পলাশ কুমার পাল - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

পলাশ কুমার পাল

      শান্তিনিকেতন থেকে বিহারে

                                                                                          

ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছে বাইরে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ চোখ এই দৃশ্য দেখতে দেখতে  ফিরে যাচ্ছে অতীতে বৃষ্টিভেজা মনে জীবন্ত হচ্ছে শান্তিনিকেতন এক বছর শান্তিনিকেতনে কাটানো প্রতিটা মূহূর্ত জীবনের স্মরণীয় প্রাপ্তি সেই স্মরণীয় মূহূর্তগুলোর টুকরো টুকরো ছবির মধ্যে একটা হল শান্তিনিকেতন থেকে সুদূরে বিহারের পাওয়াপুরী, রাজগীর, নালন্দা, বুদ্ধগয়া ভ্রমণ সঙ্গে ছিল শান্তিনিকেতনের বনিয়াদ কলেজের শিক্ষক দাদা-দিদি এবং আমার সহপাঠী দাদা-দিদি-বন্ধুরা ভ্রমণটি ছিল শিক্ষামূলক ভ্রমণ আবদ্ধ সংসারের বর্হিভাগে বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্য্যের উপলব্ধি যে মনের মুক্তি হৃদয়ের বিস্তার ঘটায়, শান্তিনিকেতনে সেই উপলব্ধি আর একটো সম্প্রসারিত করতে আমরা প্রায় নব্বই জনের একটি দল বেড়িয়ে পরেছিলাম বিহারের সুপরিচিত তীর্থকেন্দ্রগুলো ভ্রমণে বাদ্য ঝংকারের সঙ্গে কণ্ঠ কাঁপানো থেকে বিরত থেকে খালি গলায় গেয়ে ওঠা গানের মতোই আলো বাতাসে শান্তি শীতল হয়ে উঠতে শুরু করলাম যাত্রা
https://scontent-fra3-1.xx.fbcdn.net/hphotos-xaf1/v/t1.0-9/10338687_522887571188225_1709426159920833285_n.jpg?oh=4a516f02a5cfb6fac652eccfcafc8e61&oe=5616B2C1
শান্তিনিকেতনের সৃজনীতে দেখছিলাম বিহারের মানুষের সংস্কৃতি আর এই স্থান থেকে দুটি বাসে করে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ২২শে নভেম্বর,২০১২ খ্রীষ্টাব্দে দুপুর ২টায় রওনা দিলাম সূর্য তখন মধ্যাহ্নের ঘর ছেড়ে পশ্চিমের পথে ধাবমান সকলের কোলাহল হাস্যমুখর ধ্বনিতে বাসের ভিতর আনন্দের হাট বসে গেল কেউ গান গায়, কেউ গল্প করেআবার কেউ পথ পানে চেয়ে কল্পনার পাখনায় রঙ লাগায় যদিও বাদলের দিন নয়, তবু রুদ্ধ কণ্ঠ মানসমঞ্চে আবৃত্তি করে--
"হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচেরে"
এর আর এক কারণ এও হতে পারে যে সঙ্গে ছিল এক মনের রঙ কলেজের এক বান্ধবীকে মনে মনে ভালো লাগতে শুরু করেছিল সেই পূর্বি মনের খবর কতটা জানতে পেরেছিল জানি না তবে সেই পূর্বির চাপে পরে ভ্রমণে বেড়তে হয়েছিল বাস এগোতে লাগল ক্রমে ক্রমে অরুণালোকও নিদ্রায় ঢলে পরছে সন্ধ্যার বিছানায় আর সেই গোধূলি লগ্নে টু-সিটে একা জানলার পাশে বসে চঞ্চল মন ঠিক সন্ধ্যার আগের মূহূর্তে বাস থামল ঘাঘর বুড়ী চণ্ডী মন্দিরের সম্মুখে সকলে নেমে দীপালোকে সজ্জিত সেই মন্দির বিগ্রহ পরিদর্শন করে গাড়িতে উঠলাম আমাদের বাসের দায়িত্বে ছিলেন সায়ন্তনী দিদি, যিনি ভালোবাসা শাসনে আমার মনকে