সু বী র স র কা র - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

সু বী র স র কা র

                     
                                                                                                                           নভেলেট


সো না পা ড়া      

           


                      
১।
 
তো,সেই নদী করতোয়া আর তার গম্ভীর সেতু অতিক্রম করে নদীপার্শ্বের নানান দৃশ্যপট কলাবাগিচা অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলাম ঘোড়াঘাট।ইতিহাসপুরাণমিথ বিনির্মিত হয়ে সুপ্রবীন এই ঘোড়াঘাট পরগণার হাওয়াবাতাসের দিকে ঝুঁকে পড়ে কবি এগিয়ে এলেন প্রসন্নতা নিয়ে।আমি সিগার ধরালাম।কবি মজে গেলেন ধূমায়িত চায়ের কাপে।কবি আজ উৎফুল্ল।তার মাথার চুল যেন চাঁদ ধোয়া।শরীরে আবহমানের বাংলাদেশ।এই কবি আমাদের দোস্ত।এই কবি অসুখজড়ানো অসুখফেরত।এই কবি বেঁচে থাকতে চাওয়া বেঁচেবর্তে থাকা জীবনঘনিষ্ঠ এক মিরাকলের মতো।এই কবি আমার কাছে আশ্চর্য এক বিষ্ময়।কবি থাকেন বসবাস করেন নদীপুকুরবিলখালজমিজিরেত ধানের গন্ধে ভরা আশ্চর্যতম এক গ্রাম সোনাপাড়ায়।কবিতাগ্রাম সোনাপাড়া।এই কবি মাসুদার রহমান।অজস্র জন্ম ধরে আমি যার দিকে যাচ্ছি।যার দিকে ভাসিয়ে দিচ্ছি আকুতিভরা চোখ।আর করতোয়ার পানসা জলে পানসি ভাসে।মেঘ ভাসে আসমানে।

২।

দিগন্ত টিগন্ত পেরিয়ে আসে কবি।মাথার ওপর আকাশের মেঘলা আলো।জীবন ও মরণের এই পৃথিবী আর তার বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা জীবনযাপন,দৈনন্দিন মাসুদারকে অন্যমনষ্ক করে দেয়।চিরকালীন সব জিজ্ঞাসারা ঘিরে ধরলে সে ঘোরের ভিতর ডুবে যেতে থাকে।উচারণের মৃদুমন্দের ফাঁকে ফাঁকে বুনে দিতে থাকে কবিতার পর কবিতা-
‘আকাশ স্বচ্ছ হলে পড়া যাবে ঈশ্বরের সমাধি-ফলক
দাঁড়াও বাংলাদেশ,ওপারে অন্য গ্রহলোক’।
দৃশ্যের পর দৃশ্যের জন্ম দেখে মাসুদার।ধানবাংলার পাখি,পাখিদের জন্যই মনোরম হয়ে ওঠা ভোরবেলাগুলি;তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় ডিলিরিয়ামের দিকে।ওপার বাংলা থেকে আসা ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ পত্রিকার পাতায় সে আকূল হয়ে খুঁজতে থাকে অপর কবিতার ভুবনমায়া।দীর্ঘ অসুখের দিকে কখন কিভাবে যেন চলে যাওয়া!আর অসুখ থেকে ফিরে আসলেই বারীন ঘোষালের চিঠিগুলি তাকে আশ্রয় দেয়।ঘুমোতে যাবার আগে তার কন্ঠে ঝরে পড়েন আল মাহমুদ-
‘তাড়িত দুঃখের মতো চারপাশে
অস্পষ্ট স্মৃতির মিছিল’।

৩।

সোনাপাড়ার পথে পথে ক্ষেতে ক্ষেতে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে উত্তরের আকাশের বিস্তৃতির দিকে সঙ্গনিঃসঙ্গতা নিয়ে তাকিয়ে থাকা মাসুদারের।দিনের পিঠে দিন চলে যায়।উঠোনের হাঁসগুলি মোরগগুলি বেড়ালগুলি গরুগুলি মোষগুলি হালের বলদগুলি সবই থাকে চিরন্তনতা নিয়ে।মাসুদার তার ব্যর্থতাগুলি নিয়ে ভাবে।সফলতাগুলিকে উপেক্ষা করে।য়াজ বিকেলে কি তবে সে বাংলাহিলির দিকে চলে যাবে!সীমান্তের দিকে চলে যাবে!সুমাত্রাকে নিয়ে দেখা করে আসবে জিরো পয়েন্টে কবি সুরজ দাসের সাথে।ওপাড়ের বই পত্রপত্রিকারা অপেক্ষা করে আছে তার জন্য।উমাপদ কর ফোন দিয়েছিলেন।কদিন আগে ‘চিহ্নমেলা’ ঘুরে গেলেন উমা দা।সোনাপাড়াও ঘুরে গেলেন।খুব মনে পড়ে বউদির কথা।দেখা হওয়ার কথা হওয়ার আন্তরিক মূহুর্তগুলি নাড়া দিয়ে যায়।সুমাত্রাকেও।না,এসব থাক।আজ কোথাও যাবার নেই।বরং প্রশান্ত গুহ মজুমদারের ‘কাহাদের কথা’ বইটি নিয়েই বসা যাক।সাধুভাষায় লিখিত টানা গদ্যের কবিতাপুস্তক।

৪।

শোকের ভিতর আগুনের ভিতর রক্তপাতের ভিতর কতবার যাওয়াআসা।কত কত জন্মজন্মান্তর জুড়ে কবিতাবুনন।সেই বুননের হলকায় অর্ন্তদহনে ছিন্ন হতে হতে মাসুদারের যাপনটা ক্রমবর্ধিত হতে হতে একসময় পাখামেলা ব্রিজে লালন সহ তার উঠে পড়া।হাওয়ায় অগোছালো চুল।যেন বরফকুচি।মাসুদার চারপাশে পূর্ণদৃষ্টি মেলে।তার দৃশ্যসীমায় আসা খন্ডগুলি দৃশ্যসীমানার বাইরে বুঝি চলেও যেতে থাকে।আর তখন আবুল হাসানের কবিতার অন্তরীক্ষর কথা মনে পড়ে।আবুল হাসান তাকে উন্মনা করে তোলে-
‘জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন’।
জীবনের পরতে পরতে কি এক রহস্য!কি এক ইশারা!সরে আসতে আসতে কুহকের টানে কেবলই জড়িয়ে পড়া।তখন মাঠগুলি পুকুরগুলি রাস্তাগুলি পুকুরের অনন্ত হাঁসগুলি সোনাপাড়ার ভরাফসলের সব ধানবাড়িগুলি জন্মান্তরের অতিলৌকিকতায় জেগে থাকে।ভরভরন্ত হয়ে আকাশের পাখিগুলির দিকে দিনকালগুলির দিকে ধ্রুবসত্যের মতো অমোঘ হয়ে ওঠে।সোনাপাড়ার রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে আব্বার কাশীর শব্দ আম্মার মোনাজাত মিঠুভাইএর হাসি লালনের বিবাগী হাঁটাচলা সুমাত্রার দৌড়ে যাওয়া।প্রহরের হাততালি থেকে মাসুদার বাস্তবে ফেরে।তার ঘোর ভেঙ্গে যায়।ইণ্ডিয়া থেকে সোনালি আপা,মানে কবি সোনালি বেগমের ফোন আসে।কত কথা হয় আপার সাথে।ক্যানভাস ভরে ওঠে রঙ ভাঙবার শিসে।মাসুদার তার কবিসত্ত্বার হাড়হিম অস্তিত্বের সংকট টের পায়।তার ভাবনাচৈতন্যপ্রবাহে তরঙ্গ তরঙ্গ বিদ্যুত।কবিতায় কি বলবে সে?জীবনের শিকড় স্পর্শ করতে গিয়েও সে কিন্তু বিভ্রান্ত হয়।বিচলনচলনজনিত বিভ্রান্তির ভিতর খেই হারাতে হারাতে সে আদতে কবিতার ভিতর দর্শন অনুসন্ধান করতে থাকে।মহাজীবনের চিরসত্যিগুলি মাঠ মাঠ ধান আকাশ আকাশ পাখি নদী নদী পানির মতো আপাতবিষ্ময় বহন করে।মাসুদার জানে,মাসুদার টের পায় কবির নিঃসঙ্গতা।কবির সংকট।কবির উদাসীন বিষ্ময়গুলিও।সে দ্রুত তার পাঠকক্ষের নির্জনতায় শামসুর রহমানের ‘স্মৃতির শহরে’ ডুবে যায়।এই গ্রন্থ তার চোখে পানি আনে।আবেগ আনে।ঠিক তখন সুমাত্রা কাঁচের বড় গ্লাসে চা এনে দেয়।

৫।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙে মাসুদারের।ভোর প্রিয় তার।পছন্দের।ভোরবেলা তার একান্ত পাঠের সময়।পাখিদের ডাক মোরগডাকের শব্দ তাকে স্মৃতিকাতর করে।চোখে কুয়াশার মেদুরতা।এই তো কদিন আগে সুমাত্রাকে নিয়ে পাহাড়পুর ঘুরে এল।পাহাড়পুরে ছবি তুললো।সেই ছবি ফেসবুকের দেয়ালে।জয়পুরহাট থেকে ফিরে এসে তার আবার ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ পড়ে ফেলা।পাঁচবিবি জয়পুর উচাই বাজার এই সব জনপদ,খিয়ার অঞ্চলে দিনের পর দিন ক্লান্তিহীন চষে বেড়িয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।লালদীঘির ধারে পোড়াদহ মেলায় সিগারেট খেতে খেতে ঘুরেছেন কত। আজ পাঁচবিবি যেতে হবে।সুন্দরবন কুরিয়ারে চিঠি আছে।বই পাঠানো আছে।শহীদ ইকবাল ‘চিহ্ন’ পাঠিয়েছে।নিয়ে আসতে হবে।আলফ্রেড খোকনের বইও।পাঁচবিবি থেকে যেতে হবে জয়পুরহাট।‘শিঞ্জন’ বেরোবে।সে নিয়ে বসা আছে।এদিকে হাজারী ভাইএর বাড়িতেও যাওয়া প্রয়জন।নতুন লেখা লিখতে হবে।চাপ আছে।অথচ শব্দেরা ভারি কানামাছি খেলছে।ধরা-ছোঁয়ার খেলা চলছে বুঝি নদীর পানিতে।কবিকে অপেক্ষা করতে হয় এটা চিরসত্যি।মাসুদার জানে।বোঝে।তবুও কবিতার আকুলিবিকুলির রহস্যঘোরের ভিতর সে শুনতে থাকে শিস।সাইরেন ও বাজনা।ভোর কুমারীত্ব হারাতে থাকলে মাসুদার চিন্তিত মুখে উঠে পড়ে।বাইরে আসে।উঠোনের শূণ্যতায় সে সামান্য দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।আবার ঘরে ঢোকে। ‘মাসিক বাংলা কবিতার’ শেষ সংখ্যায় রাজীব সিংহ-র ‘কেমন আছো ৯-এর দশকে’ ঝুঁকে পড়ে।ঝুঁকে পড়াটা আন্তরিক।কিন্তু মাসুদার মনঃসংযোগ হারায়।হাহাকার জাগে।হাহাকারের ধারাক্রমবাহিত মহাশূণ্যতা তাকে ভোরের রাস্তায় তিসিখেত কাশঝোপ কিংবা নন্দীগ্রাম বাজারের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।ভুলভুলাইয়ের দিকেও।মাসুদার অস্থিরতার তাড়সে কেঁপে উঠতে উঠতে চুড়ান্তভাবেই ঘরে ফিরে আসে।স্মৃতির কোরাস থেকে ছিন্ন হয়ে নামে রংপুর বেতার থেকে কছিমুদ্দিনের ভাওয়াইয়া গান,
‘ও কি হায় রে হায়
আজি মনটায় মোর
পিঠা খাবার চায়’
মাসুদার চোখ বুজে ফেলে।সে ভাবে।ভাবতে শুরু করে।তবে কি রংপুর শহরের রাস্তায় রাস্তায় সে ছুটে যাবে গাড়িয়াল,মইষাল,মাহুত বন্ধুর গানের টানে!না কি চলে যাবে পায়রাবন্দে!বেগম রোকেয়ার ভিটায়।কিংবা শিমুল মাহমুদ রিষিন পরিমল ডিনা আপার সাথে আড্ডা দিয়ে সে ইকবালকে ফোন দেবে।তারপর স্মৃতিদ্রষ্ট ভাঙাচোরা মানুষের মতো টলতে টলতে সর্পাঘাত এড়িয়ে পাড়ি দেবে পীরগঞ্জের দীর্ঘ পথ।এত এত সীদ্ধান্তহীনতা তো তাকে সীদ্ধান্তহীন এক জড়ত্বের খোলে ঢুকিয়ে দেবে।তবুও বিবর্ণ স্মৃতির তাড়সে মাসুদার বেশ থাকে,তার ভোরবেলাগুলি;শুধু ভোরবেলাগুলি নিয়েই।

৬।

আছা জীবন কি অর্থহীন!মায়ামমতা দিয়ে লালনপালন করা একটা জীবন কি তবে অনবদ্য কোন বার্তা বহন করে আনে!না কি হাওর বাওড়ের পানিতে ভাসতে থাকা নানাকিসিমের নৌকোগুলির কসরত দেখতে দেখতে আত্মহনন ও প্রতিরক্ষার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে কখন কিভাবে অনেকদিবস বাদে পাঁচবিবির বৈদ্য ভাইয়ের কথা রাজশাহীর সম্রাট স্বপনের কথা রিকসায় সাহেববাজার পদ্মাচরের কাশিয়ার থোপ পদ্মাবক্ষের ভাসমানতা কেমন যেন মাসুদারের স্মৃতিবন্দরে থিতু হতে থাকে।এতসব ঘটতেই থাকে।মাসুদার নিজেকে অনেক অনেক মেঘদলের ভেসে যাওয়ার নিশ্চিন্তির মধ্যে প্রবিষ্ট করে ফেললে তো আর করবার কিছু থাকে না।ফ্রেমের সাদাকালোতে মিশে যাওয়া ঢাকার দিনগুলি,বাংলা একাডেমীর লেখক শিবিরের যৌথতার খণ্ডগুলি জুড়ে গিয়ে তখন একধরণের আত্মমগ্ন হতে চাওয়া কেবল।সোনাপাড়া থেকে বেরিয়ে তখন মাসুদারের তুলসিগঙ্গার দিকে ছোট যমুনার দিকে পীরজাদার মাজারের দিকে সন্দেহটন্দেহর দিকে কাশফুলের সফেদ মসৃণতার দিকে একটানা গড়িয়ে চলা।এতসবের বিরাটত্বকে মান্যতা দিতে না চাইলেও গানগুলি নাচগুলি বাদ্যযন্ত্রগুলি হাওয়াবাতাস পাথারবাড়ির ভিতর অদৃশ্য হতে চায়।কিন্তু তা তো আর হয় না।বাতাসআকাশমাটিমৃত্তিকার কাছে মাসুদার তার কবিতার বীজ খুঁজতে থাকে।শতসহস্র দিনকাল জুড়ে তার খেলাটা চলতে থাকে।কবিতা অন্যমনস্কতায় হড়কে গেলেও মাসুদার হারিয়ে যাওয়া ভুলে যাওয়া শব্দগুলি,গান ও অক্ষরগুলি তরতরিয়ে বহন করে আনে আর পাহাড়ের গম্ভীর শূণ্যতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কবিসত্ত্বার বিয়োজনসংজোজনপর্বে তার যুক্ত হওয়া।তখন যমুনা বল করতোয়া বল দূর্গাপুর বাজার বল নাওনৌকা বল-সব যেন মৃত্যুর শীতলতা নিয়ে অন্তরীক্ষ থেকে কেমনতর ডাক পাঠায়!সংকেত পাঠায়।সংযোগসূত্রহীন অসহায়তা তো আর চূড়ান্ত নয়।কচুপাতার একটা মাথাল হলেই কিন্তু জমিজিরেতে নেমে যাওয়া যায়।তবুও গ্রহণবর্জনের প্রস্তাবটা খারিজ করে দিয়ে আনুগত্যের নতুন সব ধারা,বর্ষাধারায় রুপান্তরিত হয়।এ যেন কাফকার ‘মেটামরফোসিস’।কিংবা লিবিডো।তখন দিনাজপুর থেকে মাসুদুল হকের ‘তামাকবাড়ি’ থেকে গান,গানস্যালুটের মতো কেবলই ধেয়ে আসতে থাকে।মাসুদার তো একসময় আদিঅন্তহীন ঘুরে বেড়িয়েছে।গঞ্জহাটের ধুলোর মলিনতা নিয়ে সে কি এবার ফিরতে থাকবে!দিনাজপুর শহরে ঘুরে বেড়াবার স্মৃতি নৈশপ্রহরীর মতো ঘিরে ধরলেও মাসুদার তার কবিপ্রতিভার চুলচেরা বিশ্লেষণ না করে কি ফিরতে পারে নদীর ওপাড়ের ভাঙা সাঁকোয়!মাসুদুল হক তার নতুন বই ‘আবার কাৎলাহার’ প্রকাশ করে পরোক্ষে কি ভয়ভীতি এড়াতে চাইছে!মাসুদুল ও তার দিনাজপুর তখন একাকার।তুলাইপাঞ্জির সুঘ্রাণ সত্য এটা মেনে নিয়ে মাসুদুল হক অবশ্যই মাসুদার কে পৌঁছে দেবেন খনগানের চিত্রবিচিত্রের একেবারে মধ্যনিশীথে।যেখানে,নাচ হবে গান হবে বাদ্য বাজবে আর জীবনের মায়ায় মায়ায় গান ভাসবে-
‘ফুলবাড়িত ফুলমালার বাড়ি
হাট করিবার যামো হামরা
গরুর গাড়িত চড়ি’
এতসবের ফাঁকেও জীবনকে মাসুদার তার কবিপ্রতিভা দিয়ে আলোঅন্ধকার দিয়ে ঢেকে ফেলতে ফেলতে কেমনতর এক বিস্তৃতিই হয়ে ওঠে।সোনাপাড়া জুড়ে জোনাকপোকা।রাত বুঝি জাগাতে থাকে রহস্যকুহকছায়া,যার চিরকালীনতায় কার্তিকের হিম জমে।চারপাশের সুপুরিবাগান সচকিত হয়।দৃষ্টিপথটাকে পরিমার্জন করতে করতে দৃষ্টিপথ অবধারিত দৃশ্যপথে রূপান্তরিত হয়।মিথের আড়ালে গেলেও ‘মিথ’-কে প্রকাশ্যে আনবার তাড়না মাসুদারকে চিন্তিত করে ফেলল।অতিনাটকের মতো মনে হওয়া এই জীবন ছেড়ে মাসুদার নদীটদীর দিকে পা বাড়ায়।

৭।

ভাস্কর চক্রবর্তীকে খুব মনে পড়ছে।পড়ন্ত বিকেলের রহস্যের ভিতর ভিজতে ভিজতে মাসুদার পড়ে ফেলছে ভাস্করের অসামান্য গদ্য-‘শয়নযান’।মেইলে পি ডি এফ কপি পাওয়া।মাসুদার ভাস্করের কবিজীবনের কবিজীবনের দিকে এগিয়ে যায় ফুলটুল ও কামলাকিষাণ নিয়ে।চারপাশে নৃত্যগীতের মহড়া।মাসুদার চর্যাপদে ফিরে যায়।লুই পা কাহ্ন পা ভুসুক পা-র পৃথিবী জুড়ে বৃষ্টি নামে।ভীষণ মনে পড়ে পালতোলা নৌকোর কথা।মাঝিমাল্লাদের সমগ্রতায় আত্মলীন হতে হতে কেমন যেন তার এই উদাসীনতা! তখন নাচ ছুটে যায়,নাচ সচল হয়েই তো গানকে যথাপ্রযুক্ত প্রয়োগ করতে পারে।এইভাবেই তো মাসুদার তার কবিসত্ত্বাকে প্রাসঙ্গিক করেই ফেলে।প্রশ্ন প্রতিপ্রশ্নের টানাপোড়েন সত্য;কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে আগামীর অনন্ত সম্ভাবনাহীন মেঘকে ডেকে আনা চারতলা গার্লস হোস্টেলের প্রবেশপথে।সারাজীবন বইপত্তর নিয়েই কেটে গেল।রাশি রাশি বই।শব্দ অক্ষর বর্ণময়তায় নিমজ্জিত বহুরৈখিক জীবনের পরতে পরতে লিপ্ত হতে হতে মাসুদার হারিয়ে যেতে চাইলেও তা তো আর হয় না।তার জীবনের সন্ধ্যেগুলি রাত্রিগুলি দিবসদুপুরগুলি মোচার খোলের মতো ভেসে যায়।কোথাও বুঝি ওৎ পেতে থাকে হাড়হিম একাকীত্ব।কবি তো একাই! ভিড়ের ভিতর শীতকালের ভিতর ঘোর বর্ষার ভিতর সাঁওতাল পাড়ার ভিতর হাটবাজারের ভিতর কুয়াশামোড়া বাঁশঝোপের ভিতর কেবলই অসীম এক একাকীত্বের খেলা চলে।একাকীত্ব একধরণের অভ্যেস।সঙ্গনিঃসঙ্গতার দিকে সঙ্গনিঃসঙ্গতা নিয়েই তার হাঁটাচলা জীবনযাপন।স্বপ্ন দেখার মহড়া।তাকে সিলেট যেতে হয়।হবিগঞ্জ যেতে হয়।সুনামগঞ্জ যেতে হয়।সুরমা নদীর গাঙচিলের ডানার ছায়ায় বিশ্রাম নিতে নিতে সে কেবল জালালী কবুতরের পাখসাটের মৃদুমেদুর ধ্বনিটাকে নিজের ভিতর সন্তর্পণে টেনে নিয়ে আসে।তার চোখ তখন কাছেদূরের গলিটলি পেরিয়ে আসে।আত্মগত এক দুরান্তরের গানের দোলায় মাসুদার একধরণের ভ্রমবিভ্রমের মৌতাতে ওঠে।একাকীত্বকে সে তার অর্জন মনে করে সেরা সম্পদ মনে করে। ভুবনমায়ায় দু’চোখ বুজে আসতে থাকে তার। আচ্ছন্নতার খুব তিমিরে তার জন্য অপেক্ষায় দু’কলি গান-
‘রং বেরঙের যত নৌকা ভবের তলায় আয়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নাও’

