রৌপ্য রায় - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

রৌপ্য রায়

সোমবারের বিজ্ঞাপন ( ধারাবাহিক রসহ্য উপন্যাস )  


দ্বিতীয় পর্ব ----








৩--

ভোর পৌনে পাঁচটা , ঘুম ভাঙল । বিছানা ছেড়ে উঠলাম । উঠে দেখি মিল্কি বিছানায় নেই । ভাবলাম বোধয় বাথরুমে গেছে । ঘুম চোখে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে নিচে নামলাম । নিচে নেমে দেখি লাইব্রেরী রুমে আলো জ্বলছে । আমি দরজা ঠেলে উঁকি মারলাম । দেখলাম মিল্কি চেয়ারে বসে টেবিলে মুখগুঁজে কিছু একটা পড়ছে । আমি সম্পূর্ণ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম । ক্ষীণ শব্দ হলো কিন্তু
মিল্কির পড়ার ধ্যান ভাঙল না । আমি মিল্কির পিছনে দাঁড়িয়ে , সবে বলতে যাবো যে কখন উঠেছো তার আগে মিল্কি বলল -
কি রে দা সবে ঘুম ভাঙল ! আমি বুঝলাম আমার ঘরে ঢোকা সে টের পেয়েছে । আমি বললাম - এই মাত্র উঠলাম
কিন্তু তুই . . . ?
' আমি ! আমি তো ভোর তিনটেই . . . । '
' কিন্তু কেন ? '
' হঠাত্‍ ঘুম ভেঙে গেল তাই ল্যাইবেরিতে এসে উঠলাম । '
' ও আচ্ছা ! '
এবার মিল্কি তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো । আমি মিল্কির মুখের দিকে তাকালাম । দেখি চোখ দুটো জ্বলন্ত লাভার মতো টকটক করছে । মনে হচ্ছে এখুনি বোধয় কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসবে । যেন কোন উপায়ে চোখতর'টো একটু বিশ্রাম চায় ।
মিল্কি ক্লান্তির চোখে বলল - আমি একটু ঘুমতে যাচ্ছি ঘণ্টা দু'ই পরে ডাকে দিও ! ভিন্ন বানারজির বাড়ী যাতে হবে ।আমি বললাম - আচ্ছা ! ডেকে দিই এ । তুই এখন যা . . . । মিল্কি ক্লান্তিময় চোখ নিয়ে দোতালায় চলে গেল । আমার যতটা মনে হয় মিল্কি আমার কাছে কিছু একটা লুকাছে । তা না হলে আমাকে মিথ্যা বলল কেন ? মিল্কির চোখ বলছে ও আজ সারা রাত ঘুমায় নি । ব্যাপার টা কি ? টেবিলের উপর রাখা বইটা প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা ধরে ভালো ভাবে ওলট পালট করে দেখলাম ।
তেমন সন্দেহজনক কিছু পেলাম না । তাই বাধ্য হয়ে দোতালয় উঠে ক্যাপ্টেন কে ডেকে স্নান পর্ব সেরে নিয়ে পৌনে আঁটটায় মিল্কি কে ডেকে তুললাম । বিছানা ছেড়ে উঠে মিল্কি স্নান বাথরুম সেরে আসতে আমরা ব্রেকফাস্টে বসলাম । মিনিট পৌনেরর মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে চা পান করছি । মিল্কি চায়ের
পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল - এই কেস টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেস । ভালো ভাবে নজরদারি রাখতে হবে । আমি মক্কেলের বাড়িতে পৌঁছে যখন ইনভিস্টিগেট শুরু করবো তখন তোমরা ও অবশ্যই সব কিছু ভালো করে দেখে নিও । যেন একটা সুঁচ পর্যন্ত বাদ না পড়ে , আর হ্যাঁ বিশেষ করে পুরানো জিনিসপত্র । আমারা দুজনে মাথা দু দিকে হেলে সম্মতি জানালাম ।
চা পান শেষ হতেই মিল্কি পচাদাকে ডেকে চাবি গোছা দিয়ে বলল - আমরা বের হচ্ছি । আজ ফিরতে পারি , না হয় কাল । চাবি গোছা হাতে নিয়ে পচাদা কেবল দুটো শব্দ বলল - আচ্ছা ! দাদাবাবু ।
পচাদা অবশ্য একটু কম কথা বলে । আসলে পচাদা একটু নিরীহ হাবা বোবা গোছের । যাই হোক আমরা আর দেরি করলাম না । ভিন্ন ব্যানাজীর বাড়ীর উদ্দেশে
ডায়মন্ড হারবার থেকে নয় টা পঁয়ত্রিশ এর ট্রেনে রওনা হলুম । ট্রেন থেকে নেমে বুঝলাম আজ তাপমাত্রা আগের দিনের তুলনায় একটু বেশি ।
বারুইপুর থেকে ট্রেন চেঞ্জ করার সময় মিল্কি ভিন্নবাবুকে ফোন করে দিয়েছিল । তাই বোধয় ভিন্নবাবু স্বয়ং নিজে এসেছেন আমাদের পিকাপ করতে । এখন প্রায় মধ্যাহ্ন । ষ্টেশন থেকে নেমে বামহাতি রাস্তা ধরলাম । মাজা ঘসা মসৃণ বেশ প্রশস্ত । যতটা মনে হয় রাস্তাটা মিনিমাম দশ ফুটের তো হবেই।
দূরবর্তী স্থানে পৌঁছানোর জন্য ভ্যান রিক্সা ও আধুনিক ম্যাজিক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে । বেশ কয়েকজন ড্রাইভার গলা ছেড়ে হাঁকছে জামনগর , মজিলপুর , জামনগর ইত্যাদি ইত্যাদি যাবে । আমরা কোন গাড়ি ধরলাম না । খানিকটা হাঁটার পরে একটা আধুনিক ঝাঁ চকচকে রঙ করা বাড়ী দেখিয়ে ভিন্নবাবু বললেন -এটাই আমার বাড়ীর । আসুন , আসুন !
আমরা বিনা দ্বিধায় প্রবেশ করলাম । বাড়ীটা দোতলা । বাহিরে থেকে যতটা মনে হয় তা নয় । তার চেয়ে ও ভিতরে অবিশ্বাস সুন্দর কারুকর্যে ভরা সাদা
ধবধবে প্যারিসের কাজ , বিশেষ করে মাথার উপরের সিলিং টা । এক কথায় মাইড ব্লয়িং । মিল্কি বাড়ীর ভিতের এক ঝলক দর্শন করে বলল -বাড়ী কি নতুন করেছেন । ভিন্ন বাবু তার সুন্দর মুখমণ্ডলে এক অদ্ভুত হাসি টেনে বললেন -আজ্ঞে হ্যাঁ ! সামনে বছর বেঁধেছি ।
মিল্কি মৃদু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো । ভিন্নবাবু তার দোতলার বৈঠকখানায় নিয়ে গেলেন । বেশ চমত্কামর ভাবে সাজানো । এক সাইডে বড়সড়ো দুটো দেওয়াল আলমারি । সম্পূর্ণ কাঁচে ঢাকা । বেশ বুঝতে পারছি ভিন্নবাবুর বই পড়ার অভ্যাস আছে । মিল্কি এক নজর চোখ ঘুরিয়ে ভিন্নবাবুর উদ্দেশে বলল - আপনার বই পড়ার শখ আছে বুঝি ?
ভিন্নবাবু স্টেটকাট বললেন - না ! না ! আমার বই পড়ার কোন শখ নেই , এসব বাবা পড়তেন ।
' ও আচ্ছা !
' আপনারা অনেকটা জার্নি করে এসেছেন একটু বিশ্রাম নিন আমি একটু আসছি । '
মিল্কি জাস্ট একটু হাসল । ভিন্নবাবু চলে গেলেন । মিল্কি এদিক ওদিক চেয়ে বলল- বুঝলে দা বোধয় খোঁজাটা সহজ সাধ্য হবে না ।
আমি বললাম - ঠিক বলেছিস দা ।
' তুমি কি করে বুঝলে ? '
আমার উত্তরের আগে ক্যাপ্টেন বলে উঠল - এটা তো অতিময় সহজ । বাড়ির যে গেটাপ চেন্জ হয়ে গেছে ।
" ব্যপারটা বেশ ধোঁয়াটে । "
" একটা উপায় আছে । "
" কি ? "
" সম্পূর্ণ পুরানো জিনিস পত্র খুব ভালো ভাবে তল্লাসি নেওয়া । "
মিল্কি বলল - " হুম ! ঠিক বলেছ ক্যাপ্টেন । "
আমাদের মধ্যে এরকম টুকিটাকি কথা বার্তা চলছে এমন সময় বৈঠকখানায় এক ভদ্র মহিলা প্রবেশ করল । মাথায় খানিকটা বড়ো করে ঘমটা টানা । হাত চায়ের ট্রে । মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না । হাতের রঙ অনুযায়ি বলা যায় ফর্সা ।
ভদ্র মহিলা চায়ে ট্রে টেবিলে রেখে বললেন - আপনার চা পান করে বিশ্রান নেন বাবা একটু বাহিরে গিয়েছেন । আমাদের কিছু বলার আগে ভদ্রমহিলা হন হন করে চলে গেলেন । মিল্কি জানালার
ধারে দাড়িয়ে ব্যাপার খানা ভালো করে লক্ষ করল । মিল্কি সোফায় বসে বলল -
দা ব্যাপারটা কিছু বুঝলে ।
আমি বললাম - হ্যাঁ ।
' কি বুঝলে? ওই ভদ্র মহিলা হলেন ভিন্নবাবুর ছেলে স্ত্রী মানে বৌ মা । '
' হুম । '
' আর ? '
' কি আর ! কিছুই. . . । '
' ভদ্র মহিলা খুবই লাজুক , কম কথা বলেন বিশেষ করে অপরিচিত লোকের সাথে , গহনা পরতে ভালোবাসেন না , সম্ভবত সদ্য বিবাহিত । ' - ক্যাপ্টেন বলল ।
মিল্কি ব্যঙ্গ করে বলল - দা ! ক্যাপ্টেনের কাছে অন্তত কিছু শেখ । কথাটা আমি অতটা গেয়ে মাখলাম না । ঘন্ট আড়াই ট্রেন জার্নি চাটিখানি মুখের কথা না । এতটা জার্নি তে আমরা খুবই ক্লান্ত । আমরা বাথরুম সেরে চা পানের পরে একটা ছোট্ট বিশ্রাম নিলাম । প্রায় সোয়া এক ঘন্টা পর হঠাত দরজায় খটাং খটাং নক এর শব্দ হল । ক্যাপ্টেন চোখ মেলে বলল - ইএস ; কাম ইন ।
ভিন্ন বাবু দরজা ঢেলে ভিতরে প্রবেশ করে বললেন - আসুন আহারের ব্যবস্থা হইয়াছে । আমরা মধ্যাহ্নকালীন ভোজনের উদ্দেশে রওনা হলাম । আহারের পর হালকা ঘুমালাম । ঘুম ভাঙতে দেখি মিল্কি আর ক্যাপ্টেন বিছানায় নেই । মক্কেলের বাড়ী তাই আর হাঁক দিলাম না । বিছানা ছেড়ে চটি পায়ে
ছাদে এলাম । এদিক ওদিক চোখ মেলতে মন ভরে গেল । অপূর্ব ; চারিদিকে সবুজ আর সবুজ । নীল আকশের রঙ ছেয়ে গেছে গোধুলীর মায়াবী রঙে । পূবে হালকা বাতা বইছে । মৃদু বাতাসা ধানের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে । এমন অমায়িক রোমান্টিক দৃশ্য দেখে একটা বিখ্যাত কবিতার কথা মনে পড়ে গেল " আহা ! কি দেখিলাম জন্ম জন্মাতরে ভুলিব না "
মনে মনে কবিতাটা একবার ঝালিয়ে নিলাম । ছাদে এদিক ওদিক পায়চারি করছিলাম । কিন্তু মনের উশখুশানি গেল না । পাইচারি করতে করতে বাগানের দিকে চোখ পড়ল । ক্যাপ্টেন , মিল্কি ও ভিন্নবাবু বাগানে বসে কিছু একটা আলোচনা করছে । আমি তাড়াতাড়ি বাগানে রওনা হলাম । ভিন্ন বাবু মুখে হাসি টেনে বললেন - কি রৌপ্য বাবু ; ঘুম হলো ?
আমি বললাম - আজ্ঞে ! ওই হলো ।
মিল্কি অন্যমনস্ক ভাবে বলল - ভিন্নবাবু আপনাদের বাড়ীতে আপনার পিতামহের আমলে আসবানপত্র বলতে কী কী আছে । ভিন্ন বাবু বললেন - আসবানপত্র বলতে তেমন কিছু নেই আছে কেবল পিতামহীর রুমে খাট , আলমারি আর কয়েকটা বাসনপত্র ।
' আর কিছু ? '
' আর কিছুই নেই । পিতামহের আমলে বেশির ভাগ আসবানপত্র ছিল কাঠের । খাট আর আলমারি বাদে সমস্ত নষ্ট হয়ে গেছে । '
' খাট আর আলমারি বাদে কেন ? '
' আসলে খাট আর আলমারি লোহা শালের কাঠে দিয়ে তৈরী তাই . . . । '
' আচ্ছা ! নষ্ট আসবানপত্র ভালো ভাবে দেখে ছিলেন ? '
' আজ্ঞে হ্যাঁ খুবই ভালো ভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছি কিন্তু কোন লাভ হয়নি । '
' খাট আর আলমারি . . . । '
' সে ও খুব ভালো করে দেখেছি কিন্তু আশানুরুপ কোন ফল পাই নে । '
' আপনার বাবাকে তো দেখলাম না । '
' পিতামহীর মৃত্যুতে বাবা মানসিক ভারসম্য হারিয়ে ফেলেছেন । এখন আর
বাহিরে বার হন না সর্বদা পিতামহীর রুমে থাকেন । '
' আপনার বাবার সাথে কি কথা বলা যেতে পারে ? '
' আমি ঠিক বলতে পারব না । সেটা বাবার উপর নির্ভর . . . । '
' তাহলে চলুন । দেখা যাক কথা বলেন কি না ? '
' চলুন তবে ! '
আমরা সবাই বাগান ছেড়ে ঘরে এসে উঠলাম । নিচের তলায় পশ্চিমের রুম ; একপাল্লার পালিশ করা দরজা । ভিন্নবাবু দরজায় নক করে বললেন - বাবা ! ও বাবা দরজা খুলুন । কে এসেছে দেখো ? বাহির থেকে দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল । মিল্কি হাত নাড়িয়ে আমাদের বাহিরে দাড়ানোর ইশারা করলো । ভিন্নবাবু আর মিল্কি রুমে প্রবেশ করল । মিল্কি ভিন্নবাবুর বাবা অর্থাত্‍ বুদ্ধিশ্বর বাবুকে অতি সাধারন কয়েকটা প্রশ্ন করে ফিরে এল । ভিন্নবাবু রুম থেকে বাহির হতে বুদ্ধিশ্বর বাবু দরজা বন্ধ করে দিলেন । সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভিন্ন বাবুকে উদ্দেশ্য করে মিল্কি বলল - যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলবো !
ভিন্ন বাবু বললেন - না , না কি আর মনে করবো ! বলুন ।
' আমি যদি রাতে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করি আপনাদের কোন প্রবলেম হবে । '
ভিন্ন বাবু বললেন - না না কোন প্রবলেম নেই কিন্তু বাহিরের গেটে তালা দেওয়া থাকে আপনি চাইলেও গেটের বাহিরে যেতে পারবেন না ।
' ধন্যবাদ । আর যদি আপনার দেওয়াল আলমারির চাবিটা পাওয়া. . . । '
একটু দাড়ান আমি এখুনি আসছি বলে ভিন্ন বাবু চলে গেলেন । ক্যাপ্টেন কে খুব চিন্তিত লাগছে । মিল্কি ক্যাপ্টেনর দিকে তাকিয়ে বলল -
রবি ! কিছু বলবে ?
ক্যপ্টেন বলল - না অঙ্কেল ।
ভিন্নবাবু দরজায় নক করে
ভিতরে প্রবেশ করলেন । এক গোছা চাবি বাড়িয়ে বললেন - সাবধান ! সমস্ত দেওয়াল আলমারির চাবি এই গোছায় আছে । যেন হারিয়ে ফেলো না ।
' ধ্যনবাদ । '
মিল্কি চাবি গোছা নিয়ে পশ্চিমের আলমারির দিকে এগিয়ে গেল । ভিন্ন বাবু যাবার উপক্রম করছেন ।
ক্যাপ্টেন বলল - ভিন্ন আঙ্কেল আপনাদের ঠাকুর স্থানের ঠাকুর গুচ্ছ অতি
সুক্ষ করুকার্য ও উজ্জল । কোন ধাতুর গড়া . . . । '
ভিন্ন বাবু বললেন - এলুমিনিয়াম আর কোন এক উজ্জল ধাতু দিয়ে গড়া । আমি
ঠিক জানি ঠাকুর গুলো পিতামহের বন্ধু গড়ে দিয়ে ছিল ।
মিল্কি একথায় তেমন কান দিল না । দেওয়াল আলমারি থেকে বই নামিয়ে ঘাটছে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র