পেক্টোরালিস মেজর দুটো বড় সুন্দর ছিল। এই সুঠাম পেশীর ডানার আড়ালে অনেকখানি বুক লুকিয়ে রেখেছিল সন্দীপন। গলার ঠিক নীচ থেকে লম্বালম্বি ইনসিশন, বুকের মাঝবরাবর। কন্ঠার হাড় বরাবর আড়াআড়ি আরেকটা। চামড়া কাটতেই বেরিয়ে পড়ে সাদা এবং প্রায় ঝকঝকে টেকসই কোলাজেনের পর্দা। পর্দার পিছনে পেক্টোরালিসেরা। তার পিছনে পাঁজরের খাঁচা আর ছোট ছোট খাঁচার পেশী... যারা নিজেরা সংকুচিত হয়ে এই খাঁচাকে টানাটানি করে ফোলায় আর চুপসে দেয় অবিরল, অক্লান্ত হাপরের মতো। খাঁচার ভেতর বুক। সেখানে কোনো‘অচিন পাখি’ ছিল কিনা দেখার জন্যে ডিসেকশন চলছে। জনা পঁচিশ ছাত্র এবং একজন শিক্ষিকা সেই “পাখি এক খোঁজ” সিরিয়াল কাটাকুটির আজকের এপিসোড দেখে গেছে কিছুক্ষণ আগে। সবাই চলে যাবার পর নিজেও বেরিয়ে যাবার ভান করে গেটের কাছ থেকে চোরের মতো ফিরে এসেঅর্ধোন্মোচিত সেই বুকের উপর ঝুঁকে পড়ে এখন চুপি চুপি রিপিট টেলিকাস্ট দেখছে জাহ্নবী।
কী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পেশীতন্তুর রেখাগুলো! বেশ ব্যায়াম করা চেহারা ছিল সন্দীপনের। শেষ যখন দেখা হয়েছিল, সামান্য মেদ জমতে শুরু করেছিল সবে। এখন সেই মেদটুকু চেঁছে তুলে ফেলেছে ওরা। পুরোনো সন্দীপন আবার সুঠাম। পেক্টোরালিস আর ডেল্টয়েডের বাদামী মালভূমির মাঝে এক সংকীর্ণ খাত। সেই পথে দক্ষিণ থেকে উত্তরে, হাত থেকে কাঁধের দিকে বয়ে চলেছে যমুনার মতো কৃষ্ণ-সুনীল এক শিরা। তার নাম কেফালিক ভেইন। একদিন এ নদীতে স্রোত ছিল। ছিল তার নিজস্ব গোপিনী।
এ:! ওপর দিকটা ছেৎড়ে গেছে। আরেকটু যত্ন করে কাটা উচিত ছিল। অনিতাকে দেওয়াই ঠিক হয়নি। বড় তাড়াহুড়ো মেয়েটার। সন্দীপনের শরীর, অন্তত সে ফেলে যাবার পর, জাহ্নবী কি পেতে পারত না? নিদেন পক্ষে থোরাক্স উইন্ডো ডিসেকশনের দায়িত্বটুকু। এটুকু পেলে বুকের জানালা আরেকবার নিজে হাতে খোলা যেত। অপরকে দিতে হত না। সুদূর অপর এই সব ছেলে-মেয়েরা সন্দীপনকে কখনো চেনেনি। তারা শুধু মাসল-নার্ভ-ভেইন দেখতে পাচ্ছে। দেহতত্বের ওরা কী জানে? ওরা খাঁচা চেনে। পাখি চেনে না।
জাহ্নবী চেয়েছিল শরীরটা দখল করতে। বিভাগীয় প্রধান তপন কুমার দত্তকে রাজি করিয়ে ফেলেছিল। ডক্টর জাহ্নবী মুখোপাধ্যায় কেন একটা ব্যাচের থোরাক্স ডিসেকশন মাস পয়লা থেকেই শুরু করতে চায়, কেন সদ্য আসা একটি ক্যাডাভার তাকে উৎসাহিত করল, এসব বিষয়ে কোনো গোয়েন্দাসুলভ কৌতূহল তপন দত্তের মনে উদিত হয়নি। তিনি ব্যাচ বি, রোল নাম্বার টুয়েন্টি সিক্স টু ফিফটির পাশে জে. এম. লিখে তালিকা সম্পূর্ণ করে টাইপিস্টের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু কাবেরীদি বারণ করল, “পারবি না। কেন করছিস ছেলেমানুষের মতো?”
