নেকবান্দার বয়ান
এইমাত্র আমার কাছে ফুল রেখে গেল কুয়াশার মতো মেয়েটা। ওর হাত ধরার খুব ইচ্ছে হলেও আমি উঠতে পারলাম না। আসলে কোনোদিন উঠতেই পারিনি আমি। আম্মি বলত, 'রিয়াজ তোর শরম লাগেনা, ছুটো ছুটো ভাইবইনগুলো সব কেমন কেলাসে ওঠে আর তুই!' আমার সত্যিই শরম নেই। পড়ার চেয়ে হেমতাজ সাহেবের বাদাম ভাজা দেখতে ভালো লাগে, মুন্নি বেগমের রাজাই বিছিয়ে এসরাজ বাজানো, লাল ঘুড়ির উড়ান, হাওয়ায় গা লাগিয়ে আলতো দোলা দিতে দিতে ওই আকাশের গায়ে বিন্দু হয়ে ওঠা এসবই আমার পছন্দ। মনসব মিঞার কাওয়ালিও প্রিয়।
পড়াশোনা হলনা বলেই আম্মি কাজে লাগিয়ে দিল, সকাল থেকে সন্ধ্যে আমায় হাতুড়ি পিটতে হত। নাহ্ অন্ধকারের ভিতর গরম লোহা পিটানো আমার ভালো লাগে না। তারচেয়ে দুই হাজার টাকা কমে উকিলবাবুর বাগান পরিস্কারের কাজ পছন্দ হল। রাতদিন বুঁদ হয়ে ডুবতে লাগলাম। আহা এই তো চেয়েছিলাম। প্রথম শীতেই জালালউদ্দিন সাহেবের বাগান গোটা মহল্লাকে টেক্কা দিল। আমি গাছগুলোর গায়ে হাত বোলাই। বিদেশী আর বনসাই গুলো, বড় দুঃখী। ওদের কষ্টে বুকের ভিতর মুচড়ে ওঠে। কথা বলি ওদের সাথে। বাতাসে তিরতির কাঁপে পাতা। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি।
-আপনি রাতদিন কী এত ভাবেন?
-ভাবতে তো পারিনা। কেবল দেখি। খোদাতালার সৃষ্টি।
-এতো আপনার কেরামতি!
-কী কন! খোদায় না করলি হত?
-তাহলে অন্যদের হয়না কেন?
-খোদায় যা দিছে তার যত্ন জানতি হয়।
মেয়েটা সেদিন প্রথম বোরখার ঢাকা সরিয়ে চোখ মেলেছিল আমার দিকে। সেইদিনই আমি কুয়াশা দেখেছিলাম। নিজেকে আড়াল করে বলেছিল, 'আর মানুষ! তার যত্ন জানেন?' মাথা নীচু করে বাগানের ঘাস খুঁটতে শুরু করেছিলাম। আম্মির পায়ের ব্যথা নাকি আমি তেল দিলেই কমে, আব্বা বলে আমি আছি বলেই তার জীবনের তকলিফ কম, 'বেটা আমার কতদিন আলুছানায় ভাত খায়, রা কাড়ে না।' বহিনরা গলা জড়িয়ে বলে, 'ভাইয়া আমার খোদার রহমত, পীর ফকির।'
-কী হল উত্তর দিলেন না!
-জি আমি ভালোবাসি মানুষ, গাচপালা আর এই আকাশ বাতাস।
মেয়েটার মুখে ঝকঝকে রোদ্দুর এল। এরপর থেকে কারণে অকারণেই বাগানে তার আনাগোনা বাড়ল। আমিও ভালোবাসলাম তাকে। আম্মি, আব্বা, বহিন আর বাগানের মতো। উকিলসাহেবও আমাকে ভালোবাসেন। হবে নাইবা কেন! তার বাগানের তারিফ এখন সবখানে। দিনটা ছিল সম্ভবতঃ রবিবার। উকিল সাহেবের বাড়ি অনেক নতুন পুরোনো মোটরগাড়ি এসেছে। আমার কাজ শেষ। খড়কুটো ধুলো ঝেড়ে এগিয়ে চলেছি সদর দরজার দিকে। গম্ভীর গলায় জালালউদ্দিন সাহেব হাঁক দিলেন, 'রিয়াজ, এদিকে শোন।' সাদা পাজামা আর খাটো ফতুয়া পরা মানুষটা যেন দরবেশ। ওর কাঁচাপাকা সাদা দাড়ি। জি বলে সালাম দিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরে বেশকিছু রইস লোকজন। আমি দেখলেই বুঝি। এদের গায়ে আদেখলা অহংকার টগবগ করে ফোটে। সবার সবকিছুতেই তারা খুঁত খুঁজে পায়। নিজের গুণগান করার সময় ওদের মুখের হাঁ বড় হতে হতে নিজেকেই গিলে ফেলে।
-রিয়াজ, হেমাইতপুরে লিটন সাহেবের একটা বড় প্রপার্টি আছে। সেটা দেখাশোনা করা, বাগানকরা, সাফ সাফাই এসব কাজের জন্য দিনরাতের একজন লোক খুঁজছে। ভালো মাইনে থাকা খাওয়া সব দেবেন উনি। কেবল লোকটি ইমানদার হতে হবে। আমি তোমার কথা বলেছি। সামনের মাসে মানে পরশু তুমি হেমাইতপুর চলে যাও। কাজ শুরু করে দাও।
হেমাইতপুর মানে তো এখান প্রায় সাতঘন্টার বাসজার্নি। সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে? কিন্তু আমি তো বলতে পারিনা কিছু। আমার বোধহয় আলজিভ নেই। ঘাড় নেড়ে জি বলে পিছন ফিরে আসতেই ভিতর থেকে শেয়ালের আওয়াজ শুনলাম।
-জালাল সাহেবের মতো একঢিলে দুইপাখি কজন মারে?
পিছন ফিরতে ইচ্ছা হচ্ছিল খুব। জালালসাহেবের মুখখানা দেখার ইচ্ছেটা বুকে চেপেই বাড়ি এলাম। আম্মি প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারলনা, টাকা বেড়েছে বলে খুশিতে নাচবে নাকি আমি চলে যাওয়ার দুঃখে কাঁদবে। ফ্যালফ্যাল করে বলল, 'আমার পায়ের ব্যাথা?' বাসে ওঠার পর বুকের ভিতর উথালপাতাল করছিল। কুয়াশা পিছনে রেখে তবু আমি চলে এলাম। শেষদিন বিদায়ের সময় মেয়েটা এসেছিল।
-মনে রাখবেন আমায়?
-হ্যাঁ।
-যদি মরে যাই।
-ক্যান মরবেন ক্যান?
-এখানে সব পাথর। আমার ইচ্ছেরা মাথা ঠুকে মরে।
-আপনার কী ইচ্ছে?
-ওড়ার, বাঁচার, দৌড়ানোর।
-তা করেন। খোদায় মালিক। তার কাছে ছাড়া আর কারুর কাছে জবাব দেন ক্যান?
-আপনি দেন না? আব্বার কথা মানলেন কেন? বোঝেন না আপনার সাথের সময়টুকু আমি বাঁচি।
বাসটা হেমাইতপুর পৌঁছানোর আগে বিশ্রী শব্দ করে থেমে গেল। আমার একটা ছোট্ট সুটকেস। ওই নিয়ে নেমে পড়লাম। একে তাকে জিজ্ঞাসা করে পৌঁছে গেলাম বাড়িটায়। ইবলিসের কারখানা সেই লিটনসাহেবের বাড়ি। বাগান আছে ঠিকই তবে সব যেন পোড়া। সুপুরি, আম, লম্বু এমনকি বাতাবিলেবুর গাছটাও। আমার ঘরটা বাগানের কোণায়। ঘরটাতে ঢুকেই বুঝলাম অনেকের সেটা পছন্দ হলনা। তার মধ্যে আরশোলা ফরফর করে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। ব্যাঙেদেরও দেখলাম বেশ আপত্তি। কেবল চন্দ্রবোড়া সাপটা তাচ্ছিল্য দেখিয়ে চলে গেল। ঘরটা পরিস্কার করে বাসযোগ্য করতে না করতেই ফরমাইশ। কিন্তু গোটা একটা সপ্তাহ কেটে গেলেও আমি বুঝলাম না উকিলসাহেব আমায় এখানে কী করতে পাঠালেন। বাগানে একটু সময় কাটালেই রে রে করে ওঠে বড় দালানের লোকেরা। তাহলে বাগান করব না! কেবল হুকুমের গোলাম আমার নসিবে লিখলেন কেন জালাল সাহেব। বাড়িটার ভিতর সব দরজায় ভারী পর্দা, ভিতরে গেলেই দেশলাই বাক্সের গন্ধ পাই। লোক আসে লোক যায়, বাক্স আসে বাক্স যায়। গাছগুলো পোড়া চেহারায় আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর সে এল। আমি আনন্দে ছুটে গেলাম। মনে হল কয়লার দেশে হঠাৎ যেন চাঁদ এসেছে। সামনে দাঁড়িয়ে বলল, 'আপনে! ইখানে!' তার নিজস্ব কুয়াশা ভরে দিয়েছে কন্ঠ, চোখ থেকে টুপটাপ বৃষ্টি।
-কেন আসতে নেই!
-আমি তো কই আপনের এখানে আসা লাগেই লাগে। এত আবর্জনা পারলে আপনেই দূর করতি পারেন।
-আর কোনো কারণ নেই!
এরচেয়ে বড় কারণ কী হতে পারে? নাহ্ আমার মাথায় এল না। আমার ঘরের বারান্দায় বসতে দিলাম, মোড়াটা ছেঁড়া, তা আর কী করা? কী কথা বলব ভেবে পাইনা। যদিও এতদিন পর আমার বুকের ভিতরটা বেশ আরাম পাচ্ছে। সে কেমন যেন জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে।
-আচ্ছা বাগানের কাজ যে করে সে ভালোবাসে গাছ?
-না।
-তাহলে কাজ করে কী করে?
-দায়সাড়া কাজ করে।
-আর গাছগুলো।
-ওরাও দায়সাড়া ভাবে বাঁচে। আচ্ছা আপনার আর কিচ্ছু বলার নেই?
-আপনার আছে?
-আছে, আপনার এখানে থাকতে কষ্ট হয় না?
-কষ্ট হয় গাছগুলোর জন্য। চুপিচুপি কই শোনেন পিছনের গাছগুলার রঙ ফিরসে।
-আর আমার রঙ!
-আপনে তো কুয়াসা! বোজ্আ যায় না। আচ্চা আপনে কার লগে আইলেন?
-একাই এসেছি তবে নিয়ে যাবার লোক এল বলে।
-সে আসুক আমি আপনের চা আনি।
সে হঠাৎ উঠে পড়ল, আমার হাত ধরে টেনে ঘরে নিল। আচমকাই ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিল। বাঁ হাতটা নিয়ে গিয়ে রেখে দিল নিজের ডান বুকের উপর। আমার ভিতর হায়াৎ ভাইয়ের আখের রসের মেশিন চলছে যেন। ধপাধপ সব ভাঙছে চুরছে অথচ মিষ্টি টুংটুং আওয়াজ ঠিক হয়ে চলেছে। ছায়া সরে গেল নাকি। সেও সরে গেল। চোখে তার পানি।
-রিয়াজ আপনি আমায় ভালোবাসেন?
-খুব ভালোবাসি। আম্মির মতো আপনার সেবা করতে ইচ্ছে হয়।
-রিয়াজ আমি আর আম্মি এক নই। এইমাত্র যা হল তা কি আম্মির সাথে হয়? এই অনুভূতি আলাদা। আপনি আমার মত নন হয়তো আমাকেও বোঝেন না, তবু জানিনা কেন আপনার দিকেই ছুটে আসি।
সে ঘর থেকে বেরোতেই দেখলাম জালালসাহেবের গাড়ি। সে একবার পিছন ফিরে আমায় দেখল। বুকের ভিতর তার ব্যথা তাই চোখেও। চুপচাপ গাড়িতে উঠল গাড়িটা চলে গেল। আমি এগিয়ে গেলেও জালালসাহেব আমার দিকে তাকালেন না। চলে গেল গাড়ি। সব কাজের ভিতর বিশেষ মুহুর্তটি বারবার মনে আসতে লাগল। ঠোঁটের স্বাদ ভুলে গেলাম, ভুলে গেলাম বুকের কোমলতা কিন্তু মুহূর্তটা কী করে যেন টিকে গেল। আরও প্রায় একমাস পর লিটনসাহেব আমায় ডাকলেন। ওর লালচে ছোপধরা দাঁত, ছোটো চোখ আর তীক্ষ্ণ নাকে একটা জবরদস্ত হিংস্রতা আছে। ঘরে তখন বারুদ গন্ধ তীব্র।
-আসো রিয়াজ। বসো। ইখানে কুনো অসুবিধা নাই তো তুমার।
-জি নাহ্!
-রিয়াজ, জালালসাহেব আমারে বড্ড ধমকায়সে।
-ক্যান?
-তুমি হলা মালি, খুবসুরৎ গুলাব তুমার পসন্দ আর তুমারে আমি বারুদ শুকাই। নাহ্ নাহ্ এইডা ঠিক না।
-হুজুর কি আমায় বরখাস্ত করছেন?
-কী যে কও! আমি ঠিক করসি এই বাড়িডা তুমারে ছাইড়া দিমু। এক্কেরে লিখা পড়া কইরা। তুমি মনের মত ইডারে সাজাও।
কী বলছে লোকটা এই এত বড় জায়গাটা তাকে লিখে দেবে? এও কি হয়? লিটন সাহেব কাগজ কলম বের করল। তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, 'নাও, সই করে দাও।' ভাঙা ভাঙা ভুলে যাওয়া অক্ষরে সই করলাম। দুটো জায়গায়। একটা আমায় দিয়ে বললেন, 'যত্ন কইরা রাইখ রিয়াজ। জালালসাহেব বড্ড ভালো মানুষ। আমি ঠিক ততডা নই। এত বড় পোপার্টি খরিদ করলেন। তারপর তুমারে দিবার কইলেন। আহা মানুষ বটে।' এই ইবলিশের কারখানাটাকে হঠাৎ আমি ভালোবেসে ফেললাম। ভুলে গেলাম বিগত ছমাস এরা আমায় দিয়ে কি খাটান খাটিয়েছে। একা আমি সব করেছি। এই বাড়িতে ওরা কাউকে ঢুকতে দেয় না। আশেপাশে এক কিলোমিটারের মধ্যে কিচ্ছু নেই। আমি বাজারে গেলে সবাই হাজার প্রশ্ন করত। তবে আমি নুনের কদর জানি তাই ঠোঁট খুলতাম না। অবশ্য একটা মুশকো মতো ছেলে নজরদারি করত। সেইসব ভুলে গেলাম। যদিও আজকের দিনটা আশ্চর্য লিটনসাহেব বলল, 'কদিন বাড়ি থেকে ঘুরে এস, এই নাও তোমার ছমাসের মাইনে।' আমার হাতে যে টাকাটা এল আমার দম বন্ধ হয়ে গেল তাতে। এত টাকা! এত!
-সাহেব ইখানে কত টাকা?
-কেন নব্বই হাজার। প্রতি মাসে পনেরো। দেখ রিয়াজ ইবার তুমি ব্যাঙ্কের বই কইরা নিবা। এত টাকা নিয়ে যাওয়া সঠিক হইব না।
-আপনে আমারে দশ হাজার দিয়ে বাকিডা রাখি দেন। ব্যাঙ্কের বই হলি ঢুকায় দেবেন।
লিটনসাহেব দোনোমনো করেন। তারপর বলেন, 'দ্যাহ রিয়াজ, জালালসাহেবরে তাহলি কিছু কওয়ো না। উনি এক কথার মানুষ। খেইপা যাইব।' আমি হাসলাম।
-চিন্তা কইরেন না।
বাড়ি ফিরে এলাম আম্মিকে বললাম সব। আম্মি তো মাইনে শুনে কেঁদে ভাসলো। আব্বু পিঠে হাতয়রেখে বলল, 'রিয়াজ তুমি নেকবান্দা তুমার ভালো হইব না তো কার হইব।' দুদিন ভালো খাওয়া দাওয়া হল। আম্মি আব্বু ভাই বইনদের সঙ্গে আলাপ করে ঠিক হল আমার মাইনের টাকায় ঘরটা পাকা হবে, পাকা বাথরুম, কল। ছোটো বইন বলল, 'রিয়াজ ভাইয়ার দুইডা জামাপ্যান্ট লাগব আম্মি।' আমি জালালসাহেবের বাড়ির পথ ধরলাম। সাথে দুটো গোলাপগাছ। দারোয়ান আমার দিকে তাকিয়ে খুব বিশ্রি হাসল।
-নিকাল ইহাঁসে। দুবারা দেখেগা তো শর ফোর্ দেগা।
এমন আচরণের কারণ বুঝলাম না। সরে এসে একটু দূরে দাঁড়ালাম। আকাশে তারা ফুটল, দেখলাম জালালসাহেব দুতিনজনের সাথে বেরোলেন ইমতিয়াজ আলীর খুশবুদার পান খাবার জন্য। এগিয়ে গেলাম।
-সাহেব আদাব!
চমকে উঠলেন জালালসাহেব।
-কবে এসেছ রিয়াজ! লিটন সাহেব মাইনে দিয়েছে তো?
-জি সাহেব। সাহেব। ফুলগাছ। দেবেন।
-কাকে?
আমার মনে পড়ল আমি তার নাম জিজ্ঞাসা করিনি কখনো, সেও বলেনি। কিন্তু তাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে বড্ড।
-সাহেব, দারোয়ান আমায় ঢুকতে দিল না। আপনি বলে দিন আমি একবার ভিতরে যাব।
-কেন?
এরও কোনো উত্তর আমার জানা নেই। মাথা নিচু করে চলে এলাম। ভেতরটা মুচড়ে উঠছে।একটাবার দেখতে ইচ্ছে করছে। কেন জানিনা। পথে পথে ঘুরলাম। ধুলো পায়ে আকাশে তাকালাম। অন্ধকার হয়ে আছে সব। চাঁদ নেই।
-দরজা খোল শুয়োরবাচ্চা!
বিশ্রী চিৎকার আর দরজায় ঘন ঘন লাথি। ভয়ে জড়োসড়ো মা, বইনেরা, ভাইয়ের চোখেও বিস্ময়। আব্বা দরজা খুলতেই ঝড় আছড়ে পড়ল ঘরে। ছিটকে পড়লাম আমি। মাথা ঠুকে গেল কিসে? অশ্রাব্য শব্দের বন্যার ভিতর ঘাড় গুঁজে পড়ে রইলাম । আম্মির কান্না চাপা পড়ে গেল গর্জনে। আমি বোমা বানাই, আমি স্মাগলার, আমার কাছে নাকি নব্বই হাজার টাকা আছে। যেটা প্রমাণ করে দেবে আমার বেইমানি। নব্বই হাজার। শব্দটা খুব চেনা। আমার ল্যাতপ্যাতে শরীরটাকে ঝুলিয়ে ঘষটে ছুঁড়ে দিল গাড়িতে। নিয়ে গেল থানায়। আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল। তবু শুনলাম, 'স্যার নব্বই হাজার কোথায়? ন হাজার চারশো পেলাম। বলল ওর বাপ দশ হাজার এনেছিল। সব খুঁজলাম কিচ্ছু নেই!' এরপরের গলাটা খুব চেনা।
-হারামখোর লিটন বোধহয় দেয়নি। সব বাটপাড়। দেখছি ওকে। আগে এটাকে দেখ। যেন ছাড়া না পায় সহজে।
-পাগল নাকি স্যার! তাছাড়া এই যে দলিলটা তো পাওয়া গেছে। ওই বিশাল প্রপার্টির মালিক যেটাতে বোমার কারখানা। ছাড়া পাবার প্রশ্নই নেই। তার উপর হ্যাংলা চেহারা। দেখছেন না আজ রাতের মারেই কেতরে পড়ে আছে।
নাহ্ আমার আর জাগতে ইচ্ছে হয়নি। আমিতো জালালসাহেবকে ভালোবেসেছিলাম। তার বাগান, তার মেয়ে। সেই কুয়াশার মতো মেয়ে। এবার জাগলে নামটা ঠিক জেনে নেব। আম্মিকে আজ রাতে পায়ে তেল দেওয়া হল না। পুলিশটা লাথি মেরেছিল ওই ব্যথা পায়েই? আব্বার ভ্যানটা ভেঙেছে বোধহয়। আর কী কী ভাঙল? আর কী কী?
আমি শুয়েই থাকি এখন। এখানে খুব শান্তি। যারা আমার সাথে শুয়ে থাকে সবাই চুপ। যতদিন একটু ঘুম ভেঙেছে পুলিশগুলো আমার হাড় ভেঙেছে। আমায় সুন্দর কিচ্ছু দেখতে দেয়নি। তাই আমি ঘুমিয়েই গেলাম। এই প্রথম মেয়েটা এল। কুয়াশার মতো মেয়ে। ফুলগুলো রেখে দিল আমার বুকের উপর। আমি পারলাম না ওর হাত ধরতে। বলতে ইচ্ছে হল আমি ভালোবাসি। আম্মিকে, আব্বাকে, ভাইকে, বহিনদের, গাছপালা নদ নদী আর তোমাকে। সে চলে গেল কবরস্হান পেরিয়ে শহরের দিকে।
বাক রুদ্ধ করে দেয় সৌমীর কলম
উত্তরমুছুনআন্তরিক ধন্যবাদ স্যার
উত্তরমুছুনসৌমী