষিয়ে হাত মুচড়ে দেশলাইবাক্সটা কেড়ে নিয়েছিল।
“মরবি শালি! মজা দেখাচ্ছি! এত সহজে এই সমাদ্দারের হাত থেকে পার পাবি ভেবেছিস? তোর নাগরকে বড় টেন্ডার পাইয়ে দিয়েছি কি আঙুল চুষবো বলে?” বলেই হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে এনে ঘরে মধ্যে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
সেই দিন থেকেই বহাল হয়েছে বাসন্তী। এ নাকি আগে বুড়োর শয়নসঙ্গী ছিল, এখনো পছন্দমতো কেউ না থাকলে বুড়োকে সঙ্গ দেয় বাসন্তী।
"ডবকা ছুঁড়ি পেয়ে রসে মজে আছে, নইলে একসময় তো উটতে বসতে আমিই ছিলুম চক্ষের মণি- এখনো সবরে অবসরে ডাক পড়ে - বুড়োর তো বাই খুব---"
বাসন্তীকে ঢুকতে দেখে ইশারায় ডাকল আরতি, "ওগুলো কী মাসি, কত পোকা!"
"ওমা, এ যে দেকি মৌমাছি চাক বাধতেছে গো!” একগাল হেসে চোখ মটকে বলে বাসন্তী, “বুজলি ছুঁড়ি, ওরাও টের পেয়েছে এই বাড়িটাও মদুর চাক!”
“মৌমাছি আমি চিনি! এগুলো তো ছোট ছোট!”
“আরে কত জাতের মৌমাচি আচে তা কি তুই সব জানিস? এরা মৌমাচিই! ভগমানের কী লীলে দেখ...” দার্শনিক হয়ে যায় বাসন্তী, “এই ইট কাটের জঙ্গলেও কেমন চাক বাধতেছে, পোকা মাকড় থেকে মানুষ পজ্জন্ত সবারই ঘর বাঁধার বড্ড শখ রে, মরলুম তো ওই স্ববনো দেকেই..."
বলতে বলতে হাই তোলে বাসন্তী, তুড়ি মারতে মারতে বলে, “যাই ভাত বসাই, কী খাবি ডিমের মামলেট না ডালনা?”
কথা সব কানে ঢোকে না আরতির। ঘর বাঁধছে ওরা? তিল তিল করে ফুলের মধু বুকে করে এনে জমাচ্ছে? নিজের মনের সবটুকু মধু দিয়েই তো একটা ঘর বাঁধতে চেয়েছিল আরতিও একদিন!
সেদিন রাতেই রন্টুর মেসেজ পেয়েছিল।
"তোকে অমনভাবে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল রে আতু, কিন্তু তোর মতো মেয়ে লোকের বাড়ি কাজ করবে? সেটা কি হয়? আমি দেখছি কী করা যায়। আর তোকে কি কলকাতায় যেতে দেবে তোর বাপ মা?”
“কাজ হলে নিশ্চয়ই দেবে। আমি সকালবেলা বেরিয়ে বিকেল বেলা ফিরে আসব তো! কত লোকই তো যায়!”
“আরে অত সোজা নয়- তোর বয়েসি একটা মেয়ের কত ঝুঁকি তা জানিস তুই?”
“কত মেয়েই তো করে- তুমি একটা দেখে দাও...”
“আরে আমারও তো একটা প্রেস্টিজ আছে না কি?”
“মানে?”
“তোকে আমি কত ভালোবাসি জানিস না বুঝি?”
টপটপ করে চোখ দিয়ে জল পড়েছিল আরতির, বড় সুখের কান্না!
ফোনে টাইপ করা বন্ধ করে ফোন করেছিল, “সত্যি বলছ?”
“এর চেয়ে বড় সত্যি আর হয় না রে। পুজো কাটলেই একটা ব্যবস্থা করব, যত তাড়াতাড়ি...”
কালীপুজো ভাইফোঁটা অবধি টানা গ্রামেই ছিল রন্টু-- স্বপ্নের মতো দিনগুলো -শরতের মেঘের মতো হালকা মন-
নভেম্বরের মাঝামাঝি পাকাপাকি কলকাতায় ফিরে গেছিল রন্টু- কিন্তু মেসেজ বা ফোন করা বন্ধ করেনি।
ডিসেম্বরে একদিন রন্টু বলল, "বাড়িতে খুব বিয়ে বিয়ে করে তাড়া দিচ্ছে রে, চল বিয়েটা করে ফেলি!?"
আকাশ থেকে পড়েছিল আরতি। মাথা কেমন কাজ করছিল না আকস্মিক এই প্রস্তাবে।
"বিয়ে? কী বলছ? বাড়িতে না জানিয়ে?”