জানু মুখুজ্জে, উমর চল্লিশ সাল, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অব অ্যানাটমি, চুপ করে থাকে। ঘন্টা দুয়েক আগে হেডুর ঘরে যে নন-শ্যালান্ট স্বাভাবিকতা তার ছিল, সেটা লোডশেডিং সন্ধের কোলকাতা শহরের মতো ঝুপ করে নিভে যায়। সত্যি তো! হাত কাঁপবে। চোখ ঝাপসা হবে।তপনাদা জানে না ব্যাপারটা। কাবেরীদি জানে। কাবেরীদি একই কলেজের তিন বছরের সিনিয়র। সে দেখেছে। সে জানে। সে নিজের মতো করে বোঝে সম্ভব-অসম্ভব। ভেজিটেবল চপ আর চা খেতে খেতে দুই আর মেধা বা নৈপুণ্যের উপর শিক্ষিতজনোচিত আস্থা রাখতে পারে না। তাদের ভাবনায় ঢুকে পড়ে অ্যানাটমি বহির্ভূত অন্যান্য হাওয়া।
কাবেরীই দায়িত্ব নিয়ে বদলে দিয়েছিল অ্যালটমেন্ট লিস্ট। আগে বদলে, পরে সেটা হেডুকে জানিয়েছিল।
- রস্টার একটু পাল্টালাম স্যার। দেখুন।
- এটা করবে? জাহ্নবী কিন্তু টেবিল টু চাইছিল।
- না, চাইছে না। কথা বলেছি। ও তিন নম্বরটা নিক। হ্যান্ড ডিসেকশন আছে। ওটা বেশী ডেলিকেট। জানু ভালো পারবে। অনিতাকে এটা দিন। থোরাক্স। সহজ হবে। সবে ডেমন্সট্রটর হয়ে ঢুকেছে তো স্যার, এম. ডি. করেনি। ওকে এখনই হ্যান্ড দেওয়া ঠিক হবে না। ওই বডিতেই ইনফেরিয়র এক্সট্রিমিটি করুক ব্যাচ ডি। ফুট ডিসেকশন শুরু করবে। বিপ্লব নিচ্ছে তো। সুবিধে হবে। বিপ্লব খানিকটা সিনিয়র। দরকারে হেল্প করতে পারবে অনিতাকে।
- তা অবশ্য ঠিকই বলেছ।
- কোন কালে ভুল বলি? (নিঃশব্দ এবং সশব্দ হাসি, যথাক্রমে কাবেরী ও তপনের)
- কিন্তু জাহ্নবীকে ওই বডিতে লোয়ার লিম্ব দিলেও তো হত। অনিতাকে গাইড করতে পারত। অন্য বডিতে দেবার দরকার কী?
- না না, এটাই থাক। জানুর টেবল থ্রি। সুপেরিয়র এক্সট্রিমিটি।
- বেশ। যা ভাল মনে কর। তাহলে এটাই ফাইনাল থাক।
বেশী কেটে যাওয়া জায়গাটায় হাত বোলায় জাহ্নবী। গ্লাভস পরেনি। অনেকদিন পর আবার গ্লাভসহীন মরা ছোঁয় সে। এবং ছোঁয়া মাত্র টের পায় যে শরীরটা জীবিত।
“শেষপর্যন্ত তোর কাছেই ফিরে আসব দেখিস,” সন্দীপন বলেছিল। সে অবশ্য আরো অনেক কথা বলার পর, অনেক কথা না বলার পর। তারপর আর মাত্র একবার দেখা হয়েছিল। মাত্র একবার, সেও আজ থেকে তিন বছর আগে। ওই একবারই কলেজের রিউনিয়নে এসেছিল সন্দীপন। যেমন হঠাৎ করে চলে গিয়েছিল কোলকাতা ছেড়ে, তেমনি হঠাৎ একদিন এল রিউনিয়নে। পূর্ব-পরিকল্পনা ছিল না যথারীতি। স্পট রেজিস্ট্রেশন। পরের দিন আর এল না। জাহ্নবী সেদিনও খুঁজেছিল বার বার, কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি। ফোন নাম্বার নেওয়া হয়নি তালেগোলে।
ফোন অবশ্য এসেছিল সন্দীপনের কাছ থেকেই প্রায় বছর দেড়েক পর। ল্যান্ড লাইন। ভিলাইয়ের নাম্বার।
- কেমন আছিস? আমাদের মেডিকেল কলেজে ফিরে এসেছিস শুনলাম ট্রান্সফারের মহিমায়। এবার কি প্রফেসর হয়ে গেলি?
- কে বলছেন? ওহ! সন্দীপন? কোথায় তুই?
- একটু ভিলাই এসেছি কাজে। এখনো বিলাসপুরেই আছি। জংলি ডাক্তার। হা হা।
- তোর মোবাইল নম্বর দে তো।
- আমার নেই তো। আমি তো ইম্মোবাইল। (আবার সেই হাসি)
- হাসিস না। বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখিস কী করে?
- বাড়ি কই? বাবাও চলে গেছেন চার বছর হল, জানিসই তো। তিনকুলে কেউ নেই, এক তুই ছাড়া। (এবার আরো উদাত্ত হাসি) তোকে ফোন করতে হলে ভিলাই আসব ঠিক করেছি। বিলাসপুর টাউন গেলেই করা যায়, কিন্তু এটা বেশী রোম্যান্টিক হবে।
- ন্যাকামি করিস না। ফোন তো করলি জীবনে প্রথমবার।
- উঁহু, ভেবে দেখ। প্রথম নয়। গত দশ বছরে প্রথম বলতে পারিস অবশ্য।
- ছাড়। আমার ট্রান্সফারের খবর জানলি কেমন করে?
- সব খবরই রাখি ম্যাডাম। গুপ্তচর আছে আমার। প্রফেসর হলি?
- না রে। এখনো অ্যাসোসিয়েট। এখানে প্রমোশন হয় স্লো-মোশনে, জানিসই তো। তোর কী খবর? এদিকে কবে আসবি।
- আমারও ট্রান্সফার হবে মনে হচ্ছে।
- তোদের ট্রান্সফার হয় নাকি? সরকার অধিগ্রহণ করেছে নাকি হাসপাতালটা?
