জয়দেব বিশ্বাস - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

জয়দেব বিশ্বাস

                                                      কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি





 স্কুলগণ্ডি পেরিয়ে সবে মুক্ত আকাশে ডানা মেলেছি । বন্ধুত্বের যে গণ্ডি ছিল সেটা থেকে ও  মুক্ত হ'ল । মুক্ত হয়ে গেল যেন সব কিছুই । দীর্ঘদিনের সেই বন্ধুত্বের পরপর  পতন ঘটতে লাগল । সবাই সবার পছন্দমতো কলেজে ভর্তি হ'ল । আমিও যেন একা হয়ে গেলাম । একা একা সব মানিয়ে নিতে শুরু করলাম  , পথ  চলতে গেলে মানিয়ে নিতে হয় এটাই নিয়ম ।  তেঁতুলিয়াতে 'শহীদ নুরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়ে যেদিন প্রথম ফর্ম ফিলআপ এর  জন্য গিয়েছিলাম , একটা উত্তেজনা হচ্ছিল , কোথাও একটা ভাল লাগা কাজ করছিল , কিন্তু কী একটা অভাব বোধ খুঁচিয়ে দিচ্ছিল । মনে হচ্ছিল কলেজ জীবনে কোথাও একটা ভাললাগা , ভালবাসার ঘাটতি আছে ।   আসলে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এক স্কুলে কাটানোর সুবাদে স্কুল জীবন ছিল এক মূল্যবান সম্পদ । যেন নিজের পরিবারে ছিলাম ।
 সমস্যাটা  তখনই  হল পরিচিত সীমানা ছেড়ে এক আলাদা পরিবেশ সবই নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে হবে । যাইহোক দীর্ঘদিনের সেই পরিচিত বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও বিচ্ছেদ সবসময়  বিচ্ছেদ নয় । সে এসেছিল , সে এসেছিল বিচ্ছেদের হৃদয়ে প্রেমের পূর্ণতা নিয়ে । এখন এই অবসরে ডাইরির পাতায় পেছনের ইতিহাস ভেসে ওঠে , ও এসেছিল উত্তর ২৪ পরগনার পাঁচপোতা ।ওর ভর্তির ফর্মটা ফিলআপ  করে দেওয়ার সূত্রেই নামটা জেনেছিলাম দীপাঞ্জনা । আহ: কি সুন্দর সেই মুখটা , চারদিকে যেন লাবণ্য ছড়িয়ে পড়ছে । পরিচয় হল , ফোন নম্বর আদান-প্রদান হল । খুব সরল স্বভাবের মেয়েটির মুখে হাঁসিটাই যেন মূল্যবান অলংকার হয়ে উঠতো । এমন করেই বোধয় শক্ত ঢ্যালার মাঠেও বৃষ্টি নামে কখনও কখনও । এভাবেই যেন সুখের সময় ধরা দেয় জীবনের কাছে ।  কলেজে দু'জনের কাজ শেয় হওয়ার পর ও বলল - চলো তাহলে ঐ বনবিভাগ টা ঘুরে আসি । বনবিভাগটা ছিল কলেজেরই কাছাকাছি । তেঁতুলিয়া ব্রিজের নীচে । সুযোগ পেয়ে গেলাম দু'জনে ঘুরতে । কোন মেয়ের সাথে প্রথম একা একা । ও- কথা বলেই যাচ্ছে ধারাবাহিক ভাবে , আমি শুনছি । আসলে আমি কথা হারিয়ে ফেলছিলাম , কি বলবো ! অগত্যা ওর কথার উপর নির্ভর করে হাঁটছি দু'জনে । বনবিভাগের দু'ধারে বিভিন্ন গাছ-গাছালি , মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা । আর আমরা রাস্তা বরাবর । ও আমার নীরবতা দেখে একবার বলেই ফেলল আমি বোধহয় খুব কথা বলি । বললাম - বেশ ভালো লাগছে তোমার কথা শুনতে । শুধু কথাই শুনেছিলাম । 
তারপর কোন যোগাযোগ ছিল না । কত ভাল লাগারা এমন করেই তো জীবন থেকে হারিয়ে যায় ।  বেশ কয়েক মাস বাদে একদিন ভিড় ট্রেন থেকে হাবড়া স্টেশনে নামার সময় মানুষের গুঁতোগুঁতি আর হুড়োহুড়িতে আমার চশমাটা চোখ থেকে ছিটকে পড়ল স্টেশনের উপর । ভিড়ের মাঝে চশমাটা তুলে নেওয়ার আগেই হিল্ জুতো দিয়ে পিষে দিল , মনে হল বুকের বাঁ পাশটাতে কেউ ক্রমাগত লাথি মারছে । ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম । কিছুদূর যাওয়ার পর মেয়েটি পিছনে তাকাল , দেখলাম চেনা সেই মুখ , একেবারে আধুনিক সাজে সজ্জিত । মুখে কোথাও সেই লাবণ্য ছিল না , সরলতার কোন বহিঃপ্রকাশ সেদিন হয়ত হারিয়ে গিয়েছিল । ভাবতে অবাক লাগে কোন দুঃখপ্রকাশও করেনি । 

আমি মুহূর্তে মুহূর্তে প্রেমে পড়ি । যখন আমি ক্লাস ফোরে পড়তাম তখন একটি মেয়ে আমাকে ভালোবাসতো । আমি তখন তাকে দু-কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম । সেই মেয়েটিকে আমি ক্লাসে সিক্স -এ পড়ার সময় ভালোবাসা নিবেদন করলাম । ও জানিয়ে দিল আলাদা ধর্ম নিয়ে প্রেম হয় না । তারপর যত দিন গেছে আমার প্রেমে পড়ার তালিকা টা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে । মনে পড়ে বসিহাটের রেণুর কথা , ওর ছিল এডুকেশন অনার্স । পরিচয় পর্বটা আজ আর মনে নেই । সেদিন বৃষ্টিতে ভিজছিলাম , ছাতাটা এগিয়ে নিয়ে মাথার উপর ধরেছিল । ভালোবেসে ফেললাম । ওর সাথেও একদিন গেলাম বনবিভাগে । জানিয়েও দিলাম ধর্ম নিয়ে লাল চোখের বাড়াবাড়ি না থাকলে তোমাকে বিয়ে করতাম । ও হেঁসে জানাল এমনটাই নাকি সবাই বলে । তারপর থেকে ওর সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই । জানি না কোথায় কেমন আছে । প্রতিভা বলে একটি মেয়েকে খুব ভালবাসতাম । ওর সাথে অনেক সময় কাটিয়েছি । ভালো মেয়ে । আমি যে ওকে ভালবাসতাম ও কথনও জানতেই পারেনি । কিছুদিন আগে ওর বিয়ে হয়েছে । স্বপ্ন , বৈশাখী , শিউলি আর সেই ক্লাস টেন-এ পড়ার সময় শম্পার সেই লাল চুল , চিবুকে তিল কখনো ভোলার না । প্রেমে পড়েছি ওদেরও । একরাশ আশা ভরা চোখ নিয়ে অনেক নদীর পিছনে ছুটেছি , তারা সবাই ডানা কাটা পাখির মতো , আমাকে ভুল বুঝিয়েছে । কেউ বলেছে বাবার লাল চোখকে খুব ভয় লাগে , কেউ বলেছে এখন ওসব নয় পরে ভেবে দেখব ।কেউ বলেছে লোকে খারাপ বলবে , আবার কেউ কেউ বলেছে 'আমার আছে ' । আমি আশা করে থাকব না হতাশায় ভুগবো ? বুঝতে পারতাম না । পরে দেখতাম তারা কোনো রেস্টুরেন্টে , কোনো বনবিভাগে কিম্বা কোনো ম্যাটিনি শো অথবা , পার্কে জুটি বাঁধা শালিকের মতো ঠোটে ঠোট দিয়ে ভালোবাসার আদান-প্রদানে ব্যস্ত । কখনো বাস স্ট্যান্ডে বা প্লাটফর্মে প্রিয়জনের অপেক্ষায় মোবাইল খোঁচা-খুঁচি । কি ভালো যে লাগত আমার ......তবে
আমার রূঢ় স্বভাবের মেয়ে সারাজীবনের পছন্দ । আমি ভালোবাসা উপহার করে পাঠিয়েছি তাদের বুকে , কিন্তু তাতে যে কেউ বিঁধল না গো । একবার দমদম ক্যান্টনমেন্টে বঁনগা লোকালের জন্য ২নং প্লাটফর্মে অপেক্ষা করছি । আমার বাঁ দিকে একটি মেয়ে বসেছিল । ওর দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে গেল । আসলে ও আমাকে দেখছিল । কিছুক্ষণ ইতস্তত করলাম । তারপর ওর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম -- ১০৮ টা জবা ও মুণ্ডুর মালা যদি ওর গলায় দিই কেমন হয় । একেবারে যেন মা চণ্ডী স্বয়ং লকলকে জিভটাও যেন সার্থক । তবে একটু যুগের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আধুনিক হয়েছে । পরনে জিন্স ও স্কিন সাঁটা গেঞ্জিতে বেশ লাগছে , হাতে রয়েছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন । আবার ভাবছি গায়ের রং টা যদি মা চণ্ডীর মতো না হয়ে একটু ফর্সা হ'ত তবে ঐ আধুনিক পোশাকে না হয় অসুর বধ করার সাজে সাজিয়ে তুলতাম । ট্রেন এসে গেল উঠে পড়লাম । ট্রেন থেকে যতদূর দেখা যায়
কৃষ্ণকলির মুখটা দেখতে লাগলাম । কি সুন্দর সেই মায়াবী মুখ , চোখের ভালোবাসা যেন এক অমূল্য সম্পদ । কৃষ্ণকলিকে আজ বলতে ইচ্ছে করছে সেদিন চোখে চোখে যে ভালোবাসা দিয়েছিল তা আমার পরম প্রাপ্তি । এই ভালোবাসার
জন্যই ছুটে মরি কৃষ্ণকলি .....

২টি মন্তব্য:

  1. ভালো লাগলো বন্ধু।। শৈশব ও কৈশোরের সন্ধিক্ষণে, প্রথম যৌবনে পদার্পনে, ভালোবাসা বিনিময়ের এই আকাঙখা চিরকালীন।এভাবেই বোধহয় মানুষ, মানুষকে ভালোবাসতে শেখে, সম্মান করতে শেখে এবং পরিপূর্ণতা লাভ করে।

    উত্তরমুছুন
  2. আপনার মন্তব্য পেয়ে ভালো লাগলো বন্ধু

    উত্তরমুছুন

Featured post

সোনালী মিত্র