চন্দন ভট্টাচার্য - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

চন্দন ভট্টাচার্য

                      
                             শ্রাবনীড়








এক  


                ঘুমভাঙ্গা চোখে সে প্রথম দেখতে পায় বরের মুখ। তারপর পা টিপে খাট থেকে নেমে নাইটির ওপরহাউসকোট জড়িয়ে বাইরে আসে। ছোট্ট লন পেরিয়ে গেট খুলে বাঁদিকে তাকালেই কুচকুচে নীল স্পষ্টবাক একপাহাড়শ্রেণী এখানকার মানুষরা বলেন ভুটান পাহাড়। প্রতিদিন ঘুম ভেঙে এই তার দ্বিতীয় মুখ দেখা। 

                          হাউসকোট শুধু শালীনতাই বাঁচায় না শ্রাবণীর, শীতের  শিরশিরানিকেও পোষ মানায়। না না ,এটাভয়ংকর ডিসেম্বর  বা বিপজ্জনক জানুয়ারি নয় , খুব গোবেচারা তেসরা আশ্বিন   (যেমন ছিল তার বরটা ...একসময় ) এখন তার বাপের আর শ্বশুরবাড়ির দেশ কৃষ্ণনগরে ফ্রিজকে ফ্রিজ ঠান্ডা জলের বোতল উড়ে যাচ্ছে ,কিন্তু যদি তোমাকে  এখানে কেউ ভোর ছটায় তুলে দিয়ে বলে, বুঝলে আজ হলো গিয়ে আঠারোই মাঘ , তুমিবিশ্বাস করতে বাধ্য !
সারা বছরই নাকি জায়গাটা এইরকম পেঁজা পেঁজা কুয়াশা, মার্বেলের কাচগুঁড়োর মত শিশির  আর একটু গরমছড়াতে ছড়াতেই  ঝুর ঝুর বৃষ্টি ভেঙে পড়ল চা বাগানের মাথায়

      ওহ্‌ , চা বাগান ! কিছুদিন আগেই আলোদ্যুতির অফ ডে-তে বা কোনও রবিবার তারা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়েপড়ত টি গার্ডেন সফরে। দেখা যেত,একটা সেনাবাহিনীকে দম লাগিয়ে ছুটতে বলে হঠাৎ যদি চেঁচিয়ে ঠো  ' হল্ট',ঠিক তেমনি চা-বাগানের সবুজ সমুদ্র সগর্জনে দৌঁড়ে এসে ভুটান সীমান্তে  নিজেরই ঢেঊ  দাঁতে দাঁত চেপে
আটকেছে। আর থেমেই চোখ তুলে দেখছে , লম্বা লম্বা শেডট্রি-  হাসিঠাট্টা মেখে দাঁড়িয়ে  লাল-নীল-হলুদেড্রাগন আঁকা রাজকীয় তোরণ। তার ঠিক পেছনে --- হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে --- সেই পাহাড়টার রক্তমাংস, যাকেরোজ ভোরবেলা গুড র্নিং  বলে শ্রাবণী।


                    -অঞ্চলে সব চা বাগানের মাঝখানেই বড় বড় কারখানাবাড়ি গণেশের মত চিমনি-শুঁড় তুলে বসেআছে  এখন   .ডি .এম স্যার হচ্ছেন বাগানের ম্যানেজার, বড়বাবু বা গুদামবাবুর কলেজে পড়া ছেলেমেয়েদেরফিজিক্স টিচার, আলোদ্যুতির পুরো নাম ওরা কেউ জানে না।  সেই স্যারকে তাদের এলাকায় বউ নিয়ে  বেড়ু-বেড়ুকরতে দেখলে তারা কি আর ছাড়ে! জোর করে  ম্যানেজারের বাংলায় নিয়ে বসাবে, কারখানায় ঘোরাবে আরফ্যাকট্রির চৌহদ্দিতে এলে মানে তুমি যেন এক সুগন্ধের রাজবাড়িতে ঢুকে পড়েছ  প্রথমে কাঁচা চা-পাতার বুনোভেষজ গন্ধ, যেখানে সদ্য তোলা পাতা বিরাট বিরা টবে ঢেলে শুকোনো হচ্ছে। ওই সুবাসই আরো অনেক তীব্র,টানটান, যেখানে ক্রাসিং মেশিন থেকে নামিয়ে কুচিকুচি সবুজ-রস-টোপানো পাতা মেলে দেওয়া হয়েছে ট্রে-তে,ফারমেন্টেশন হবে।আবার, ড্রায়ার-এর কাছে দাঁড়ালে গরম বাতাসের হলকায় উড়ছে চায়ের ঘ্রাণ পাশেই সর্টিংমেশিন, তার গায়ে লাগানো নলগুলো থেকে বেরিয়ে এল এক এক রকম সাইজের চায়ের দানা। বড়বাবু একজনকেবলছেন, বি. . পি ওয়ান-টা দু 'কেজি ওজন কর তো তারপর হাতের খুঁচি মেঝের ওপর জমা হওয়া  চায়ের ঢিপিরমধ্যে চালিয়ে খানিকটা চা তুলে ওদের সঙ্গে ফিরে চললেন কারখানার  অফিসঘরে। আলোদ্যুতিকে হেসে জিজ্ঞেসকরলেন, হাত দিয়ে দেখবেন নাকি স্যার? পুড়ে গেলে কিন্তু আমার দোষ নেই! অফিসের এক কোণে দেয়ালের সঙ্গে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো সাদা চিনামাটির বেসিন, সেখানে কনডেন্সড দুধের কৌটা আর সার দেওয়া বড় বড়কাপ, অমিতাভ বচ্চন যেন কোন সিনেমায় এই রকম কাপ হাতে নেচেছিল। বড়বাবু বললেন, গরম চা তো সবাই খায়,এবার গরম চা-পাতায়  তৈরি চা খাওয়াবো আপনাকে 

                           শ্রাবণীর বাড়িতে চা-কফির গুণগত মান নিয়ে সূক্ষ্ম গবেষণার রেওয়াজ আছে, কিন্তু আলো ব্যাপারে ভ্যাদভেদে টাইপ তবু সদ্য ভূমিষ্ঠ চা-দানার চায়ে চুমুক দিয়ে সেও একজন স্মিত  নেশাড়ুর চোখনিয়ে তাকায় বউয়ের দিকে। তারও কিছু পরে যখন ওঠবার সময়, বড়বাবু একটা বড়সড় চায়ের প্যাকেট ধরিয়েদিলেন শ্রাবণীর হাতে। ওরা নিতে চাইবেনা , স্বাভাবিক তিনিও বুঝিয়ে চলেন, এই দেখুন স্যার, ট্যাক্স পেমেন্টকরা ইনভয়েস, আপনার নামেই বিল হয়েছে। স্যরি মাস্টারমশাই , তা বলে টাকা নিতে পারব না।

                                 গল্পের  শেষ আরও চমৎকার ওরা বেরিয়ে এসেছে, হঠাৎ  এক ঝাঁক ঝমঝম বৃষ্টি যেন আকাশ কাত করে তার সব জল গড়িয়ে দেওয়া হবে এই চা বাগানে করুগেটেড টিনের ওপর তবলায় জোরটুকড়া-রেলা বাজছে  এই যাঃ, কারখানার ছাদে ইট পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করল কারা! এবার উঠোনও ভরে যাচ্ছেনানা  চেহারার বরফে, গড়িয়ে শ্রাবণী পায়ে এসে  মুখ গুঁজছে বরফের কোনওটা  স্বচ্ছ  খাঁজকাটা শঙ্খ,কোনওটা ফ্রস্টেড পেপার ওয়েট  অ্যাত্তো বিরাট করে শিলা বৃষ্টি হয় নাকি এখানে ! আনন্দের চোটেদুজনে অনেকগুলো বরফ কুড়িয়ে তুলল গাড়িতে  চা বাগানের চায়ের মতই  পাহাড়ী নদীর ধক সামলাতে সেদিন অন্যরাস্তায় উঠে জং-পড়া লোহার ব্রিজ ধরল জিপ। বাসায় ফিরে দেখে, শরীরে অনেকটা গরীব হয়ে গেলেও তখনওধুকধুক করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে শিলাবৃষ্টির বরফগুলো।



দুই


আলোদ্যুতির কলেজ থেকে ফিরতে এখনও অন্তত দুঘন্টা  সঙ্গীতাকে ফোন করতে যাচ্ছিল শ্রাবণী,তৎক্ষণাৎ মধুরার কলটা চলে সেছে  
-------এখন কেমন বুঝছিস ?
------বোঝার আবার কি আছে ! যেমন চলছিল, তেমনই
------ এটা স্ট্যাটাস কো ধরে রাখার ব্যাপার নয়, নি  খোলাখুলি কথা বল। আর যদি তাতেও ঝেড়ে না কাশে---- 
মধুরার এই চুপ করে যাওয়াটা মারাত্মক লাগে  আংশিক নৈঃশব্দের সঙ্গে তো আনন্দেই ঘর  করছিল এই ছমাস,কিন্তু বন্ধুর ইশারার মধ্যে কেবল কাচের বাসন ভাঙার বিপজ্জনক শব্দ পায় সে। ওর বিশ্লেষণের সঙ্গে একশোভাগ সহমত, অথচ সিদ্ধান্তগুলো মানতে সাহস পা না 
------ শোন শ্রাবণী, বিয়ের চারমাসের মাথায় যে বর ডাহা  মিথ্যা বলে, তাও টাকা-পয়সার ব্যাপারে , তাকে যদিএখনও আশকারা দিস তো দুদিন পরে তোকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে ছাড়বে তখনি বলেছিলাম, টিয়াস্যারের মতইনট্রোভার্ট ছেলেকে সামলানো তোর পক্ষে খুব টাফ!


         ' তখনই ' মানে ছমাস আগে, তাদের প্রেমের উন্মেষকালে। কিন্তু সঙ্গীতা যে আবার উল্টো গাইল! স্কুলথেকে কলেজ, তারপর চাকরির কোচিং ক্লাস --- সব জায়গাতেই একই বেঞ্চে তিন বন্ধু , মাঝখানে শ্রাবণীকেনিয়ে বাঁদিকে মধুরা আর ডানে সঙ্গীতা। স্কুলে তাদের দেখতে পেলেই ছোটখাট চেহারার সংস্কৃত স্যার দুহাতদুদিকে ছড়িয়ে বলতেন, শ্রাবণে মধুর সংগীত
সঙ্গীতা বলেছিল, টিয়াস্যারের মত ছেলে আজকাল হয় না রে ওকে অ্যাকসেপ্ট করলে তুই ঠকবি না
এখন  ইচ্ছা করছে পরমাণু বোমা মেরে মেয়েটির মাথা উড়িয়ে  দিতে!

          শেষবার বাড়ি যাওয়াটা তার সুখের হয়নি , দেখা হতেই মা কেঁদে ফেলেছিল। শ্রাবণী আগে থেকেই জানে,মায়ের কিডনির চিকিৎসা করাতে বাবার জমানো
...

1 টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র