“তুই কি ভাবছিস বাড়িতে জানালে আমার মা তোকে বরণডালা নিয়ে ঘরে তুলবে?”
“না না ,এমনটি তুমি কোরো না, বাড়িতে বুঝিয়ে বললে রাজি হবেন না ওঁরা”
“মাথা টাথা খারাপ আছে তোর। চল কলকাতায় গিয়ে বিয়েটা করে ফেলি, কলেজেও পড়তে পারবি, তারপর কাজের চেষ্টা করা যাবে, হায়ার সেকেন্ডারি পাশকে আর কে চাকরি দেবে বল, বাচ্চা ধরা বা রান্না এছাড়া কাজ তুই পাবি না! এখন আমাকেই না হয় রান্না করে খাওয়া!”
আরতির মনে সুখ ছড়িয়ে পড়ছিল, তবু বলে উঠেছিল, “কিন্তু বাবা, মা, ভাই..ওদের কী হবে?”
“আরে এত চিন্তা করছিস কেন? আমি আছি না!”
“তুমি!”
“হ্যাঁ! আমারও তো একটা দায়িত্ব আছে তোর পরিবারের ওপর, না কি?”
“কিন্তু তোমার বাড়িতে?”
“আরে আস্তে আস্তে ম্যানেজ করে নেব সব! তোকে গ্রামে ছেড়ে রেখে আসতে ভালো লাগে না রে- খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তোর ইচ্ছে করে না ঘর বাঁধতে?”
ঘরের নেশা বড় নেশা! এই মৌমাছিগুলোরও কি সেই নেশা লেগেছে? নেশা লেগেছে কেমন যেন আরতিরও !
রোজ ঘুম ভাঙার পর পর্দা সরিয়ে দেখে, কত বড় হল ওদের বাসা। এখন আর পোকাগুলোকে দেখলে খারাপ লাগে না বরং ওদের কাজ কর্ম, ব্যস্ততা দেখে মনে পড়ে যায় সেই ছোটোবেলার কবিতা, ‘মৌমাছি মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি!’
ওদের তো আর বাধা নেই ঘর বাঁধার!
মানুষ জন্মেরই যত জ্বালা। ভাবতে ভাবতে ব্রাশে পেস্ট লাগায় আরতি, আড়মোড়া ভেঙে বাথরুমের দিকে এগোয়।
মরে যাবার ইচ্ছেটা মরে গেছিল সেই প্রথম দিনই, মনে তারপর তখন থেকে শুধু চিন্তা বদলা নেবার! একটানে যদি রন্টদার মুখোশটা খুলে দেওয়া যেত। কী বলে বেড়াচ্ছে কে জানে? মা, বাবা, ভাই সবাই কী যে ভাবছে আরতিকে! কিন্তু কী করে এই জেলখানা থেকে বেরোবে?
বুড়োটার ক্ষমতা নেই ভোগ করার, তাই হয়ত অত্যাচারটা বেশি। কত রকম নোংরা নোংরা ভিডিও দেখায়, নানা রকম ভাবে আরতিকে সেই সব ভঙ্গিমা করতে যখন বলে মনে হয়য় রান্নাঘর থেকে নোড়টা নিয়ে এসে মাথায় বসিয়ে দেয়, মনে হয় বলে, ‘নে, জম্মশোধের ভোগ বেরিয়ে যাক এবার!’
কত রকম কথা যে মনে পাক দেয়- বুড়োটাকে মেরে ফেললে পুলিশ আসবে নিশ্চয়ই, তখন যদি আরতি সব কথা বলে দেয়? ধরা পড়বে রন্টুদাও কি? কিন্তু কেউ কি বিশ্বাস করবে আরতির কথা?
মাঝে মাঝে একটা দুটো কথা বাসন্তীকে বলে। প্রথম প্রথম খুব কাকুতি মিনতি করত আরতি, “আমাকে ছেড়ে দাও মাসি, তোমার দুটো পায়ে পড়ি!”
“ওরে ব্বাবা, আমার ঘাড়ে কটা মাতা রে, ওই বুড়োর খ্যামতা কত তোর ধারণা আচে? আমার তো গদ্দান নেবেই, আর তোকে ঠিক খুঁজে বের করে আনবে! একেনে একবার ধুকলে আর বেরোবার রাস্তা নেই রে!”
আরতিকে কাঁদতে দেখে বলে, “তার চে গুচিয়ে নে বুড়োকে বলে, একন জৈবন আচে, বুড়োর কাচে যা চাইবি পাবি, জমি জিরেত, টাকা পয়সা নিয়ে নে। আমি নিয়েচি!”
