ফাল্গুনী ঘোষ - মায়াজম

Breaking

২৮ জানু, ২০২৪

ফাল্গুনী ঘোষ

 




ছায়া জীবন

সব মানুষই আসলে ছায়া খোঁজে... নাহ, ছায়া সবসময় রোদের চড়া আলোয় যে খুঁজে পাওয়া যায় তা নয়। দেহপোজীবিনি রোদ তো একটু সুযোগ পেলেই চড়া রুজ, লিপস্টিক, পাউডার মেখে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ইশারা ছুঁড়ে দেয় পথচলতি পথিককে। সে রৌদ্রের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ানো মানেই ঠা ঠা পুড়ে যাওয়া। অনেকটা ভাদুরে রোদের মতই আলাপন তার। কোনো গিদের নেই। সোজাসুজি ব্যবসাদারির দুনিয়ায় আহ্বান।

অত গিদের করার তার সময়ই বা কই! ইচ্ছে যে নেই বা থাকে না সে কথা আপনার বা আমার অভিধানে লেখেনি কখনও। তবে হাট্টাকাট্টা পুরুষের মত ধীর, ঠান্ডা একটা দেওয়াল তার আছে, যে ছায়ায় গিয়ে সে বসে। এ ছায়া বালবিধবার মত ক্ষণিকেই নিরাসক্ত। শুধু দেওয়ালে একটি  হ্যাঙার রাখার নির্দেশ থাকে।

সে হ্যাঙারে ঝুলতে থাকে সারি সারি প্রজাপতির পাখা। ছোট, বড়, একঘেয়ে, ছটফটে, মনমরা, রঙচঙে। যেদিন যে ইচ্ছে তার উপর ভর করে সেদিন সে সেইরকম ডানা হ্যাঙার থেকে খুলে তার পিঠে খুব কষে আটকে দেয়। কোনো পাখা বা পুরনো হয়ে গেছে.... ভেতরের রঙ ফ্যাকাসে, আবার কোনো পাখার এক দিক ঝনঝন করছে পুরনো ট্রামগাড়ির মত।

একঘেয়ে ফ্যাকাসে একটি ডানা পিঠে গুঁজে মিনতি মাসি পথে বেরোয় রোজ। মিনতি মাসির পেটের রোগ। তলপেট ফুলে থাকে সবসময়। সে ফোলার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ব্যথাজীবন। মাসি হাঁটে। যদিও তার বেশি হাঁটা মানা, তবুও সে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে বুকের আশ্চর্য প্রদীপে আঙুল ছুঁইয়ে ব্রা-এর অন্দরমহল থেকে জোর করে টেনে নিয়ে আসে হাড় জিরজিরে অথচ কনেবউ রঙা লাল টুকটুকে পার্স। সেফটিপিন দিয়ে সেখানে সলাজকে ফালা ফালা করা হয়েছে নির্দয় ভাবে। তারই ভেতর থেকে উঁকি দেয় কিছু রেজকি। বিড়বিড় করে মিনতি। নাহ, আজ ভরদুপুরের ভন্যি রোদ্দুরে তাকে আবার হেঁটেই ফিরতে হবে।

কাজের জায়গায় যা হোক দুটো খেতে পাওয়া যায় এই শান্তি। রোজের পয়সা দিন সাতেক জমলেই শপিং মলের উল্লাস মনে। মেয়েটার কাঁধে যে রঙচঙে ডানা! আবার সে ডানা মনের আনন্দে নাচতে নাচতে ছুঁয়ে যায় হাওয়া জীবন....

মিনতি মাসির খুব ইচ্ছে হয় মেয়েটার ডানার রঙ ঘষে ঘষে মুছে দেয়। কেন বাপু! ফ্যাকাসে ঝনঝনে ডানাটি তো এক আধবার কাঁধে ছোঁয়ানো যায়!

