মলয় চ্যাটার্জী - মায়াজম

Breaking

২৪ জুন, ২০২৩

মলয় চ্যাটার্জী

          না ধিন ধিন না





-- পর মা'য়ি, ইতনা ছোটা বাচ্চা আপন পরিবার ছোড় সকেলা?
-- ছোড় সকেলা পণ্ডিতজী। আপকো ইস বাচ্চে কো রাখলে পড়ি। আজ সে হামার পোতা কো সব জিম্মাদারি তোহর বা।
-- ঠিক বা মা'য়ি। হাম আপনে তরফ সে পুরে কোশিস করওয়ে। তোহর পোতা হামরে ঘর পে রহ কর রেওয়াজ করওয়ে। নাম কা হ্যায় ইস বাচ্চে কি?
-- ইসকা নাম আনোখে পণ্ডিত জী। আনোখেলাল মিশ্র।
এই ভারত ভূখণ্ড চিরকালই জন্ম দিয়েছে অসাধারণ সব প্রতিভার। সেই সব প্রতিভারা নিজ নিজ দক্ষতার সৌরভে মাতিয়েছেন পৃথিবীকে। সেই ধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই ১৯১৪ সালে উত্তরপ্রদেশের সকলডিহা তহশীলের তাজপুর গ্রামের এক সঙ্গীতজ্ঞ পরিবারে জন্ম নেন আনোখেলাল মিশ্র। তাজপুর গ্রাম বর্তমানে চান্দৌলির অন্তর্গত। এ পরিবার ছিল সঙ্গীতজ্ঞ, কিন্তু ছিল দরিদ্র পরিবার।
আনোখেলালের বাবা ছিলেন সেই যুগের নামী সারেঙ্গীবাদক শ্রী বুদ্ধুপ্রসাদ মিশ্র। নামী, তবে দামী নয়। সেই কারণেই পরিবারে লেগেই থাকত অভাব অনটন। তার ওপর আনোখেলালের মাত্র আড়াই বছর বয়সেই মারা গেলেন তার পিতা বুদ্ধুপ্রসাদ মিশ্র। পরিবারে অভাবের কামড় নেমে এল আরো বেশি করে। এতেই শেষ নয়। এরপর ছয় বছর বয়সে মা'ও মারা যান আনোখেলালের।
আনোখের প্রিয় দাদীমা জানকীদেবী আর দেরি করেননি মনস্থির করতে। এরপরই নিজের প্রাণাধিক প্রিয় পোতাকে নিয়ে তিনি চললেন গঙ্গা পার করে বেনারসের অভিমুখে। এসে পৌঁছলেন কবির চৌরায় বেনারস ঘরানার তখনকার ভারতবিখ্যাত তবলাবাদক পণ্ডিত ভৈরবপ্রসাদ মিশ্রের বাড়িতে। শুধুমাত্র একটিই অভিলাষ জানকীদেবীর।
বেনারস ঘরানার বাজে নিজের নাতিকে তবলা শেখাবেন। আর সে শিক্ষা হতে হবে এমন গুরুর কাছ থেকে, যিনি নিজে এই বেনারস ঘরানার তবলাবাদনে একেবারে অদ্বিতীয়।
সে গুরুও তো আর যে সে লোক নন...
স্বয়ং পন্ডিত ভৈরবপ্রসাদ মিশ্র।
পন্ডিত ভৈরবপ্রসাদ মিশ্র নিজে ছিলেন ভগৎজির গান্ডাবন্ধ শিষ্য।
আর ভগৎজি?
বেনারস তবলা ঘরানা বা বেনারসের পূরব বাজের স্রষ্টা পন্ডিত রাম সহায়জীর গান্ডাবন্ধ শিষ্য ছিলেন ভগৎজি।
পন্ডিত রাম সহায়জির অপর শিষ্য পন্ডিত ভৈঁরো সহায়জির তৈরী ফরমায়েশি চক্রধার তখন সমঝদারদের কানে অনুরণন তুলেই দিয়েছে...
