দেবপ্রিয় সমাদ্দার - মায়াজম

Breaking

২০ সেপ, ২০১৫

দেবপ্রিয় সমাদ্দার

                                                    আবর্ত









           ট্যাক্সি ধরলাম অফিসের সামনে থেকে। ক্লান্ত, তাই উঠেই সিটে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। অনেক রাত হয়ে গেল আজ। হঠাৎ ড্রাইভারের সিটের পিছনে লেখা ট্যাক্সির নম্বরটা চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম। এই নম্বর প্লেট লাগানো একটা ট্যাক্সি সেদিন আমারই চোখের সামনে লরির এক ধাক্কায়ে দুমড়ে, থেঁতলে গিয়েছিল, পিছনে কেউ বোধহয় ছিল না, কারণ বডিটা বের করা হয়েছিল শুধু ড্রাইভারের। অফিস থেকে সাধারণত বেরোই না, কিন্তু সেদিনের ব্যাপারটা ছিল অন্যরকমের। আজকাল অবশ্য নিজেরই খেয়াল হয় না কখন কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। ফ্রন্টলাইন কর্প কোম্পানির কলকাতার যাবতীয় হিসেব নিকেশের ফাইল খুঁজতে খুঁজতে ঘড়িতে আড়াইটে বেজে গেল যখন, লাঞ্চের আশা ছেড়ে দিলাম। অফিসের সামনের চায়ের দোকানে একটা সিগারেট ধরিয়ে সবে দুটান মেরেছি, তখনই ঘটল দুর্ঘটনাটা। এসব ক্ষেত্রে প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে কিঞ্চিৎ সময় লাগে। ভিড় জমার আগেই সিগারেট ফেলে অফিসে ঢুকতে হল। আমার ফ্লোরের ব্যালকনিতে তখন লোকজন উপচে পড়েছে নীচের দুর্ঘটনার জন্য। আমার অবশ্য সেসব ভাবার মত অবস্থা ছিল না, পাঁচ বছরের পরিশ্রমের পর পদোন্নতি, কিন্তু প্রথম অ্যাসাইনমেণ্টেই তার পঞ্চত্বপ্রাপ্তির জোগাড়। ফ্রন্টলাইনের গত দু বছরের সমস্ত কাজকর্মের গোপনীয় তথ্য আমার জিম্মাতেই থাকত। থাকত বলছি, কারণ সেদিন সকালে হঠাৎ ল্যাপটপ হ্যাং করে যায় আর তাই সিস্টেম রিস্টোর করতে হয়। তারপর...সব হাওয়া। অনেক খুঁজেও সেটা বেপাত্তা।
তাড়াহুড়োতে কোথায় যাবো বলা হয়নি, একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম “গড়িয়াহাট যাবো”। ড্রাইভার ঘাড়টা হাল্কা ঘুরিয়ে বলল “আচ্ছা”। এখানটা অন্ধকার, তাতেও লোকটার মুখটা দেখে কেমন যেন মাথা গুলিয়ে উঠল। এটা কি আমার চোখের ভুল, না মনের? দুর্ঘটনার পরেরদিন কাগজে মৃত চালকের ছবিটা ছেপেছিল, ঐ চোখ, ঐ বাঁদিকের কাটা দাগটা... এ তো অবিকল এক! ছোটবেলায় পড়েছিলাম, আমাদের চারদিকে অদ্ভুত কিছু আবর্ত বা ধাঁধা থাকে, এই যেমন স্বপ্ন। স্বপ্নে অনেক অবাস্তব অসম্ভব ঘটনা আমরা ঘটতে দেখি। ঠিক সেরকমই সেখান থেকে অনেক বিগত হারানো জিনিস হঠাৎ চোখের সামনে চলে আসে, বিজ্ঞানে যার ব্যাখ্যা হয় না ।

চাকরিটা গেলে আর কোথায় আবেদনপত্র ফেলব সেটা ভাবতে ভাবতে যখন একটু তন্দ্রা এসেছে, গাড়ি তখন চিংড়িঘাটায় এসে থেমেছে। এইসময়ে এখানে লোকজন খুব একটা হাঁটে না, তাও এক বৃদ্ধকে রাস্তা পেরোতে দেখে অবাক লাগল। সেদিনও এক বৃদ্ধকে পাশ কাটাতে গিয়েই লরিটা ধাক্কা মারে ট্যাক্সিতে। কি দেখছি এসব আবোলতাবোল? মানসিক চাপটা আজকাল বড্ড বেশী ঠেকছে, পাগল হয়ে গেলাম নাকি? হঠাৎ করে এই ডেজা ভু, আমার মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা আনলো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের তাড়নায় ল্যাপটপ অন করি। এ কি!! অবিশ্বাস্য কাণ্ড!! আমারই বানানো ফোল্ডারে যথাস্থানে আছে সেই ফাইল, যা আমার গোটা আইটি সাপোর্ট টিম খুঁজে হয়রান!! তড়িঘড়ি সেটা ইমেল করে দিই নিজের নামে, গোপনীয়তা পরে, আগে চাকরি বাঁচানো দরকার।
গড়িয়াহাট এসেছে, বেশ আলো এদিকটায়। এইমাত্র যে লোকটা আমার থেকে ভাড়া নিল, তাকে আমি কস্মিনকালেও দেখিনি। শুনশান রাস্তায় আমাকে হতভম্ব করে ট্যাক্সিটা যখন চলে যাচ্ছে, লক্ষ্য করলাম নম্বরটাও সম্পূর্ণ অচেনা...
ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ঐ ধাঁধার আবর্তগুলো বাস্তব থেকে যেমন কিছু টেনে নিতে পারে, তেমনই আবার হারানো কিছু ফিরিয়েও দিয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানে তার ব্যাখ্যা.... .

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র