সম্বুদ্ধ সান্যাল - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

সম্বুদ্ধ সান্যাল

ইয়োকসম






সিকিমের রাজধানীর নাম কি? বললেই তো সবাই হাঁ হাঁ করে চেঁচিয়ে উঠবে গ্যাংটক বলে। তারপর ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে পুজোতে সেখানে যাওয়ার জন্যে আব্দারও ধরতে পারো বাড়িতে। কিন্তু এই গ্যাংটক কিন্তু সিকিমের প্রথম রাজধানী নয়। সিকিম ওইটুকু রাজ্য হলে হবে কি, বৌদ্ধ ধর্মে তার তেজ কিন্তু ধানী লঙ্কার সমান। এমনিতে মাপের দিক থেকে হিসেব করলে তা ভারতের সবচেয়ে ছোট রাজ্য গোয়ার থেকে খানিকটাক বড় ঠিকই, কিন্তু এত শান্ত পাহাড়ী পরিবেশ কিন্তু পৃথিবীতে খুবই কম রয়েছে। এমনিতেই বৌদ্ধ বললে চোখের সামনে ভেসে ওঠে গেরুয়া পড়া মিষ্টি মিষ্টি শান্তস্নিগ্ধ হাসিমুখ। সুতরাং তাদের তো এমনধারা শান্ত জায়গা পছন্দ হবে তা কি আর বলে দিতে হয়? জাঁকিয়ে বসে আরামসে শান্তিচর্চা করতে তারা বেশ বেছে নিয়েছিলো সিকিমকে। সিকিমের ইতিহাসটিও নেহাত ছোট নয়। ভারতীয়, তিব্বতি আর চৈনিক সংস্কৃতি সেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সবার জানা রেশমপথ বা সিল্করুটের বেশ খানিকটা পড়ে সেখানে। সেখানে এই তিন দেশের মানুষ ব্যাবসা ফেঁদে বেশ দুপয়সা কামিয়েছে অনেকদিন ধরে।







সে সব অন্য কথা। কথা হচ্ছিলো সিকিমের রাজধানী নিয়ে। রাজধানী মানে রাজাগজারা যেখানে থাকে। এখন তারা গ্যাংটকে থাকলেও তাদের পূর্বপুরুষরা থাকতো অন্য জায়গায়। সুতরাং সেটাই তাদের রাজধানী ছিলো তখন, এখন আর নেই। জায়গাটির নাম ছিলো ‘ইয়োকসম’, শব্দটি তিব্বতি। কথাটির মানে হল তিনজন ভারী জ্ঞানী ব্যাক্তি বসে যেখানে আলাপ আলোচনা করে। এখন তারা কি আলোচনা করেছিলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সে কথায় এখন যাচ্ছিনা। শুধু বলে রাখি সিকিমের প্রথম রাজা কে হবে তা নিয়ে তিনজন তিব্বতি বিজ্ঞ পাহাড়ের মধ্যে এক সুন্দর মনোরম পরিবেশে আলাপ আলোচনা করে ‘চোগেল’ বা রাজা ঠিক করেন। সে ১৬৪২ সালের ঘটনা। এরকম প্রথম রাজার নাম ছিলো ‘ফুনসোক নামগেল’ (ফুনসোক ওয়াংরু নয়, সে আলাদা লোক)। আর যে জায়গায় বসে এই তিন পন্ডিতের মধ্যে এই আলোচনা হয়, সেই জায়গার নাম হয় ‘ইয়োকসম’। আর ‘চোগেল’এর অর্থ হল ‘যে রাজা ধর্মকে রক্ষা করে’ বা ‘রিলিজিয়াস কিং’। এনারা প্রায় ৩৩৩ বছর রাজত্ব করে রাজপাট ভারত সরকারের হাতে সঁপে দিয়ে এখন নিশ্চিন্তে গ্যাংটকে বসবাস করেন। তবে সিকিমের লোকেরা এখনও তাদের খুব মান্যিগন্যি করে।
ইয়োকসমকে রাজধানী হিসাবে চিহ্নিত করার পর সেখানে মস্ত জনপদ গড়ে ওঠে। মস্ত বললাম বটে, কিন্তু আমাদের পশ্চিমবঙ্গের শহরবাসীদের কাছে সেটা নিমিত্ত একটা পাহাড়ী গ্রাম ছাড়া আর কিছুই নয়। আর গ্রাম হলে হবে কি? কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে যদি যেতে চাও, তবে ইয়োকসমে একদিন কাটাতেই হবে মানসিক স্থিরতা বজায় রাখতে। এছাড়া এখানে জোংরী, গোয়েচা-লা, সমিতি লেক, কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্ক প্রভৃতি জায়গাতেও যাওয়া যায়।
তো ফুনসোক নামগেল তো ধর্মীয় রাজা হিসাবে স্বীকৃতি পেল, কিন্তু ধর্মকর্ম করতে গেলে তো নিদেনপক্ষে একটা প্রতিষ্ঠান লাগে। তাই নামগেল রাজার আদেশে সেখানে তৈরী হতে লাগলো বৌদ্ধশিক্ষা সংস্থা বা মনেষ্ট্রি বা গুম্ফা। মুশকিল হল জনপদের মধ্যে পন্ডিতেরা ধর্মাচারন করতে চাইলেন না। রাজা তখন তাদের একটি পাহাড় দিয়ে দিলেন, যাতে তারা নির্জন শান্তিতে ধর্মগবেষনার কাজ চালাতে পারেন। ১৭০১ সালে সেই পাহাড়ের চূড়ায় তা তৈরীর কাজ সম্পন্ন হল, গড়ে উঠলো ‘দুবদি মনেষ্ট্রি’, তথা সিকিমের প্রথম মনেষ্ট্রি। তিব্বতী বৌদ্ধিক মতে এই গুম্ফার সমস্ত রীতিনীতি পালন করা হয়। জনসাধারনের সুবিধার্থে পরে ইয়োকসমেও একটি গুম্ফা গঠন করা হয়। নাম দেওয়া হয় পেমাংগতসে গুম্ফা বা কাথোক গুম্ফা। কাথোক গুম্ফায় জনসাধারনে শিক্ষালাভ করতে পারতো। দুবদি গুম্ফার পন্ডিতেরা সেখান থেকে নেমে এসে অনেক সহজবোদ্ধ উপায়ে জনসাধারনকে জ্ঞানদান করতেন।







দুবদি গুম্ফা আস্তে আস্তে জ্ঞানচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ন পীঠস্থান হয়ে ওঠে। বহু বড় বড় তিব্বতী লামা এসে এখানে তত্ত্বকথা আলোচনা করে গেছেন। যে তিনজন তিব্বতী পন্ডিত একত্রিত হয়েছিলো ইয়োকসমে, তাদের মধ্যে একজন ‘লাতসুন নামকা জিগমে’ রাজাকে জ্ঞানদানের জন্যে সেখানে থেকে যান এবং দুবদি গুম্ফার প্রতিষ্ঠাতা হিসাবেও তার নাম আমরা পেয়ে থাকি। ‘দুবদি’ কথাটির অর্থ হল ‘নির্বান লাভের স্থান’ বা ‘যেখানে আসলে নির্বান লাভ হয়’। দুবদিকে প্রথম দর্শনেই যে মনের মধ্যে আশ্চর্য শান্তি পাওয়া যায় তা বলাই বাহুল্য।
লামা নামকা জিগমের হাত দিয়েই এই গুম্ফার তৈরীর কাজ শেষ হয় ১৭০১ সালে। বাকী দুইজন লামাও তাকে এই কাজে সাহায্য করেন। গুম্ফাতে নামকা জিগমের ছবিও দেখতে পাওয়া যায়। তবে তিব্বতী আঁকায় লেৎসুনের মূলোর মতো দাঁত বের করা ছবি সত্যিই ভয়ঙ্কর (ক্যামেরা ব্যাবহারে বারন থাকায় ছবি তুলতে পারিনি)। এরপর লেৎসুন দেবাদেশ পান আরো চার জায়গায় এরকম গুম্ফা তৈরী করতে হবে, এবং জায়গাগুলো চিহ্নিত হবে বিখ্যাত জুনিপার গাছ দেখে। দুবদি গুম্ফায় এই জুনিপার গাছটি আজও দেখা যায়। এই চারটি জুনিপার গাছের সমন্বয়কে বলা হয় ‘খারদোকপা চতুষ্কোন’। মজার কথাটি হল লেৎসুন তিনটি জুনিপার গাছ খুঁজে পান সারা জীবনে, চার নম্বরটি তিনি পাননি। অনেক খোঁজার পর তিনি যেখানে দেহ রাখেন সেখানে তৈরী হয় ‘নোরবুগাং শোর্তেন’। পরে দেখা যায় চতুর্থ জুনিপার গাছটি এখানেই বিরাজ করছে। তবে এই তথ্য ইয়োকসমের মানুষের গল্পকথা।
দুবদি গুম্ফার উচ্চতা নেহাৎ কম নয়। সমুদ্রর থেকে প্রায় ৭০০০ ফুট। ইয়োকসমের মানুষের মতে ‘আধ ঘন্টার হাঁটাপথ’, কিন্তু আমাদের মতো সমতলের মানুষের পক্ষে প্রায় দেড়ঘন্টা পেরিয়ে যাবে। ধরো ৯০০ মিটার খাড়া পাহাড়ে উঠতে উঠতে তিন পা যেতে দুবার থামা অবস্থা। ওই খাড়া পাহাড়ে ৩ কিমি যেতে হাঁপ ধরে বসে পড়ার উপক্রম হয়। কিন্তু উপরের লামারা তরতর করে ওঠে আর নামে, আর বসে পড়া আমাদের দেখে সে কি হাসি! কিন্তু এর ভালো গুনটা হল এত কষ্ট করে পঞ্চত্বপ্রাপ্তির আগের মুহূর্তে দুবদিকে দেখে মনে হবে যেন স্বর্গে এসে পড়েছি। তখন কোথায় যায় হাঁপ, সবুজ লনের উপর ইউক্যালিপ্টাস দিয়ে ঘেরা দুবদি যেন সাক্ষাৎ অমরাবতী।
গুম্ফার ভেতরে ও বাইরে আছে নানারকম তিব্বতী আঁকিবুকি, পন্ডিতেরা যাকে শিল্প বলে। তাতে কারোর দঁত বের করা তো কারোর শিং আছে এমনধারা। অনেক তিব্বতী ভাষার মন্ত্রও চোখে পড়ে। তাতে কিসব লেখা বলতে পারবো না, শুধু ‘ওঁ মণিপদ্মে হুম’ মন্ত্রটা চিনেছিলাম। আর তিব্বতী আঁকাগুলো দেখে মনে হতে পারে রাবনরাজার বংশধরদের ছবি, কিন্তু আসলে সেগুলো বুদ্ধদেবে নানা রূপ, তিব্বতী দেবদেবীর ছবি, সন্ত-সন্ন্যাসীরা যারা চিরশান্তি খুঁজে বেড়িয়েছেন ইত্যাদি লোকজনের। সকালের আরতী বাদে সাধারনতঃ মূলগৃহে ঢোকা যায়না। সেখানে ভগবান বুদ্ধ ‘ন্যায়িগমা’ রূপে বিরাজ করেন। তার ছবি তোলা আর হাতে চাঁদ পাওয়া সমান সমান। গুম্ফাগৃহের বাইরে আছে মস্ত এক কাঠের ঘন্টা, আজব তার আকৃতি। শখ করে আবার তার নাম দিয়েছে ‘গেলসেন’। এই ঘন্টা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সময়সারনী সাজিয়ে আসছে গত ৩১১ বছর ধরে। গুম্ফার মুখ ও বিগ্রহের মুখ দক্ষিনমুখী। গুম্ফার মধ্যে সেই তিন জ্ঞানী ব্যাক্তিরও মুর্ত্তিও সাজানো আছে।











গুম্ফাটি দোতলা ও পাথরের তৈরী। হালে ইঁটবালি দিয়ে কিছু ছাত্রাবাস তৈরী হয়েছে। সৌরবিদ্যুৎও ঢুকে গেছে সেখানে। দু-একজন শিক্ষার্থীর হাতে মোবাইল ফোনও দেখতে পাওয়া যাবে যদিও সেখানে কোন নেটওয়ার্ক নেই। নেটওয়ার্ক আসলে ভগবান বুদ্ধের কানেও এই যন্ত্র দেখা যেতে পারে, এতে ছাত্রদের সাথে তিনি সরাসরি যোগাযোগ করে তাদের শিক্ষাদান করতে পারবেন। মন্দিরটি বর্গাকার ও তার ছাদ লোহার তৈরী। গুম্ফাগৃহের পেছনের দিকে আছে ধর্মীয় শিক্ষাদান কেন্দ্র বা মেডিটেশন সেন্টার। তার মধ্যে মাটির তৈরী অসংখ্য উইন্ডবেলের আওয়াজ নিম্ন পিচের সেতারের সুর মনে পড়িয়ে দিয়ে মনোরম এক পরিবেশের সৃষ্টি করে। ছাত্রদের নানারকম বৌদ্ধ মন্ত্র, আদব কায়দা, যোগাসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে শিক্ষাদান করা হয় এখানে।
পাহাড়টিতে চড়তে গেলে বাঁধানো রাস্তার সাথে চোখে পড়ে নানারকম ঝরনা ও বড় বড় গাছের অরণ্য। রাস্তার পাশে খানিকটা অন্তর যাত্রীদের বসার সুব্যাবস্থা আছে। লম্বা লম্বা গাছে দুস্প্রাপ্য অর্কিডও চোখে পড়বে ভাগ্যে থাকলে। চিতাবাঘ ও হায়নাও পাওয়া যায়, কিন্তু তারা কাওকে কোনদিন আক্রমন করেছে বলে শোনা যায়নি। বৌদ্ধ মেডিটেশনে তারাও ভদ্র হয়ে গেছে। যারা এখনও ভদ্র হয়নি তাদের নাম হল ‘জোঁক’। অবশ্য এদের ভদ্র না করার কারনও আছে। বৌদ্ধসংস্কৃতি শিখতে গেলে তাদের সাথে জোঁকের মত লেগে থাকতে হয়। জোঁকই যদি ভদ্র হয়ে যায়, তবে এই প্রমান আর কে দেবে শুনি?













কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র