গৌতম যুথিপুত্র

মায়াজম
0
                        ছাতিম ফুলের গন্ধে...




সেই রাতেই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছি হোটেল থেকে ।
স্পিডোমিটারের কাঁটা একশো ছুঁই-ছুঁই ; ক্রমাগত গতি বাড়াচ্ছি , অ্যক্সিলেটারের ঘাড়ে চেপে বসেছে আমার পা । সারারাত গাড়ি চালিয়েছি একনাগাড়ে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে আমাকে পৌঁছুতেই হবে গ্রামের সেই ছাতিম গাছটার কাছে । ক্র্যাঁ...আ...চ...চ..ব্রেকের তীব্র আওয়াজ , সামনেই একটা তীক্ষ্ণ বাঁক ।…. “”তুমি পারবে না নীলুদা , তুমি পারবে না।””
অফিসের কাজে বাইরে আসলে আমি এই হোটেলটাতেই থাকি । তিনতলার জানালা দিয়ে সামনের প্রকৃতি যেন ঘরের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়ে । সামনেই একটা বড় ছাতিম গাছ । শীতের শুরুতে ছাতিমের তীব্র গন্ধে মনে পড়ে যায় গ্রামের স্কুলের পাশের সেই পুরোনো গাছটার কথা । সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে আমি হাঁটছি , বিষণ্ণ ছাতিমের গন্ধ , বিষণ্ণ ভোর , সূর্যটাকে ঢেকে দিয়েছে অচেনা অনাহূত মেঘ । পাশে ময়ূরকণ্ঠী শাড়ী । গ্রামে বাড়ুজ্যেদের বাড়িতে প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে ; ও বাড়ির মেয়ের বিয়ে । সারা গ্রাম নিমন্ত্রিত ।“…….”ও দিন তুমি এসো না , তুমি পারলে না নীলুদা , তুমি পারলে না ।””
হোটেলের মালিকের সাথে পরিচয় হয়ে গেছে । সদালাপী ,অতিথিপরায়ণ । ব্যস্ততার মাঝেও আমি আসলে কিছুটা সময় কাটিয়ে যেতেন আমার ঘরে । খোঁজ নিতেন কোন অসুবিধা হচ্ছে কি-না । পরিচয় নিবিড় হলে বন্ধুত্ব হয় । এবার এসেছি আবার সেই শহরে । দূর থেকেই পাচ্ছি ছাতিমের গন্ধ কিন্তু কেমন যেন বিষণ্ণ , ম্লান ; হয়তো এ আমার মনেরই ভুল । হোটেলের সেই পরিচিত ঘরটাতে এসে লাগেজ গুছিয়ে এক কাপ চা চাইলাম । ম্যানেজার নিজে এলেন চা নিয়ে বেয়ারার সাথে । “”উনি যাওয়ার সময় বলে গেছেন আপনি আসলে যেন এই ঘরটাই দেওয়া হয় আপনাকে।”” ছাতিমের গন্ধ আরও তীব্রভাবে বিষণ্ণ । “”মানে” ?” ম্যানেজার নিয়ে গেলেন তাঁর ঘরে যেখানে মালিক বসতেন । শূন্য চেয়ার , পিছনের দেওয়ালে মালা দেওয়া তাঁর ছবি । “”একমাস হ’ল ।””
অপরিচিত একটা নম্বর থেকে ফোন এল আমার মোবাইলে । “”কাল সন্ধ্যায় একবার আমার বাড়িতে এসো নীলুদা , উনি তোমার কথা খুব বলতেন । তোমার নাম ওনার মুখেই শোনা , আর ফোন নম্বরটা হোটেলের রেজিস্টার থেকে নেওয়া।”” ও প্রান্তে ময়ূরকণ্ঠী শাড়ি ।
মুখোমুখি আমি আর ময়ূরকণ্ঠী । “”বিয়ে হয়ে এখানে আসার পর হোটেলের পাশে ছাতিম গাছটা আমিই লাগিয়েছিলাম নীলুদা । সেই একই রং , একই গন্ধ । তোমার নামটা ওনার কাছে শোনার পরেও সন্দেহ হ’ত একই নামে অন্য কেউ নয়তো ! হোটেলে তো কত লোক আসে । তুমি কেমন আছো নীলুদা ?”” ময়ূরকণ্ঠী উঠে জানালার দিকে গেল , এই ঘর থেকেও দেখা যায় ছাতিম গাছটাকে । “”কতদিন তোমাকে দেখার চেষ্টা করেছি এখান থেকে ।“” আমি উঠে দাঁড়ালাম । আমার বুকের কাছে ময়ূরকণ্ঠীর মাথা ; “”এই গাছটাই বোধহয় তোমাকে টেনে নিয়ে এসেছে এখানে।“” অনেকক্ষণ হয়ে গেছে এ ঘরে আমরা দু-জন । ছাতিম গন্ধ আমার অতীতটাকে বয়ে আনছে তীব্রভাবে । অতীত আর বর্তমানের দু-প্রান্ত ধরে একটা বৃত্ত বানাতে চাইছিলাম সম্পর্কটাকে কেন্দ্র করে ; ইচ্ছে করছিল ওকে কাছে টেনে নিই নিবিড়ভাবে , ঠিক আগের মত । পারলাম না । “”আজ উঠি।””
“ “তুমি আজও পারলে না নীলুদা , আমি জানতাম তুমি পারবে না , কোনদিনই না....””
অতীত বৃত্তের স্পর্শক ধরে নিকষ কালো রাতে ছুটে যাচ্ছে একটা গাড়ি গ্রামের সেই ছাতিম গাছটার দিকে 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)