রুখসানা কাজল - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

রুখসানা কাজল

                                                 দেবদারু প্রেম







গেটের সামনে কে যেন অনবরত ক্রিং ক্রিং করে যাচ্ছে। ভরসন্ধ্যাবেলা। ধূপদানি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রূপা সন্ধ্যে দেখাচ্ছিল ঘরে বাইরে। এই সময় শুয়ে থাকতে নেই বলে মা দুর্বল পায়ে উঠে বারান্দার গার্ডেন চেয়ারে বসে থাকে। মাঝে মাঝে কেউ বেড়াতে আসে। তারা মার পাশে বসে এই বাড়ির পুরানো জাঁকজমকের গল্প করে। মা শোনে আর ম্লান হাসে। ওরা চলে যাওয়ার পরে মা রূপাকে ডেকে বলে, স্রোতের সাথে চলবে। কি ছিল আর কি নেই তাই নিয়ে ভাবলে পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু তুমি ভাব। সত্যি কিনা বল ? মা ধরা পড়ে হেসে বলে, এটা সুখের ভাবনা। তোমার বাপির কথা ভেবে আমার আনন্দ হয়। আমি সাহস পাই। বেঁচে উঠি বার বার।
ঘাসপথ মাড়িয়ে গেট খুলে দেয় মা। আজ আবার কারেন্ট নেই। আবছা অন্ধকারে প্রথমে একটি সাইকেলের চাকা তারপর অসম্ভব লম্বা একজন কেউ মাকে জড়িয়ে ধরে। শিওর মিন্টুদা। রূপার চাচাত ভাই। টাকার দরকার হলে বা কোন অন্যায় করে এলে এই নাটক প্রায়ই করে মিন্টুদা। রূপা রান্না ঘরে আলো দিতে চলে আসে । এখানকার সব বাড়ির এই কালচার । সন্ধ্যা হল তো ঘরবাড়ি, বাগানকে আলো দেখিয়ে আনতে হবে। রে বাবা ঝকঝকে লাইট জ্বলছে ফকফকে বেলফুল দেখা যাচ্ছে তাও মা বলবে সন্ধ্যেটা দিয়ে এসো তো মা রূপা ।
বাড়ি ঘিরে থাকা দেওয়াল ভেঙ্গে পড়েছে। এবাড়ি ওবাড়ির মাঝে কেবল ভাঙ্গা ইটের প্রাচীর। বাচ্চুচাচা চাচির সাথে ঘুরে আলো দেখাচ্ছে । চাচার সাফ কথা আমার বাড়ি আমি আলো দেব। মেয়েদের যখন নিজের বাড়ি হবে তখন তারা তাদের বাড়িতে আলো দেবে। শুনে রূপা মাকে বলে তাই তো চাচা ঠিক বলেছে। এবার থেকে তুমি আলো দেখাবে তোমার বাড়িকে। মা হেসে লুটোপুটি খেয়ে বলে তাহলে তো তোমাকে বিয়ে দিতে হয়। নিজের বাড়ি হবে। রূপা নিজেই বেকুব হয়ে পালিয়ে আসে। ওর কেবল অনার্স প্রথমবর্ষ। কালবেলা উপন্যাসের ভাঁজে একটি লুকানো ছবি আছে । নীল জিন্স কালো গেঞ্জি । পেছনে মহা দেবদারু গাছ। মা কি জেনে গেল নাকি ? 