আকর্ষণ করেন তবে আমাদের কলেজের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা মৌ-দিকে আমাদের বাসে পাইনি এই আফশোস রয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যা ৭টার সময় আমাদের বাস চিরকুণ্ডায় একটি পেট্রোল পাম্পের কাছে দাঁড়াল এবং সেইখানেই রাত্রিকালীন আহার করা হয় এই রাত্রিকালীন বনভোজনের মধুর স্মৃতি আজও জীবন্ত সকলে মিলে সেখানে নৃত্য গানে অংশগ্রহণ করা একে অপরের মনের বাঁধন ছেঁড়া এভাবেই কিছু সময় আনন্দের স্রোতে বহে গেল রাত্রি ১১টার সময় আমাদের গাড়ি আবারও রওনা দিল গন্তব্যের অভিমুখে সকলে উদর তৃপ্তির পর নিদ্রায় ঢলে পরল আমার চোখে ঘুম আসে না আমি একা একটি সিটে বসে, পাশেই থ্রি-সিটের ধারে বসে থাকা পূর্বিকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখি কি অপরূপ মাধুর্য ঘুমন্ত মুখে, ঘুমন্ত চোখে হৃদয় শিরশিরিয়ে ওঠে বিষন্ন চোখে বাসের জানলা দিয়ে রাত্রি দেখি এবং মনের খাতায় আঁচড় কাটি কবির ভাষায়--
"আকাশের পানে চাই সেই সুরে গান গাই
একেলা বসিয়া
একে একে সুরগুলি অনন্তে হারায়ে যায়
আঁধারে পশিয়া"
তবু এলো না ঘুমপরী ঘুম পাড়াতে, এলো না কোনো স্বপ্নচারিণী কেবল সে রজনী জাগিয়ে রাখল এই বাঁশিটিকে--
"আমার চোখে ঘুম ছিল না গভীর রাতে
চেয়েছিলাম চেয়ে থাকা তারার সাথে
এমনি গেল সারারাতি, পাইনি আমার জাগায় সাথি-
বাঁশিটিরে জাগিয়ে গেলাম গানে গানে"
রাতের আলস্য কাটিয়ে ২৩শে নভেম্বর,২০১২ সকাল ৬টার সময় জগদম্ভা ধাবা হয়ে বাস এসে পৌঁছাল পাওয়াপুরীতে ইতিহাস সংস্কৃতি সমৃদ্ধ বিহারের পাওয়াপুরী জৈনদের পবিত্র স্থান এই স্থান শেষ তীর্থঙ্কর এবং জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা প্রভু মহাবীর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৫০২ খ্রী: পূর্বাব্দে এই মহান মানুষটির শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার পর অসংখ্য মানুষ এই শেষকৃত্য চিতার ছাই গ্রহণ করে নিয়ে যায় এইভাবে এই স্থানটি জলাধারে পরিণত হয় আর এই জলাধারের মাঝে মার্বেল পাথর দিয়ে 'জলমন্দির' নির্মিত হয় আমরা সকলে গাড়ি থেকে নেমে এই 'জলমন্দির' পরিদর্শনে যাই চারিপাশে জলদ্বারা বেষ্টিত মন্দির অপরূপ শোভা বর্ধন করেছিল অনেকেই সেখানে R¢h তুলল                                     
 আমিও মৌ'দির সঙ্গে ছবি তুলেছিলাম এই ছবি আর আমার সংগ্রহে নেই কিন্তু মূহূর্তটা আজও ভুলতে পারি না দিদির সঙ্গে ছবি তোলাটা ছিল আমার স্মরণীয় মূহূর্ত এই দিদির কাছেই মানবতার অনেক শিক্ষা পেয়েছি তাই উনি আমার প্রিয় ছিলেন পাশে দিদি মন্দিরের পবিত্রতা মনকে পবিত্র করে দিয়েছিল নবসূর্যে স্নাত সেই শীতের সকালে মন্দির দর্শনে মন পুলকিত হয়ে উঠল যেন সংসার জগতের বহির্ভাগের দৃশ্য মনের সমস্ত জড়তার ঘুম ভাঙিয়ে দিল--
"আজি প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পরে
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান
না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ"
এই জাগ্রত প্রাণে পাওয়াপুরীর কাছে 'সামোশরণ মন্দির' দর্শন করে আমাদের গাড়ি রাজগীরে রাজলক্ষ্মী হোটেলে পৌঁছাল
রাজগীর হোটলে স্নান আহার করে ভ্রমণ পিপাসায় টাঙ্গায় করে রাজগীর দর্শনে বেড়লাম আমার টাঙ্গার সঙ্গী ছিল প্রসেনজিত্‍, চন্দ্রশেখর, উজ্জ্বল প্রিয়াঙ্কা এই রাজগীর দর্শনে বেড়িয়ে আমরা এক একটি টাঙ্গায় বিভিন্ন গ্রহের মতোই বিভক্ত হয়ে পরি বিভিন্ন দলে তবে যাইহোক ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চাপার প্রথম অভিজ্ঞতা ¢Rm
 খুবই মন মুগ্ধকর এখানে বলে রাখা ভালো টাঙ্গা চালকদের সংগ্রামী জীবন মনের কোণায়  দাগ কেটেছিল
টাঙ্গায় চরে প্রথমে মনিয়ার মঠে গেলাম এটি ছিল প্রাচীন মনসা মন্দির প্রথমে উঁচু বেদিতে চড়ে সিঁড়ি ভেঙে নীচে মন্দিরের মূর্তি দর্শন করলাম টিন দিয়ে ছাউয়া এই মন্দিরে সকলে মিলিত হই সেখান থেকে আমরা হেঁটে স্বর্ণভাণ্ডার বা সোনে গিয়েছিলাম লোকশ্রুতি অনুযায়ী এই স্বর্ণভাণ্ডার ছিল রাজা বিম্বিসারের কোষাগার বিশাল পাহাড়ের রাঙা পাথুরে শরীর কেটে তৈরী দুটি কক্ষ এই কক্ষ চিরউন্মুক্ত থাকলেও কোষাগার উন্মুক্ত করার গোপন সূত্র কারোর জানা ছিল না এই চিরউন্মুক্ত স্বর্ণভাণ্ডারের কোষাগার উন্মুক্ত করতে ব্রিটিশরা কামান দাগে কিন্তু ব্যর্থ হয় এর রহস্য আজও উন্মোচন হয়নি সেখানে দেখলাম কিছু বানর বাঁদরামি করছে
এরপর পিতা বিম্বিসারকে বন্দী করার জন্য অজাতশত্রু নির্মিত বিম্বিসারের কারাগার দর্শন করতে করতে রত্নগিরির দিকে টাঙ্গা এগিয়ে যেতে লাগল এক কোমর সমান উঁচু পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা কারাগার দেখতে দেখতে চোখে পরল অন্য একটি টাঙ্গায় শর্মিলা'দি হাসছেন ওনাদের টাঙ্গা আমাদের টাঙ্গাটিকে অতিক্রম করেছে বলে দিদির খুশি টাঙ্গা চালকেরা একে অপরকে অতিক্রম করছিল বারবার আমাদেরও মজা হচ্ছিল খুব এইভাবে টাঙ্গাগুলো গৃধ্রকূট পাহাড়ের কাছে এসে থামল সবাই সেখান থেকে রোপওয়েতে রত্নগিরির চূড়ায় উঠল বিশ্বশান্তি স্তুপ পরিদর্শন করতে তবে হাঁটা পথেও উপরে ওঠা যায় আর্য আর অভিষেক'দা হেঁটে সেই পর্বতে ওঠে আমি নার্ভের সমস্যার কারণে উপরে উঠিনি কারণ উচ্চতা রক্ত এই দুইয়েতে আমার ভয় আমি দূর থেকে কেবল পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইলাম আর মনে মনে আওড়ালাম-
"পর্বতমালা আকাশের পানে
চাহিয়া না কহে কথা--
অগমের লাগি ওরা ধরণীর
স্তম্ভিত ব্যাকুলতা"
  