- না রে। আগের মতো করেই চলছে, মানুষের উদ্যোগে। অবশ্য অনেক বড় হয়েছে এখন। ভাল কাজ হচ্ছে। দুর্দান্ত কিছু সার্জারিও। তোদের শহরকে ধরে ফেলবে আমাদের জঙ্গল, দেখিস।
- সে শুনেছি কিছু কিছু। কিন্তু ট্রান্সফারের ব্যাপারটা বুঝলাম না।
- ওটা আমিও ঠিক বুঝিনি এখনো। কিন্তু মন বলছে। মনে হচ্ছে আর বেশীদিন না এখানে। আবার হয়ত অন্য কোথাও! অন্য কোনো শহর, জঙ্গল, পাহাড় বা আকাশ।
- কেন রে? কী হয়েছে?
- কিছুই হয়নি তেমন। জাস্ট একটা প্রিমনিশন বলতে পারিস। স্রেফ মনে হচ্ছে।
- এখানে চলে আয়। এখানে সব আছে। শহর আছে, কংক্রিটের জঙ্গল আছে, পাহাড় প্রমাণ উঁচু বাড়ি আছে, টুকরো টুকরো আকাশও আছে। এবার ফের।
- ফিরব তো বটেই একদিন। তোকে তো কথা দেওয়াই আছে।
- ওটা আর বলবি না। প্লিজ।
- থাক তাহলে। আচ্ছা, আজ রাখি রে। রূপাই ভাল আছে?
- হ্যাঁ। মহা পাজি হয়েছে। পড়াশুনার ধারে কাছে নেই।
- আর মৃগাঙ্ক?
- আছে নিজের মতো করে ভাল। ব্যাঙ্কক গেছে কাজে।
- বুঝলাম।
- কী বুঝলি?
- তুই সুখী নোস, না রে? (উপযুক্ত সমমর্মিতা বোধক ভয়েস মডিউলেশন সহ)
- কে তোকে এত বুঝতে বলেছে শুনি? মৃগাঙ্ক ভটচাযের বৌ সুখী কিনা, তা জেনে তুই কী করবি এতদিন পরে?
- থাক। রাখি রে।
- আচ্ছা। ভাল থাকিস।
কোলকাতা ছেড়ে পাকাপাকি চলে যাবার আগের
দিনও ফোন করেছিল সন্দীপন। তখন জাহ্নবীর ল্যান্ডলাইন, সন্দীপনের পাবলিক বুথ।
সে ছিল প্রাক সাউথ সিটি যুগের কোলকাতা। মেট্রো তখন দক্ষিণে
টালিগঞ্জ অব্দি। জাহ্নবী তখনো যাদবপুরের পৈতৃক বাড়িতে থাকে। সেল ফোনের বাজার
মোটোরোলার দখল থেকে নোকিয়ার হাতে যাবে যাবে করছে সবে। ইনকামিং কলের পয়সা
লাগত। সেই রকম একদিন সান্ধ্য ট্রিং ট্রিং।
- চললাম বুঝলি? বিলাসপুর ফাইনাল।
- আমাকে বলছিস কেন?
- বাহ! একেবারে চলে যাচ্ছি। ভাবলাম জানাই একবার।
- বেশ তো, যা না। সশস্ত্র বিপ্লব কর গিয়ে।
- জঙ্গল শুনলেই তোদের সশস্ত্র বিপ্লব মনে হয় কেন? পুলিশের গুলি ছাড়া কি গরীব আদিবাসী মরে না নাকি? অসুখ-বিসুখ হয় না?
- এই তর্ক অনেক বার হয়েছে স্যান্ডি। এখানেও গ্রাম আছে। গরীব আছে। সরকারী চাকরি নিয়েও তাদের জন্য কাজ করা যায়। আমরা কি হাসপাতালে বড়লোকদের চিকিৎসা করছি? ওসব ছাড়। তুই জঙ্গলে শ্রেণীশত্রু খোঁজ গিয়ে যা।
- আজকেও রাগ করছিস? অন্তত তুই তো জানিস, আমি কী চাই। শ্রেণীসংগ্রাম বলতে পারিস অবশ্য। চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকু এক শ্রেণীর মানুষের কাছে পৌঁছানোর সংগ্রাম। সশস্ত্রই বটে। স্টেথোস্কোপ, স্ক্যালপেল, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ কি কম শক্তিশালী অস্ত্র? মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়ে ওরা।
- ঠিক আছে। দূরে তো চলেই গেছিস। এখন একটু ভৌগোলিক দূরত্ব বাড়াবি, এইটুকুই তো। আমার কিচ্ছু যায় আসে না।
- আমি জানি, তোর আসল রাগটা হল এইখানে। কোথায় আর যাব? যেখানেই যাই, শেষ পর্যন্ত তোর কাছেই ফিরে আসব দেখিস।
মৃগাঙ্ক জাহ্নবীর বিয়ের তখন হপ্তা দুই বাকি। ঠিক সেই সময় সিদ্ধান্ত পাকা করে সন্দীপনের চলে যাওয়ার কারণ, অন্তত অন্যতম কারণ, বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। কিন্তু যাবার আগে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসার কথাটা বলে গেল কেন বোকার মতো? অন্যের সাথে বিয়ের দু-সপ্তাহ আগে এ কথা কোনো মেয়েকে বলতে নেই, সেটুকু কবে শিখবি সন্দীপন?