মিন্টুদা জাঁকিয়ে বসেছে। আজকের কেস আলাদা মনে হচ্ছে। অন্যদিন টাকা নিয়েই চলে যায় । এই সময় হইহই করে কারেন্ট চলে আসে। হিটারে চায়ের জল চাপিয়ে মা বলে কি ভয়ের কথা বল তো রূপা এইমাত্র পুলিশ তোর আশফাক কাকুর ছেলেটিকে থানায় নিয়ে গেছে । রূপার মন থেকে নিমিষে সব আলো নিভে যায়। ইমনের তো এখন ঢাকায় থাকার কথা। চিঠিতে তো তাই জানিয়েছিল। মিন্টুদা বিস্কুটের কৌটা খুলতে খুলতে বলে, এর নাম সামরিক শাসন বুঝলি। বাস থামতেই সাদা পোশাকের পুলিশ ইমনকে ভ্যানে তুলে নিয়ে গেল। দুই দুইবার আর্মি পরীক্ষায় ফেল করে পাস কোর্সে বি কম পড়ছে মিন্টুদা কিন্তু আর্মি প্রীতি ষোলআনা । কিছু না বলে রূপা উপরে আসে। বইয়ের ভাঁজ খুলে চিঠি বের করে। ইমন লিখেছে এ মাসে অনেক কাজ। তার উপর এগজাম। অশিক্ষিত বিপ্লবী হয়ে ও থাকতে চায় না। তাই হলে থেকেই পড়াশুনা করবে। তাহলে কি এমন হল যে ইমনকে বাড়ি আসতে হল! রূপা আবার নীচে নেমে আসে। মিন্টুদা জানিস কেন ইমনকে ধরে নিল ? গরম চায়ে অসভ্যের মত ফু দিতে দিতে তাচ্ছিল্য দেখিয়ে মিন্টুদা বলে, ভার্সিটি ক্যাম্পাসে ওস্তাদি দেখাতে গেছিল । পোষ্টার সাঁটিয়ে ও পালাতে পেরেছে কিন্তু সাথের দুজন ধরা পড়ে ওর নাম বলে দিয়েছে। ফু: কি কমরেড একেকজন। আতংক নিয়ে মা বলে , মারবে টারবে নাকি রে ? “মার মানে? কি যে বল বড় কাকিমা! এতক্ষণে চেহারা ভবেন হয়ে গেছে। পুলিশের মার বলে কথা। তবে ছেড়ে দেবে। ছাত্র তো !” অসহ্য লাগছে মিন্টুদাকে। আর্মি পুলিশের পা চাটা হয়ে উঠছে দিনকে দিন। ভুলে গেছে ইমন ওর বন্ধু। থানার ছোট দারোগা কেমন যেন মামা হয় মিন্টুদার । সেখানেই থাকে বেশি সময়। রূপা ভাবে এই নব্বুই দশকে কি পুলিশ মারধর করবে? কত শিক্ষিত রাজনৈতিক সচেতন ছেলেরা এখন পুলিশে চাকরী করছে। 

বারান্দা পেরিয়ে বাচ্চুকাকুর সীমানায় চলে আসে রূপা। বাচ্চুকাকুর বাসার পাশেই ইমনদের বাসা। রাস্তা দিয়ে গেলে অন্য রাস্তায় পড়ে কিন্তু ভেতর দিয়ে গেলে পাশাপাশি। কিরে মা তুই? ইমন ভাইদের বাসায় যাব চাচিমা । সাথে মিথ্যে জুড়ে দেয়, মা পাঠিয়েছে। চাচী মুখের কাছে শাড়ির আঁচল তুলে ফিসফিস করে বলে, ফিরে যা বাসায়। ওদের বাসায় পুলিশ এসেছে। ইমন নাকি ঢাকায় ডাকাতি করে এসেছে। চমকে ফিরে আসে রূপা। ডাকাতি ! বলে কি? বুক কাঁপে রূপার । পুলিশ কি ইমনের আসল রাজনৈতিক পরিচয় পেয়ে গেল ? রূপা নিজেই নিজের বুকের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এবার একমাত্র মিন্টুদাই পারবে খবর এনে দিতে। মিন্টুদার বকুনিতে ক্লান্ত মা বইয়ে মুখ গুঁজে হা হু করে যাচ্ছে । রূপা ডাকে, দাদা শোন তোর টাকা লাগবে ? চোখ গোল্লা করে মিন্টুদা বলে তুই দিবি? এক টাকা দিস না কোনদিন আজ যে বড়— একটি একশ টাকার নোট দেখিয়ে বলে আরো দেব তুই ইমনের খোঁজ এনে দে। পাঙ্গাশের মত হা থেকে আস্তে আস্তে মুখ ছোট করে মাথা ঝাঁকায় মিন্টুদা। তুই ? মিন্টুদার কনুইয়ের কাছে খামচে ধরে রূপা, প্লিজ দাদা ! সাইকেল বের করে বোঁ বোঁ করে বেরিয়ে যায় মিন্টু ।
বারান্দায় ভুতের মত বসে থাকে রূপা। ডাকাতির কেস দেওয়া মানে ইমন আর কোনদিন পিঠ সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। ইমনের পকেটে চে গুয়েভারার ছবি আর নিজের লেখা কবিতা ছাড়া কখনো কোন অস্ত্র দেখেনি রূপা। ব্যাগ ভর্তি বই। ওরা যখন শ্মশানঘাটের আড়ালে ঘুরতে যায় তখন ইমন কবিতা শুনায়। ইমনের শুকনো শরীর জড়িয়ে রূপা কবিতার প্রতিটি শব্দের ওঠানামা বুঝতে পারে। শব্দগুলো রূপার বুক ছুঁয়ে সমান উচ্চতায় কাঁপন জাগায়। ইমনের গলার ত্রিভুজে বৃষ্টির মত চুমু খেয়ে রূপা জানতে চায়, সত্যি কি সাম্য আসবে ? শূন্য শ্মশানে স্মৃতিমঠের পায়ের কাছে বসে ইমন বলে, তুই খুব বেশি রোমান্টিক। কালবেলার মাধবী হতে চাস না রূপাই । আমাকে নয় বিপ্লবকে ভালবাসে নে। রূপা আরো গভীরে ইমনকে জড়িয়ে নিয়ে বলে, বিপ্লব মাধবীলতা কালবেলা কিচ্ছু জানিনা। আমি শুধু তোকে জানি। তুই থাকলে আমি আছি। সে যেখানে হোক। অস্থির হয়ে ওঠে রূপা । এত দেরী করছে কেন মিন্টুদা ? থানায় তো খুব খাতির মিন্টুদার। কি হল?
ঘুমিয়ে পড়েছে মা। আলো নিভিয়ে বারান্দা বাগান গেট ছুঁয়ে অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়ায় রূপা। দেশের জন্যে মানুষের জন্যে যারা কাজ করছে তাদের ডাকাত বলে ধরে নিচ্ছে। কি চমৎকার স্ট্রাটেজি। রাত বাড়ছে। ক্লান্তিতে হেলে পড়েছে চাঁদ। জ্যোৎস্নালেপা রাস্তা দেখে মনে হচ্ছে অনন্ত পথ। শেষ নেই এই পথের। ওদের বাসা থেকে থানা বেশ দূরে। মিন্টুদার কতক্ষণ লাগবে আসতে ? টেনশন গলা ছুঁয়ে দম বন্ধ করে দিচ্ছে। রাস্তায় কুকুরগুলো ডেকে উঠছে ভাঙ্গা কর্কশ গলায়। এই সময় মিন্টুদার ছায়া ছুটে আসে আলোক গতিতে। রূপা চল, ইমনকে যদি দেখতে চাস এখনই যেতে হবে।
ছোট দারোগার বউয়ের কালো চাদরে মাথা মুখ ঢেকে থানার পেছনে চলে আসে ওরা। পুলিশ ভ্যানে কেউ একজন শুয়ে। মিন্টুদা হাত শক্ত করে ধরে বলে, কাঁদবি না রূপা। কাঁদার অনেক সময় পাবি। এখন দেখে নে। কুইক। এখনো কি উষ্ণ ইমনের শরীর। কপালের কাছে গভীর ক্ষত ছাড়া আর কোন আঘাত নেই। দুহাতে ইমনের শরীরে আঘাত খোঁজে। কোন রক্তও নেই। ইমন কি সেন্সলেস হয়ে গেছে? ইমনের নাকে হাত দেয়। নিঃশ্বাস কি পড়ছে? বুকের সাথে কান লাগিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে হৃদয়ের স্পন্দন। ইমনের ইঞ্চি ইঞ্চি শরীর রূপার স্বভূমি। প্রতিটি রোমকূপে রূপার স্পর্শ। কোথায় মৃত্যু? কেঁদে ফেলে রূপা। ওঠ ইমন ওঠে দাঁড়া। কিচ্ছু হয়নি তোর। মিন্টুদা টেনে তুলে। যেতে হবে। সোনা বোন আমার। শুয়োরের বাচ্চারা এখুনি অপারেশনে দেখাতে বেরুবে।
ছোট দারোগার উঠোনে পা রাখতেই শব্দ করে বেরিয়ে যায় জিপ। পেছনে পুলিশ ভ্যান। খুব ভোরে শহরবাসীরা জানতে পারে পুলিশের এনকাউন্টারে মারা গেছে একজন দুষ্কৃতি। দুস্কৃতির গুলিতে আহত হয়েছে একজন সিপাহি। ছকটি চেনা তাই শহরের কেউ বিশ্বাস করেনা। কিন্তু কেউ কিছু বলতেও পারেনা। মিন্টুদা দুষ্কৃতির কাছে পাওয়া জিনিসগুলো থানায় লিস্টি করার আগেই রূপার নাম লেখা বইগুলো আর ইমনের লেখা কবিতার খাতাটি সরিয়ে ফেলে। ভোরের বাতাস মিন্টুর গাল বেয়ে ঝরে পড়া জল ছুঁয়ে যায় মিহিনভাবে। ওরা বন্ধুরা কেউ জানত না তার বোনই ইমনের মাধবীলতা !

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র