"ক্রেধেন্না ঘেঘে নানা
তাড় ধার ধা
ঘেঘেতা ঘেঘেতা ঘেঘে তা
ঘেঘে দিন দিন দিন দিন
নাড় নাড় না
ধার ধাতিনা ধার ধাতিনা ধার ধাতিনা ধা"
মনোবাসনা পূর্ণ হলো জানকীদেবীর। পণ্ডিত ভৈরবপ্রসাদ মিশ্র আনোখের হাতে গাণ্ডা বেঁধে তাকে নিজের শিষ্য হিসাবে দিলেন সম্মতি। তবলার প্রশিক্ষণের জন্য গুরুগৃহেই থাকার ব্যবস্থা হলো শিশু আনোখেলালের।
আর সে রেওয়াজের সময়ও বড় কঠিন। খাওয়া ঘুম বিশ্রাম বাদ দিয়ে প্রথম প্রথম দিনে আট থেকে দশ ঘণ্টা বরাদ্দ হলো শিশু আনোখের রেওয়াজের জন্য। এভাবেই কাটলো কয়েকবছর। শোনা যায় যে এইসময় যখন একদিন রেওয়াজ করছেন আনোখেলাল, তখন সে রেওয়াজ শুনে শুধু দুদিকে মাথা নেড়েছিলেন গুরু ভৈরবপ্রসাদ মিশ্র। গুরুর এই ভঙ্গি নজরে আসে শিষ্যের। মনে জাগে সংশয়। তাহলে কী রেওয়াজ ঠিকমতো হচ্ছে না?
শুধু এই সংশয়টুকু মনে আসারই যা অপেক্ষা। সেদিন থেকে ধীরে ধীরে রেওয়াজের সময় বাড়িয়ে দিলেন আনোখেলাল। যে রেওয়াজ হতো দিনে আট থেকে দশ ঘণ্টার, সেই রেওয়াজের সময়ই এবার হয়ে দাঁড়ালো দিনে পনেরো থেকে ষোলো ঘণ্টার।
টানা পনেরো বছর ধরে পন্ডিত ভৈরবপ্রসাদ মিশ্র নিজের সমস্ত অধীত বিদ্যা দিয়ে যান শিষ্যকে। আর আনোখিলাল, প্রতিদিন কমপক্ষে চৌদ্দ থেকে পনেরো ঘন্টা রেওয়াজ ছিল তার বাঁধা। শুধু কি গুরুর দেখানো পথ ধরে একান্তে রেওয়াজ? উঁহু, সেইসময়ের বিখ্যাত গায়ক দাউজী মিশ্রর সঙ্গে সঙ্গীতে এবং প্রখ্যাত কত্থকশিল্পী শিউকুমার বাইয়ের কত্থক নৃত্যের সাথেও রেওয়াজ চলতো ঘণ্টার পর ঘন্টা।
বাজনশৈলীতে সম্পূর্ণ শুদ্ধতা এবং অসাধারণ তৈয়ারীর সাথে গুরুর শিক্ষা আর নিজের প্রয়োগ নিয়ে মাত্র ষোলো বছর বয়সেই স্টেজ পারফরমেন্স শুরু হয় আনোখেলালের।
এরপর ১৯৩২ সালে এলাহাবাদে অখিল ভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলনে মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিনি তবলায় অসাধারণ সঙ্গত করেন ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁয়ের সঙ্গে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
পণ্ডিত ভৈরব প্রসাদ মিশ্রের প্রিয় শিষ্য আনোখেলাল হয়ে উঠলেন পন্ডিত আনোখিলাল মিশ্রজী।
যদিও নিজের ঘরানা বেনারস, কিন্তু তবলার বাকি সব বন্দিত ঘরানার সাথেও স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন তিনি।
কার সাথে না বাজাননি আনোখেলাল মিশ্র। ওস্তাদ ফৈয়াজ খান, পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, বাবা আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ বিলায়েত খান, বিনায়ক রাও পটবর্ধন, ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান, পণ্ডিত শম্ভু মহারাজ, কেশরবাই কেরকর, পণ্ডিত ভীমসেন যোশী, হরিশঙ্কর মিশ্র, বি ভি পালুসকর, ওস্তাদ আব্দুল হালিম জাফর খান, সুশ্রী অলকানন্দা, নারায়ণ রাও ব্যাস, ভি জী যোগ, পান্নালাল ঘোষ, ওস্তাদ হাফিজ আলী খান, সিদ্ধেশ্বরী দেবী, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলি আকবর খান, নাসিরউদ্দিন আমিনুদ্দিন ডাগর, ওস্তাদ বিসমিল্লা খান, রসুলন বাই, হীরাবাই বরোদকর, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা, যশবন্ত রাও পুরোহিত... এ তালিকা মনে হয় গুনে শেষ করা যাবে না। সেযুগের তাবৎ কণ্ঠ আর যন্ত্রশিল্পীর সাথে সঙ্গত করেছেন তিনি।
এমনকি যখন অল ইন্ডিয়া রেডিওর ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফ মিউজিকে সুযোগ পাওয়াটাই ছিল অত্যন্ত সম্মানের বিষয়, সেসময়ও একেবারে নিয়মিত সেখানে বাজিয়েছেন তিনি।
সে যুগের সুবিখ্যাত সব তবলাবাদক যারা ছিলেন, যেমন ওস্তাদ আহমেদজান থিরকুয়া, ওস্তাদ কাদের বক্স, ওস্তাদ হাবিবুদ্দিন খান, ওস্তাদ আল্লারাখা খান, গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পণ্ডিত কণ্ঠে মহারাজ, ওঁনারা সবাই ছিলেন পণ্ডিত আনোখেলাল মিশ্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
আজরারা ঘরানায় সেসময় মধ্যগগনে বিরাজমান ওস্তাদ হাবিবুদ্দিন খাঁ সাব। নিজের ঘরানা আজরারা হলেও ফারুকাবাদের সেই বিখ্যাত বোলও তখন তার হাতে কথা বলছে...
"ধাত্রক ধিনাগ
ধেনে কতাগ ধেনে কতাগ
ধাত্রক ধিনাক ধেনে
ধেরেধেরে কেটেতাক
না তেরে কেটেতাক "
এই বোলের লগগি তিনি বাজান একেবারে নিজের স্টাইলে। এই লগগি পরে ওস্তাদ আহমেদজান থিরকুয়া খাঁ সাব এবং ওস্তাদ নিজামুদ্দিন খাঁ সাবও বাজিয়েছেন অনায়াস ভঙ্গিমায়। এমনকি গহরজানের সাথে সঙ্গত করার সময়ে এই লগগিতে ওস্তাদ নিজামুদ্দিন খাঁ সাব নিয়ে এসেছেন তাঁর গুরু এবং পিতা ওস্তাদ আজিম বক্সের নিজস্ব গৎ। আর বাজিয়েওছেন একেবারে নিজের মতো করে...
ধা থুন না না
তা থুন ধা না
ধিন নানা ধিন নানা ধিন না
নাধি নাধি নানা ধিন না
ধা তেটে ধিনাগ ধেনেকতাগ ধেনেকতাগ
ধা তেটে ধিনাগ তাক ধেরেধেরে কেটেতাক তা
তা তেটে তিনাগ তেনেকতাগ তেনেকতাগ
ধা তেটে ধিনাগ ধেরেধেরে কেটেতাক ধা
এমনকি এই লগগি বাজানোর সময় ধেরেধেরে বাজান একেবারে নিজের স্টাইলে।
দিল্লীর এক প্রোগ্রামে তখন বাজাচ্ছেন আনোখেলালজি। দর্শকাসনে একেবারে সামনের সারিতেই বসে ওস্তাদ হাবিবুদ্দিন খাঁ সাব, ওস্তাদ আহমেদজান থিরকুয়া খাঁ সাব, ওস্তাদ মসিত খাঁ সাব। কিছুক্ষন বেনারসের উঠান আর রেলা বাজাবার পর আনোখেলালজী বাজালেন একেবারে নিজের সৃষ্টি করা গৎ কায়দা...
"তা কিতে ধা
তেরেকেটেধেটে ধাগিনা ধিনাকে
ধিন না তাক ধা তেরেকেটে ধেৎ
ধেরেধেরে কেটেতাক তাকতেরেকেটে তাক
তা কিতে তা
তেরেকেটেতেটে তাকিনা তিনাকে তিননা তাক
ধা ধেরেকেটে ধেৎ
ধেরেধেরে কেটেতাক তা
তেরেকেটে কিটেতাক ধা"
চলনের গুনে সে গৎ কায়দা শুনে মনে হচ্ছে যেন কোথাও গিয়ে ফারুকাবাদ বেনারস লখনৌ পাঞ্জাব দিল্লী আজরারা, সব এক হয়ে যাচ্ছে।
বাজানো শেষ হলে দর্শকাসন থেকে উঠে এসে স্টেজে দাড়ালেন স্বয়ং ওস্তাদ হাবিবুদ্দিন খাঁ সাব। জড়িয়ে ধরলেন পন্ডিত আনোখেলাল মিশ্রজীকে।
চোখে তখন দুজনেরই জল।
পরম স্নেহে পূত্রবৎ আনোখেলালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তখন প্রৌঢ় হাবিবুদ্দিন খাঁ সাব। অস্ফুট কণ্ঠে বলেই চলেছেন...
-- জিতে রহো বেটা। দিল জিৎ লিয়া তুমনে। ম্যায় বোল রহা হুঁ বেটা, হিন্দুস্তান মে যব তক তবলা রহেগা, আনোখেলালকা নাম তবতক সর আঁখো পে লিয়া জায়গা।
পন্ডিত সামতাপ্রসাদজি ওঁনার সম্মন্ধে বলতে গিয়ে বলেছিলেন...
-- উনকা স্টাইল কা সির্ফ পৌনেহি তো হাসিল কিয়া হ্যায় ম্যায়নে। ইস জনম মে তো অউর নেহি হোগা, পর আপ সব দুয়া কিজিয়ে মেরে লিয়ে কি অগলে জনম মে উনকে স্টাইল কা কমসে কম আধা তো হাসিল কর পাঁউ।
ওঁনাকে বলা হতো "না ধিন ধিন না" -এর জাদুকর। জাদুকরই বটে...
তবলায় যখন হাত পড়তো তখন কনিষ্ঠা থাকতো বাইরে, অনামিকা শুধু ছুঁয়ে থাকতো কিনারের নিচে।
শুধু তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে তামাম শ্রোতাদের উঁঁনি মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন, আর বাজতো...
"না তিন তিন না
না তিন তিন না..."
শ্রোতারা যখন সবে বলে উঠতে যাবে কেয়াবাৎ... তখনই একেবারে বেনারসের ভঙ্গিতে লাগতো বাঁয়া...শুরু হয়ে যেত...
"না তিন তিন না -- না তিন তিন না
না ধিন ধিন না -- না ধিন ধিন না
ধেরেধেরেধেরেধেটে তেরেকেটেকিটেতাক
ধা ধেরে তেরেকেটে তেরেকেটে তিন না
না ধিন ধিন না
না ধিন ধিন না"
বিমুগ্ধ শ্রোতাদের মুখ থেকে এবার বের হতো...
-- হায় হায় হায়...মার ডালা...কেয়াব্বাত হ্যায়।
ওস্তাদ বিলায়েত খান সাবের সাথে সঙ্গতে বসেছেন আনোখেলালজী। খাঁ সাবের সেতারের মূর্ছনায় সেদিন যেন স্বয়ং রাগ মালকোষ নিজেই আবির্ভুত হয়েছেন। শ্রোতারা শুনছেন শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মতো। ঝালার সময়ে হঠাৎই পাশে তাকালেন খানসাব। আনোখেলালজীর দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বলে উঠলেন...
-- সির্ফ ইয়ে গুণীজনহি নেহি, ম্যায় ভি আপকো শুননে কা খোয়াইশ রাখতা হুঁ। ম্যায় সির্ফ টিপ পকড়তা হুঁ, অব আপ শুনাইয়ে।
এরপর টানা পনেরো মিনিট ধরে আনোখেলালজী পেশ করলেন না-ধিন-ধিন-না এবং তেরেকেটে কিটেতাক। শ্রোতারা এবং বিলায়েত খান সাব নিজেও মাথা ঝুঁকিয়ে হাততালি দিয়ে কুর্নিশ জানালেন পন্ডিতজিকে।
পরদিন খান সাবের পটশিষ্য অরবিন্দ পারেখজি যখন জিজ্ঞাসা করলেন ওঁঁনাকে...
-- আরে আনোখেজী, কাল আপ অ্যাইসা বাজায়া ক্যায়সে?
নিতান্তই সাধারণ ভাবে উত্তর এলো পন্ডিত আনোখেলালজীর থেকে...
-- আরে ছোড়িয়ে না অরবিন্দ ভাই, ওহ তো গলতিসে নিকাল গয়ে।
এই অরবিন্দ পারেখজীরই আমন্ত্রণে এক অনুষ্ঠানে এসে পন্ডিত স্বপন চৌধুরী সর্বসমক্ষে বলেছিলেন...
--সব মুঝসে ধেরেধেরে শুননা চাহতে হ্যায়। ওহ ইসলিয়ে কে আজকাল কা নওজোয়ান শায়দ আনোখেলালজী কা ধেরেধেরে নেহি শুনা হ্যায়। উনকা ধেরেধেরে কে সামনে ম্যায় তো কুছভি নেহি হুঁ।
সেটা ১৯৫০ সাল। কলকাতায় আসলেন আনোখেলাল মিশ্র।
এই কলকাতা শহরের বড়বাজারের ১০নং মল্লিক স্ট্রীটের বাড়িতে থাকেন দামোদরদাস খান্না। পারিবারিক ব্যবসা বিলিতি কাপড়ের, কিন্তু দামোদরদাস নিজে একজন সঙ্গিতানুরাগী। যদিও পিতৃদত্ত নামে তাকে কেউ চেনে না বিশেষ। তিনি পরিচিত লালাবাবু নামেই। লালাবাবুর বাবা মনোহরদাস খান্নারও ছিল গানবাজনার প্রতি অত্যন্ত অনুরাগ। তিনি নিজে ভালো সেতার বাজাতে জানতেন। প্রতি বছর কার্তিক পুজোর দিন এনাদের বাড়িতে বসতো সঙ্গীতের আসর। এই বাড়িতেই একসময় আসতেন বিষ্ণুদিগম্বর পালুসকরের মতো খ্যাতনামা সঙ্গীতশিল্পী। এভাবেই সঙ্গীত জগতের সাথে নিজের আস্তে আস্তে জড়িয়ে ফেললেন লালাবাবু।
লালাবাবুকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করে তাদের বারাণসী ঘোষ স্ট্রীটের অপর একটি বাড়িতে তৈরি হলো ক্যালকাটা মিউজিক অ্যাসোসিয়েশন। ১৯৩৭ সালের ২৫শে জুলাই লালাবাবুর এই বারাণসী ঘোষ স্ট্রীটের বাড়িতেই বসলো বিশাল মহফিল। শিল্পীদের মধ্যে উপস্থিত থাকলেন গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, হরেন্দ্রকৃষ্ণ শীল, বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, গৌরীশঙ্কর মিশ্র এবং নাট্যরত্ন গিরিশ ঘোষের সুপুত্র শ্রী সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ। আপামর বাঙালির কাছে যিনি পরিচিত দানীবাবু নামেই। এই সংগঠনে থাকতে থাকতেই লালাবাবুর মাথায় আসে অপর একটি সঙ্গীত সম্মেলনের। ১৯৪৩ সালে কলকাতার মার্বেল প্যালেসে বসে তৈরি হলো কমিটি। সে কমিটির চেয়ারম্যান হলেন মহারাজা শ্রীশচন্দ্র নন্দী, এবং সভাপতি হলেন দীনেন্দ্রনাথ মল্লিক। এই কমিটির আমন্ত্রণেই প্রথম কলকাতায় বাজাতে আসেন কেশরবাই কেরকর, বাবা আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ ফৈয়াজ খান, গাঙ্গুবাই হাঙ্গল। এরপর এই কমিটির নামই পাল্টে রাখা হয় অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্স। যা কিনা সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে লালাবাবুর মহফিল নামেই।
এরপর প্রায় দেড় দশক ধরে লালাবাবুর এই মহফিল হয়ে উঠেছিল শহর কলকাতার অন্যতম সেরা সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। একবারে প্রথমে হ্যারিসন রোডের ( অধুনা মহাত্মা গান্ধী রোড) দীপক সিনেমাহলে ( পরে নাম পরিবর্তন করে হয় গ্রেস সিনেমা) এই মহফিলের আসর বসলেও পরে স্থানাভাবে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় পূরবী সিনেমা, রক্সি সিনেমা, এবং মহাজাতি সদনে।