৮।

চাঁদের আলোর সুখ রুপালী ইলিশের সুখ আম্মার হাতের ঝিঙ্গেপোস্তর সুখ কইমাগুরের সুখ ব্যপ্ত এক জীবনযাপনের সুখ ঢাকা শহর নবাববাড়ি সদরঘাট রমনা পার্ক ছবির হাট লালবাগ কেল্লায় একা একা ঘুরে বেড়াবার অনন্ত সুখ মাসুদারকে তাড়া করে।অথচ বন্ধুরা বিগত আজ! সুখের আদিঅন্তমধ্য নেই।নদী পেরিয়ে কুয়াশার জালে আটকে পড়া নেই।একদিন বেশ চলে যাওয়া যায় বগুড়ায়।ওয়ালি কিরণ ইসলাম রফিক জয়ন্ত দেবদের সঙ্গে ঢের আড্ডা দিয়ে চলে যাওয়াও যায় মহাস্থানগড়ে।তারপরে বগুড়া থেকে জয়পুর পাঁচবিবি হয়ে সোনাপাড়ায় ফেরা।স্বপ্নে স্বপ্নে কোথায় কোথায় কতকোথায় চলে যাওয়া!ভ্রমণ আর ভ্রমণে আটকে না থেকে পরিভ্রমণ হয়ে ওঠে।চাঁদের আলো জোরালো হলে মাসুদার পড়তে শুরু করে ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’।যদিও তার সত্ত্বাস্মৃতির কোষে কোষে এখনো ক্রিয়াশীল কদিন আগে পড়া মজনু শাহের ‘জেব্রামাষ্টার’।মজনু ভাই গাইবান্ধার।এখন ইটালীপ্রবাসী।মাসুদার মনসংযোগ হারায়।এলোমেলো হয়ে ওঠে।অস্থিরও।‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ বন্ধ করে সামনে ঝুঁকে সে উঠে দাঁড়ায়।তার পিঠ ঝুঁকে পরে।আবার বসে পড়ে।টেবিলে রাখা ‘কবিতা পাক্ষিক,’অরণি’,’অনিকেত’ শামীমের ‘লোক’ ‘কবিতীর্থ’ এসব ওলটাতে থাকে।চাঁদ হেলে পড়তে থাকে।ঘুমোতে চলে যায় বাবু ও সুমাত্রা।মাসুদারের অস্থিরতা বেড়েই চলে।আরো এক নির্ঘুম রাত তার অপেক্ষায় এটা বুঝে যায়।এমনটা হয়।হয়েই চলেছে জীবনভর।এই বুঝি হৈহুল্লোড়ের বাইরে থাকা দলছুট কবির নিয়তি।নিজেকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে আপাদমস্তক বিপন্নতা নিয়ে সে আকুল এক ব্যাকুলতায় জীবনের অনাদিঅনন্ত রহস্যগুলি সনাক্ত করতে চাইলেও দ্বিধাগ্রস্ত মোহমায়া থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে জীবনের উদ্দেশ্য জানাবার মরীয়া প্রয়াসটুকুন শুরুই করে দিলে চারপাশে সমগ্র মস্তিস্ক জুড়ে নির্জনতা নেমে আসে।অবসাদ থেকে বেরিয়ে এসে তাকে প্রবেশ করতে হয় পুনরায় অবসাদের চূড়ান্ত গভীরেই।চাঁদ ডুবে মরে।সোনাপাড়ার পুকুরগুলি বাড়িঘরগুলি ইউক্যালিপটাসের ছায়ায় মোড়া রাস্তাগুলি মাঠগুলি চাতালগুলি পাকঘরগুলি চিরদিনের চিরসত্যের মতো জীবনভর মিথ হয়ে হাঁচিকাশিঝাড়ঝোপসমেত একধরণের পূর্ণতাই বয়ে বেড়াতে থাকে।সব অবসাদ দু’হাতে সরিয়ে দিয়ে মাসুদার উঠে দাঁড়ায় আর চলে যেতে থাকে অমোঘ ভোরবেলার দিকে।পাখি গান গরম চা খেঁজুরপাতা আর তুমুল কবিতার দিকে।সে কি জীবনেই ফিরতে থাকে এভাবে! 

৯।

সবকিছুই কি আর ব্যক্তিগত থাকতে পারে না কি ব্যক্তিগত করে রাখা যায়!মাসুদার জীবনভর কবিতাই করে গেল।মাথাভরতি শরীরভরতি হৃদয়ভরতি শব্দঅক্ষরযতিতরঙ্গ নিয়ে ভরা বাজারের ভিতর ক্রমাগত একা হতে থাকা।কিছুই কি আর লেখা হল!খুব মনে পড়ছে টোকন ঠাকুরের কথ।টোকনের মা কেমন আছেন?গতকাল পড়া সাঙ্গ হল শিমুল মাহমুদের ‘শিলবাড়ির চিরায়ত কাহিনী’।কোনকিছুই ব্যক্তিগত থাকে না।ডুগডুগির হাটে একটা আড্ডা ছিল তাদের।ঢাকা সহ নানান জায়গার বন্ধুরা আসতো।জীবনকবিতার স্বপ্নে জাগরণে আজও বয়ে বেড়ানো সেই সব আড্ডার স্মৃতি।ব্যর্থতাবোধ কমে গেলেও পর্বে পর্বে তা ফিরেও আসে আবার।তখন জয়পুর যাওয়া পাঁচবিবি যাওয়া মামাবাড়ি সড়াইল যাওয়া নওগাঁ যাওয়া বাংলাহিলি যাওয়া পাঠ উন্মোচনের মতোন।মাসুদার কি বুঝে গেছে কবিতা লেখার এই জীবন জীবনে নিমজ্জিত এই জীবন কোথাও পৌঁছে দেবে না তাকে।ইতিহাসপুরাণের পাকে পাকে লোকলোকত্তরতায় সে কেবল ঘন ঘন দুলে ওঠে।মাথা নাড়ে।পাখিদের ছায়ায় ছায়ায় তাকে বৃত্তাকারে জীবনের খালবিল ও পরিখার বৃত্তেই পাক খেয়ে যেতে হবে।মাসুদার চশমা পরে নেয়।তাকে সঙ্গনিঃসঙ্গতা থেকে বের করে আনেন নির্মলেন্দু গুণ।

১০।

আকুলিবিকুলি নিয়ে আকুতিভরা দ’চোখ স্বপ্নমুখর করে দিয়ে বাল্যশৈশবস্মৃতিতে নিবিষ্ট হতে থাকে মাসুদার।নানাবাড়ির খোলান থেকে গরুর গাড়িতে খেড়বিছানো কেদারায় গা এলিয়ে আম্মার সাথে কতবার বাড়ি ফেরা।গরুর গাড়ির নিচে দড়িবাঁধা কালিপড়া লন্ঠণ দুলে ওঠে।সন্ধে পেরোলে চারপাশটা নিঝুম।কেমন গা ছমছম ব্যপার।গাড়োয়ানের একটানা হেট হেট হুরুরু ধ্বনিপ্রতিধ্বনিময়তায় সেই সব যাতায়াত।কখনো প্যাঁচার ডাক কখনো রাতচরা পাখিদের পাখসাট।ছোট ছোট গঞ্জে হাটচালার নিঃসঙ্গতায় আপাতঅর্থহীন অথচ অর্থময় আবহমানতা।যা পীড়ীত করে প্রাণিত করে।ঘোরাক্রান্ত হতে হতে মাসুদারের বেড়ে ওঠা।নিজেকে গড়েপিটে নেয়া।অথচ নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে সরসেবাগিচার দিকে যাওয়া হল না তার।সে সিলেট গেল শাহ জালালের মাজার গেল ধামাইল গান শুনে চা বাগান দেখে কখন কিভাবে কুষ্ঠিয়ায় শিলাইদহে গিয়ে পড়লো।রাজশাহীর পদ্মার চরে কবিদের সঙ্গে আড্ডা তার তেমন জমে না।সে চরাঞ্চলের বালি ভাঙতে ভাঙতে পুরো পদ্মাকেই বুঝি প্রদক্ষিণ করে এল।চরবক্ষে খড়ের চালার নিচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনতে থাকলো শিশিরের শব্দ।তার দূরাগত যাপনপর্ব তাকে নিশ্চিন্ত নিরাপদ এক জীবন থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে রাখে।জীবনানন্দের কবিতায় কবিতায় সে জীবনের উজান ঠেলতে থাকে।দূরে ভূতুরে আলোর আবছায়া মেখে দাঁড়িয়ে থাকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।ঐ বুঝি ছুটতে শুরু করে ‘সুরমা মেল’।স্মৃতির পরত খুললে তো গুচ্ছ গুচ্ছ উদ্বেল কাশের বন।উত্থান পতনের দিকে আপ্রাণ যেতে যেতে মাসুদার অপেক্ষা করে অনেকানেক নদীর বাঁকের জন্য।সর্পদংশনের ক্ষতের জন্য।চকিত দৌড়ে পালানো সাপ ও বেজিদের জন্য।তাকে সুপ্রচুর লেখাপড়ায় ডুবে যেতে হবে।স্বপ্নে স্বপ্নে তার বরিশাল যাত্রা।কীর্তনখোলার উদাসীনতায় মিশে গিয়ে ধানসিঁড়ি নদীটির দিকে তাকে অনিবার্যভাবেই চলে যেতে হয়।হয়তো হেনরি স্বপনের কাছে।তুহিন দাসের কবিতাযাপনের কাছে।তার বিভ্রান্তিকে বিস্তৃততর করে ফেলে মাসুদার শেষপর্যন্ত ওয়ালীউল্লাহের ‘লাল শালু’র কাছে নিজেকে সমর্পণ করে।অবিরত কাঁদতে থাকা নদীর কোলে মাথা রাখে।এভাবেই কবিতাময় হয় ওঠে তার যাপন।

১১।

আল মাহমুদের গদ্য তার পছন্দের।‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘জলবেশ্যা’ তাকে মগ্ন করে।আবু ইসহাক শওকত আলী শামসুদ্দিন আবুল কালাম আবু বকর সিদ্দিক সেলিনা হোসেন শহীদুল জহীর হয়ে ফিরতে থাকে জফির সেতু মুজিব মেহদী জহর সেন মজুমদার আলোক বিশ্বাস উমাপদ করের লেখার কাছে।সোনাপাড়া ঘুমিয়ে পড়লেও মেধার লাঙল ছুঁয়ে থাকা অগনণ ভাষাকর্মীরা মাসুদারকে প্রান্তিকতা থেকে বাইরে নিয়ে আসে।বিশাল আকাশের প্রেক্ষিতে সব কেমন বিন্দুবৎ মনে হয়।কীটপতঙ্গ কৃমিকীট পোকামাকড়ের চলাচল প্রখর হয়ে উঠতে থাকলে কেন জানি তাকে আঁকড়ে ধরতে হয় জয় গোস্বামী ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা।জলজলার এই পৃথিবী মন্দাক্রান্তা রোদে ভেসে যায়।মাসুদার তার বেঁচে থাকবার বৃত্তান্তকে সম্প্রসারিত করে দিতে চাইলেও তাকে উন্মনা করে দিতে থাকে দিনাজপুরের সুপুষ্ট লিচুর স্বাদ যা তার স্বাদকোরক ছাড়িয়ে অনেক অনেক বিকেলবেলার যাদুবাস্তবতায় থিতু হয়।বুকে হামা টেনে তাকে এগিয়ে যেতে হয় মানিক তারাশঙ্কর পথের পাঁচালী অমিয়ভূষণ ও দেবেশ রায়ের দিকে।মাদারীর মা গয়ানাথ জোতদার বাঘারু কেমন চেনা মনে হতে থাকে আর চেনাঅচেনার গতানুগতিকতা থেকে ভয়ভীতিত্রাসের বিপরীতে আজীবনের অস্থিরতা তাকে শঙ্কিত করলে সে নিজেকে ‘চিলেকোঠার সেপাই’-এর ভিতর ছেড়ে দেয়।ডুবিয়ে দেয়।বিশালত্বের ছায়ায় ছায়ায় কত কত জন্মমরণ ছাড়িয়ে একে একে হাজির হয় হাড্ডি খিজির খয়বর গাজি মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদ।মাসুদারের কিছুই করবার থাকে না আর।সে তা স্মৃতিবিস্মৃতির খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ঘুম ও জাগরণের চিরনতুনতায় সমর্পণ করে।আত্রাই বিল থেকে শীতল বাতাসের ঘুমপাড়ানি গান নিয়েই তো সে চলনবিলের দেশে শুটকির আড়তে ধানবাংলার কাকের সাথে চলে গিয়েছিল পতিসরে।রবীন্দ্র কাচারী বাড়ির সামনে বসে দীর্ঘ দুপুর ধরে পড়তে হয়েছিল আবার ‘ছিন্নপত্র’।সত্যিই তো,জীবনের হাসিআহ্লাদ প্রসঙ্গটসঙ্গ দিয়ে তো আর জীবনের গভীর কুহকে অনুপ্রবেশ করা যায় না!জীবনের অর্থময় উচ্চারণগুলি তখন বারবার নদীর দিকে নদীতে ভাসতে থাকা সালতিগুলোর দিকে আরো আরো অন্ধকারের দিকে জোনাক পোকার সিজিল মিছিল হয়ে কেবলই ব্যাপ্ত হতে হতে গুহাগাত্রে ঝরণার ছবি হয়ে মরণশাসিত পৃথিবীতে কেমনতর এক জীবনযাপনই বহন করে আনে।নদীবক্ষে নেমে যায় মাসুদার সমস্ত হত্যাদৃশ্য একপ্রকার উপেক্ষা করেই।

১২।

সেই ভয়ংকর অসুখগুলি বারবার কেন তার জীবনে ফিরে আসে!বুকের অসুখ নিয়ে এই বেঁচে থাকাটার কোন মানে নেই।তীব্র কাশির ঝাঁকুনি সহ্য করতে করতে অনিশ্চিত এই বেঁচে থাকাটা তাকে হতাশার দেশে বিষাদময়তার দেশে গুটিবসন্তের দেশে নিরুচ্চারিত সংশয়তাড়িত এক মহামড়কের নৈরাজ্যের ভিতর টেনে নিতে থাকে।অসুখপর্বে সে তার অবচেতনে টের পায় বুঝে নিতে থাকে আধোআঁধার টানেল দিয়ে গুহাসুড়ঙ্গের শিহরণের মধ্যে দিয়ে যেন বাজনা বাজাতে বাজাতে মরুযাত্রীরা চলেছেন অনির্দিষ্ট কোন পালকিযাত্রায়।অসুখ তাকে ধ্বস্থ করে।কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না তার।জীবনমরণের নো ম্যানস ল্যান্ডে কি দিশাহীন এই ব্যর্থতায় মোড়া মোড়কহীন জীবনযাপন!অসুখ তাকে পরিত্রাণহীন পরিণতত্বে ঠেলে দিলে তার তো কিছুই করবার থাকে না।অসুখ আশ্রয়হীন করে দিলেও মাসুদার কিন্তু জীবনেই ফিরতে চায়।সুমাত্রার কাছে ফিরতে চায়।বাবুর কাছে ফিরতে চায়।সোনাপাড়ার চৌহদ্দীর ভিতর ময়মুরুব্বীর গোরের কাছে অবধারিতই ফিরতে চায়।এবং ফিরেও আসে দ্রুতগামী অশ্বারোহীর দক্ষতায়।এই যে জড়িয়ে জড়িয়ে বাঁচা;এই যে চমৎকার যৌথতায় বাঁচা,এই যে হাওয়া রোদ শীতবর্ষার ভিতর দিনগুলির প্রবহমানতা,এই সব নিয়েই তার জীবনকে বিনির্মিত করে ফেলে সে।মাঘনিশীথের কোকিল ডাকে সোনাপাড়ায়।মাসুদার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।জ্যোৎস্নায় ভিজে ভিজে বাঁশবাগান সুপুরির বন সোনা মসজিদ তাঁতিপাড়া রহমানের বিল হাই মাদ্রাসার মাঠ পেরিয়ে কোথায় কোথায় চলে যায় সে!তার দৃষ্টিতে জন্মজীবনের ঘোর ও ঘোরের যাদুবাস্তব পটভূমির ভিতর সে পরম প্রশান্তি বোধ করে।খোলা মাঠের হাওয়ায় মজা ও ম্যাজিক।শিমুলের তুলো ওড়ে।দিস্তা দিস্তা সাদা পৃষ্ঠার সামনে তাকে হাজির হতে হবে।জীবনের সাতসতেরো বুঝে নিতে না চাইলেও মহীপালের ঘোড়া শায়েস্তা খাঁর বাঘনখ লালবাগের হামামখানা চিলমারীর বন্দরের কুলজঙ্গল ভগ্নসব নীলকুঠি টাঙ্গাইলের গণগ্রন্থাগার ময়মনসিংহের সেনবাড়ি রোড রংপুরের কাঁচাসুপারি রাজশাহীর চন্দন আনোয়ার চাপাই নবাবগঞ্জের আম সব কেমন গড়িয়ে গড়িয়ে দৃশ্যবন্দরে নোঙর ফেলে।তখন নদীর পানিতে পানিতে মাঝিমাল্লারা গান ভাসাতে থাকে নাচ ভাসাতে থাকে;যেন পূর্বজন্ম থেকে চলে এসেছেন হাসন রাজা-
‘সুয়া উড়িলো উড়িলো উড়িলো রে
জীবের জীবন/সুয়া উড়িলো’…

১৩।

তুই কি নাগকেশরের ফুল নিয়ে আসবি আমার জন্য মাসুদার!মেঘের গর্জন শুনে শুনে আপাদমস্তক কোন সমাধানসূত্রতায় হাড়হিম হতে হতে নির্জনতার পক্ষপাতদুষ্টতা অতিক্রম করে করে হাজার বছরের জীবনযাপনকে মান্যতা দিবি!কতবার শোনা গল্প থেকে খসে পড়বে বারকান্দির বাঘের ডাক।সেই সব বাঘেরা সেই সব জঙ্গলটঙ্গল আজ উধাও।বাঘ ও বাঘের ডাক তবুও তীব্র প্রতীক হয়ে অপেক্ষায় থাকে।বারকান্দি থেকে যেতে থাকা সোনারোদের এক পৃথিবীতে।হয়তো মেঘ ডাকবে। তীব্র দ্বিপ্রহর থেকে আগুনের হলকা।মাসুদার তার দূরমনস্কতায় সব মিশিয়ে দিলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলেও সেনপালযুগের ইতিকথাগুলি মাসুদারকে উদ্বেল করে তোলে।সে কুমিল্লা শেরপুর নীলফামারী লালমনী ঘুরে এসে ধানবাংলার এক বিশ্বস্ত ও নিখুত ছবি উপহার দেয়।এতশতর মান্যতায় তবুও আগুনের সেঁক নিয়ে চলে যাওয়া দুরদুরান্তের ইশারার দিকে।ধানপাটতামাকের দেশে আবারো বৃষ্টি নামলে মাসুদার তার সংকটগুলিকে সনাক্ত করে।সোনাপাড়ার দিনগুলি রাতগুলি তো নিরাপদ থাকতে চায়;যদিও মেঘের নিচে বসে তো আর সব হয় না!বরং নদীগুলি মেঘগুলি পাখিগুলি্র জন্য তীব্র এক আবিলতা,আকুতি তার।এই যে নদীর দিকে নদীভরা ভরাপানির নদীভাঙনের অংশত কর্মকান্ড তাকে উন্মনা করলেও সে তা নয়।আসলে সবটাই দ্বন্দদ্বিধার এক বকমবকমের সূত্রে ক্রমান্বয়ে ধুতুরার বীজ খেয়ে সচকিত হতে থাকা।ভাঙনে ভাঙনে লালনের গানে গানে উন্মাদনা ফিরে আসতে থাকলে এই সব অস্থিরতার গোপনে গোপনে ভাসিয়ে নিয়ে আসা ধানের দেশের ফড়িংগুলির হাঁসগুলির আবহমানের মানুষগুলির মায়াময়তার গভীর গোপন থেকে কবির নিজস্ব নির্জনতা মাসুদারকে তার স্বভাবজাত অন্যমনস্কতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে।জীবনের পর জীবন সমগ্র আয়ুষ্কাল ধরে সে তার বিষাদবিষন্নতাকেই নির্মিত বির্নিমিত পুননির্মিত করতে করতে অদ্ভূত এক পারাপারের গল্পকেই বুঝি মাঠপ্রান্তর ধান ও গানের দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে।কবিকে কবি হতে হয়।সন্নাসী ও ফকির হতে হয়।শোলক বলতে বলতে মজনু শাহের মতো ঘুরে বেড়াতে থাকে সে করতোয়ার অন্দরে কন্দরে দিবসরজনীর ক্লান্তিহীন একাকীত্ব তার বাঁচাটাকেই তীব্র করে তুলতে থাকে।জীবন থেকে জীবনেই ঘূর্ণাবর্তের মতো ফিরে আসা।বরফের মতো শীতল জল পান করে মাসুদার তার নিরাসক্তি নিয়েই শীতলপাটির উপর শুয়ে পড়ে।

১৪।
দেশ তো একটা বাড়ি।সোনাপাড়াও একটা দেশ।অপরূপ এই নন্দিত বাংলাদেশ।জারিগানের দেশ সারিগানের দেশ বাইচের নাও দৌড়োবার দেশ জিকির মারফতি ভাটিয়ালি মুর্শিদি ভাওয়াইয়ার এই দেশে ধানে ধানে,উপচে পরা সোনারোদে
ভিজতে থাকা এই দেশের ভিতর সোনাপাড়ার অলিগলি খড়ের চালা সবুজ ঘাসবিচালি অগনণ পাখিদের উড়ে যাওয়া কালবৈশাখীর আন্ধারিয়া মেঘের মরচে ধরা আলোয় বেঁচে থাকতে থাকতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মাসুদার।তার খড়ের গাদার আগুন নেভেনি।বুকের তুমুল গভীরে তিরতির কাঁপছে।মাসুদার তার বাড়ির নিকোন উঠোনে এসে দাঁড়ায়।দাঁড়ানোটা সাময়িক ভ্রমবিভ্রমের যুক্তিফাটলে ধাক্কা দিতে চাইলে মাসুদারের আর দাঁড়িয়ে থাকা হয় না।তাকে চলে যেতে হয় সোনাপাড়ার দিকদিগন্তের ভিতর।সোনাপাড়ার সোনাপাড়া হয়ে ওঠার মধ্যে রহস্য আছে।ইতিকথা আছে।মাসুদার দিকদিগন্ত দিয়ে তার পৃথিবী রচনা করে।মহরমের তাজিয়ায় তার সোনাপাড়া আবহমানের এক সোনাপাড়ার মতো।মাসুদার দিকদিগন্ত দিকদিগরের উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যেতে থাকে।সে তার অসুখবিসুখ তুলাইপাঞ্জী চাল ঢেকিশাকের সবুজ হাটবাজার তুলসিগঙ্গা নদী পীরের দরগা ছোট যমুনার চরে ফুটে থাকা কাশিয়ার ফুল বারকান্দির শেয়ালের ডাক উৎপলকুমার বসু দাউদ হায়দার রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহের কবিতা মঞ্জু সরকারের ছোট গল্প জাকির তাকুকদারের ‘কুরসিনামা’ নন্দীগ্রাম বাজারের আড্ডা সবকিছুকেই অনন্ত জীজ্ঞাসা নিয়ে উথালপাথাল উন্মাদনায় সোনাপাড়াকে সোনাপাড়ার সকালদুপুরবিকেলরাত্রি দিয়ে বহুরৈখিক এক দেশকালের জঙ্গমতায় ধারাবাহিকতার এক ফ্রেমে নিজেকে সমগ্রতার এক উজানরেখায় ফিরিয়ে আনতে থাকে।সোনাপাড়া তখন দেশকালের উর্দ্ধে ওঠা মিথ।কিংবদন্তী। কিংবদন্তীর দেশে গান বাজে-
‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার
সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার’

১৫।

মাসুদার কি খুলনা যাবে।সাতক্ষীরা যাবে।না কি বাগেরহাট দিয়ে ঢুকে পড়বে সুন্দরবনের ভিতর।সুজন হাজারীকে কবিতা শোনাতে গিয়ে মাসুদারের স্মৃতিতে জেগে উঠবে ‘ট্রেন টু পাকিস্থান’ বইটি পড়বার স্মৃতি।কিংবা সেলিনা হোসেনের ‘ভুমি ও কুসুম’।এত এত জীবনযাপন নিয়ে সন্ধান অনুসন্ধান দিয়ে মাসুদার তার ভুবনমায়ায় তার কবিতায় নিজেকে এলিয়ে দিলে সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে রেডিওবিতান।মাসুদার তার সোনাপাড়ায় জেগে থেকে বেঁচে থেকে বেঁচে থাকতে থাকতে চিরদিনের চিরনতুনত্বকে চকিত হরিনের পদশব্দের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে,বিশ্বস্থ ছবিগুলোকেই মান্যতা দিতে থাকে।এখানেই তার কবিস্বত্বার জিত।এভাবেই তার ভ্রমণ পরিভ্রমণকে সোনাপাড়ার বৃত্ত থেকে সে পল্লবিত করে দিলেও মাসুদার কি বিষাদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে?আত্মখননে এক জন্ম কেটে গেলো তার।সে কি আর্ন্তজাতিক হয়ে উঠবে ক্রমে!বাতাসের কোন গতিবেগে তুই নিজেকে আটকে রাখিস রে মাসুদার!

১৬।

জীবনের মত বয়ে চলা জীবনকে দু’হাতে জাপটে ধরে মাসুদার।যেমন সে জাপটে ধরে তার সোনাপাড়াকে।মাসুদার গুবরে পোকাদের চলাচল দেখে।তার সোনাপাড়া তার বাংলাদেশ তার দেশকাল জন্মমরণ দিয়ে জন্মমরণের ভিতর দিয়ে মাসুদার আগামীর প্রস্তুতি শুরু করে।সোনাপাড়ার হাওয়ায় ঢেউ ওঠে।তারপর সারি সারি পিঁপড়ের শোকযাত্রার মাঝখানে ধানবাংলায় বৃষ্টি নামে।সোনাপাড়ায় বৃষ্টি নামে।                                                                                       

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র