আরতি শুধু ভাবে।
দিন কাটে একটা একটা।
প্রথম মৌচাকটা দেখার পর থেকে দিন পনেরো কেটে গেছে। মৌচাকটা বেশ বড় এখন। মৌমাছিদের ব্যস্ততা যেন এখন আরো বেশি।
চারদিকে তো বাড়ি আর বাড়ি, মধু আনে কোথা থেকে ওরা? জায়গাটা কোথায় তো ঠিক জানে না আরতি, কাছে পিঠে কি কোথাও বাগান আছে?
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে বুড়োটা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি আরতি।
“কী দেখছিস বাইরে, নাগর টাগর জোটাবার ধান্দা? সরে আয় শিগগির! সরে আয় বলছি!”
বলেই আরতির চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিল বুড়োটা।
বিরক্ত হয়ে আরতি পরদাটা ফাঁক করে দেখাল বুড়োকে, “কী দেখছি? দেখো দেখো! কোন পুরুষমানুষটা আছে দেখে নাও ভালো করে!”
বুড়োটা বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চেঁচাল, “বাসন্তী! বাসন্তী!”
বাসন্তী রান্নাঘরে চা ছাঁকছিল, শেষ করে এসে দাঁড়াল।
“ওই দেখ, কত্তবড় বোলতার চাক!”
“বোলতা নয় গো, মৌমাছি, কুচো মৌমাছি। অন্য এট্টা জাত!”
“মৌচাক? তাহলে মধু আছে ওখানে?”
“মদু তো এবাড়ির চারদিকে গো!” বাসন্তী চোখ টিপে একটা অশ্লীল ইশারা করে।
“একেবারে টাটকা মধু, ভাবা যায় এই কলকাতা শহরে! মধুর গুণ কত জানিস! ওই মধু আমার চাই! যৌবন বাড়ায় আসল মধু!”
“এখন কিছু কোরোনি গো! মৌমাচি ধরলে জানে মরে যাবে তুমি! অন্য জায়গায় চলে যাবে যখন, তখন চাক ভেঙ্গে এনো!”
চাক ভাঙ্গার কথাটা বুকে সজোরে বিঁধল আরতির। কিন্তু মুখে কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল ও।
পরের দিন ভোর থেকে বেশ জ্বর এসেছে আরতির। সময়টা ভালো নয়, একদিন খুব গরম তো আর একদিন খুব ঠাণ্ডা।
বুড়োটা রাতে ছিল না, তাই বিছানাতেই গড়াচ্ছিল। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
কোন রকমে উঠে বারান্দায় বেরোতেই দেখল বাসন্তী পরদা সরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“একটু আদা চা করে দেবে মাসি্? জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে!”
“বুড়োটা একটা পাষন্ড জানিস তো, নিজেকে ছাড়া কিচ্চু বোঝে না!”
“কেন গো, কী হয়েছে?”
“ওই দেখ! বাইরে!”
বাইরে তাকিয়ে আরতির মাথাটা টলে গেল, কার্নিসে, নিচে শয়ে শয়ে মৌমাছি মরে পড়ে আছে।
“মাগো! কী করে হল মাসি এমন!”
“কী করে আবার! বিষ দিয়ে মেরেছে মৌমাচিগুলোরে! কী অধম্ম মা গো! টাটকা মদু খেয়ে জৈবন ফেরাবে!”
বিষ!
বুকটা কি ফেটেই যাবে আরতির!
বুড়োটা হাতে একটা বড় জ্যারিকেন নিয়ে ঢুকল।
“বাসন্তী, এই মধুটা ভালো করে ছেঁকে বোতলে রাখ, একদিনে সব পাওয়া যাবে না। আবার কদিন পর আবার দিতে হবে, তখন আবার বেশ খানিকটা মিলবে। এই ওষুধ আর স্প্রেটাও রেখে দে সাবধানে, তালা মেরে!”
বুড়োটা বেরিয়ে গেছে। দুপুরে ভাত খেয়ে বাসন্তী ঘুমোচ্ছে নাক ডেকে। রান্নাঘরের আলমারির তালাটা মাথার ক্লিপ দিয়ে একটু ঘোরাতেই খুলে গেল। দ্রুত হাতে বিষের বোতল খুলে ছেঁকে রাখা মধুর বোতলদুটোয় ঢালতে লাগল আরতি।
ঘর ভাঙ্গার খেলা এবার বন্ধ হোক!
বলিষ্ঠ গল্প, সাবলীল চলন, অপূর্ব উপস্থাপনা
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন