উস্রি দে - মায়াজম

Breaking

২৮ জানু, ২০২৪

উস্রি দে

 আলোকলতার চশমা


লোকলতার চশমা টা পাওয়া যাচ্ছে না। চৌধুরী বাড়িতে আজ সকাল থেকেই সবাই ব্যস্ত ওই চশমার খোঁজে। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে দোতলা বাড়ির প্রতিটি ঘরের কোনা খামচি এমনকি তেতলার চিলেকোঠাও। নাঃ, কোত্থাও নেই ! আশ্চর্য ! চশমার তো আর পাখা নেই যে উড়ে যাবে ! আলোকলতার বয়স, তা প্রায় আশির কাছাকাছি। চৌধুরী পরিবারের কর্ত্রী। সবার মাথার ওপরে আছেন। আজকাল বয়সের ভারে সংসারে কর্তৃত্ব চালাতে পারেন না ঠিকই তবে নজর আছে সবদিকে। আজ থেকে প্রায় পঁয়ষট্টি বছর আগে পনেরো বছরের মেয়েটি এই বাড়িতে এসেছিল বাড়ির বড় বউ হয়ে। এবাড়ির বড় ছেলে বিধুশেখর তখন ওকালতি পড়ছেন। তার পরের দুই ভাই তখনও একজন স্কুলে আর একজন সবে কলেজে উঠেছে। তাছাড়া বিধুশেখরের জ্যাঠা, জেঠিমা, কাকা, কাকিমা, তুতো ভাই বোনেরা – সব মিলিয়ে বাড়ি একদম সরগরম।

প্রথম প্রথম দিশেহারা লাগত আলোকলতার। এত বড় চকমিলান বাড়িতে এতগুলো ঘর তাছাড়া ঠাকুরঘর, রান্নাঘর, ভাড়ারঘর – মনে রাখতে পারতেন না আলোকলতা বাড়ির কোন দিকে কোন ঘর। সেই সময় শাশুড়ি রাধারানী নিজের মেয়ের মত করে বউ কে এ বাড়ির আদব কায়দা সব শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিলেন। রাধারানী মানুষটি শান্ত স্বভাবের, চুপচাপ থাকতেন। তবে সংসারের হাল হকিকত সব ওনার নখদর্পণে। কে কি খেতে ভালোবাসে, কাকে কখন কোন জিনিষটা হাতের কাছে এগিয়ে দিতে হবে সমস্ত কিছু। শ্বশুরমশাই বেশ কড়া স্বভাবের মানুষ ছিলেন। পান থেকে চুণ খসলেই বিপদ !
আলোকলতা স্বর্ণলতারই আর এক নাম। সোনার মত গায়ের রং, টুকটুকে মেয়েটির নাম তাই বাবা রেখেছিলেন আলোকলতা। দেখতে রীতিমত সুন্দরী ছিলেন, আর স্বভাবটিও ছিল মধুর। তাই ধীরে ধীরে চৌধুরী বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিতে বিশেষ অসুবিধে হয় নি আলোকলতার। মিলেমিশেই থাকার চেষ্টা করতেন এই বড় পরিবারের সবার সাথে।
সময়ের সাথে সাথে চৌধুরী পরিবারটিও ছোট হয়ে আসে। বড়রা সবাই একে একে গত হয়েছেন। খুড়তুতো দেওরের দিল্লির বাড়িতে কিছুকাল আগেই দেহ রেখেছেন কাকি শাশুড়ি। এখন এ বাড়িতে শুধু আলোকলতার পরিবার, দুই ছেলে, বউরা, নাতি, নাতনী। বিধুশেখর চলে গেছেন তাও বছর সাতেক হল।
“ ঠাম্মি, তুমি মনে করে দেখো তো, শেষ কখন চশমাটা খুলেছিলে ?” দশ বছরের নাতি ঋদ্ধি বলে।
“ আরে সেটাই তো মনে করতে পারছি না রে !” আলোকলতার খেদোক্তি ! “ এখন কি করে যে খবরের কাগজ, বই এসব পড়ব !”
“ ঠাম্মি, তোমার বাথরুম টা একবার ভালো করে দেখে আসি। বাথরুমের তাকে রেখেছ কি না…” ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে মন্তব্য নাতনী গিনির।
“ তুই কলেজে যা, তোর দেরী হয়ে যাবে। আমি দেখেছি, নেই।“ বলে ওঠেন আলোকলতা।
“ আরে না না, কিচ্ছু দেরী হবে না। একটু দেখতে দাও না ভালো করে !”