রিউনিয়নের বিকেলে আরো একবার এসে পড়েছিল কথাটা। প্রিন্সিপালস লন তখন সরগরম। মানবদা আবৃত্তি করছেন। কেউ শুনছে না। জটলা করে ঘোরতর আড্ডা চলছে এদিক ওদিক। সেই ফাঁকে ওরা দুজন পালিয়েছিল।
- কুমার্স ক্যান্টিনে বসবি?
- না। ওখানে সবাই চেনা।
- তাহলে হেদো যাবি? আগের মতো ট্রামে চড়ে?
- না। বরং কফি হাউসের ভিড়টা কাজে লাগাই।
- তুই ভিড় ভালবাসিস নাকি আজকাল?
- ভালবাসার প্রশ্ন নয়। ঐ ভিড় আর অন্ধকারটা চাইছি। সহজে মিশে থাকা যাবে অনেকের মধ্যে। তুই তো চলে যাবি জঙ্গলে। আমাকে তো এই শহরেই থাকতে হবে।
- তাহলে থাক। কথা বলে কাজ নেই।
- না চল।
কফি হাউসের অল্প আলোর মতো ঝুপসি নিরালা মুখ নিয়ে সন্দীপন অন্ধকার কলরবে মিশে গেল। চুপচাপ এল রাস্তা পেরিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে উঠল, চেয়ার টেনে নিয়ে বসল কথা না বলে।প্রায় দশ মিনিটের নীরবতা এই লোকটার সাথে একেবারে বেমানান।
- চুপ করে থাকবি বলে এলি নাকি? কেমন আছিস-টাছিস বল কিছু?
- আছি রে দিব্বি। হাসপাতালটা বাড়ছে। একটা ভাঙা বাড়িতে শুরু হয়েছিল। একটা বাতিল গুদাম ঝেড়ে-মুছে প্যাথোলজি ল্যাবরেটরি। সেই জায়গা থেকে এখন পঞ্চাশটা ইনডোর বেড। জানিস তো এসব। তোর খবর বল। বর, বাচ্চা, সংসার... খবর তো তোর।
- খবর তোরও হতে পারত স্যান্ডি। না হওয়াটা তোর চয়েস।
- ঠিক তাই কি?
- নয়? পিজি এন্ট্রান্স দিলি না, চাকরি নিলি না, প্র্যাক্টিস করলি না। আজ এখানে, কাল সেখানে। কোন বাবা-মা চাইবে তার মেয়েকে যাবাবরের সাথে বিয়ে দিতে?
- বাবা-মার চাওয়াটা বড় ফ্যাক্টর হত না জানু। তুই নিজেও চাসনি।
- আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম স্যান্ডি। ইজ ইট আ ক্রাইম? তোর খেয়াল-খুশি মতো সব ছেড়ে উড়ে যেতে পারিনি বলে...
- আহা! আমি তো তোকে দোষ দিইনি।
- এটা তাহলে কী দেওয়া? ইউ মেক মি ফিল গিলটি অল দ্য টাইম। সম্পর্কটা ধরে রাখার দায়িত্ব একা আমার ছিল? তুই নিজের ইচ্ছেটা ছেড়েছিলি? নাকি তোর ইচ্ছেগুলো খুব মহান বৈপ্লবিক বলে শুধু সেগুলোই মূল্যবান? সাধারণ ভাবে কেউ বাঁচতে পারবে না? সব মেয়েকেই অনিমেষের মাধবীলতা হতে হবে?
- বাদ দে। টপিক বদলা। অ্যানাটমি নিলি কেন? কোনো ক্লিনিকাল সাবজেক্ট নিতে পারতিস।
- পিজি এন্ট্রান্সের স্কোর ভাল ছিল না। এটাই পেলাম। চাকরি, সংসার সামলে কতটুকু পড়াশুনা করা যায়, সে তুই বুঝবি? তবে ভালই হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজগুলো ছাড়া পোস্টিং হবে না। ঘড়ি ধরে নটা-পাঁচটার চাকরি। ইমার্জেন্সি নেই। সংসারী মেয়েদের পক্ষে ভাল।
- এটাই কি তুই চেয়েছিলি?
- কী চেয়েছিলাম, সেটা পিছন ফিরে ভেবে লাভ নেই। এখন এটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই স্বাচ্ছন্দ্যটুকু এখন আমার দরকার।
- তুই খুশি?
- বললাম যে, কমফোর্টেবল। ওটা সুখের একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
- স্বস্তি বলছিস? হ্যাঁ সুখের চেয়ে সে নাকি ভাল বলে শুনেছি। ডিসেকশন নিয়ে আমার অস্বস্তির কথা তোকে বলেছিলাম, মনে আছে?
- হ্যাঁ। ভায়োলেন্স বা ওরকম কিছু একটা।
- একরকম ভায়োলেন্স তো বটেই। একটা মানুষের দেহ তোর টেবিলে শুয়ে আছে। তুই নিজের ইচ্ছে মতো কেটে ছিঁড়ে তাকে দেখছিস। নিজের মতো ব্যাখ্যা করছিস। দেহটার নিজের কোনো বক্তব্য নেই, অংশগ্রহণ নেই। এক অনন্ত প্যাসিভিটি নিয়ে সে শুয়ে আছে, আর তুই তার শরীরে বিনা বাধায় প্রবেশ করছিস। এরকম মনে হয় না? আচ্ছা, তুই তো মেয়ে। মনে হয় না যে ওই মৃতদেহগুলো আরো বেশী করে নারী, আর ছুরি হাতে পেলেই তুই খানিকটা পুরুষ?
- ওভাবে ভাবি না।
- কেন ভাবিস না?
- ওরকম ভাবলে কাজটা করতে পারব না, তাই। আমরা শরীরকে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে পড়ি আর পড়াই। এ নিয়ে আমার মনে কোনো অপরাধবোধ নেই।
- না না, অপরাধবোধ কেন থাকবে? আমি বলছি শুধু এই প্যাসিভিটির কথা। যাকে পড়ছিস, কাটছিস, দেখছিস, তার যেন কোনো উপস্থিতিই নেই সমগ্র চর্চার মধ্যে। অপ্রতিরোধী অনস্তিত্ব শুধু। বিযে সব আনক্লেইমড বডি হাসপাতালে আসে, তারা তো স্বেচ্ছায় নিজেদের দান করেনি। তাদের সাথে আমরা যা করি, সেটা অবশ্যই ভায়োলেন্স।
- তুই এখনো খুব ভাল কথা বলিস। কিন্তু কী বলিস, সেটা সম্ভবত তুই একাই বুঝিস। আগেও তোর কথা শুনে আমরা অনেকেই মুগ্ধ হতাম। বাড়ি ফিরে দেখতাম কিছুই আর গুছিয়ে মনে করতে পারছি না।তখন বুঝতে পারতাম যে সব কথা আসলে ওপর দিয়ে হুস হয়ে গেছে।এতদিনেও বদলাসনি। কোথায় ভাবলাম মাওবাদী হবি, দেখছি গান্ধীর বাড়া অহিংস।
দুজনে প্রাণ খুলে হাসে খানিকটা। হাসতে হাসতে সিগারেট ধরায় সন্দীপন।
- সিগারেটটা ছাড় এবার।
- সিগারেট খাই না তো। ছেড়ে দিয়েছি। বিড়ি খাই এখন। নেহাত তোদের ভদ্রলোকের শহরে এলাম বলে দুদিন একটু...
- সেই বাজে বকার অভ্যেস। আচ্ছা, লেট মি অ্যামেন্ড। বিড়িটা ছাড়।
- বিড়ি ছেড়ে সিগারেট ধরতে বলছিস?
- উফ!
- আমি সব ছেড়ে দিতে পারি, কিন্তু বিড়ি আমাকে ধরে রেখেছে। সে ছাড়া আমার কে আছে বল বিদেশ-বিভূঁইয়ে?
- কে বলেছে বিদেশে পড়ে থাকতে? ফিরে এলেই পারিস।
- আসব আসব। ঠিক ফিরে আসব দেখিস। তোকে তো কথা দেওয়াই আছে। শেষে দেখবি ঠিক...
- থাম।
- চললাম বুঝলি? বিলাসপুর ফাইনাল।
- আমাকে বলছিস কেন?
- বাহ! একেবারে চলে যাচ্ছি। ভাবলাম জানাই একবার।
- বেশ তো, যা না। সশস্ত্র বিপ্লব কর গিয়ে।
- জঙ্গল শুনলেই তোদের সশস্ত্র বিপ্লব মনে হয় কেন? পুলিশের গুলি ছাড়া কি গরীব আদিবাসী মরে না নাকি? অসুখ-বিসুখ হয় না?
- এই তর্ক অনেক বার হয়েছে স্যান্ডি। এখানেও গ্রাম আছে। গরীব আছে। সরকারী চাকরি নিয়েও তাদের জন্য কাজ করা যায়। আমরা কি হাসপাতালে বড়লোকদের চিকিৎসা করছি? ওসব ছাড়। তুই জঙ্গলে শ্রেণীশত্রু খোঁজ গিয়ে যা।
- আজকেও রাগ করছিস? অন্তত তুই তো জানিস, আমি কী চাই। শ্রেণীসংগ্রাম বলতে পারিস অবশ্য। চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকু এক শ্রেণীর মানুষের কাছে পৌঁছানোর সংগ্রাম। সশস্ত্রই বটে। স্টেথোস্কোপ, স্ক্যালপেল, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ কি কম শক্তিশালী অস্ত্র? মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়ে ওরা।
- ঠিক আছে। দূরে তো চলেই গেছিস। এখন একটু ভৌগোলিক দূরত্ব বাড়াবি, এইটুকুই তো। আমার কিচ্ছু যায় আসে না।
- আমি জানি, তোর আসল রাগটা হল এইখানে। কোথায় আর যাব? যেখানেই যাই, শেষ পর্যন্ত তোর কাছেই ফিরে আসব দেখিস।
মৃগাঙ্ক জাহ্নবীর বিয়ের তখন হপ্তা দুই বাকি। ঠিক সেই সময় সিদ্ধান্ত পাকা করে সন্দীপনের চলে যাওয়ার কারণ, অন্তত অন্যতম কারণ, বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। কিন্তু যাবার আগে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসার কথাটা বলে গেল কেন বোকার মতো? অন্যের সাথে বিয়ের দু-সপ্তাহ আগে এ কথা কোনো মেয়েকে বলতে নেই, সেটুকু কবে শিখবি সন্দীপন?
রিউনিয়নের বিকেলে আরো একবার এসে পড়েছিল কথাটা। প্রিন্সিপালস লন তখন সরগরম। মানবদা আবৃত্তি করছেন। কেউ শুনছে না। জটলা করে ঘোরতর আড্ডা চলছে এদিক ওদিক। সেই ফাঁকে ওরা দুজন পালিয়েছিল।
- কুমার্স ক্যান্টিনে বসবি?
- না। ওখানে সবাই চেনা।
- তাহলে হেদো যাবি? আগের মতো ট্রামে চড়ে?
- না। বরং কফি হাউসের ভিড়টা কাজে লাগাই।
- তুই ভিড় ভালবাসিস নাকি আজকাল?
- ভালবাসার প্রশ্ন নয়। ঐ ভিড় আর অন্ধকারটা চাইছি। সহজে মিশে থাকা যাবে অনেকের মধ্যে। তুই তো চলে যাবি জঙ্গলে। আমাকে তো এই শহরেই থাকতে হবে।
- তাহলে থাক। কথা বলে কাজ নেই।
- না চল।
কফি হাউসের অল্প আলোর মতো ঝুপসি নিরালা মুখ নিয়ে সন্দীপন অন্ধকার কলরবে মিশে গেল। চুপচাপ এল রাস্তা পেরিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে উঠল, চেয়ার টেনে নিয়ে বসল কথা না বলে।প্রায় দশ মিনিটের নীরবতা এই লোকটার সাথে একেবারে বেমানান।
- চুপ করে থাকবি বলে এলি নাকি? কেমন আছিস-টাছিস বল কিছু?
- আছি রে দিব্বি। হাসপাতালটা বাড়ছে। একটা ভাঙা বাড়িতে শুরু হয়েছিল। একটা বাতিল গুদাম ঝেড়ে-মুছে প্যাথোলজি ল্যাবরেটরি। সেই জায়গা থেকে এখন পঞ্চাশটা ইনডোর বেড। জানিস তো এসব। তোর খবর বল। বর, বাচ্চা, সংসার... খবর তো তোর।
- খবর তোরও হতে পারত স্যান্ডি। না হওয়াটা তোর চয়েস।
- ঠিক তাই কি?
- নয়? পিজি এন্ট্রান্স দিলি না, চাকরি নিলি না, প্র্যাক্টিস করলি না। আজ এখানে, কাল সেখানে। কোন বাবা-মা চাইবে তার মেয়েকে যাবাবরের সাথে বিয়ে দিতে?
- বাবা-মার চাওয়াটা বড় ফ্যাক্টর হত না জানু। তুই নিজেও চাসনি।
- আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম স্যান্ডি। ইজ ইট আ ক্রাইম? তোর খেয়াল-খুশি মতো সব ছেড়ে উড়ে যেতে পারিনি বলে...
- আহা! আমি তো তোকে দোষ দিইনি।
- এটা তাহলে কী দেওয়া? ইউ মেক মি ফিল গিলটি অল দ্য টাইম। সম্পর্কটা ধরে রাখার দায়িত্ব একা আমার ছিল? তুই নিজের ইচ্ছেটা ছেড়েছিলি? নাকি তোর ইচ্ছেগুলো খুব মহান বৈপ্লবিক বলে শুধু সেগুলোই মূল্যবান? সাধারণ ভাবে কেউ বাঁচতে পারবে না? সব মেয়েকেই অনিমেষের মাধবীলতা হতে হবে?
- বাদ দে। টপিক বদলা। অ্যানাটমি নিলি কেন? কোনো ক্লিনিকাল সাবজেক্ট নিতে পারতিস।
- পিজি এন্ট্রান্সের স্কোর ভাল ছিল না। এটাই পেলাম। চাকরি, সংসার সামলে কতটুকু পড়াশুনা করা যায়, সে তুই বুঝবি? তবে ভালই হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজগুলো ছাড়া পোস্টিং হবে না। ঘড়ি ধরে নটা-পাঁচটার চাকরি। ইমার্জেন্সি নেই। সংসারী মেয়েদের পক্ষে ভাল।
- এটাই কি তুই চেয়েছিলি?
- কী চেয়েছিলাম, সেটা পিছন ফিরে ভেবে লাভ নেই। এখন এটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই স্বাচ্ছন্দ্যটুকু এখন আমার দরকার।
- তুই খুশি?
- বললাম যে, কমফোর্টেবল। ওটা সুখের একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
- স্বস্তি বলছিস? হ্যাঁ সুখের চেয়ে সে নাকি ভাল বলে শুনেছি। ডিসেকশন নিয়ে আমার অস্বস্তির কথা তোকে বলেছিলাম, মনে আছে?
- হ্যাঁ। ভায়োলেন্স বা ওরকম কিছু একটা।
- একরকম ভায়োলেন্স তো বটেই। একটা মানুষের দেহ তোর টেবিলে শুয়ে আছে। তুই নিজের ইচ্ছে মতো কেটে ছিঁড়ে তাকে দেখছিস। নিজের মতো ব্যাখ্যা করছিস। দেহটার নিজের কোনো বক্তব্য নেই, অংশগ্রহণ নেই। এক অনন্ত প্যাসিভিটি নিয়ে সে শুয়ে আছে, আর তুই তার শরীরে বিনা বাধায় প্রবেশ করছিস। এরকম মনে হয় না? আচ্ছা, তুই তো মেয়ে। মনে হয় না যে ওই মৃতদেহগুলো আরো বেশী করে নারী, আর ছুরি হাতে পেলেই তুই খানিকটা পুরুষ?
- ওভাবে ভাবি না।
- কেন ভাবিস না?
