সৌমিত্র চক্রবর্তী - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

সৌমিত্র চক্রবর্তী

                                           বাঙালির আড্ডা







সেই আগন্তুক মনে পড়ে? সেই সম্বন্ধে মামা অথচ প্রায় অজানা আগন্তুকের আড্ডা সম্পর্কে নানা তথ্য! আরে সত্যজিতের আগন্তুকের কথা বলছি। বাপ্রে! আড্ডা যে এত গুরুগম্ভীর হতে পারে সেটা আগে জানাই ছিল না। সাধে কি আর সক্রেটিস, পিথাগোরাস, আর্কিমিডিসের মতো মাইলস্টোনরা সে দেশে জন্মাতে পেরেছেন সেই সময়ে। অথচ আমাদের দেশে সেই সময়েই কালিদাস এসে গেছেন তাঁর হেঁয়ালির ভাণ্ডার নিয়ে। তারমানে আমাদের দেশে গম্ভীর রসের সঙ্গে হাল্কা ললিত রসেরও রীতিমত কদর ছিল।
তা বেশ, তা থাকুক। ক্লাস টেনের পরে ইতিহাস ছেড়ে এসে এখন আর ওই সাল,তারিখ,মাসের চক্করে ঢোকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও নেই আমার। আর এতবড় সার্কেলে বকর বকর করার ক্ষমতাও জিরো। তাই অগত্যা এই নিজের ঘানির রেডিয়াসেই চরকা কাটি।
বাঙালি! এই জাত টা এক আশ্চর্য স্পিসিস। আমার তো মনে হয় শুধু বাঙালি নিয়ে গবেষণা করেই যে কেউ অনায়াসে পিএইচডি করে তোফা একখানা প্রফেসরের চাকরী বাগিয়ে বাকী জীবন ঘরের ড্রয়িংরুমে লুকিয়ে ট্যুইশন করে আর কলেজে দু এক ঘণ্টার ক্লাস নিয়ে মৌতাতে পায়ের ওপর পা তুলে কাটিয়ে দিতে পারেন।
ধরুন কোনো একটা নির্দিষ্ট প্রদেশের কিম্বা দেশের মানুষের গড়পড়তা স্বভাবের নৈকট্য থাকে। যেমন গুজরাটিরা বা রাজস্থানিরা ব্যবসা প্রবণ। দিল্লীওয়ালা সম্পত্তিপ্রবণ। বিহারীরা অপরাধপ্রবণ। এরকম আর কি। কিন্তু বাঙালিকে আপনি কোন ক্যাটাগরিতে ফেলবেন? সাধারণভাবে ভারতের অন্য প্রদেশের মানুষ মনে করেন বাঙালি সংস্কৃতিপ্রবণ। কিন্তু নিজে একজন বাঙালি হয়ে একথা সত্যিই বলা যায় কি?
ভারতের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরে আর বলা যাবে না যে টাকা পয়সার ব্যাপারে আমরা এক্কেরে উদাসীন। যে কোনো দিন কলকাতায় শেয়ার মার্কেটে গেলেই বোঝা যাবে সেখানে ভিন প্রদেশের মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে বাঙালি ব্রোকাররা লড়ে যাচ্ছে গলা ফাটিয়ে। যদিও কলকাতার প্রায় ষাট ভাগ অবাঙালিরা দখল করে ফেলেছে, তবুও ব্যবসা বাণিজ্যের জগতে বেশ কিছু বাঙালি দাপটে রাজত্ব করে যাচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে ব্যবসা ছাড়াও যে কোনো সাবজেক্ট বাঙালির সামনে জাস্ট ফেলে দেওয়ার ওয়াস্তা। হেন বিষয় নেই যেখানে তার অবাধ যাতায়াত।
তা এ হেন পূর্বপ্রাদেশিক জাতির সবচেয়ে দিলচসপি সাবজেক্ট হলো আড্ডা। একটু সুযোগ পেলেই হলো, ব্যস বাঙালি বসে পড়বে আড্ডায়। সে গোমড়া মুখো কর্পোরেট কর্তাই হোন বা ট্রেনের দিন আনা দিন খাওয়া হকারই হোন, এ ব্যাপারে সব্বাই দড়। দুজন বাঙালি এক জায়গায় জমায়েত হলেই শুরু হয় আড্ডা, পাঁচজন হলে পত্রিকা প্রকাশ করে আর দশজন একত্র হলেই সেখানে শুরু হয়ে যায় দুর্গাপুজো। সেটা উত্তরমেরু হোক কিম্বা থর মরুভূমি।
আড্ডার বিষয়! ঐ যে বল্লুম, তার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। আমরা সব জানার বাইরেও আরোও বেশি কিছু জানি। যারা মোটামুটি টিভি দেখেন, খবরের কাগজ পড়েন তারা ওবামার কথা জানেন। কিন্তু আমরা ওবামার বউ কি কালারের প্যান্টি আর ব্রেসিয়ার পড়ে তাও জানি। মোদির বউ কেন আলাদা থাকে, হুসেনের আঁকা সরস্বতী আসলে কে, আমেরিকার লুকানো পরমাণু বিস্ফোরণের ধাক্কায় নেপালের ভূমিকম্প হলো, পৃথিবীর ধ্বংস হতে ঠিক ঠিক কত বছর, কত মাস, কত ঘন্টা, কত মিনিট মায় সেকেন্ড শুদ্ধু জানি আমরা। রাজনীতির কথা ছেড়েই দিলাম, কারণ অন্তত একবার রাজনীতি নিয়ে বিশেষজ্ঞের মন্তব্য ঝাড়েনি এরকম বাঙালি বিরল।
আরেকটা জিনিসের বিশেষজ্ঞ আমরা। সেটা হলো রোগ। এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত বা অনাবিষ্কৃত সব রোগের কথা জানে বাঙালি। আর জানে তার অব্যর্থ দাওয়াই। মনে হয় প্রত্যেক বাঙালিই এক একজন ক্ষুদে ডাক্তার। একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলেই অবধারিত প্রশ্ন আসবেই, “কেমন আছেন?” আর চোখ বুজে বলে দেওয়া যায় উত্তর আসবেই, “ভালো নেই। পিএনপিসির চাটনি খাওয়া বাঙালি তখন খুঁচিয়ে জানতে চাইবে কেন ভালো নেই তার ডিটেইলস। কারণ সব্বাই মনে করেন আমি নিজে ভালো নেই, অন্যরা ভালো আছে। কিন্তু যেই আরেকজন বলবে সেও ভালো নেই, তখন অবচেতনে একটা আনন্দ কুলকুল করে উঠে আসে।
কেন ভালো নেই? ব্যস সওয়ালের ছল টুকু শুধু থাকে, পকেট থেকে বেরিয়ে আসবে তাড়া তাড়া প্রেসক্রিপশন আর তাদের সবিস্তার বৃত্তান্ত। সব রোগীই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা ডাক্তারকেই দেখায়, আর সেই সব পৃথক পৃথক সেরা ডাক্তাররা তাদের সবচেয়ে সেরা, সবচেয়ে দামী ওষুধই দিয়ে থাকেন। এত এত সেরা ডাক্তার আমাদের, অথচ খবরের কাগজ ওয়ালারা দেখুন কিরকম ছিদ্রান্বেষী যে প্রায়শই ডাক্তারদের ভুল ধরে।
এরপরের চ্যাপটার বড়ই মর্মান্তিক। সেখানে যদি দশজন উপস্থিত থাকেন, তাহলে সেই দশজনই দশরকম ওষুধ, দশ রকম ব্যায়াম, দশ আলাদা আলাদা ডাক্তার বা হাসপাতালের নিদান হাঁকবে। কিন্তু অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে শুনছে সেও একজন বাঙালি, তাই তারও পকেটে আছে সবচেয়ে অব্যর্থ ওষুধের নাম।
আগেই বলেছি আড্ডার অন্যতম আকর্ষণ হলো পিএনপিসি। খুব সাধারণ ভাবে আমরা পুরুষেরা পিএনপিসির যাবতীয় দায় দায়িত্ব মেয়েদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা বেশ ভোলাভালা মহান একখান মুখোশ পরে মুচকি হেসে পা দোলাই। যেন গিন্নী একাই রান্না করতে করতেও কিচেনের জানলা দিয়ে পাশের বাড়ীর সমবয়সীনি কিম্বা অসমবয়সীনিটির সাথে রাজ্যের হাঁড়ির খবর দেওয়া নেওয়া করেন। আমরা খুবই সাধুপুরুষ। বাব্বা! এসবের মধ্যে আমরা থাকিনা। আমরা খুব সোজা সাপটা।
আসল ঘটনা হলো, অফিসের লাঞ্চ ব্রেকের যে তুমুল আড্ডা জমে তার সিংহভাগ অংশ জুড়েই থাকে অফিসের অমুক কর্মচারিনী কেন দিন দিন সেক্সি হয়ে উঠছে। অমুক বসের বউ থপথপে মোটা। তমুকের মেয়ে স্কুল লাইফেই প্রেম করে কেটে পড়েছে। কোন রিটায়ার্ড বাবু এখন কত দুঃখে আছে। কার ঘুষের বহর দিন দিন বাড়ছেই অন্যদের চোখ টাটিয়ে। এমনকি সিবিআইএর পরের টার্গেট কোন রাজনৈতিক দাদা সেই হাঁড়ির খবরও কিভাবে যেন ডাইরিয়া পেশেন্টের মলত্যাগের ফ্লো এর মত আমাদের কাছে লিক করে যায়।
যদি মনে করি, বাঙালি এখন এরকম হয়ে গেছে তাহলে বড্ড ভুল হয়ে যাবে। মুঘল আমলেও আমরা এরকমই ছিলাম। ব্রিটিশ পিরিয়ডেও মেজাজে আড্ডা দিয়ে সারাদিন নাটমন্দিরে কাটিয়ে ঘরে ফিরে বউএর ওপর খাবার দেওয়ার জন্যে চোটপাট করেছি। আর এখনও বাঙালি আছে সেই বাঙালিয়ানাতেই। এই বিচিত্র জাতি বাঙালি কাজে অকর্মণ্য তা কিছুতেই বলা যাবে না। নীতি বা দুর্নীতি দুই এই আমরা সমানে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে টক্কর দিয়ে চলেছি। তাই চোখ বন্ধ করেই বলা যায়, বাঙালি আড্ডাবাজ ছিল, আছে, থাকবে।

Top of Form
Bottom of Form






1 টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র