সারাদিন ধরে সবাই মিলে প্রচুর খোঁজাখুঁজি হল। কিন্তু ফল কিছুই পাওয়া গেলো না।
বড় ছেলে সৌগত অফিস যাওয়ার আগে বলে গেলো –
“ মা, দুটো দিন একটু কষ্ট করো, পরশু তোমায় চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে চোখ দেখিয়ে পাওয়ার নিয়ে চশমা করিয়ে দেবো। এখন তো অফিসে খুব চাপ চলছে, তাই এক্ষুনি পারছি না”।
“ ঠিক আছে, ওসব নিয়ে চিন্তা করিস না, সাবধানে যা”।
মনটা খারাপ লাগছে। সময় যেন কাটতেই চায় না। আসলে সকালে উঠে খবরের কাগজ পড়া, তারপর বিভিন্ন বই পড়া, দুপুরে প্রতিদিন শব্দজব্দ -এর জট ছাড়ান, কিছুই করার রইল না। ঠাকুরঘরের কাজটাও তো ঠিকমত করতে পারবেন না। চশমা ছাড়া তো প্রায় অন্ধ ! জানালার পাশে চেয়ারটা টেনে বসেছিলেন। বাইরে তাকিয়ে ভালোমত কিছু দেখতেও যে পান না খালি চোখে ! এমন সময় লাফাতে লাফাতে ঋদ্ধি ঘরে এসে ঢুকল ।
“ ঠাম্মি ! একটা চশমা পেয়েছি ! দেখোতো, তোমার ফিট করে কি না ! “
“ কোথায় পেলি ? কার চশমা ?”
“ পেলাম ওই চিলেকোঠায় ট্রাঙ্কের ভেতর পুরনো জিনিষপত্রের মধ্যে। আরে তুমি আগে পরেই দেখো না !”
আলোকলতা অবাক হয়ে দেখলেন গোল্ডেন ফ্রেমের সুদৃশ্য চশমাটি। খুব চেনা চেনা লাগছে ! মনে পড়ে গেলো এটি তো তাঁর শাশুড়ি মা রাধারানীর চশমা ! পরে দেখলেন বাঃ চমৎকার ফিট করেছে তো ! আর বেশ স্পষ্ট দেখতেও পাচ্ছেন ! ঋদ্ধি বলল –
“ কি ? কেমন দেখছ ?”
“ দারুণ রে, দাদুভাই ! সোনা আমার ! খুব উপকার করলি রে !”
“ তাহলে আমি কি পাচ্ছি ?”
“ ওরে দুষ্টু ! ওমনি পুরস্কারের দাবি ! আচ্ছা দাঁড়া” বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে পঞ্চাশ টা টাকা এনে নাতির হাতে দিলেন। যাক বাবা, এখনকার মত তো সমস্যা মিটল !
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বেশ আয়েশ করে জানালার পাশে চেয়ারে বসে খবরের কাগজের দ্বিতীয় পাতাটা টা খুললেন, যেখানে সেদিনের শব্দছক প্রকাশিত হয়েছে। আগের দিনের বেশ কয়েকটা পারেন নি আলোকলতা। সেগুলো আগে মিলিয়ে মিলিয়ে বসালেন পুরনো কাগজের পাতায়। তারপর আজকের টা নিয়ে যেই ভাবতে বসেছেন, একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল ! হঠা চোখের সামনে লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে এলো। ধীরে ধীরে একটা ছবি ভেসে উঠল পুরনো দিনের। আলোকলতা দেখছেন রাতের বেলা একজন পুরুষ মানুষ নিঃশব্দে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। কে উনি ? প্রথমটা ঠিক ঠাহর করতে পারলেন না আলোকলতা। নিচে নেমে চুপিসাড়ে এগিয়ে গেলেন দরদালান এর পেছন দিকে, যেখানে ছোট দুটো কামরাতে থাকত বাড়ির ঝি চাকররা। কৌতূহলী হলেন আলোকলতা। কে কোথায় যাচ্ছেন এত রাতে ! একটা দরজায় টোকা মারলেন পুরুষমানুষটি। দরজা খুলল হরিদাসি, বাড়ির ঝি। সে কিছু বোঝার আগেই পুরুষটি তাকে ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। উত্তেজনায় আলোকলতার গলা শুকিয়ে আসছে ! বেশ কিছুক্ষণ বাদে দরজা খুলে যিনি বেরোলেন, তাকে দেখেই চিনতে পারলেন আলোকলতা ! তাঁর জেঠশ্বশুর ! মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল আলোকলতার। এ কি দেখলেন তিনি ! চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিলেন চেয়ারে। মনে পড়ল হরিদাসি ছিল বছর তিরিশের মহিলা। চেহারায় চটক ছিল। আর খুব কাজের ছিল। সবার ডাকে সাড়া দিত। সারা বাড়িময় ছুটোছুটি করে কাজ করে বেড়াত হাসিমুখে। সেই হরিদাসি একবার গর্ভবতী হয়ে পড়ে। সেই সময় বাড়িতে খুব অশান্তি হয়েছিল। জেঠশাশুড়ি তো পরিস্কার জানিয়ে দিলেন ওই নষ্টচরিত্র মেয়েকে আর এ বাড়িতে রাখা চলবে না। হরিদাসি অনেক কান্নাকাটি, অনুনয় করেছিল। কিন্তু কোন ফল হয় নি। বাড়ির বড়দের মতে হরিদাসি নিশ্চয়ই চাকর গনেশের সাথে কোনভাবে ...। আলোকলতার শাশুড়ি ওকে আলাদা করে ডেকে জানতে চেয়েছিলেন ওর এই অবস্থার জন্য কে দায়ী। কিন্তু হরিদাসি মুখ খোলেনি। আলোকলতা ভাবলেন কত দুঃখে হরিদাসিকে অপবাদ নিয়ে চৌধুরী বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল ! আর জেঠশ্বশুর ! ছিঃ ! এমনকি আর একজন নিরপরাধ গনেশ দা কেও হুমকি শুনতে হয়েছিল বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার।
সেদিন দুপুরে বিছানায় শুয়ে আলোকলতা আকাশ পাতাল ভাবছিলেন। কি অদ্ভুত ! এ কি জাদু চশমা নাকি ? নাহলে উনি এগুলো কি দেখছেন, কিভাবে দেখছেন ! চশমাটা এরপর থেকে খুলেই রেখেছেন আলোকলতা। রিদ্ধি এসে বারদুয়েক জিজ্ঞেস করে গেছে ঠাম্মির পছন্দ হয়েছে কিনা চশমাটা। ওটা কেন খুলে রেখেছেন, ইত্যাদি। আলোকলতা জানিয়েছেন মাথাটা একটু ধরেছে, তাই চশমা খুলে রেখেছেন।
পরেরদিন অভ্যাসবশত আবার চশমাটা টেনে নিয়ে কাগজ পড়েছেন, শব্দছক করেছেন। নতুন করে কিছু ঘটেনি। ঘটল সেদিন রাতে। বিছানায় বসে রবিবাসরীয়র পাতা খুলে ছোট গল্প পড়তে শুরু করেছেন, আবার সেই ঝাপসা হয়ে আসা অক্ষরগুলো, ক্রমশ একটা ছবি ফুটে ওঠা ! বুক ঢিপঢিপ করছে আলোকলতার। এবারে কি দেখবেন ! একটি মহিলার অবয়ব ফুটে উঠছে ! আরে, ইনি তো কাকিমা, অর্থাৎ খুড়িশাশুড়ি ! কোথায় যাচ্ছেন পা টিপে টিপে ! রান্নাঘরে ঢুকলেন ! ওকি ! মাছের বাটি থেকে একটা বড় পেটি আর একটা মুড়ো তুলে নিলেন একটা ছোট বাটিতে ! এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন কেউ দেখছে কিনা, তারপর আঁচল চাপা দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠে চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে ! এই তাহলে আসল ব্যাপার ! আলোকলতা ভাবলেন, রাঁধুনিকে কে কত গালমন্দ শুনতে হয়েছে চুরির অপবাদে ! কত নজরদারি চালিয়েও মাছের পিস গুনতিতে কম কেন পড়ছিল পরিবেশনের সময়, বোঝা যাচ্ছিল না। আসলে ঘরের লোকই যে সময় সুযোগ বুঝে সরিয়ে নিচ্ছে, তা কি কেউ ভাবে ! এখন আলোকলতার কাছে সবই জলের মত পরিস্কার ! আজ এই আশির দোরগোড়ায় পৌঁছে তার এতকালের ধ্যানধারণা সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ! নাঃ, এই চশমাটাই যত নষ্টের গোড়া ! এটা আর পরবেন না, মনে মনে ভাবেন আলোকলতা।
কিন্তু পরেরদিন যেই খবরের কাগজ হাতে আসে, ওমনি চশমাটাও সরাসরি চোখে উঠে আসে। কাগজ পড়া, বই পড়ার নেশায় তখন অন্য কিছু মনে আসেনা। তৃতীয় দিন দুপুরে শব্দছক করতে করতে একটু তন্দ্রামতন এসেছে। হঠাৎ বাইরের কোন আওয়াজে চটকাটা ভেঙে গেলো। আর সাথে সাথে আবার চোখের সামনে ছবি ভেসে উঠল ! একতলার উঠোন পেরিয়ে এক কোণে কলতলা ছিল সেই সময়। ভরসন্ধ্যেয় কলতলায় পা ধুচ্ছে কে ও ! ওমা ! এ তো নন্দিতা ! জেঠতুতো ননদ। কোথায় গিয়েছিল ও ? সদর দরজা ফাঁক করে কার সাথে কথা বলছে ? অন্যজনকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। এবার দরজাটা আর একটু ফাঁক হল। লম্বা কালোপানা ছেলেটা নন্দিতার হাত ধরে টানাটানি করছে ! ও তো শিবেশ ! এবারে চিনতে পেরেছেন আলোকলতা। মন্ডল বাড়ির বখাটে ছোঁড়া ! সব্বোনাশ ! তার মানে এর সাথে বাইরে গিয়েছিল নন্দিতা ! আর এখন শিবেশ ওকে ছাড়তে চাইছে না ! জেঠিমা জানতে পারলে তো দক্ষযজ্ঞ বাঁধাবেন ! পর মুহূর্তেই মনে হল কি সব ভাবছেন আলোকলতা ! এতো অতীত ! এবার শিবেশ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দরদালানের পেছন দিকে চলে গেলো। ঈশারায় নন্দিতাকে ডেকে নিল। তারপর আবছা অন্ধকারে সেঁধিয়ে গিয়ে দুজনে জাপটাজাপটি করে …! ছিঃ ছিঃ । আর দেখতে পারলেন না আলোকলতা। মনে পড়ছে সেইসব দিনের কথা। নন্দিতা ওনার কাছ থেকে শাড়ি চেয়ে নিয়ে সেজেগুজে সন্ধ্যের মুখে প্রায়ই বেরিয়ে যেত যখন জেঠিমা ঠাকুরবাড়িতে পাঠ শুনতে যেতেন। পরে মনে হয় জেঠিমা সবই টের পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই তড়িঘড়ি নন্দিতার বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। নন্দিতা তখন স্কুলের গন্ডি ডিঙোতে পারেনি। যদিও বয়স খুব একটা কম ছিল না। মাত্র দশ দিনের মধ্যে সম্বন্ধ দেখে বয়সে নন্দিতার থেকে বেশ বড় একজনের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন জেঠিমা। আলোকলতার সেই সময় ব্যাপারটা অদ্ভুত লেগেছিল। এত তাড়াহুড়ো কেন ? আজ সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাচ্ছেন একে একে।
চশমাটাকে ভয় পাচ্ছেন আলোকলতা ! অতীত খুঁড়ে আনছে প্রতিদিন ! কি জানি আরও কি দেখতে হবে ! রাধারানীর চশমা পড়ে পুরোন ঘটনা যেন সিনেমার মত তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ! কি করে ! আলোকলতার মনে হল শাশুড়ি মা নিশ্চয়ই সব জানতেন। কিন্তু কোনদিন কোন বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেন নি। আশ্চর্য ! আসলে মানুষটি খুব শান্ত আর স্থিতধী ছিলেন। সংসারে অশান্তি চাইতেন না। তাই সব দিক সামলে চলতেন।
সেদিন দুপুরে টিভি তে একটা অনেক পুরোন দিনের বাংলা সিনেমা হচ্ছে শুনে আলোকলতা ড্রইং রুমে সোফায় গিয়ে বসলেন। আজকাল বয়সের জন্য টিভি খুব একটা দেখা হয় না। কিন্তু বই পড়া উনি ছাড়তে পারেন না। যাহোক, পুরোন ছবি দেখতে বেশ ভালো লাগছে অনেকদিন পর। হঠাৎ আবার সেই সবকিছু আবছা হতে শুরু করল। আস্তে আস্তে একটা ছবি ফুটে উঠছে। আলোকলতা ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছেন। কি হয় কি হয় ! চরম উত্তেজনা ! ওনার পাশে পরিবারের যারা বসে রয়েছে, তারা কিছুই টের পাচ্ছে না যদিও। দেখা যাচ্ছে দোতলার বারান্দা থেকে পেছন দিকের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি, প্রধানত জমাদারের যাতায়াতের জন্য, সেই সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে নেমে যাচ্ছে একজন পুরুষ মানুষ। ছবিটা এখনও ঠিক স্পষ্ট নয়, তাই বোঝা যাচ্ছে না মানুষটি কে ! নিচে নেমে বাড়ির পেছন দিকের বাগানে গিয়ে থামল। একজন মহিলা, সাদা কাপড় পড়া বিধবা, এগিয়ে এল। লোকটি সামনে যেতেই মহিলা ওনার হাতে একটা বড় খাম তুলে দিল। এবারে লোকটি বাগানের মধ্যে বাড়ির জানালা দিয়ে আসা স্বল্প আলোয় খামটি খুলে কিছু দেখতে লাগল। লোকটির মুখ এবার অনেক স্পষ্ট। একি ! এ তো বিধুশেখর ! আলোকলতার স্বামী ! উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছেন ভেতরে ভেতরে আলোকলতা। মহিলাটি নিচু হয়ে বিধুশেখরকে প্রণাম করতে গেলে, উনি দু হাতে তাকে তুলে ধরলেন। তারপর …। নাঃ, আর দেখতে পারবেন না, আলোকলতা ! টান মেরে চশমাটা খু্লে ফেলে মাথাটা সোফায় এলিয়ে দিলেন।
“ কি হয়েছে, মা ! শরীর খারাপ লাগছে ?” বড় বউ সুনেত্রা উদ্বিগ্ন।
“ না না, ঠিক আছি। এমনি মাথাটা একটু…”।
“ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন”।
“ হ্যাঁ, তাই যাই”।
বলে টলোমলো পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। ধীরে ধীরে উত্তেজনা কমে এল। মন কে বোঝালেন বিধুশেখর নিশ্চয়ই কোন মামলার ব্যাপারে কাউকে সাহায্য করছিলেন। আবার সাথে সাথেই মনে হল, তাই যদি হবে, তাহলে সেটা এমন গোপনে কেন ? এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখ লেগে এসেছে। একটা শোরগোলে আচমকা তন্দ্রা কেটে গেলো।
“ ঠাম্মি ! এই দেখো, আমার হাতে কি !”
ঋদ্ধির চিৎকার শুনে ধরফড়িয়ে উঠে বসলেন আলোকলতা।
“ চোখ বন্ধ করো, হাত পাতো।“
আলোকলতা চোখ বুজে হাত পেতে দিলেন। হাতে কিছু একটা দিল ঋদ্ধি।
“ এবারে চোখ খোল !”
চোখ খুলেই আলোকলতা দেখেন তার হারানো চশমা ! আনন্দে উদ্বেল হয়ে ঋদ্ধিকে জিজ্ঞেস করলেন -
“ কোথায় পেলি, দাদুভাই ?”
“ পুরোন খবরের কাগজগুলো বিক্রি করতে নিয়ে গিয়েছিল সাবিত্রী মাসি।
সেই খবরের কাগজের ভাঁজে তোমার চশমা ছিল !”
“ ও মা, তাই ! দেখেছিস তো ! কখন মনের ভুলে জড়িয়ে কাগজের ভাঁজে
রেখে দিয়েছি ! যাক বাবা, সমস্যা মিটল ! কী যে ভাল লাগছে আমার !”
বলে নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সেদিন রাতে আলোকলতা নিশ্চিন্তে ঘুমোলেন। আর কোন অতীত ঘটনা নিয়ে ওনাকে বিচলিত হতে হবে না। শান্তি ফিরে পেয়েছেন অশীতিপর মানুষটি। রাধারানীর চশমাটি একেবারে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে আসতে হবে এবার।কি সব্বোনেশে চশমা রে বাবা ! বলা তো যায় না, উনি যখন থাকবেন না, কেউ কোনদিন মজা করে ওটা চোখে দিয়ে পরিবারের লুকোন কেচ্ছা জেনে না ফেলে !

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র