পিন্টু রহমান - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

পিন্টু রহমান

                                                               কালচক্র 







নিজ-নিজ কপালকে গালমন্দ করলেও কপালের ওপর মজু কিংবা আম্বিয়ার কোনো হাত নেই। যদি থাকতোই তবে বার-বার আর এমন হতো না; স্বপ্নের ফানুসটা শূন্যে ডিগবাজি খেত না। অথচ স্বপ্ন নিয়ে অস্তিত্বহীন জল্পনা-কল্পনা, বাস্তবায়নের কত রকম উদ্যোগ কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না; যোগফল শূন্য। তথাপি স্বপ্নগুলো নতুন করে জোড়াতালি দেয়। নিত্য-নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। বৃত্তের বাইরে পা ফেলার প্রত্যয়ে চলতে থাকে দ্বন্দ্ব । অবশ্য এসব দ্বন্দ্বের কোন কুল-কিনারা হয় না। কেনোনা, একজনের সময় তো আরেক জনের অসময়; কেউ একজন এক পা এগোলে অন্যজন দুপা পেছাবে। সাধ আর সাধ্যের সমীকরণ সরলরেখায় আনতে পারে না কিছুতেই। 
তির-তির করে মজু ব্যাপারীর হাত-পা ঘামতে শুরু করে; সেই সাথে মেজাজও। হতাশাময় মূহুর্তে মুখে হতাশার সুর ধ্বনিত হয়, উঃ অসয্যু, আর তো পাচ্চিনি খুদা; মশার কামুড়ি শরীলডা এক্কেবারে শ্যাষ হয়ি গেল য! 
পাটক্ষেতের সংকীর্ণ পরিসরে মজু ব্যাপারী অস্থির চিত্তে পায়চারি করে। এক-একবার সম্মুখে উঁকিঝুঁকি মারে। দৃষ্টির প্রখরতায় নিজের চারপাশটা সন্তর্পণে খেয়াল করে। দিনের আলোয় এই একটা বাড়তি ঝামেলা; যে কোন মূহুর্তে বিপদের আশঙ্কা। কেউ একজন দেখে ফেললেই হলো, সমাজের সাথে-সাথে বাড়ির দরজাও স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। মজুতবু না এসে পারে না; হয়তো জীবনের জন্যই জীবনের সাথে জুয়া খেলে! একচিলতে সুখের আশায় সমাজের চোখ ফাকি দিয়ে ছুটে আসে-ছুটে আসে আম্বিয়াও। 
পাটের বাড়ন্ত ডগাগুলো কদিনেই মাথা ছাড়িয়ে গেছে। মজু বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয়। তারপর থেমে-থেমে শিস দিতে থাকে। আগের মত এখন আর দম নেই। শরীরেও কুলায় না। অল্পতেই হাফিয়ে ওঠে। মাথার মধ্যে চক্কর দেয়। চোখের আকাশে তখন যেন জোনাকিপোকার মিছিল শুরু হয়!
ক্ষেতের ওপারেই আম্বিয়ার শতচ্ছিন্ন কুটির। অন্যান্য দিন শিস দেওয়া মাত্র হাজির হয়। লুকিয়ে-লুকিয়ে দুজন আড্ডা দেয়। সুখ-দুঃখের গল্প করে। অনাগত ভবিষ্যতের ছবি আঁকে। পিছনের দিনগুলোতে ফিরে যায়। কিছু-কিছু ভুলের জন্য অনুশোচনা হয়। মনে হয়, ঐ ভুলগুলো না করলে জীবনের মলিন চিত্রটা আরো বেশি উজ্জ্বলতা পেত; কিংবা বয়সের ভারে নুঁয়েপড়া শরীরে আরেকটি নতুন যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিতে হতো না। 
শশ্-শড় শব্দে একটা শেয়াল ছুটে আসে। মুখে তার কিশোরী হাঁস; হাত-পা ছুড়ে লাফালাফি করে। ধূর্ত শেয়ালের চোখে যেন আগুনের প্রজ্বলিত শিখা। মজু ঘাবড়ে যায়। বার-কয়েক ঢোক গেলে। কি আশ্চর্য; যে মানুষটাকে দেখলে একদা মেছো-বাঘ পালাতো, বুনো-মহিষের সাথে ছিল যার ঘরবসতি, বল্লম-হাতে লড়াই করতো শুকরের সাথে; কাল পরিক্রমায় সেই মানুষটাই আজ শিয়ালের কাছে অসহায়! ইচ্ছে করলেও চিৎকার চেঁচামেচি বা লাঠি হাতে তাড়া করতে পারে না। সাক্ষীগোপালের মতো হাঁসের জীবনযুদ্ধ লক্ষ্য করে। তাছাড়া চিৎকার করলেই তো বিপদ, লোকজন ছুটে আসবে! আর দিনকাল যা পড়েছে; কামড় দিলে বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে। কতদিন হয়, ডাক্তার বাড়ির রাস্তাটা সে ভুলতে বসেছে। অসুখ-বিসুখ হলে অন্দরমহলে জায়গা হয় না; বার-বারান্দায় অভুক্ত কুকুরের মত জড়সড় হয়ে শুয়ে থাকে। নিঃসঙ্গ জীবন। বৌ-ঝিদের ভয়ে নাতি-নাতনিগুলোও কাছে আসতে সাহস পায় না। 
শিয়াল চলে যাওয়ার পরেও মজু ঝুপ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। তার স্মৃতির সুতোয় টান পড়ে। মতির মার কথা মনে হয়। মানুষটার কি যে হলো, ৩৫ বছরের ঘর-সংসার ফেলে দুদিনের জ্বরেই ওপারে পাড়ি জমালো! 
দোষে-গুণে মানুষটা একেবারে খারাপ ছিল না। অভাবের সংসার। ঘরে সাত-আটটা মুখ। মজুর তখন সবে গরু-ব্যবসার হাতেখড়ি। বাড়ি ফিরতে-ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত। ছেলে-মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লেও রহিমন না খেয়ে অপেক্ষা করতো। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে গা হাত পা টিপে দিত। মমতামাখা মুখে অভিযোগের সুরে কোন-কোনদিন রহিমন বলতো, ও মতির বাপ, এত ছেরমত করি কি করবা; অকালে গোরে যাবা নাকি! এতো ছেরমত করার দরকার নি; একদলা শরীলে আর কতো কুলাবে। তাছাড়া বেশি ট্যাকা-পয়সা ভালো না,সুংসারে অশান্তি টানি আনে, মানুষ অমানুষ হয়ি যায়।
এসব কথা তখন মজু ব্যাপারী পাত্তা দিত না। উল্টো রহিমনকে বোঝাতো, ট্যাকা-পয়সার তুমি কি বোজো; ট্যাকা-পয়সা না থাকলি দুনিয়ায় কুনু দাম নি; বুড়ুকালে না খায়ি মত্তি হবে। 
রহিমনের জীবনভাবনা ছিল খানিকটা অন্যরকম। হাটে যাওয়ার আগে বার-বার মনে করিয়ে দিত, মতির বাপ, না খায়ি জানবান্দি রাকু না; খিদি লাগলি ইডা-সিডা কিনি খায়ু। 
আজ মনে হয় রহিমনের কথাগুলোই হয়তো সঠিক ছিল। 
একটা বিষয় ভেবে মজু ব্যাপারী অবাক হয়; লুকিয়ে-লুকিয়ে আম্বিয়ার সাথে দেখা করতে এলেই রহিমনের কথা বেশি করে মনে পড়ে যায়, অপরাধ-বোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আচ্ছা, মানুষটা ওপারে গিয়েও কি সব দেখতে পায়! মজু প্রবল বেগে মাথা নাড়ায়। 
-ষাঁড়ের নাকাল এরাম করি মাতা ঝেকাচ্চু ক্যানে; মাতার মদ্দ্যি ক্ষেতের পুকা ঢুকিচ নাকি? 

আম্বিয়ার কথা শুনে মজু ব্যাপারির ঘোর কেটে যায়। একটু-একটু করে বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসে। আম্বিয়ার নাকে আলতো টান দিয়ে বলে, ক্ষেতের পুকা ঢোকপে ক্যানে লো মাগী; তুমি নিজিই তো আস্ত একখান পুকা। 
মজুর সাথে যে কথায় পেরে ওঠা দুষ্কর আম্বিয়া তা হাড়ে-হাড়ে জানে। কারণ মধ্য জীবনের প্রায় দুই দশক সে গরু-ছাগলের ব্যবসা করেছে। হাটে-বাজারে দালালী করে বেড়িয়েছে। সাত-ঘাটের পানি তার পেটে।
আম্বিয়া খাতুন তটস্থ। চোখের পাতায় ঘরে ফেরার টান, কি কবা কউদিনি; মেলা কাজ পড়ি রয়িচে; ছাগলগুনির ঘাস কাটতি হবে। তাছাড়া এই ভরদুপুরে কেউ দেকি ফেলতি পারে। 
কথাটা অবশ্য মন্দ না। দিনের বেলা দেখা করার হাজারটা বিপদ। কথা বলতে গেলেও বার-বার তাল কেটে যায়। সবকিছু গুছিয়ে বলা হয় না। মজুর বুকে হতাশার ব্যঞ্জনা, কি কোরবু কউ, তুমাক না দেকি তো থাকতি পারিনি। মনের মদ্দ্যি আনচান ছটফট করে। জানডা যেনি বের হয়ি যাতি চায়!
মনের অবস্থা আম্বিয়ারও ভাল না। নয় বছর গত হয় স্বামী মারা গেছে। সেই সাথে ফুরিয়ে গেছে জীবনের সাধ-আহ্লাদ। মজু ব্যাপারীর শাড়ি পরে তাই খুশির উচ্ছ্বাস। কিন্তু রঙের জন্য মনটা খুত-রুত করে, নাল শাড়ি কিনুছু ক্যান; আমার বুজি সরম লাগেনা! মানুষ কি ভাববে কউ দেকি। 
মজু এত ভাবাভাবির মধ্যে নেই। তার ভাবনা জুড়ে শুধু একজন, সে আম্বিয়া- আম্বিয়াকে নিয়েই সে সুখের সাগরে ডুবে মরবে; পতঙ্গ হয়ে আগুনে ঝাপ দেবে। 
আম্বিয়ার কপালে টিপ দেখে মজু ব্যাপারী পুলকিত হয়; রক্তের মত গাড় লাল টিপ। 
- জানো আম্বি, তুমাক না খুব মানান লাগচে; মনে হচ্চে হুরপরী।

- মানান না ছাই; তুমি এমনি-এমনি রসিকতা কোচ্চু।

আম্বিয়ার চোখে চোখ রেখে মজু পুনরায় বলে, রসিকতা না গো, সত্যি কচ্চি। তুমাক দেখলি আমার দেল ঠাণ্ডা বরপ হয়ি যায়। 
আম্বিয়ার চোখে-মুখে ঈষৎ লজ্জা। অন্যের মুখে রূপের প্রশংসা শুনতে কার না ভাল লাগে! অকারণে আঁচলের খুট আঙ্গুলের সাথে প্যাচ মারে। মজু আবেগের আতিশয্যে আম্বিয়ার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলে, আর পারতিছিনে আম্বি। এই সুংসারে আমরা খালি ভূতির মতোন ছেরমত করি মরচি।কেউ এট্টু তালাশ করে না; ভাল কতা শুনায় না; শুদু লাত্তি ঝাটা মারে । আর না, চলো দেশান্তরি হই। নোতুন করি ঘর বান্দি। 
আজ নতুন না, অনেকদিন থেকেই ওরা দেশান্তরি হওযার কথা ভাবে। একঘেয়ে জীবন আর ভাল লাগে না। মজু ব্যাপারীর এখন অফুরমত্ম অবসর। রহিমন মানুষ করেছে ছেলে-পুলে আর তার ভাগ্যে আল্লাহ্‌ জুটিয়েছে একপাল গরুছাগল। সারাদিন মাঠে-মাঠে চরিয়ে বেড়ায়; সেবাযত্ন করে; মাঝে-মাঝে বিলের জলে গোসল করায়। 
নিজ-হাতে গড়া সংসারে মজু আজ নিজেই পরবাসী। রাস্তায় রকমারি স্বাদের ফেরিওয়ালা। জিভে পানি আসার মত বর্ণনা। খুব খেতে মন চায় কিন্তু পকেটে টাকা নাই। একটা বিড়ির জন্য ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এক-আধপোয়া যে চাউল চুরি করবে, বউ-ঝিদের জন্য সে পথও বন্ধ। রোগে-শোকে পথ্য নেই। কেউ খোজ-খবরও নেয় না। মাঝে-মধ্যে মজু কপাল চাপড়ায়। গভীর রাতে আম্বিয়ার কাছে দুঃখ করে। আম্বিয়ারও ঐ এক অবস্থা, সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই, দুক্কু কোরুনা গো, জীবন এরামই হয়। আমার দিকি চায়ি দেকো; আমিউ কি সুকি আচি! ছাগল না রাকলি কেউ একমুঠো ভাত দেয়না, মুকি ঠুঁকনা মারে, বৌ-ঝিরা গলায় দড়ি নিতি কয়। কতদিন তি এট্টু ফেনভাত খাতি মন কয়, কিন্তুক কতি পারি নি। 
মুহূর্তের জন্য মজু প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। নিজেই নিজেকে ধিক্কার দেয়, শালার জীবন; এই জীবন আমি মানিনি, গুষ্টি মারি। থুতু ছিঁটায়; থুঃ।
শূন্যে ছুড়েমারা থুতু তার নিজ শরীরেই ফিরে আসে। হয়তো থুতুগুলোও তার অসহায়ত্বের সাথে মশকরা করে। তবু মজুর মুখে শক্ত কথা শুনে আম্বিয়ার খুব ভাল লাগে। দেশামত্মরী হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ পায়।
- কিন্তুক, যাবো কুতায়, খাবো কি! 

- সেই হিসাব তোর না আমার; আমিই দেকচি কি করা যায়। দরকার হলি পালের একখান গরু বেচপো। কেউ বুজতিউ পারবে না। 

আম্বিযা ঘাড় নেড়ে এ কথায় সায় দেয়, ঠিকিই কোয়িছু, আমিউ তুমার সাতে আচি। পাল্লি পালের একখান ছাগোল বেচপো। কি আছে জীবনে!
দিনক্ষণ সব ঠিকটাক, তবু প্রতিবারই অজ্ঞাত কারণে তাদের যাওয়া হয় না। কেউ না কেউ বেকে বসে। টেকসই অজুহাত খাড়া হয়ে যায়। সংসারটাকে, জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা একটু সময় চায়। 
কিন্তু চাইলে তো আর সব সম্ভব নয়- হাজারটা পিছুটান,সংশয়। ছেলে-মেয়ে, বউ-ঝি, নাতী-নাতনি আর ছাগল গরুগুলো জীবনের সাথে continious tense এর ing মত গেঁথে আছে। আগ বাড়লেই ছোবল মারে।
কিন্তু আর কোন পিছুটান নয়; পিছনে বিধ্বস্ত অতীত আর সম্মুখে অনাগত ভবিষ্যৎ। আধারের বুক চিরে ওরা পথে নামে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমাগত পা চালায়। 
কিছুক্ষণ চলার পর মজু ব্যাপারী মনে-মনে অবাক হয়; সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া দুরন্ত যৌবন যেন প্রাণ ফিরে পায়! বুক-ভরে শ্বাস নেয়। কারো মুখে কথা নেই। আম্বিয়া বুকের সাথে শক্ত করে পুটলিটা খামচে ধরে। ডানে সোনাকান্দরের বিল আর বামে বাজিতপুর নামের বর্ধিষ্ণু গ্রাম- যে গ্রাম অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। এখানেই সে বড় হয়েছে। জীবনের অনেকগুলো দিন কাটিয়েছে। অথচ আজকের পর থেকে এই গ্রামের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। হয়তো কোন একদিন ভুলে যাবে নাড়ির টান। গ্রামটির প্রতি আম্বিয়ারও মায়া জড়িয়ে আছে। বউ হয়ে আসার পর মনে হয়েছে এটাই তার আসল ঠিকানা। নাইয়োরে গিয়ে গ্রাম নিয়ে ভাই-বোনদের সাথে কত মধুর বিতর্ক হতো! আম্বিয়ার মনে হতো, বাজিতপুরের পরাজয় মানে তার নিজেরই পরাজয়। 
বুকের মধ্যে সূক্ষ্ম যন্ত্রণার কষাঘাত। জলে ভেজা ঝাপসা চোখ। মজু ব্যাপারি হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। কয়েক পা পিছন ফিরে আম্বিয়া কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, মতির বাপ, হোঁচট লাগিছে নাকি?
মতির বাপ না সূচক ঘাড় নাড়িয়ে বলে, না:, দেকচি।
- অরাম করি কী দেকচু তুমি! 

- ঘাস দেকচি। দেকো কি চমেটকার সপ ঘাস! আহা: গরুগুন নিয়ি আলি মজা করি খাতু, তাই না আম্বি?

বাড়মত্ম ঘাসগুলো দেখে আম্বিয়া নিজেও আনমনা হয়ে যায়। এ যেন স্বর্গের খাসগালিচা! 
- , ঠিকিই বুলিচু; আমা ছাগলগুনুউ যদি আনতি পাত্তাম! 

হেটে-হেটে ওরা ক্লামত্ম; অবসন্ন। বুড়ো-বটগাছের নিচে খানিক বিশ্রাম নেয়; শরীর এলিয়ে দেয়। 
আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। পৃথিবীতে জ্যোৎস্নার বান ডেকেছে। বাতাসে ঝিঁ-ঝিঁপোকার মিহি সুরের আর্তনাদ। সবুজে ভরা ফসলের মাঠ। তার ওপর কুয়াশার হালকা আসত্মরণ। মজু ব্যাপারী সজাগ দৃষ্টিতে সম্মুখে তাকায়। বাতাসের বুকে কিছুক্ষণ কান পেতে বিস্ময়ঘেরা দৃষ্টিতে আম্বিয়াকে জিজ্ঞেস করে, কিচু শুনতি পাচ্চু নাকি আম্বিয়া? 
বাতাসের বুকে কিছুক্ষণ কান পেতে আম্বিয়া জানতে চায়, কি শুনার কতা বুলছু? 
- বাচ্চা ছেলির কান্দা; মনে হয় আমার নাতিছেলিডা কাচ্চে। আহারে, দুদির বাইচ্চা গো; সকালে উটি আমাক দেকতি না পায়ি খুব কান্দাকাটি করবেনে। ছুড়াডা আমাক বড়ই পিয়ার করে, দাদু বুলি মিষ্টি করি ডাকে। 

আম্বিয়ার বুকের মধ্যেও রক্তক্ষরণ। শিকড়-কাটা বৃক্ষের পাতার মত নেতিয়ে পড়ে। 
- না না, ঐইডি মনেহয় আমা কাটুর কানদা। আহারে, হাউস করি আমার কাচে শুতি আচুলু; ভয় পায়ি কি বিছেন ভরি মুতি ফেলবেনে?

মজু ব্যাপারী ঘোরলাগা চোখে আকাশের পানে তাকায়। দুচোখ ভরে রাত্রির বিচিত্র রূপ উপভোগ করে। 
বিশাল এই পৃথিবীর কাছে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়; ক্ষুদ্র। সারাজীবন উজান বাইলো অথচ এক মুহূর্তর জন্যও ভাটির নাগাল পেল না। আম্বিয়াও চিমত্মামগ্ন। পাদুটো মাটির সাথে গেঁথে যেতে চায়। মনের মধ্যে দোলাচাল, পিছুটান, একখান কাজ কল্লি কেরাম হয়, ব্যাপারী?
- কি কাজের কতা বুলছু? 

আম্বিয়া কিছুক্ষণ দম ধরে থেকে উত্তর দেয়, চলো ফিরি যাই; সুংসারডা আরেট্টু গুচি নি। ছোট-ছোট; ছেলিগুন আরেট্টু বড় হোক, তকু না হয় ......... 
আম্বিয়া তার কথা শেষ করতে পারে না; একখণ্ড ব্যথা কুণ্ডলী পাকিয়ে বুক থেকে গলা পর্যমত্ম ওঠানামা করে। মজু কৌতূহলী দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়। তার সারামুখে বিষাদের ছায়া। চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করে, এসব তুমি কি বুলছু আম্বিয়া; তুমার মাতা ঠিক আচ তো! 
আম্বিয়ার মুখ দিয়ে কথা সরে না। মজুর মধ্যেও পিছুটান। জীবনের হিসেবটা আর একবার মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে.........

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র