এখনই কোন পঙ্গপালের দল ঝাঁপ দিয়ে পড়লে ফুলে ফুলে রঙ ছড়িয়ে উড়ে বেড়ানো বন্ধ হয়ে যাবে। তাও মিনতি হাঁটে, সক্কাল সক্কাল হাঁটে, ভরদুপুরে হাঁটে, সন্ধার পরতে পরতে হাঁটে

হাঁটতে হাঁটতে একদিন কালীঘাট জীবনে মেয়ের ডানার রঙে রওশনবাজি এল। মায়ের পেটব্যথার খবর তখন সরকারি হাসপাতালের মেঝে জানে! তবু মিনতি মাসি থামে না। ছেঁড়াফাটা ডানা সেলাই করে ট্যাঁকে গুঁজে বেরিয়ে পড়ে। ডানা নাড়াবার মত জোর কাঁধে নেই, কিন্তু অভ্যেস জোঁকের মত লেগে থাকে চামড়ায়। শুষে নেয় মিনতি মাসির যাবতীয় নোনা জল।

দিনশেষে বাড়ি ফিরে হ্যাঙারের শুন্যতায় মাথা পাতে মিনতি। বড্ড ফাঁকা লাগে হ্যাঙারটা। ঐ একটিই রঙচঙে ডানা ছিল দেওয়ালের। কিন্তু... দাঁতে দাঁত পেষে সে। হঠাৎ খুট শব্দে দরজা খোলে। এক সকরুণ অবয়ব দেওয়াল জোড়া প্রজাপতি ডানার সামনে দাঁড়ায়।

কে এ মহিলা! মিনতি তো একে তেমন চেনে না। একটি একটি করে ডানা মহিলার চোখের সামনে সরে যায় অথবা ডানাগুলিকে রেলের কামরার মত হাত নেড়ে বিদায় দিতে দিতে একটি ধূসর কামরার হাতল ছুঁয়ে দেয় সে। দেওয়ালের গা থেকে খসে পড়ে সুড়কিযাপন। ধীরে ধীরে অবয়বে চোখ, নাক, মুখ ফুটে ওঠে রাতের আকাশের তারার মত।

ঠিক সে সময় দশ দিক দিকবিদিক হয়ে ছুটে নামে লোক গিজগিজে ট্রাম বাসের ভীড়ের ঝাঁপিতে।  ভীড়ের মধ্যে ধূসর ছেঁড়াফাটা একটি প্রজাপতি ডানা কেজো দ্রুততায় ছুটে যায়। যেতে যেতে বিড়বিড় করে...  খুব হাঁটে...  সকালে হাঁটে... দুপুরে হাঁটে...  সন্ধায় হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে বুকের আশ্চর্য প্রদীপে আঙুল ছুঁইয়ে ব্রা-এর অন্দরমহল থেকে বের করে নিয়ে আসে ছেঁড়াখোড়া পার্স।

কটি খুচরো হাতে নিয়ে ভাবে... এ আজ আর খরচ করতে পারবে না প্রাণে ধরে... খুচরো জমতে জমতেই পাহাড়... তাহলেই চিকেন আর গরম ভাতের উল্লাস!

ধূসর ছেঁড়াফাটা ডানার মহিলার একটু তফাতে মিনতি মাসি আরো জমাট ভীড়ে নিজেকে মিশিয়ে রাখে। আজকাল কোঁচড়ে ডানা বাঁধলে তার পরিশ্রম হয়! তাই দুহাতে দুটি ডানা নিয়ে সে মেয়েটাকে ডাক দেয়.... একহাতে তার নিজের ধূসর ডানা, অন্য হাতে একটি রঙচঙে ডানা...তার মেয়েটা রঙের আলাপ খুব ভালোবাসে.... এ রঙচঙে ডানাটি তার মেয়ের হাতে দিতেই হবে আজ।মলিন মেয়েটির মুখে মিনতি মাসির ছায়া পড়ে...

২টি মন্তব্য:

  1. সমকালের অন্যতম বা সর্বাপেক্ষা প্রিয় লেখকের গদ্যে কী অনায়াস দক্ষতায় উঠে আসে প্রতিরোধের ভাষ্য-"অনেকটা ভাদুরে রোদের মতই আলাপন তার। কোনো গিদের নেই। সোজাসুজি ব্যবসাদারির দুনিয়ায় আহ্বান।" জ্বালাপোড়ার তীব্রতা আছে, আছে উত্তরণের বাসনা। নেই অনাবশ্যক চিৎকৃত প্রতিশোধস্পৃহা। এই মুক্তগদ্য বা মনকণিকা, যে নামেই তারে ডাকি-মুগ্ধ করে, মুক্ত করে বারবার। অনবদ্য সৃষ্টি। সঙ্গের অলঙ্করণের প্রশংসা করা ভাষার অতীত। সতত শুভকামনা এবং অভিনন্দন জানাই।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব সুন্দর গদ্য। জাদুবাস্তবতার পরশ লেগে আছে।

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র