চারপাশ শুধু পাহাড় আর পাহাড় বিপুলগিরি, রত্নগিরি, বৈভবগিরি, শোনগিরি উদয়গিরি নিয়ে এই পঞ্চগিরির দেশ এটি বন্ধুরা নেমে এলে টাঙ্গায় চাপলাম জীবক উদ্যান থেকে টাঙ্গা চালক ঘোড়ার চোখের ঠুলি খুলে দিয়ে টাঙ্গা চালাতে লাগল আর এই টাঙ্গাতে বসেই শুনলাম বিশ্বশান্তি স্তুপের গল্প ভগবান বুদ্ধের ২৫০০বছর পূর্তি উপলক্ষে এই চূড়া নির্মাণ করা হয় এই বিশ্বশান্তি স্তুপের ডোমের ব্যাস ৭২ফুট উচ্চতা ১২৫ফুট প্রায় আর এই পাহাড় থেকে দেখা যায় দেবদত্ত দ্বারা বুদ্ধের প্রতি নিক্ষিপ্ত পাথর পাথরটি আজও পাহাড়ের গায়ে ঝুলছে

এখান থেকে পরে গন্তব্য সপ্তপর্ণী গুহা স্বল্প দৈর্ঘ্যের গুহার ভিতর বুদ্ধমূর্তি দেখলাম তারপর একটি উষ্ণ প্রস্রবন দেখে বেণুবন বিহারে গেলাম এই বেণুবন বিহারটি রাজা বিম্বিসার প্রভু বুদ্ধকে দান করেন বেণুবনের ভিতর দিয়ে জাপানী মন্দিরে গেলাম, যেখানে অপূর্ব এক শান্তির বাতাবরণ জড়িয়ে ছিল সেখানে একটি প্রস্তর ফলকে খোদাই করা 'MA MU MYO HO REM GE KYO'-এর অর্থ আজও অনুধাবন করতে পারিনি বেণুবনে মত্স্য কন্যাদের ক্রিয়াকলাপ জাপানী মন্দিরের শান্তি পেছনে ফেলে রেখে বীরায়তন, যাদুঘর, দিগম্বর মন্দির, নাওলাখা মন্দির, মকদুম কু, বার্মিজ বৌদ্ধ মন্দির পরিদর্শন করলাম সব স্থানের দৃশ্য প্রসেনজিত্ চন্দ্রশেখর ক্যামেরা বন্দী করেছিল বিশ্বের এই আংশিক বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য্য মনের কোঠায় ভরে নিয়ে হোটেল ফিরলাম এবং মাছ সহযোগে ভাত খেলাম তখন রবি ঘুমন্ত প্রায় বিশ্রামের খোঁজে সকলেই শশব্যস্ত ছিল শরীরে ক্লান্তিতে আমিও কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম হঠাত্পূর্বির ডাকে সন্ধ্যায় রাজগীরে কিছু কেনাকাটি করতে বেড়লাম সঙ্গে ছিল পূর্বি,কাবেরী, আর্য, ঈশানী দুই দাদা ওখানে প্রস্তর পাত্র, কাগজ পাতায় তৈরী ক্ষুদ্র চিত্র, এবং পাথর পুঁথির গহনা বিখ্যাত আমরা যে যার সামর্থ্য মতো কেনাকাটি করলাম এছাড়া ওখানের বিখ্যাত 'তিলকুট' মিষ্টিও খেয়েছিলাম রাতে ফিরে আহারে বসে মটন দেখে সাহিত্যপ্রেমী মনে ঈশ্বরগুপ্তের কবিতাটি ভাসল--
"এত গুণ ধরিয়াছ পাতা ঘাস খেয়ে
না জানি কি হত আরো ঘৃত ক্ষীর খেলে"
আহার শেষে ঘুম ঘুমবার সময় মনে বিহারের রাজগীর পাওয়াপুরীর দৃশ্যগুলো চোখে ভাসছিল ভাসছিল সেখানকার মানুষের জীবন চিত্র মনে মনে ভাবছিলাম এই যে ভ্রমণ কেবল মনের রসভাণ্ডারকে পূর্ণ করে না, পাশাপাশি জ্ঞানের মৌচাকে মধুও পূর্ণ করে ভিন্ন ভৌগলিক পরিবেশ, তার আচার, পোষাক, খাদ্য সম্পর্কে পরিচিত হওয়ার সাথে সাথে দুই পরিবেশের মানুষের মন একসূত্রে মিলিত হয়

ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন পুলকিত মনে ঘুম ভাঙল ঘুম ভাঙার পর মৌ'দির সুপ্রভাত বলে মিষ্টি ডাক ছিল একটি অন্যতম মূহূর্ত যাইহোক গতকালের ভ্রমণ ঔত্সুক মন সেদিন আরও তীব্র হয় উঠেছিল কারণ এবার আমাদের গন্তব্য নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সেই উন্মনা মনকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে পেটকে কচুরী আলুর দমে তৃপ্ত করি এরপর বাসে উঠলাম বাসে ওঠার আগে পূর্বির সঙ্গে একটি ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষুদ্র কথা বিনিময় কথার ফাঁকে গোলাপী রঙের জ্যাকেট পরিহিত পূর্বির ঘোড়াকে আদর করার স্মৃতি এখনো প্রাণবন্ত শৈশব প্রেমকে জাগাতে পারিনি কখনো কিন্তু অলীক কল্পনার হাল ছাড়িনি
    https://scontent-fra3-1.xx.fbcdn.net/hphotos-xfa1/v/t1.0-9/10672063_522920841184898_8947099204717371826_n.jpg?oh=26f09dc363a70e23c87886ef68233274&oe=561EAC59
আমাদের বাস নালন্দা পৌঁছাবার পর প্রথমে টিকিট কেটে নালন্দা যাদুঘর দেখলাম নানান মাটির পাত্র, খাদ্য সামগ্রীর নমুনা, কিসিমের মূর্তির সংগ্রহশালা এটা এখান থেকে আমরা সকলে গাইডসহ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংস স্তুপ পরিদর্শনে করলাম নালন্দা  সম্বন্ধে জানলাম গৌতমের প্রধান শিষ্য সারিপুত্তের জন্মস্থানে পৃথিবীর প্রথম  বিশ্ববিদ্যালয়টা অবস্থিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ও আজ পৃথিবীর অন্যান্য বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম আর সেখানের স্পর্শ নিয়ে এই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্পর্শে আসা জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওনা সারিপুত্তর স্তুপ ছিল এই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক সেখানে ওঠার সিঁড়ি থাকলেও উপরে ওঠা নিষিদ্ধ ছিল আর এর পাশেই লাল ইঁটে নির্মিত মহাবিহারের ধ্বংস স্তুপ পরে আছে, যেখানে এক সময় দেশ বিদেশের প্রায় দুই হাজার শিক্ষক দশ হাজার ছাত্র ছিল তবে এই সংখ্যা বিষয়ে মতবিরোধ আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল আবাসিক এখানে ৪টি পাঠ চত্বর, ১০টি মন্দির, ধ্যানকক্ষ, শ্রেণীকক্ষ, আবাসিক হল, পাঠাগার, দীঘি এবং উদ্যান ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে  ধর্ম, দর্শন, ভাষা, বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষালাভ করত হিউয়েন সাঙ প্রায় ৫দছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন সারিপুত্তর স্তুপের কাছে ঘাসের মাঠে আমরা সকলে দলবদ্ধ ছবি তুলেছিলাম
https://scontent-fra3-1.xx.fbcdn.net/hphotos-xap1/v/l/t1.0-9/10616452_522944271182555_4147022574566586970_n.jpg?oh=ce885efbb24bb8e67eb88e90aba8c9f9&oe=56306A16    https://scontent-fra3-1.xx.fbcdn.net/hphotos-xft1/v/t1.0-9/10636044_522943687849280_7262868626183075250_n.jpg?oh=6045aac8dca31f752c860758d792b402&oe=5619E6D6
 তারপর বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে স্থান ঘুরছিলাম মিলয়াতনের ছাদে উঠে নীচের তলায় রান্নাঘর, শৌচাগার কক্ষ দেখে পাঠাগারের নিকটে এলাম, যেটি বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণে ভস্মীভূত হয়ছিল ধ্বংস হলেও অতীত মানবের ইতিহাস আজ যুগান্তর পরও মানুষের মুখে গীত হচ্ছে অদ্ভুদ অনুভূতি হল সেখানে যুগান্তর পর নয়, আমরা সেই মূহূর্তে হোটেল ফিরে খাওয়া দাওয়া করে বুদ্ধগয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম

দুপুর ২টার সময় গাড়ি ছাড়ল গাড়ি ছাড়ার আগের মূহূর্তে পূর্বির সিট রাখা নিয়ে তিন দাদার সঙ্গে বিবাদ হয়েছিল ওরা পূর্বিকে পূর্বির রাখা সিটে বসতে দিচ্ছিল না  এই বিবাদের কারণে নিজেরও মন খারাপ হয়েছিল তবে ঘটনাটা সহজে মিটিয়ে নিই শেষে গাড়ি ছুটে চলল বুদ্ধগয়ার দিকে প্রায় আড়াই ঘণ্টার পথ পথধারে বিহারকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম বিহারের ভূমি অনেকটা বরেন্দ্র ভূমির মতো আর পথের পাশে গোয়াল ঘর, খোয়াড়, উঠান, সেখানকার চাষভাষ আমাকে এক অনন্য উপলব্ধি দিয়েছিল শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় সরু রাস্তা মাঝে মাঝেই গাড়ির গতি রুদ্ধ করছিল রাস্তায় ধর্মষাঁড়ের বিচরণ পুরীর মন্দিরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল ফলে পথেই দিনান্তের অবসান প্রায় সৃষ্টির রহস্যে--
"আলো যবে ভালোবেসে
মালা দেয় আঁধারের গলে
সৃষ্টি তারেই বলে"
প্রহর ক্রমশ শেষের দিকে হলেও বিশ্বভুবন তো শেষ নয়, শেষ হয়নি বিহার ভ্রমণ--
"মধুর তোমার শেষ যে না পাই, প্রহর হল শেষ"
বুদ্ধগয়া দর্শনের জন্য মন আকুল হয়েছিল
বুদ্ধগয়া পৌঁছাবার আগের মূহূর্তে দেখলাম ফল্গুনদী, যার বাইরে জল দেখা যায় না প্রায় সন্ধ্যায় বুদ্ধগয়া পৌঁছে অটোতে করে মন্দির দর্শনে গেলাম যদিও তখন অনেক মন্দির বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অটোয় আমার সঙ্গী ছিল পূর্বি, কৃষ্ণা, শুভজিত্‍, আর্য, চিরঞ্জিত্ প্রথমে জাপানী মন্দিরের শান্ত পরিবেশ নির্জনতার পাশাপাশি পবিত্র বুদ্ধ মূর্তিও আমাকে মোহিত করেছিল প্রণাম করে নেমে আসার সময় সেই মনোরম পরিবেশে খনিকের পূর্বির চোখাচুখি হৃদয়ের নির্জনতা ভঙ্গ করেছিল স্বপ্নঘন এক আনন্দময় মূহূর্ত ভালোবাসা  যেন রংধনু হয়ে উঠেছিল নীরবে মনের সাতরঙ নিয়ে তিব্বত মন্দির, চীনা মন্দির, থাই মন্দির ঘুরলাম থাই মন্দিরে বুদ্ধের মূর্তিটা আমার খুব ভালো লেগেছিল প্রতিটা মন্দিরের পরিবেশ মনে প্রশান্তি ঢেলে দিয়েছিল গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দূর থেকে দেখেছিলাম দাইজুকিয়ু মন্দিরের বিশাল বুদ্ধের মূর্তি, যার স্থাপত্য কীর্তি চোখ জুড়ানো
সবঘুরে শেষে পৌঁছেছিলাম মহাবোধি মন্দিরে
   সন্ধ্যাকালীন মূহূর্তে কৃত্রিম আলোয় মন্দিরের অপরূপ শোভা পবিত্রতার বাণী রচনা করেছিল কিছুক্ষণ আমি স্থির হয় যাই এই মুগ্ধতায় যে এর কারুকার্য ছিল অসাধারণ মোবাইল নিষেধ থাকায় মোবাইল রেখে মন্দিরে প্রবেশ করে বুদ্ধ মূর্তি দর্শন করি মহাবোধি মন্দিরের পাশে পাথরে খোদাই করা বুদ্ধের পদচিহ্ন নজরে এল এছাড়া দেখলাম ভিন্ন প্রদেশ ভিন্ন দেশ থেকে আসা তীর্থযাত্রীরা হাতে শাপলা ফুল নিয়ে ঘুরছে কারোর পরনে গেরুয়া চীবর বৌদ্ধদের পবিত্র ফুল পদ্মের পরিবর্তে এই ফুল হাতে এই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ঘুরে বেড়াচ্ছিল মূর্তি পরিদর্শনের পর মন্দিরের পেছনে পত্রপল্লবে বিস্তৃত বোধিবৃক্ষের কাছে গিয়ে দেখলাম বুদ্ধের সাধনার বজ্রাসন সেখানে দল বেঁধে বৌদ্ধরা প্রার্থনা করছে আর পাঠ হচ্ছে ত্রিপিটক যদিও সেই ভাষা বুঝতে পারিনি, তবু এক অজানা বোধশক্তি হৃদয়কে বিস্তৃত করেছিল কিছুটা মনের চেতনা নদী পাড় হয়ে মনুষ্যত্বের গহন মন্দির যেন প্রকাশ্য হয়েছিল নিজের কাছেই এই মন্দিরের পাশেই দেখলাম একটি ঐতিহাসিক স্থান, যেখানে বুদ্ধের মাথা থেকে ছয়টি রঙ ঠিকরেছিল সবটাই অবশ্য লোকশ্রুত এরপর মন্দিরের দক্ষিণে মুচালিকা লেকে গেলাম একটা বাঁধানো পুকুরের মাঝে জলের উপর সর্পফণার নীচে ধ্যানস্থ বুদ্ধের মূর্তি এবং জলে মাগুরে মাছের ক্রিয়াকলাপ লোকশ্রুত যে ভয়ঙ্কর সর্পরাজা মুচালিকা ধ্যান মগ্ন বুদ্ধকে ফণার ছায়া দিয়ে বৃষ্টি বাতাস থেকে রক্ষা করেছিল সেই লেকে কিছুক্ষণ কাটিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলাম আজও সেই লেকে মাছেদের ক্রিয়াকলাপ দর্শনার্থীদের খাবার ছুঁড়ে দেওয়ার দৃশ্য মনে পরে মন্দির থেকে বেড়বার মূহূর্তে দেখলাম কিছু ছেলে একটি অশোকস্তম্ভে পয়সা ছুঁড়ছে কেন তা জানতে পারিনি মন্দির চত্বরের বাইরে এসে পূর্বির সঙ্গে দেখা অনেকবার আমাকে ডাকে কিছু কেনাকাটিতে সাহায্য করে দেওয়ার জন্য আমি যাইনি কারণ দুপুরে দাদাদের কটু কথা মনে বিঁধেছিল অভিমান হয়েছিল পূর্বির উপর কেন সে বিবাদের সময় নিরুত্তর ছিল! তবে আর্য অভিষেক'দার সঙ্গে ঘোরার সময় দেখলাম একটি হার পছন্দ করছে চোখাচুখি হতে ওর মুখের ভাবটা পাল্টে গিয়েছিল মনে হল আমি ওকে আঘাত দিলাম না তো? বোধি মন্দিরের সামনে হালকা আলোয় সেই মুখচ্ছবি ভোলার নয় আমার বোধে যেন সেও একটা বোধি আর দাঁড়ালাম না ঐখান থেকে চলে এলাম একটি ধর্মশালায় বসে রাতের আহার শেষ করে বাসে উঠলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে তখন কানে বাজছে "বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি..." ধ্বনি

ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এই উল্লেখযোগ্য তীর্থকেন্দ্র ত্যাগ করার সময় মন বিষন্ন হল সবার 'যেতে নাহি দেব' বলে কোনো অদৃশ্য পেছুটান দেয় তবু ফিরতে হবে নিয়মে ফিরে আসার সময় সেই তীর্থকেন্দ্রগুলো, সেখানকার মানুষজন, তাদের সাংস্কৃতিগুলো মনের অন্দরে জাবর কাটতে কাটতে বিনিদ্রভাবে শান্তিনিকেতনে পা রাখলাম অসীমের বার্তা একচিলতে প্রেমে প্রাণকে সিঞ্চিত করলেও ফিরতে হয়েছিল আবার সীমার মাঝে তবু সেদিনের স্মৃতি আজও জীবন্ত এই বৃষ্টির দিনে শান্তিনিকেতনের সাথে স্মৃতি-বিহারে সেই শীতের দিনে বিহারের ছবি হাত ধরে হাঁটে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র