পায়েল চট্টোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

২৬ জানু, ২০২৪

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 





মার দিকে অমন করে দেখেছিস কেন? আমাদের কি অনেকদিন পর দেখা? না ঠিক তা তো নয়। এই তো সেদিন দুপুরে কত খেললাম। আমরা সবাই। তুই, আমি, আর ওরা সবাই। তবে তুই চলে যাচ্ছিস কেন?

আমাদের কি অনেকদিন পর দেখা হবে আবার? নাহ! তা তো হবে না। আমরা কথা বলব কখনো আর? কথা বললে কি কথা বলব? কারোর মৃত্যুসংবাদ নিয়ে কথা! বা কিছু আলগোছে সাজানো কথা। কেমন আছিস? কেমন চলছে সংসার? কি করছিস? পড়াশোনা চলছে কেমন? এসব না-সাজানো কথাগুলোই তো বলা হবে এরপর। কিন্তু এসব কথার ভেতর কোনও কথা থাকবে না। সবটা শূন্য। ভয়েড। ফাঁকা। নিস্তব্ধ। নিশ্চুপ। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দও শুনতে পাব না। বিকেল পাঁচটা বাজলেই ঘড়ির টিকটিক শব্দ পিন ফোটাবে। আমায় সকলে ডাকবে। আমি যাব না। তোর গন্ধ ছাড়া বন্ধুত্ব হয় না।
হয়তো একদিন রাতে তোকে ফোন করলাম।
“ আমার খুব ভয় করছে জানিস? সব বন্ধুরা হারিয়ে যাচ্ছে। সবাই চলে যাচ্ছে। সবাই কোথাও না কোথাও চলে যাচ্ছে। সকলে বলছে ওরা শেকড়হীন। আমি পারছি না শুধু। আমি আটকে থাকছি। পাটা আটকে রয়েছে। কোন এক শেকড়ের সঙ্গে আটকে রয়েছে। আমার ডিপ্রেশন হচ্ছে।”
তুই শান্ত। পাথরের মত।
“শুনতে পাচ্ছিস তুই? কী রে? ওই শুনতে পাচ্ছিস?”
তুই হয়তো অনেকক্ষণ পরে উত্তর দিবি।
“কাল রাতে খেয়েছিলি? গান শোন একটু, কিছু পড় নইলে।”
তুই আমায় পাগল ভাবছিস? আমি তোর পায়েসের বাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এসব ভাবছি। নিশ্চয়ই পাগল ভাবছিস। আমি অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। আমার চোখের সামনে দরজার পর্দাটা স্থির হয়ে যাচ্ছে। সিলিং-এ পাখার ঘড়ঘড় শব্দটা কানফাটানো মনে হচ্ছে। মায়া হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু বিষাদের মলম হয় না। সহ্য করে নিতে হয়। বিষের মত।
আমি তোকে কী করে বোঝাব আমি কেন বিষন্ন। আমার ভেতরের কুয়োতলায় অনবরত জলের স্রোত। জলের অবিরাম ওঠা-পড়া। আমার ভেতরে কেউ গল্প শোনাচ্ছে। ছোটবেলার কথা, স্বপ্নের কথা, মাঠের কথা, বন্ধুত্বের কথা। এসব কথা কি এমন করে শেষ করতে আছে? এমন অর্ধেক লেখা পাতার মত করে শেষ করতে আছে..? আমার ভেতর বিপন্নতা বাড়ছে। তুই পায়েসের বাটিটা তুলে নিয়েছিস। একটু পরে শেষ হয়ে যাবে। বেড়ালটাও অপেক্ষা করে করে চলে গেছে। আমায় শক্তিহীন করে এভাবে চলে যাওয়ার কী মানে? বন্ধুত্ব কি তবে অন্ধকার পর্দা? কেন তুই চলে যাবি? আমাদের সত্যি দেখা হবে না? কথা হবে শুধু। সত্যি হবে কথা?
উঠোনের সামনে এসে তুই দাঁড়িয়েছিস। আমাদের ছোট্ট বাড়ি। ফুলগাছ। সব ঝরে যাচ্ছে। তুই কি একবারও বলবি না যে আবার আসব! আবার আমাদের দেখা হবে। মা বলছে-
-“অত দূরে যাচ্ছিস তোরা সব! আর কি আসতে পারবি এখানে?”
আমি উত্তরটা শুনতে চাই না বলে ছাদে পালাচ্ছি। দেওয়াল ভেঙে পড়ার ভয় নিয়ে আমি ছাদে উঠি। তবুও ছাদের মাথা ভেঙে
পড়ার ভয় নেই। আমি আকাশ দেখব বলে পালাচ্ছি। তুই অবাক চোখে দেখছিস আমায়।আমি কাউকে দেখছি না । কাউকে না।
আমি ছাদ থেকে নামতে পারছি না। আমার পা আটকে যাচ্ছে। আচ্ছা ধর আমার যেদিন বুকে ব্যথা হবে, সেদিন কোথায় যাব? আমার ভেতরের মরুভূমিটা শুকনো। বড় রুক্ষ্ম। আমাদের ভেতর অনন্ত দূরত্ব তৈরী হচ্ছে। তোর বিমানযাত্রার পরের সোনালি মুহূর্তের রোদ তোর মুখে। মা বলছে” বিকেল হচ্ছে তো! কখন যাওয়া তোদের?”
আমার ভেতরে সাদা-কালো পর্দার মত দুঃখ জেগে উঠছে। আমার ভেতর কতগুলো পাথর জেগে উঠেছে। পাথরটা চোখের ভেতর, গলার ভেতর, বুকের ভেতর জেগে উঠছে আবার। মনে হচ্ছে পাহাড়ের বুকে হেঁটে চলেছি।পাহাড়ের বুকে পাথর ঠেলে হেঁটে চলেছি আমি। তোর ফেলে রাখা শূন্য পায়েসের বাটির দিকে আমি তাকিয়ে। দরজার পর্দা শূন্য, স্থির। তুই বাইরের দিকে পা বাড়াচ্ছিস। আমি বুঝতে পারছি আমার পাথর ঠেলা ছাড়া কোনও উপায় নেই। তোর মিলিয়ে যাওয়া বিনুনী, চুলের ফিতে আর আমার পাথর এক হয়ে যাচ্ছে। ধূসর। সবটা ধূসর।

২টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র