সঞ্জয় সোম

মায়াজম
0
                                       রুদালী একটি মেয়ের নাম





         মেয়েটি ব'সে থাকে মূর্তি নদীর এক বাঁকে সময় অসময়, যেন কারও অপেক্ষায় । ধুপঝোরা গ্রামের প্রায় সকলেই ওঁকে পাগলি আখ্যা দিয়ে ফেলেছে । নদীর পাড় ছাড়াও তাঁকে দ্যাখা যায় একা একা হাঁটতে গ্রাম লাগোয়া সবুজ বনানীর ধার দিয়ে । শরীরের গড়ন বলতে বছর তিরিশের রুদালী সুন্দর মুখশ্রীর শ্যামলা মেয়ে । পড়নের বেশভূষা কিন্তু মোটেই পাগলি পাগলি নয়, শুধুই ওই নদীর পাড়ে ব'সে জলের সাথে কথা বলা আর চাপড়ামারী ফরেস্টের দিকে তাকিয়ে কাউকে খোঁজা ।
এক বিকেলে ধুপঝোরা গ্রামের মূর্তি নদীর তীরে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে উপস্থিত ।একটি মেয়েকে হাত নাড়িয়ে নদী ঘেঁষা জঙ্গলের উপর দিকে তাকিয়ে কারও সাথে কথা বলার আশ্চর্য ঘটনা আমার নজরে আসে । পাগলি ভেবে নেই তৎক্ষণাৎ ! ঠিক এক সপ্তাহ পরেই বাইরের এক বন্ধু আসে আমার বাড়ি ঘুরতে । মূর্তি নদীর নাম আগেও শুনেছে তাই , আবার যেতে হ'ল । নদী ধ'রে এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে একটু দুরেই চোখে পড়ল সেই মেয়েটা । নদীর এক ধারে পাথরে ব'সে জলের সাথে কথা বলছে । আমার চিনতে একটুও অসুবিধে হয় নি , এই সেই পাগলিটা , যে গাছের সাথে কথা বলছিল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম , ধীরে ধীরে ফিরে এলাম মূর্তি নদীর ব্রিজের উপর । একটা ঝুপড়ি দোকান পেয়ে সিগারেট ধরালাম, আর দোকানী ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটা ওভাবে বসে আছে কেন ! শুনলাম,ওর নাম রুদালী । বছর তিনেক আগে স্বামী পথ দুর্ঘটনায় মারা যায় , আর কোলের ছেলেটাও অজানা জ্বরে মারা যায় তাঁর সাতদিন পরেই। তারপর থেকে ধীরে ধীরে ও কেমন যেন হয়ে যায় , গ্রামের প্রায় সকলেই ওঁকে রুদালী পাগলি ডাকে ! মনটা ভার হয়ে গেল , সন্ধ্যাও নেমে এসেছে তাই যথারীতি প্রায় পনেরো কিমি পথ অতিক্রম করলাম টিয়াবন হয়ে চালসার উপর দিয়ে মালবাজার ।
মাস ছয়েক পরে কোলকাতার বন্ধু অখিলেশ এসে উপস্থিত আমার ডুয়ার্সে , জলপাইগুড়ির মালবাজারে । ওঁকে নিয়ে গুরুবাথান , লাভা , লোলেগাঁও ঘুরে পরের দিন সামসিং ঘুরিয়ে নিয়ে চললাম মূর্তি নদীর দিকে । এমনিতেই বর্ষাকাল তাও আবার বিকেল হয়ে এল মূর্তি পৌঁছাতে । ব্রিজের পাশেই দেখি কিছু লোক ভিড় করে আছে , বোঝা যাচ্ছে যে সকলেই স্থানীয় । এগিয়ে গেলাম , দেখি একজন বয়স্ক লোক চিৎকার করে কাঁদছে । জিজ্ঞেস করতে চাইলাম কি ঘটেছে ! ভাবতে ভাবতেই চোখে পড়ল চেনা সেই মুখটা এই সেই রুদালী , নিথর দেহটা ধ'রে ওর বাবাই কাঁদছে। বুকটা কেঁপে উঠল,মনটা অস্থির হয়ে গেল । জিজ্ঞেস করেই বসলাম কি করে হ'ল ? কেউ একজন বলল শরীরে জ্বর নিয়েই সকালে ঘর থেকে বেরিয়েছিল মেয়েটি । কিন্তু জলে ডুবল কি করে কেউ আর বলতে পারল না , কোন এক গরু পালক লাশটা ভাসতে দেখেছে । মেয়েটা এভাবে কারও অপেক্ষা করতে করতে ম'রে যাবে , কেউ ভাবতে পারে নি । সব শুনতে শুনতে আমি হতবাক হই , আর ভাবতে থাকি আমিও সাক্ষী রয়ে গেলাম একটি মেয়ে রুদালী পাগলির অন্তিম সময়ের !

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)