চরের মানুষ,এক আর্তি ও যন্ত্রণার আখ্যান
১.
তৃষ্ণা বসাক।কবি।নয়ের দশকে লিখতে এসেছেন।
কবিতার বাইরেও তৃষ্ণা নিয়মিত গদ্য লেখেন।করেন অনুবাদের কাজও।তার নিজস্ব এক পাঠকবৃত্ত রয়েছে গোটা বাংলা ভাষা জুড়েই।
হাতে পাবার পরেই পাঠ করে ফেলেছিলাম বইটি।আর ভেতরে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল বইটি নিয়ে লিখবার।
শেষ পর্যন্ত বসতে হল বইটি নিয়ে একটা লেখা লিখবার জন্য।আর আবারও পড়ে ফেলতে হল তৃষ্ণা বসাকের "চরের মানুষ"।প্রথম পাঠের থেকে সরে এসে এই দ্বিতীয় পাঠ আমার মধ্যে নুতন এক অনুরণন তৈরি করে দিল।
বিষয়,ভাবনা,দৃশ্য নির্মাণ এক অপরূপ আর বিশ্বস্ত চালচিত্র সাজিয়ে দিল আমার সামনে।
পড়তে পড়তে একটা আবেগ,একটা মায়া,একটা মনকেমন বারবার জড়িয়ে ধরছিল আমাকে।
এই আখ্যান জুড়ে তীব্র এক পরিপক্কতা।লেখক নিঃসন্দেহে তার মগজ মেধা কলমের জাত চিনিয়ে দিতে পেরেছেন।প্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ আর সৎ সমাজবাস্তবতা এই বইকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
২.
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা সাবেক পূর্ব বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাঙালি(সংখ্যায় খুবই কম হলেও কিছু মুসলিম পরিবারও) ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ আসাম ত্রিপুরা মেঘালয় রাজ্যে উদ্বাস্তু হয়ে প্রবেশ করে বা প্রবেশ করতে বাধ্য হয়।এরপর প্রায় নিয়ম করে সংখ্যালঘু হিন্দুরা এই দেশে আসতে বাধ্য হয়েছে। দাঙ্গা,নিরাপত্তাহীনতা,আতঙ্ক তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে।এখনও কম হলেও সেই পলায়ন চলছে।
কিন্তু যে সমস্ত হিন্দুরা নিজেদের ভিটে মাটি দেশ ছাড়লেন না।মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকলেন নিজের শিকড়ের কাছে।কেমন কাটছিল তাদের জীবন।
এই নিয়ে খুব কিছু কিন্তু বিস্তারিত লেখা হয়নি আমাদের বাংলা সাহিত্যে।
দেশভাগ নিয়ে অনেক মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে।পাশাপাশি দেশভাগ কে ব্যান্ড হিসেবে মান্যতা দিয়ে কিছু প্রকাশক সফলতা পেয়েছেন।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সমাজ কেমন আছেন সেই নিয়ে মূলত তৃষ্ণার এই আখ্যান।
৩.
চারটি পর্বে এই উপন্যাস বিন্যস্ত।টুনু নামে একটি মেয়ে এই উপন্যাসের মূল বিন্দু। টুনুর বাবা সুরেশ ডাক্তার প্রথিতযশা চিকিৎসক।ময়মনসিংহের সম্মানীয় ব্যাক্তি।টুনুর মা অসুস্থ থাকেন।সদা বিষন্ন মানুষ।মেজ মেয়ে ইন্ডিয়ায়।টুনুর মায়ের বিষাদের অন্যতম কারণ তার প্রথম সন্তান জন্মানোর পরে তার বাপের বাড়ির কেউ আসতে পারেন নি।যে কারণে টুনুর মা আর পিত্রালয়ে যেতে পারেন না সুরেশ ডাক্তারের নির্দেশে। টুনুর দাদা স্বরাজ মুসলমানের হাতে খুন হয়ে যায়।কিন্তু এই ঘটনাকে সুরেশ ডাক্তার হিন্দু মুসলমানের সংঘাত মানতে রাজি নন।টুনু নিজের মতন করে বড় হতে থাকে।আর তাদের সংসার চালায় মনোর মা।
কত কত ঘটনা ঘটে,কত কত চরিত্র ঘুরে বেড়ায়।
হিন্দু সমাজের বিপন্নতা,নিরাপত্তাহীনতা বারবার ছায়া ফেলে আখ্যানের শেষ পর্যন্ত।
৪.
আমরা দেখি চাকরি থেকে অবসরের পর পদ্ম সান্যাল ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছেন।দেখি পপিকে।পপির মা নুসরতখালাকে।পুত্র সন্তান হয় না বলে পপির বাবা অর্ধেক বয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করে।আর নুসরতখালারা হারিয়ে যায়।
হিন্দু ও মুসলিম সমাজের দূরত্ব,হিন্দু সমাজের জাতপাত বিশ্বস্ত ভাবে এই আখ্যান জুড়ে উপস্থাপিত হয়েছে।হিন্দু বাড়িতে মুসলিম কেউ এলে তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হত।যেমন,কোন মুসলিম যেখানে বসতেন সেখানে গোবর জল ছিটানো হত।
মুসলমানের দেশ পাকিস্তান হবার পর তাই হয়তো মুসলমানেরা এই অপমান ভুলতে পারেন নি।
আমরা দেখি প্রমীলারানীকে।তার বিস্তৃত সংসারের গল্প পল্লবিত হয়।
দেখি প্রমীলার ছেলে অমর কে।লৌহজং নদীর পাশে বসে বসে যে তার অন্তরে বুনে চলতো স্বপ্নের তাঁতঘর। পরে এই অমর ডাক্তার হয়।মুক্তিযুদ্ধের পরে ভারতে চলে যায়।এই অমর ডাক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল টুনুর।
৫.
আমরা দেখি আখ্যানে জুড়ে বসছে করুটিয়া কলেজ,ছাত্র রাজনীতি,পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতির বাঁকবদল।সুরাবর্দি,ফজলুল হক,শেখ মুজিব,২১ দফা,ছাত্র লীগ,আয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্র্যাট।
পাশাপাশি কাদের সর্দারের কিসসা,জয়রাম বসাকের মেয়ের চিত্রনায়িকা শবনম হয়ে ওঠা মূলত মা যোগমায়ার প্রচ্ছন্ন উৎসাহে।ঢাকাইয়া বসাকদের বৃত্তান্তে ঢুকে পড়তে থাকা পুরোন ঢাকার একসময়ের হিন্দু আধিপত্যের মহল্লাগুলি।
বাউসার প্রভাত মামা যিনি ছিলেন একদম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন।তার পাশে চলে আসতে থাকেন প্রভা সুন্দরী,মিলিটারি তুলে নিয়ে যাওয়া শোভনা নার্স,বিন্দুবাসিনী স্কুল,সন্তোষের জমিদারি,পারুলবালার অন্ধ শাশুড়ি আরো কত কত অনুষঙ্গ।
৬.
আখ্যানের একটা উজ্জ্বল অংশ ড. বি পি সাহা।অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে নিজের শ্রম আর বুদ্ধিতে যিনি একটি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন।মা সরোজীনি বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন।
বি পি সাহা ৭৫০ শয্যার একটি আধুনিক হাসপাতাল গড়ে তুলেছিলেন মির্জাপুরে। পরে অমর এখানেই চাকরি পেয়েছিল।বি পি সাহার জাহাজ ছিল।নাম বাংলার নদী।
বি পি সাহার মেয়ে বিয়ে করে এক মুসলিম ছেলেকে।তাদের সন্তান হয়।বাবুল।বাবলু। পরে এই সম্পর্ক বি পি সাহা মেনে নেন।
ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যায় পাক বাহিনীর আক্রমণ সারা পূর্ব বাংলা জুড়ে।পাশাপাশি শুরু হয় তীব্র প্রতিরোধ।মুক্তিযুদ্ধ।অত্যাচার,খুব,ধর্ষণ এর উৎসবে মেতে ওঠে পাক সেনা রাজাকার আল বদরের দল।
গোটা দেশ জুড়ে আতঙ্ক।হাহাকার।
টুনুদেরকেও লুকিয়ে পড়তে হয় তার শিশু সহ জংলা অন্ধকারে।ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় যদিও তারা।
কাহিনী গড়াতে থাকে।মুক্তিযুদ্ধ আর পাক সেনার অত্যাচারে দেশ পরিণত হয় নরকে।রক্তের এক উপত্যকায়।জেসমিন ইমাম সেলাই করেন বাংলাদেশের পতাকা।
বি পি সাহা খুন হয়ে যান খান সেনাদের হাতে।তার বাসা দেখিয়ে দেয় অমর ডাক্তার।
তারপর অমর পালিয়ে যায় ইন্ডিয়ায়।
একসময় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।ভাঙা দেশে জীবন জীবনের মতন করে নুতন করে সেজে উঠতে থাকে।আর অমরের চিঠি আসে।
টুনুকে চলে যেতে হবে ছেলে সহ ভারতে অমরের কাছে।
সুরেশ ডাক্তারের চোখে জেগে থাকে বিষাদের অশ্রু।
,প্রভাসুন্দরীর বলা কবেকার সেই কথা ভেসে ওঠে_
"এপারে বাপের ঘর, ওপারে শ্বশুর ঘর।আর মধ্যিখানে চর।সেই চরে বইসা তোমার মা,আমাগো লক্ষীরানি দিনরাত কাইন্দা মরে।"
চরের মানুষ এক অপরূপ আখ্যান।
অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের নানান প্রান্তে এই গ্রন্থটি পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
চরের মানুষ:তৃষ্ণা বসাক
ধানসিড়ি
কলকাতা_৫০
খুব সুন্দর আলোচনা। এমন পাঠকের আলোচনাই তো লেখকের প্রাপ্তি। অবশ্য পাঠক যদি সুবীর সরকারের মতো অসাধারণ কবি ও গদ্যকার হন তখন এইরকম আলোচনাই তো পাওয়ার কথা। তৃষ্ণাদি ও সুবীর সরকারকে শুভেচ্ছা।
উত্তরমুছুন