এই অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সের আমন্ত্রণেই কলকাতায় আসলেন আনোখেলাল মিশ্র।
কলকাতার শ্রোতা। সে বড়ই কঠিন। এই শ্রোতাদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন যারা কোনোদিন গান বাজনা কোনোকিছুর চর্চাই করেননি। কিন্তু এরা ছিলেন প্রকৃত শ্রোতা। নিজের কর্মজগৎ থেকে ফিরেই এরা ছুটতেন এমন সব মহফিলের সামনে আসনে বসে বিখ্যাত সব গাইয়ে বাজিয়েদের দেখার জন্য, শোনার জন্য। কোনোদিন চর্চা না করলে কী হয়, স্রেফ সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা আর সেই সবার গান শুনে শুনেই এনারা সবাই ছিলেন এক একজন পরিপূর্ণ কানসেন। হয়তো স্টেজের ওপর গাইতে থাকা কোনো নামকরা গাইয়েকে বলেই দিলেন মুখের ওপর "আরে পণ্ডিতজী, আপনার সা'য়ের টিপ তো লাগছেই না ঠিকমতো।" অথবা হয়তো বললেন "ওস্তাদজী আপনি গাইছেন দরবারী, কিন্তু গান্ধার তো সেই সামান্য ছুঁয়ে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে। আর ধৈবত আরো একটু খেলবে যে আপনার।" বলাই বাহুল্য যে এই ধরনের কানসেন শ্রোতাদের সবসময়ই সমঝে চলতেন গাইয়ে বাজিয়েরা।
সেই শহর কলকাতাতেই এলেন আনোখেলাল। এবং প্রথমবারেই তাঁর অসাধারণ তবলা বাদনে হৃদয় জয় করে নিলেন কলকাতার শ্রোতাদের। কলকাতা তাঁকে ভূষিত করলো সঙ্গীতরত্ন উপাধিতে।
১৯৫২ সালে আফগানিস্তানের আমন্ত্রণে ভারত সরকারের তরফে আমন্ত্রিত সদস্য হয়ে আনোখেলাল গেলেন সেই দেশে। সেখানে ওঁনার তবলা বাদন শুনে আফগানিস্তানের সম্রাট জাহির শাহ ওনাকে ভূষিত করলেন মৌসিকী-এ-তবলা-নওয়াজ উপাধিতে।
এরপর ১৯৫২ সালে দেশের সাংস্কৃতিক দূত হিসাবে গেলেন নেপালে। নিজের বাদনশৈলীতে সেখানকার শ্রোতাদের মনও জয় করলেন অনায়াসে।
খ্যাতির মধ্যগগনে তখন তিনি। তার শিষ্য পন্ডিত চন্দ্রনাথ শাস্ত্রী, যিনি নিজের জীবনের ছয় থেকে দশ, এই পাঁচ বছর শিখেছিলেন ওঁনার কাছে এবং তারপর ওঁনার সুযোগ্য পুত্র পন্ডিত রামজি মিশ্রর কাছে, তার বাড়ি ছিল আনোখেলালজীর কবির চৌরার বাড়ির প্রায় লাগোয়া। তারই জবানিতে...
"সারারাত এক অনুষ্ঠানে বাজিয়েছেন গুরুজী। ভোরে বাড়ি ফেরার সময় খেয়াল হোলো যে বাড়ির কেউ তো এখনও ওঠেইনি ঘুম থেকে। কুছ পরোয়া নেই, সারারাত বাজানোর পরেও গঙ্গার ঘাটে রেওয়াজে বসলেন গুরুজী। আমি তখন খুব ছোট, তবুও জিজ্ঞাসা করলাম, 'এখন রেওয়াজ করছেন কেন গুরুজী?' অল্প হেসে তিনি বললেন 'রেওয়াজটাই তো আসল, বাকি সবই তো দাড়িয়ে আছে এই রেওয়াজের ওপরেই।"
বহু পরে ঠিক এই একই কথা বলেছিলেন পদ্মবিভূষণ পন্ডিত কিষেন মহারাজজি।
নৃত্যশিল্পী সুনন্দা পট্টনায়েক গিয়েছেন ওঁনার বাড়িতে, বসার ঘরে বসেছেন আর শুনছেন সত্তরোর্ধ কিষেন মহারাজজী ভিতরের ঘরে একমনে রেওয়াজ করেই চলেছেন। ঘন্টা দেড়েক পর যখন দেখা হোলো তখন সুনন্দা পট্টনায়েকের প্রথম প্রশ্নই ছিল...
-- পন্ডিতজি, ইস উমর মে ভি আপ ইতনা রেওয়াজ করতে হ্যায়?
হো হো করে হেসে উঠে উত্তর দিয়েছিলেন পন্ডিত কিষেন মহারাজ...
-- দেখো সুনন্দা, হাম রোজ নাহা কে খা শকতে হ্যায়, কাপড়ে বদল শকতে, তো রেওয়াজ কাহে না কর শকতে?
এই রেওয়াজের প্রসঙ্গেই আনোখেলালজীর শিষ্য চন্দ্রনাথ শাস্ত্রী শুনিয়েছিলেন সেই কঠোর অথচ মর্মান্তিক ঘটনার কথা। আনোখেলালজীর প্রথম পুত্রসন্তান যখন গুরুতর অসুস্থ, তখনও তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছেন গভীরতর রেওয়াজে। এরপর ওঁনাকে যখন নিজপুত্রের মৃত্যু সংবাদ দেওয়া হলো তখনও তিনি অবিচল ভাবে বললেন "ঈশ্বরের দেওয়া উপহার ঈশ্বর নিজেই নিয়ে নিয়েছেন। এসবে বিরক্ত না করে আমাকে আমার রেওয়াজ করতে দাও তোমরা।"
সেই অতি কঠোর রেওয়াজের পর তিনি যখন অনুভব করলেন যে কী ঘটে গেছে, তখন কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এরপর অনেকদিন নিজের প্রিয় তবলায় হাত দেননি আনোখেলালজী।
পন্ডিত আনোখেলাল মিশ্রজীর সমস্ত শিষ্য, যাদের মধ্যে আছেন ওঁনার পুত্র জ্যেষ্ঠপুত্র রামজি মিশ্র, কনিষ্ঠপুত্র কাশীনাথ মিশ্র, মহাপুরুষ মিশ্র, ছোটেলাল মিশ্র, চন্দ্রনাথ শাস্ত্রী , পার্থনাথ শাস্ত্রী, ইন্দুভূষণ পাহাড়ি, রাধাকান্ত নন্দী...এদের সবার কথায় তাদের গুরুজী ছিলেন সমুদ্রের মতো। বিশাল, অনন্ত কিন্তু একেবারেই সাধারণ জীবনযাপন।
ওঁনার তবলা লহরার রেকর্ড যখন বাজানো হতো ভয়েস অফ আমেরিকায়, তখনও আনোখেলালজী থাকতেন জ্ঞানতপস্বীর মতো নিরহঙ্কারী।
ভয়েস অফ আমেরিকা থেকে ওঁনাকে বলা হয়েছিল Wizard of Na Dhin Dhin Na.
এ দেশেও সবাই ওই কথাই বলতো ওঁনার সম্মন্ধে।
"না ধিন ধিন না" - র জাদুকর।
কিন্তু ওঁনার নিজের কাছে তবলা ছিল শুধুই সাধনার বিষয়। আর কিচ্ছু না।
্যাঁ ...তবলার এই জাদুকরেরই নাম পন্ডিত আনোখেলাল মিশ্রজী।
১৯৫৮ সালের ১০ই মার্চ, পন্ডিত আনোখেলাল মিশ্রজী মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান।
না... উঁনি মারা যাননি। পণ্ডিত আনোখেলাল মিশ্রের মৃত্যু নেই।
পন্ডিত আনোখেলাল মিশ্রজীর নশ্বর দেহটাই শুধু প্রাণহীন হয়...আমাদের কাছে উঁনি বেঁচেই থাকেন।
আর কানের ভিতর অনুরণন চলতে থাকে...চলতে থাকে...চলতেই থাকে...
ধাগেতেটে নাগেধিনা
ধিগধিনা নাতিধিনা
ধাগেধিনা নানাকেটে
নাগেধিনা ধিগধিনা
না ধি ধি না
না ধি ধি না
না ধি ধি না
না ধি ধি না

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র