- ওরকম ভাবলে কাজটা করতে পারব না, তাই। আমরা শরীরকে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে পড়ি আর পড়াই। এ নিয়ে আমার মনে কোনো অপরাধবোধ নেই।
- না না, অপরাধবোধ কেন থাকবে? আমি বলছি শুধু এই প্যাসিভিটির কথা। যাকে পড়ছিস, কাটছিস, দেখছিস, তার যেন কোনো উপস্থিতিই নেই সমগ্র চর্চার মধ্যে। অপ্রতিরোধী অনস্তিত্ব শুধু। বিযে সব আনক্লেইমড বডি হাসপাতালে আসে, তারা তো স্বেচ্ছায় নিজেদের দান করেনি। তাদের সাথে আমরা যা করি, সেটা অবশ্যই ভায়োলেন্স।
- তুই এখনো খুব ভাল কথা বলিস। কিন্তু কী বলিস, সেটা সম্ভবত তুই একাই বুঝিস। আগেও তোর কথা শুনে আমরা অনেকেই মুগ্ধ হতাম। বাড়ি ফিরে দেখতাম কিছুই আর গুছিয়ে মনে করতে পারছি না।তখন বুঝতে পারতাম যে সব কথা আসলে ওপর দিয়ে হুস হয়ে গেছে।এতদিনেও বদলাসনি। কোথায় ভাবলাম মাওবাদী হবি, দেখছি গান্ধীর বাড়া অহিংস।
দুজনে প্রাণ খুলে হাসে খানিকটা। হাসতে হাসতে সিগারেট ধরায় সন্দীপন।
- সিগারেটটা ছাড় এবার।
- সিগারেট খাই না তো। ছেড়ে দিয়েছি। বিড়ি খাই এখন। নেহাত তোদের ভদ্রলোকের শহরে এলাম বলে দুদিন একটু...
- সেই বাজে বকার অভ্যেস। আচ্ছা, লেট মি অ্যামেন্ড। বিড়িটা ছাড়।
- বিড়ি ছেড়ে সিগারেট ধরতে বলছিস?
- উফ!
- আমি সব ছেড়ে দিতে পারি, কিন্তু বিড়ি আমাকে ধরে রেখেছে। সে ছাড়া আমার কে আছে বল বিদেশ-বিভূঁইয়ে?
- কে বলেছে বিদেশে পড়ে থাকতে? ফিরে এলেই পারিস।
- আসব আসব। ঠিক ফিরে আসব দেখিস। তোকে তো কথা দেওয়াই আছে। শেষে দেখবি ঠিক...
- থাম।
আকারে ইঙ্গিতে কথাটা তিনবার বলেছিল বা বলার চেষ্টা করেছিল সন্দীপন। তিনবারে ধাপে ধাপে “শেষ পর্যন্ত ফিরে আসা”-র মানে বদলে যাচ্ছিল। বদলে যাবার কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছিল না। কিন্তু অর্থ বা দ্যোতনার সেই পরিবর্তনটা জাহ্নবী যেন টের পাচ্ছিল। দ্বিতীয় আর তৃতীয়বার তাই অসমাপ্ত কথাটা থামিয়ে দিয়েছিল সে। কিন্তু অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতি রেখেছে সন্দীপন। শুধুমাত্র জাহ্নবীর জন্যেই এই কলেজে শরীর হয়ে এসেছে সে, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না। কেন তাকে নিতে পারল না জাহ্নবী?কেন যে কাবেরীদির কথা শুনে মনের জোরটা হারিয়ে ফেলল হঠাৎ? আরেকবার এই পরাজয়ের কি কোনো প্রয়োজন ছিল?
ভিলাই থেকে সেই ফোনের বছর খানেক বাদে কোলকাতায় ফিরে এসেছিল সন্দীপন। দুই কুড়ি বয়স হবার আগেই প্রথম হার্ট অ্যাটাকের পর। জাহ্নবীকে জানায়নি। বিড়িও ছাড়েনি। একদিন মেডিকেল কলেজে এসে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করে নিঃশব্দে ফিরে গেছিল চেনা কারো সাথে দেখা না করে। তারপর ইতস্তত ঘুরে বেড়িয়েছে পরবর্তী মাস তিনেক, দ্বিতীয় অ্যাটাকের আগে অব্দি। আলিপুর দুয়ারে ধনাদাদুর বাড়িতে কদিন, হিলিতে কুন্টুমাসি, ছোটবেলার বন্ধু নির্মাল্য পাল ওরফে ন্যাংটা নিমোর কাছে লখনৌতে কদিন। এভাবে লোকের বাড়ি যাওয়ার ইতিহাস সন্দীপনের কোনো অনুপুঙ্খ জীবনীকার খুঁজে বের করতে পারবে না। যোগাযোগ না রাখার জন্যে চিরকাল গালি খেয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দে হাসত সে। হঠাৎ নাকি এদের দেখতে ইচ্ছে করছিল। অসময়ের অসুখ কি মানুষের কলজের জোর কমিয়ে দেয়? নাকি সন্দীপন বুঝতে পারছিল তার আবার ট্রান্সফার হয়ে যাবে শহর-জঙ্গল-পাহাড় সবকিছু থেকে দূরে? দেহদানের অঙ্গীকারপত্রে সই করার সময় সে যে সনির্বন্ধ অনুরোধ নথিভুক্ত করেছিল যাতে তার দেহ মেডিকেল কলেজেই আসে, তা কি শুধুই প্রাক্তনিসুলভ সেন্টিমেন্ট? নাকি সে জানত জাহ্নবী আবার অন্যত্র চলে যাবার আগেই সে একেবারে চলে আসতে পারবে তার কাছে?
এত তাড়াহুড়ো করে সে এল, অথচ জাহ্নবী তাকে নিতে পারল না। সন্দীপন কথা রেখেছিল। সুযোগ দিয়েছিল। সম্পর্কটাকে পরিণতি দেবার একটা শেষ চেষ্টা ছিল তার দিক থেকে। জাহ্নবীর হাতে একটু একটু করে সে উন্মোচিত হতে চেয়েছিল। ভালবাসার রাতে ঘোমটা সরানোর মতো নিজেকে মেলে ধরতে চেয়েছিল একটি পুরুষ। তার একমাত্র নারী শানিত স্ক্যালপেলের মসৃণ যত্নে সরিয়ে দেবে তার দেহের আবরণের এক এক স্তর। ধীরে ধীরে সমূহ নির্মোক মোচন হলে পড়ে থাকবে খাঁচার আগল খুলে উড়ে যাওয়া একটি পাখি অথবা অদৃশ্য হৃদয় সম্বল এক পুরুষ, আর তার মুক্তিদাত্রী অদ্বিতীয়া নারী। সেই মেয়ে তাকে অন্যের হাতে ছেড়ে দিল!
কাবেরী আর অনিতার ওপর, অথবা নিজের ওপর হিংস্র আক্রোশে ছটফট করে জাহ্নবী। বুকের সামনে থেকে সরে পায়ের দিকে যায়। ডান পা কাটা শুরু করেছে আরেক গ্রুপ। “সোল অব দ্য ফুট” উন্মোচিত। ফিতের মতো পেশীগুলো চলে গেছে আঙুলের দিকে, জাহ্নবী দেখে। আবার ফিরে আসে বুকের কাছে। বাঁ কাঁধের কাছাকাছি একটা জায়গা অযত্নে বিক্ষত। সেই জায়গাটা এখন ঝাপসা দেখাচ্ছে। বেশীক্ষণ ঝুঁকে দেখলে ভিজে যেতে পারে। জাহ্নবী জায়গাটা ছোঁয়। সন্দীপনের বুকে হাত রাখে। আর তখনি শরীরটা জেগে ওঠে।
ফর্ম্যালিনের ঝাঁঝে শুকিয়ে যাওয়া অনন্ত অপ্রতিরোধে শয়ান সেই শব সহসা শব্দহীন কথা বলে ওঠে জাহ্নবীর সঙ্গে। ক্ষত ছুঁয়ে থাকা হাতটিকে চিনতে পারে সে। মৃত স্নায়ুতন্ত্রে স্পন্দন জাগিয়ে সেই হাতের ভেতর দিয়ে তরঙ্গ পাঠায় মেয়েটির মগজে। শুরু হয় কথোপকথন। নিঝুম অ্যানাটমি ডিসেকশন ঘরে দুই প্রাক্তন সহপাঠীর রাঁদেভু।
এতদিনে সন্দীপনের কথার মানে বুঝতে পারে জাহ্নবী। শবের সাথে এই ভাষাতীত কথোপকথন তাকে স্পষ্ট দেখিয়ে দেয় এতদিন ধরে কেটে-ছিঁড়ে দেখে ফেলা দেহদের সাথে তার সংযোগহীনতা। অপ্রতিরোধী প্যাসিভিটিকে সম্মতি ভেবে এতদিন নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ করেছে শুধু। খাঁচা আর মোড়কের অ্যানাটমি। পাখি খোঁজা হয়নি কখনো। দেহের আনাচে-কানাচে লুকোনো টেপ রেকর্ডারে পলাতকের ফেলে যাওয়া গান খোঁজা হয়নি। সন্দীপনের মতো করে কেউ তার কাছে আসেনি।
কেউ আসেনি এবং সে নিজেও যায়নি কারো কাছে। নিজেকে শয্যালীন দেখতে পায় জাহ্নবী। এতদিনের সমস্ত অপরিচিত শবের মতো সে রোজ রাতে শুয়ে থেকেছে নিশ্চেষ্ট, নির্বিরোধ। মৃগাঙ্কর শরীরে সে কোনো তরঙ্গ পাঠাতে পারেনি। আসলে মৃগাঙ্ক কখনো তাকে সেভাবে ছোঁয়নি, যেভাবে এখন সে সন্দীপনকে ছুঁল। বৈখরী ভাষার বৃত্তের বাইরে কোনো কথোপকথন হয়নি কখনো অন্য কারো সাথে। এতদিনের এত কথা, এত ব্যবচ্ছেদে কথোপকথনের মানে স্পষ্ট হয়নি। ভালবাসা হয়ে ওঠেনি এর আগে।
বহুদিনের দুর্বহ ব্যর্থতার শেষে একটি স্পর্শময় হাতকে আশ্রয় করে সন্দীপন প্রবেশ করে জাহ্নবীর শরীরে। হাসির মতো, কান্নার মতো, কথার মতো, প্রেমের মতো সে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। নিজের সর্বাঙ্গে সন্দীপনকে নিয়ে জাহ্নবী পা রাখে কোলকাতার সন্ধ্যায়। অফিস ফেরতা দ্রুতগামী শহর বুঝতে পারে না, মৃতের দেহ থেকে মানুষ চুরি করে পালাচ্ছে এক মেয়ে ডাক্তার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন