বিবাহ কি অবাধ যৌনাচারের বৈধ ছাড়পত্র ?
এবার দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব --
বিবাহ-বিচ্ছেদ : অর্থশাস্ত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের কথা উল্লিখিত হয়েছে । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনের অমিল হলে এবং উভয় পক্ষ রাজি হলে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যেত । স্বামী দুশ্চরিত্র, চিরপ্রবাসী, রাজদ্রোহী বা ক্লীব হলে স্ত্রী তাকে পরিত্যাগ করতে পারত। স্ত্রী যদি পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম হত, তাহলে আট বছর অপেক্ষা করবার পর স্বামী তাকে ত্যাগ করতে পারত । এসব ক্ষেত্রে স্ত্রী ভরণপোষণ দাবি করতে পারত । হিন্দু বিবাহ বিধিতে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করা চলতে পারে এবং উপযুক্ত কারণ দেখাতে পারলে আদালত তা মঞ্জুর করতে পারে। কিন্তু বিবাহ হবার পর থেকে তিন বছরের মধ্যে এই আবেদন করা চলবে না। নিম্নলিখিত কারণগুলি উপযুক্ত কারণ হিসেবে গণ্য করা হবে : হিন্দু বিবাহ আইনের ফলে কোনো পুরুষ স্ত্রীর জীবদ্দশায় অথবা বিবাহ বিচ্ছেদের আগে অন্য বিয়ে করতে পারেন না। তবে এই আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী যে-কোনো হিন্দু বিবাহই এই কারণগুলির জন্য বাতিল করা যেতে পারে – (১) যেখানে স্বামী হীনবল, পুরুষত্বহীন অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে ইম্পোটেন্ট।(২) যেখানে স্ত্রী বিয়ের আগেই অন্য কারোর ঔরসে গর্ভবতী হয়েছেন। (৩) যেখানে পাত্র বা পাত্রীর অনুমতি ছাড়া বিয়ে হয়, অথবা ২১ বছরের নীচে পাত্র এবং ১৮ বছরের নীচে পাত্রীর অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে হয়। ছলনা, প্রতারণা বা প্ররোচনা করে যেখানে বিয়ে হয়। (৩) যেখানে বিয়ে হিন্দু বিবাহ আইনের পঞ্চম ধারা অর্থাৎ ‘প্রোহিবিটেড ডিগ্রিজ’-এর বাধা লঙ্ঘন করে হয়। ‘প্রোহিবিটেড ডিগ্রিজ’, অর্থাৎ যে বৈবাহিক সম্পর্ক খুব নিকট আত্মীয়, ব্লাড রিলেশনসদের মধ্যে হয়, তা বাতিল করানো সম্ভব।
বিয়ে বাতিল যদি করাতে হয় তাহলে তার জন্য দরখাস্ত বা আবেদন করতে হবে ছলনা বা প্রতারণা আবিষ্কৃত হওয়ার এক বছরের মধ্যে, অথবা সেই প্রভাব বর্তমান থাকাকালীন সময়ে। আদালত এই আবেদন গ্রাহ্য করবেন যদি বিয়ের আগে আবেদনকারী এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল না হয়ে থাকেন এবং সেই আবেদন বিয়ের এক বছরের মধ্যে উপস্থাপন করা হয় এবং ওই প্রতারণা সম্পর্কে জানার পর যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো যৌন সম্পর্ক না হয়ে থাকে।অপরদিকে হিন্দু বিবাহ আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী যে-কোনো বিয়ে ওই আইন প্রবর্তিত হওয়ার আগে বা পরে যখনই সম্পন্ন হোক না-কেন এই কারণগুলির জন্য বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্য আবেদন করা যায় – (১) বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পরে স্ত্রী বা স্বামী নিজের সঙ্গী বা সঙ্গিনী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ বা মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হলে। (২) বিবাহের পর অত্যন্ত নিষ্ঠুর ব্যবহার করলে।(৩) আবেদন পেশ করার আগে আবেদনকারীকে যদি ২ বছর ধরে তাঁর স্বামী বা স্ত্রী ত্যাগ করে থাকেন। (৪) স্বামী বা স্ত্রীর মস্তিষ্ক বিকৃতির ফলে তাঁর সঙ্গে আবেদনকারীর জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে উঠলে। মস্তিষ্কের বিকারের মধ্যে নানান মানসিক ব্যাধি, অপরিণত বুদ্ধি। (৫) মানসিক অসুস্থতা বা অপূর্ণতা বোঝায়। (৬) স্বামী বা স্ত্রী কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত হলে। (৭) স্বামী বা স্ত্রী সংক্রামক যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হলে। (৮) স্বামী বা স্ত্রী সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করলে। (৯) ৭ বছর তাঁর কোনো সন্ধান না পেলে।
উপরের কারণগুলি ছাড়াও যেখানে আইন অনুমোদিত বিচ্ছেদের (জুডিশিয়াল সেপারেশন) ডিক্রি জারি হওয়ার পরই স্বাভাবিক বিবাহিত জীবন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় না অথবা সে ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ আবেদন করা সম্ভব। আবার স্বামী যদি বিয়ের পর বলাৎকার বা ধর্ষণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন, অথবা অন্য পুরুষের সঙ্গে ‘অস্বাভাবিক’ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন এবং তা প্রমাণিত হয়, সেক্ষেত্রেও স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা রজু করতে পারেন।
হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টের ২৪ ধারা অনুযায়ী ইন্টেরিম অ্যালিমনি বা অন্তর্বর্তীকালীন খোরপোশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাৎ যতদিন বিবাহ বিচ্ছেদ মামলা চলবে, ততদিন স্ত্রীর খোরপোশের জন্য টাকার কী ব্যবস্থা হবে তা আদালত দুই পক্ষের অবস্থা বুঝে নির্ধারণ করবেন। বাদী ও প্রতিবাদীর আর্থিক সংগতির বিবেচনা করে আদালত মামলার খরচের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় আদালত পাকাপাকি খোরপোশ অর্থাৎ পারমানেন্ট খোরপোশের ব্যবস্থা করে।
ইসলামী বিবাহরীতি : ভারতবর্ষে মুসলিম আইন সৃষ্টি হয়েছে মূলত কোরানের নির্দেশ থেকে (তবে নির্দেশগুলি সংশোধিত হয়েছে বিধানসভা ও লোকসভায় গৃহীত বিল এবং কোর্টের বিভিন্ন রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে)। মুসলিম আইন (শরিয়ত) অনুসারে বিবাহ বা নিকা হল পরস্পরের উপভোগের জন্য এবং বৈধ সন্তান উত্পাদনের জন্য স্বেচ্ছায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া। ইসলামী বিবাহরীতিতে পাত্র-পাত্রী উভয়েরই সম্মতি এবং বিয়ের সময় উভয়পক্ষের বৈধ অভিভাবক বা ওয়ালির উপস্থিতি ও সম্মতির প্রয়োজন। ইসলামী বিবাহে দহেজ বা যৌতুকের কোনো স্থান নেই। বিয়ের আগে পাত্রের পক্ষ থেকে পাত্রীকে পাত্রীর দাবি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা বা অর্থসম্পদ বাধ্যতামূলক ও আবশ্যকভাবে দিতে হয়, একে দেনমোহর বলা হয়। এছাড়া বিয়ের পর তা পরিবার পরিজন ও পরিচিত ব্যক্তিবর্গকে জানিয়ে দেওয়াও ইসলামী করণীয়গুলির অন্তর্ভূক্ত। ইসলামে বিবাহ-পূর্ব ও বিবাহ-বহির্ভূত যৌনতা নিষিদ্ধ। ইসলাম ধর্মে বিয়ের মাধ্যমে শুধুমাত্র নারী ও পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্কের অনুমতি আছে। সমকামিতা ও সমকামী বিয়ে উভয়েই প্রকৃতিবিরুদ্ধ ও বিকৃত যৌনাচার হিসাবে ইসলামে অবৈধ ও নিষিদ্ধ|
বিবাহের বিধান : ইসলামী বিধান অনুযায়ী, একজন পুরুষ সকল স্ত্রীকে সমান অধিকার প্রদানের তার চাহিদা অনুসারে সর্বোচ্চ চারটি বিয়ে (এক স্ত্রীর বর্তমানে আর-একটি বা একাধিক বিবাহ করাকে বহু বিবাহ বলে। ইসলামী আইনে বলা হয়েছে, কেউ যখন বস্তুগত দিক দিয়ে এবং স্নেহ ভালবাসার দিক দিয়ে প্রত্যেক স্ত্রীর সঙ্গে সমান আচরণ করতে পারবে কেবলমাত্র তখনই সে চারটি পর্যন্ত বিবাহ করতে পারবে। তবে বাস্তবে এটা কখনও সম্ভব নয়। কারণ যে স্বামী নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসে তার দ্বিতীয় বিবাহ করার ইচ্ছেই হবে না। কাজেই পবিত্র কোরান শরিফে বহু বিবাহকে অনুমতি দেওয়ার চেয়ে একটি বিবাহ করাই উত্তম বলে উল্লেখ করেছে। যদিও মুসলিম সমাজে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের আইনগত অধিকার স্বামীদের থাকলেও নারীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধান নেই। বহুবিবাহের আর্থসামাজিক বাস্তবতা ইসলামে বহুবিবাহের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে ইসলাম আবির্ভাবের প্রথমদিকে একটি ভিন্ন আর্থসামাজিক ও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক বাস্তবতায়। মূলত বিধবা, এতিমদের নিরাপত্তা ও রক্ষার জন্য ইসলামে এ ধরনের প্রতিকারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেই সময়কার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওহুদের যুদ্ধে বহু মুসলিম পুরুষ শাহাদত বরণ করেন, ফলে স্বাভাবিকভাবে অভিভাবক ও স্বামীহীন নারীরা চরম নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে। এসব নারীদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তার জন্য বহুবিবাহ প্রথা চালু হয়।) করতে পারে। আর সমান অধিকার দিতে অপারগ হলে শুধু একটি বিয়ে করার অনুমতি পাবে। মেয়েদের ক্ষেত্রে একাধিক বিয়ের অনুমতি নেই। একজন মুসলিম পুরুষ মুসলিম নারীর পাশাপাশি ইহুদি কিংবা খ্রিস্টান নারীকে বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু মুসলিম নারীরা শুধু মুসলিম পুরুষের সঙ্গেই বিয়েতে আবদ্ধ হতে পারবে। ইসলামে বিবাহ বাধ্যতামূলক বা ফরজ নয়, এটি একটি নবির সুন্নত। একজন মুসলমান চাইলে বিয়ে না-করে সে সারাজীবন একা একা থাকতে পারবে। তবে প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাবলম্বী মুসলমানকে বিবাহ করায় উৎসাহিত করে ইসলাম।
ইসলাম ধর্মে বিবাহ হল বিবাহযোগ্য দুজন নারী ও পুরুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক প্রণয়নের বৈধ আইনি চুক্তি। ইসলাম ধর্মে পাত্রী তার নিজের ইচ্ছানুযায়ী বিয়েতে মত বা অমত দিতে পারে। একটি আনুষ্ঠানিক এবং দৃঢ় বৈবাহিক চুক্তিকে ইসলামে বিবাহ হিসাবে গণ্য করা হয়, যা পাত্র ও পাত্রীর পারষ্পারিক অধিকার ও কর্তব্যের সীমারেখা নির্ধারণ করে। বিয়েতে অবশ্যই দুজন মুসলিম সাক্ষী উপস্থিত থাকতে হবে।
চুক্তিভিত্তিক বিবাহ : চুক্তিভিত্তিক বিবাহ পদ্ধতিতে কনে বর ও কনের পরিবারের মধ্যে বিয়ে ও বৈবাহিক রীতিনীতির ব্যাপারে বহুবিধ চুক্তি হত। যেমন মেয়েরা একই ধর্মের হলেও নিজ গোত্র ব্যতীত বিয়ে করতে পারবে না, সন্তান জন্মের পর কনের পিতৃগৃহে প্রতিপালনের জন্য প্রেরিত হবে প্রভৃতি।
যুদ্ধবন্দি বিবাহ : যুদ্ধবন্দি বিবাহ পদ্ধতিতে গোত্রে গোত্রে সংঘটিত লড়াই বা যুদ্ধে এক গোত্র অপর গোত্রের মেয়েদের বন্দি করে নিজেদের বাজারে নিয়ে আসত এবং তাদেরকে স্ত্রী বা দাসী হিসাবে বিক্রি করা হত।
যৌতুকের বিবাহ : যৌতুকের বিবাহ পদ্ধতিতে বিয়ের সময় কনেপক্ষ বরপক্ষকে যৌতুক প্রদান করত।
উত্তরাধিকার সূত্রে বিবাহ : উত্তরাধিকার সূত্রে বিবাহ পদ্ধতিতে পিতার মৃত্যুর পর পুত্র তার মাকে বিয়ে করতে পারত।
ইসলাম আগমনের পর বৈবাহিক প্রক্রিয়ার পূনর্গঠন : ইসলাম আবির্ভাবের পর নবি প্রচলিত বৈবাহিক রীতির পুনর্গঠন করেন। তিনি চুক্তিভিত্তিক বিবাহ এবং যৌতুকের বিবাহের পুনর্গঠন করে পাত্রীকে মত প্রকাশের অধিকার দেন এবং যৌতুক বা পণ পাত্রীপক্ষ থেকে পাত্রকে দেওয়ার পরিবর্তে পাত্রপক্ষ বা পাত্র থেকে পাত্রীকে পণ দেওয়ার বিধান চালু করেন যাকে দেনমোহর নামে নামকরণ করা হয়। এর পাশাপাশি সম্পত্তি বিবাহ ও বন্দিকরণ বিবাহ চিরস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করেন। কোরানের অনেক আদেশ-নিষেধ সম্পর্কিত আয়াত তখন এ বিষয়ে নাজিল হয়।
শর্ত : ইসলামী বিবাহে বর, কনে এবং কনের অভিভাবকের(ওয়ালি) সম্মতির(কবুল) প্রয়োজন হয়| বৈবাহিক চুক্তিটি অবশ্যই কনের অভিভাবক (ওয়ালি) এবং বরের দ্বারা সম্পাদিত হতে হবে, বর এবং কনের দ্বারা নয়। ওয়ালি সাধারণত কনের পুরুষ অভিভাবক হন, প্রাথমিকভাবে কনের বাবাকেই ওয়ালি হিসাবে গণ্য করা হয়। মুসলিম বিয়েতে ওয়ালিকেও অবশ্যই একজন মুসলিম হতে হবে। বৈবাহিক চুক্তির সময় চাইলে কনেও সে স্থানে উপস্থিত থাকতে পারে, তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। বিয়ের পর ঘোষণা করে বা অন্য যে-কোনো পন্থায় সামাজিকভাবে তা জানিয়ে দিতে হবে, যাকে "এলান করা" বলা হয়।
রক্তসম্পর্কের ভিত্তিতে বিবাহে নিষেধাজ্ঞা : পুরুষের জন্য : মা, সৎ মা, বোন, সৎ বোন, দাদি (দিদিমা), বড়োদাদি এবং তাদের মাতৃসম্পর্কের পূর্বসূরী নারীগণ; নানি (ঠাকুরমা), বড়োনানি এবং তাদের মাতৃসম্পর্কের পূর্বসূরীগণ; কন্যা সন্তান, নাতনি, নাতনীর কন্যাসন্তান এবং জন্মসূত্রে পরবর্তী প্রজন্মসমূহের নারীগুণ (উদাহরণ -- নাতনীর কন্যার কন্যা ও তার কন্যা ইত্যাদি); ফুফু (পিসি), খালা (মাসি), সৎ মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়ে, দুধ-মা (কোন পুরুষ-সন্তান জন্মের প্রথম দু-বছরের মধ্যে আপন মা ছাড়া রক্ত সম্পর্কের বাইরে যদি কোনো মহিলার স্তন্যদুগ্ধ পান করে থাকে তবে তাকে ওই ছেলে সন্তানের দুধ-মাতা বলা হয়। বিবাহের ক্ষেত্রে আপন মায়ের মতো ওই মহিলার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। তাই একজন পুরুষের জন্য তার দুধ-মাতার সঙ্গে এবং দুধ-মাতার বোন ও মেয়ের সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ।), দুধ-বোন দুধ-মায়ের বোন, আপন পুত্রের স্ত্রী, শাশুড়ি, সমলিঙ্গের সকল ব্যক্তি অর্থাৎ সকল পুরুষ। নারীর জন্যেও বিপরীতভাবে লিঙ্গীয় বিবেচনায় উপরোক্ত একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
মুসলিম বিবাহ বাতিল এবং বিচ্ছেদ : মুসলিম বিবাহ আইনে অনেক অবৈধ বিবাহ বৈধ হয়ে যায় যখন অবৈধতার কারণ লুপ্ত হয়। যেমন, চারটি স্ত্রী বর্তমান থাকলেও কেউ যদি আবার বিবাহ করে, তাহলে সেই বিবাহ অবৈধ (আয়াত-৩, সুরা- নিসা)। কিন্তু সে যদি একজন স্ত্রীকে তালাক দেয় (বা পরিত্যাগ করে), তাহলে তার অবৈধ বিবাহটি বৈধ হয়ে যায়। কোনো নারীর ইদ্দতের সময়কালে তাকে বিবাহ করলে সেই বিবাহ অবৈধ, আবার ইদ্দতের সময়ে পার হয়ে গেলেই সেটি বৈধ বলে গণ্য হবে। [ইদ্দত: স্বামীর মৃত্যুর পর বা বিবাহ-বিচ্ছেদের পর মুসলিম নারী যে সময়ের জন্য (মোটামুটিভাবে তিনমাস বা তার অধিক) একা থাকে]। সুন্নি পুরুষ যদি কোনো মুসলিম নারী বা কিতাবিয়াকে [অর্থাৎ, যে ধর্মে ঈশ্বরপ্রদত্ত বাণী পুস্তকাকারে (বাইবেল, কোরান, ইত্যাদি) আছে - সেই ধর্মাবলম্বীকে] বিবাহ করে, তাহলে সুন্নি আইন অনুসারে সেটি বৈধ হবে। কিন্তু যে ধর্মে পৌত্তলিকতা আছে (যেমন, হিন্দু ধর্ম), সেই ধর্মাবলম্বী নারীকে বিবাহ করতে পারে না। করলে সেটিকে নিয়ম বহির্ভূত বা অনিয়মিত বলে গণ্য করা হবে। শিয়া আইনে এটি শুধু অনিয়মিত নয়, এটি হবে অবৈধ। সুন্নি ও শিয়া -- কোনো আইনেই মুসলিম নারী কোনো অমুসলিম পুরুষকে (সে কিতাবিয়া হলেও) বৈধভাবে বিবাহ করতে পারে না। সুন্নি আইন অনুসারে সেটি হবে নিয়ম বহির্ভূত বিবাহ। শিয়া আইন অনুসারে সেটি হবে অবৈধ। যদিও কোরান ও হাদিসে এ বিষয়ে সমর্থন নেই, তবুও অন্যান্য চুক্তির মত বিবাহ চুক্তিও যাতে ভঙ্গ করা যায়, তার ব্যবস্থা ভারতবর্ষের মুসলিম আইনে রয়েছে। “The Dissolution of Muslim Marriage Act, 1939” অনুসারে মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে নারীর পক্ষে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আদালতে যাবার কয়েকটি শর্ত আছে – (১) চার বছর যাবৎ স্বামী নিখোঁজ হলে, (২) দুই বছর যাবৎ স্বামী তাকে অবহেলা করছে বা ভরণপোষণ দেয়নি, (৩) স্বামী সাত বছর বা তার চেয়ে বেশি কালের জন্য কারাদণ্ড পেয়েছে, (৪) তিন বছর যাবৎ কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া দাম্পত্য কর্তব্য করেনি, (৫) দুই বছর যাবৎ স্বামীর মাথা খারাপ কিংবা কুষ্ঠরোগগ্রস্ত বা দুরারোগ্য যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত, (৬) বিবাহের সময় স্বামী অক্ষম ছিল এবং এখনও অক্ষম আছে, (৭) ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগে যে বিবাহ হয়েছিল, ১৮ বছর বয়সের আগেই সে বিবাহকে স্বামী অস্বীকার করেছে এবং দাম্পত্য সম্পর্ক ঘটেনি, (৮) স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করছে, যেমন-- তাকে প্রহার করছে বা মানসিকভাবে নিপীড়ন করছে, স্ত্রীকে জোর করে অসামাজিক অবৈধ জীবনযাপন করতে বাধ্য করছে, ধর্মীয় আচরণে হস্তক্ষেপ করছে, স্ত্রীর আইনসংগত অধিকারে বাধা দিচ্ছে, কোরানের অনুশাসন অনুযায়ী সকল স্ত্রীদের সঙ্গে সম-আচরণ করছে না ইত্যাদি।
পুরুষদের ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের একক ইচ্ছার আইন আছে। যে-কোনো পুরুষ তিনবার তালাক উচ্চারণ করে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে পারে। যার উদ্দেশে তালাক দেওয়া হল, সে সেখানে না-থাকলেও এই বিচ্ছেদ স্বীকৃতি পাবে। তবে তালাক দেওয়া স্ত্রীকে সেই পুরুষ আবার বিবাহ করতে পারবে না। তালাকপ্রাপ্তা সেই মুসলিম নারী যদি অন্য কোনো পুরুষকে বিবাহ করে এবং সেই বিবাহ ভেঙে যায়, তখনই আবার তাকে বিবাহ করা যাবে। শরিয়ত আইনে স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দেওয়া হয়েছে দুটি ক্ষেত্রে। এক হল জিহার, অর্থাৎ স্বামী যদি নিষিদ্ধ সম্পর্কের কোনো স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয় এবং তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি না হয়। সেক্ষেত্রে স্ত্রী আবেদন করলে আদালত বিবাহ বিচ্ছেদের আদেশ দেবে। স্ত্রী স্বামীকে মুক্তিমূল্য (স্বামীর শর্ত অনুযায়ী ‘খুলা’) দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ করিয়ে নিতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের সন্মতিতেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, একে বলা হয় ‘মুবারাত’।
ভারতে মোহম্মদ আহমেদ খান ও শাহবানু মামলায় সুপ্রিমকোর্ট রায় দিয়েছিল যে, বিবাহ বিচ্ছেদের পরে যদি মুসলিম নারী যদি নিজের ভরণপোষণ চালাতে পারে, তবে পুরুষের দায়িত্ব ইদ্দতের (ইদ্দতকাল হল বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনটি ঋতুকালের পর্যন্ত আর যদি ঋতুর অবস্থা না থাকে তাহলে তিনটি চান্দ্রমাস পর্যন্ত।) পরেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সেই নারী যদি নিজের ভরণপোষণ চালাতে সক্ষম না-হয়, তাহলে ক্রিমিনাল কোডের ১২৫ ধারা অনুযায়ী তার ভরণপোষণের দায়িত্ব প্রাক্তন স্বামীর থাকবে । এরপর মুসলিম স্বামীদের প্রাক্তন স্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে নানান বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয়। মুসলিম নারী (বিবাহ বিচ্ছেদের পর অধিকার রক্ষা আইন), ১৯৮৬ পাশ করানো হয় সুপ্রিমকোর্টের এই রায়ের প্রযোজ্যতা সীমিত করার জন্য। সাধারণভাবে ফৌজদারি আইনের ১২৫ ধারা মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, যদি-না সেই নারী ও তার প্রাক্তন স্বামী যৌথভাবে বা আলাদা ভাবে কোর্টে ঘোষণা করে বা স্বীকৃতি দেয় যে তারা ফৌজদারী আইনের ১২৫ থেকে ১২৮ ধারা মেনে চলবে। প্রসঙ্গত ১২৫ ধারার প্রযোজ্যতা সম্পর্কে বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি। কলকাতা হাইকোর্ট ২০০১ সালে রায় দিয়েছে যে, মুসলিম মেয়েদের ১২৫ ধারায় আবেদনের পথ খোলাই রয়েছে, কারণ ১২৫ ধারা একটি ধর্ম নিরপেক্ষ আইন। তাঁরা ইচ্ছে করলে এই আইনের সুযোগ নিতে পারবেন। ১২৫ ধারা বেশ কঠোর আইন। এই ধারায় টাকা দেওয়ার আদেশ দেওয়া হলে, সেই টাকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে না দিলে, ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ারেন্ট জারি করতে পারবে। সময়মত টাকা না-দিলে একমাসের বা যতদিন টাকা না-দেওয়া হচ্ছে ততদিন কারাদণ্ডের আদেশ দিতে পারবে।
তালাক : ‘তালাক’ শব্দের অর্থ ‘বিচ্ছিন্ন’, ‘ত্যাগ করা’ ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মে আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদকে ‘তালাক’ বলা হয়। স্বামী সর্বাবস্থায় তালাক দিতে পারেন। স্ত্রী শুধুমাত্র তখনই তালাক দিতে পারবেন, যদি বিয়ের সময় এর লিখিত অনুমতি দেওয়া হয়। মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে -- "কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে তাহকে মুসলিম আইনে অনুমোদিত যে-কোনো পদ্ধতিতে ঘোষণার পরই তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন এ মর্মে চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে নোটিশ প্রদান করবেন এবং স্ত্রীকেও সেগুলির নকল দেবেন" অর্থাৎ তালাক প্রদান বা ঘোষণার ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়তের প্রবর্তিত পদ্ধতিই হচ্ছে মুসলিম পারিবারিক আইনের পদ্ধতি। তাই শরিয়ত প্রবর্তিত তালাক সংক্রান্ত বিধানাবলি ভালোভাবে জানা ও বোঝা খুবই জরুরি। বিশেষ করে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
তালাকের উদ্দেশ্য : তালাক দেওয়ার উদ্দেশ্য হল অন্যায়, জুলুম ও নিদারুণ কষ্ট, জ্বালাতন ও উৎপীড়ন ইত্যাদি অশান্তি থেকে মুক্তি লাভ করা। প্রকৃতপক্ষে ইসলামে তালাক প্রদানের যে উদ্দেশ্য তা হল স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে যে সমস্ত অশান্তি সৃষ্টিকারী কারণগুলি আছে তা সংশোধনের চেষ্টা করা। তালাক শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নবি তালাক সম্পর্কে বলেছেন, তালাক অপেক্ষা ঘৃণার জিনিস আল্লাহ তায়ালা আর সৃষ্টি করেননি। হজরত আলি বর্ণিত বাণী হল : তোমরা বিয়ে করো, কিন্তু তালাক দিয়ো না। কেন-না, তালাক দিলে আল্লাহর আরশ (সিংহাসন) কেঁপে উঠে।
পদ্ধতিগত দিক দিয়ে তালাক তিন প্রকার : (ক) আহসান বা সর্বোত্তম তালাক (তালাকে হাসানা তাকে বলে, যে তুহুরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহবাস, জায়েজ অবস্থা কিংবা গর্ভাবস্থা নেই। উল্লেখিত অবস্থাসমূহ নেই এমন তুহুর অবস্থায় শুধু মাত্র এক তালাক দিয়ে ইদ্দত পূর্ণ হতে দেওয়া। অর্থাৎ তিন তুহুর অতিক্রম করলে তালাকটি কার্যকর হয়ে যায়। এমতাবস্থায় স্ত্রী ইচ্ছা করলে অন্য যে-কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে কিংবা তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী ইচ্ছা করলে এবং স্বামী চাইলে তারা পুনঃবিবাহে আবদ্ধ হতে পারে। এই ধরনের তালককে বলা হয় তালাকে আহসান।) ; (খ) হাসান বা উত্তম তালাক (হাসান তালাক হল প্রত্যেক তুহুরে একটি করে তালাক দেবে। এই নিয়মে তিন তুহুরে তিন তালাক দেওয়ার নিয়মকে তালাকে হাসান বলে। তালাকে হাসান দিলে অর্থাৎ তিন তুহুরে তিন তালাক দিলে সেই স্ত্রী তার স্বামীর জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যাবে। সে তার স্বামীর নিকট রেজাত বা পুনঃবিবাহে আসতে পারবে না। তবে স্ত্রীর যদি অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হয় এবং দ্বিতীয় স্বামী যদি কোনো দৈবাৎ কারণে তালাক দেয় অথবা মৃত্যুবরণ করে, তবে ইচ্ছা করলে পূর্বের স্বামীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।) এবং (গ) বিদই বা শরিয়া বিরূদ্ধ তালাক (বিদই বা বিদায়াত তালাক হল কোনো ব্যক্তি একসঙ্গে তিন তালাক দিয়ে দেওয়া বা হায়েজ অবস্থায় তিন তালাক দেওয়া অথবা যে তুহুরে সহবাস করেছে সেই তুহুরে তিন তালাক দেওয়া। উল্লেখিত যে-কোনো প্রকারে তালাক দেওয়া হোক না-কেন তালাকদাতা গুনাহগার হবে গর্ভাবস্থা প্রকাশ পাইনি এমন সন্দেহজনক অবস্থায় তিন তালাক প্রদান করাও বিদায়াত বা হারাম। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ তালাক অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইন অথবা শরিয়ত প্রবর্তিত পদ্ধতি কোনোটাই অনুসরণ করা হচ্ছে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে চেয়ারম্যান, মেম্বার বা কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তি তালাকের নোটিশ সই বা স্বাক্ষর করলেই তালাক হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তারা তালাকের ঘোষণা দেন না, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় তালাকের নোটিশে লেখা হয় এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক ও বাইন তালাক। এমন ধরনের তালাক প্রকাশ্য তালাকে বিদয়ীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং যারা এ ধরনের তালাক অনুষ্ঠিত করে থাকেন তারা সবাই গুনাহগার হবেন।)
ক্ষমতা বা এখতিয়ার গত দিক দিয়ে তালাক পাঁচ প্রকার : (১) তালাকে সুন্নাত (২) তালাকে বাদী (৩) তালাকে তাফবিজ (৪) তালাকে মোবারত ও (৫) খোলা তালাক। কার্যকর হওয়ার দিক দিয়ে তালাক প্রধানত দুই প্রকার : (১) তালাকে রেজি ও (২) তালাকে বাইন। তালাকে বাইন আবার দুই প্রকার : (১) বাইনে সগির এবং (২) বাইনে কবির। মর্যাদা ও অবস্থানের দিক থেকে তালাক চার প্রকার : (১) হারাম (২) মাকরুহ (৩) মুস্তাহাব এবং (৪) ওয়াজিব।বিস্তারিত আলোচনা থেকে বিরত থাকলাম কলেবর বৃদ্ধির আতঙ্কে।
তালাকের পর পুনর্বিবাহ : তালাকের পর স্বামী ও স্ত্র্রী পুনর্বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে তবে তা শর্তসাপেক্ষ। শর্তটি এই যে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে অন্য কারো সঙ্গে শরিয়া অনুসরণপূর্বক যথাযথভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে এবং নতুন স্বামী তালাক প্রদানের পর আগের স্বামীর সঙ্গে পুনর্বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। এই শর্তটি কঠিন, কারণ ইসলাম সামান্য অজুহাতে বা রাগের মাথায় উত্তেজনাবশত তালাক দেওয়ার বিপক্ষে।
কোরানের ৬৬৬৬ টি আয়াতের মধ্যে প্রায় ২০০টি আয়াতে মুসলিম আইনের সাধারণ নীতিমালার বর্ণনা আছে। কোরানে উত্তরাধিকার, বিবাহ, তালাক, দেনমোহর, ভরণপোষণ, হিবা, এতিমের মাল রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি সম্পর্কিত আইন এবং জুয়াখেলা, সুদ গ্রহণ, নরহত্যা ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত আইন প্রায় ৮০টি আয়াতে লিপিবদ্ধ আছে।
খ্রিস্টান বিবাহ : খ্রিস্টান বিয়ে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং একটি পবিত্র চুক্তি। খ্রিস্টান বিয়ে লিখিত মাধ্যমে সম্পাদিত হয় এবং রেজিষ্ট্রি বাধ্যতামূলকভাবে করতে হয়। খ্রিস্টান বিয়ের ক্ষেত্রে যিনি বিয়ে সম্পাদন করবেন তিনিই বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করবেন। খ্রিস্টান বিবাহ আইন ১৮৭২, বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন ১৮৬৯ এবং উত্তরাধিকার আইন ১৯২৫ সমন্বয়ে সংকলিত আইনবিধান। এ আইন দ্বারা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ ও উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রিত হয়। “The law regulating solemnisation of marriages among Indian Christians is laid down in the Indian Christian Marriage Act of 1872. It was the British-Indian administration that enacted the law.The Indian Christian Marriage Act of 1872 extends to the whole of India except the territories which, immediately before the 1st November, 1956, were comprised in the State of Travancore-Cochin, Manipur and Jammu and Kashmir. Therefore this Act does not apply to marriages of Christians solemnised in the territories of the former States of Travancore and Cochin which now form part of Kerala and Tamil Nadu. However, civil marriages among Christians in the former State of Cochin are governed by the provisions of the Cochin Christian Civil Marriage Act (Act V of 1095 M.E = 1920 A.D). There is no statute regulating solemnisation of marriages among Christians in Jammu and Kashmir and Manipur. It is the customary law or personal law that prevails there. It is specifically provided under section 4 of the Act that every marriage in India between persons, one or both of whom is or are a Christian or Christians, shall be solemnised in accordance with the provisions of the Indian Christian Marriage Act and any such marriage solemnised otherwise than in accordance with such provisions shall be void.”( Indian Christian Marriage Act, 1872)
খ্রিস্টান নাগরিকদের বিবাহ খ্রিস্টান বিবাহ আইন ১৮৭২-এর বিধান মোতাবেক সম্পন্ন হয়ে থাকে। বিবাহে পাত্রপাত্রীর একজন বা উভয়ে খ্রিস্টান হলে তাদের বিবাহে এমন এক ব্যক্তি পৌরোহিত্য করেন, যিনি বিশপের দীক্ষা পেয়েছেন কিংবা যিনি স্কটিশ চার্চের একজন যাজক বা এ আইনের আওতায় অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো ধর্মযাজক। কোনো বিবাহ-নিবন্ধক বা এ আইনের আওতায় নিযুক্ত/লাইসেন্সপ্রাপ্ত অপর কোনো ব্যক্তির উপস্থিতিতে বিবাহ সম্পন্ন হতে হবে। বিবাহে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে কোনো ধর্মযাজকের নিকট উপস্থিত হয়ে এ মর্মে ঘোষণা দিতে হয় যে, এ বিবাহে তার অর্থাৎ পাত্রপাত্রীর কোনো জ্ঞাতিগত, কিংবা অন্য কোনো আইনগত প্রতিবন্ধকতা নেই এবং যুগপৎ তাকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদিসহ ধর্মযাজকের কাছে একটি নোটিশও দিতে হয়। ধর্মযাজক এরপর নোটিশ প্রাপ্তি সম্পর্কে একটি প্রত্যয়নপত্র দেন। এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র প্রদানের পর প্রত্যয়নপত্রে উল্লিখিত পাত্রপাত্রীর বিবাহ দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে ধর্মযাজক কর্তৃক যথার্থ বিবেচিত রীতি বা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে পারে। দেশীয় খ্রিস্টান ব্যতিরেকে ধর্মযাজক কর্তৃক সম্পাদিত অন্য সকলের বিবাহের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। অন্ততপক্ষে দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে নোটিশ প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা পালন করে বিবাহ-নিবন্ধক খ্রিস্টান বিবাহ সম্পন্ন করতে পারেন। বিবাহ-নিবন্ধক নাবালক পাত্রপাত্রীর (দুজনের একজন সাবালক হলেও) তাদের অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া বিবাহ সম্পাদন করতে পারেন না। যাজক বা ধর্মযাজক বা বিবাহ-নিবন্ধক কর্তৃক সম্পন্ন দেশীয় খ্রিস্টানদের বিবাহ আলাদাভাবে নিবন্ধন বহিতে নিবন্ধিত হয়ে থাকে। দেশীয় খ্রিস্টানদের বিবাহের একটি বয়ঃসীমা রয়েছে। অধিকন্তু, কোনো দেশীয় খ্রিস্টানের স্বামী/স্ত্রী জীবিত থাকলে ওই ব্যক্তি অপর কোনো দেশীয় খ্রিস্টানকে বিবাহ করতে পারে না।
বিবাহ-বিচ্ছেদ আদালতের ডিক্রি ছাড়া বিবাহিত নারী পুরুষের কোনো এক পক্ষের ঘোষণা অথবা উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে খ্রিস্টানদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো যায় না। আদালতের ডিক্রিবলে খ্রিস্টান বিবাহ-বিচ্ছেদের বিধান ১৮৬৯ সালের বিবাহ-বিচ্ছেদ আইনের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ আইনের আওতায় স্ত্রী ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী এ কারণ দর্শিয়ে স্বামী আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন দাখিল করতে পারে। অনুরূপভাবে, স্ত্রী উল্লিখিত দুই আদালতের যে-কোনো একটির কাছে নিম্নোক্ত যে-কোনো কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন পেশ করতে পারে -- (১) স্বামী আর-এক জনকে বিবাহ করলে ও ব্যভিচারে অপরাধী হলে, (২) স্বামী ব্যভিচারে অপরাধী হলে, (৩) স্বামী ব্যভিচার সহ দ্বিতীয় বিবাহ করলে, (৪) স্বামী ব্যভিচারসহ নিষ্ঠুরতার অপরাধে অপরাধী হলে, (৫) স্বামী ধর্ষণ, পায়ুকাম বা পাশবিকতার অপরাধে অপরাধী হলে, (৬) স্বামী কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া দু-বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় স্ত্রীকে পরিত্যাগ ও সে সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত থাকলে। (৭) স্বামী বিয়ের পর ধর্মান্তরিত হলে এবং আর-এক স্ত্রী গ্রহণ করলে। যদি আদালত এ মর্মে সন্তুষ্ট হন যে অভিযোগ সম্পর্কে প্রদত্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ সঠিক এবং অভিযোগকারীর আবেদন যোগসাজশমূলক নয় অথবা ব্যভিচারের অভিযোগ উপেক্ষাযোগ্য বা মার্জনীয় নয়, তাহলে আদালত বিবাহ-বিচ্ছেদের ডিক্রি মঞ্জুর করেন।
খ্রিস্টীয় বিয়েতে দেশীয় রীতি, কৃষ্টি ও সামাজিক মূল্যবোধ উপলব্ধি করে লোকাচার ও স্ত্রী আচার মিলে একটি নান্দনিক, আনন্দময় ও সুন্দর রূপ দেওয়া হয়েছে।
(১) কনে নির্বাচন : খ্রিস্টান সমাজে সাধারণত প্রথমে পাত্রী দেখা হয়। প্রথমত পাত্রপক্ষই কনে নির্বাচন করে। পাত্রপক্ষ পাত্রী নির্বাচন করে তাঁর চরিত্র, দোষ-গুণ, বংশ পরিচয় জেনে নেয়।
(২) প্রস্তাব : শুভদিন দেখে পাত্রপক্ষ পাত্রীর বাড়ি যায়। সাধারণত পাশের কোনো আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে পাত্রীর বাড়ি যায় এবং তাদের উদ্দেশ্যের কথা জানায়।
(৩) বাগদান : পাত্রপক্ষের প্রস্তাবে পাত্রীপক্ষ রাজি হলে বাগদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কোথাও এ অনুষ্ঠানকে ‘পাকা দেখা’ও বলে। এ অনুষ্ঠানকে ‘পানগাছ’ অনুষ্ঠানও বলে। বাগদান উপলক্ষে পান, সুপারি, বিজোড় সংখ্যক মাছ নিয়ে যাওয়া হয়।
(৪) বাইয়র : এই অনুষ্ঠানে পাত্রপক্ষের লোকজন পাত্রের বাড়িতে যায়। যা আগেই কথা বলে ঠিক করে রাখা হয়। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত পাত্রপাত্রী সবার আশীর্বাদ গ্রহণ করে।
(৫) নাম লেখা : বিয়ের তিন সপ্তাহ আগে পাত্রী বাড়িতে পুরোহিতের কাছে পাত্রপাত্রী নাম লেখান। অনেকে এ অনুষ্ঠানে আতসবাজি ও বাজনার আয়োজন করে।
(৬) বান প্রকাশ : এই অনুষ্ঠানে পাত্রপাত্রী বিয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। মণ্ডলীর বিধি অনুযায়ী এ সময় বিয়ের ক্লাস করতে হয়। এটি বিবাহ-পূর্ব বাধ্যতামূলক ক্লাস ব্যবস্থা।
(৭) অপদেবতার নজর : নাম লেখা থেকে শুরু করে বিয়ের আগ পর্যন্ত পাত্রপাত্রীকে অতি সংযমী জীবন করতে হয়। অনেকে এ সময় ভূত-প্রেত ও অপশক্তির নজর থেকে রক্ষার জন্য ‘রোজারি মালা’ বা ‘জপমালা’ গলায় পরেন।
(৮) কামানি বা গা-ধোয়ানি : বিয়ের আগের রাতের অনুষ্ঠানকে গা-ধোয়ানি বলে। অনেক খ্রিস্টান সমাজে এই দিন গায়ে হলুদ মাখিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠান করা হয়।
(৯) কনে তোলা : বিয়ের দিন ভোরে বাদকদলসহ বরের আত্মীয়-স্বজন কনের বাড়ি গিয়ে পাত্রীকে নিয়ে আসে। পাত্রীকে ঘর থেকে আনার সময় তার হাতে পয়সা দেওয়া হয়। পাত্রী বাড়ি থেকে আসার সময় সেই পয়সা ঘরের মধ্যে ছুড়ে ফেলে। এর অর্থ হল যদিও সে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে, তারপরও বাড়ির লক্ষ্মী ঘর থেকে চলে যাচ্ছে না।
(১০) গির্জার অনুষ্ঠান : শুরুতে গির্জার প্রবেশ পথে যাজক বিয়ের পাত্রপাত্রীকে বরণ করে নেয়।
(১১) ঘরে তোলা : এই অনুষ্ঠানে উঠানের দিকে মুখ করে বড়ো পিঁড়ির উপরে বর-কনেকে দাঁড় করানো হয়। এরপর বর-কনে সাদা-লাল পেড়ে শাড়ির উপর দিয়ে হেঁটে ঘরে ওঠে। এ সময় বর ও কনে একে অপরের কনিষ্ঠ আঙুল ধরে থাকে।
বৌদ্ধ বিবাহ : বৌদ্ধ বিয়ে লোকাচার ও বৌদ্ধ শাস্ত্র অনুযায়ী হয়। প্রথমত পাত্রপাত্রী নির্বাচনের পর সামাজিকভাবে সবাইকে জানিয়ে তারিখ ঠিক করে বৌদ্ধ বিহারে পাত্রপাত্রীকে নিয়ে আসা হয়। এখানে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে বুদ্ধের পুজো করা হয়। ত্রিস্বরণ পঞ্চশীল পুজোর মাধ্যমে বৌদ্ধ ভিক্ষুকের আশীর্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয়। এরপর একজন গৃহী তাদের সামাজিক অনুশাসন প্রদান করে।
পৃথিবীর সব ধর্মের বিবাহ নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয় এই স্বল্প পরিসরে। প্রধান ধর্মাবলম্বী বিবাহ বিষয়ে মোটামুটি একটা রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করলাম মাত্র।
বিবাহ এবং যৌনতা : বিয়ে মানেই যৌনজীবন। এক জোড়া নরনারী বিয়ে করেছেন, অথচ যৌনতা বা যৌনক্রিয়া করেননি এমনটা শোনেনি কেউ। যদি তেমন হয় তা হয় অস্বাভাবিক। একদিনের জন্যেও দাম্পত্য জীবন টিকে থাকবে না। কারণ যৌনতাহীন দাম্পত্য জীবন সোনার পাথরবাটি হয়। তাই যৌনতা নিয়ে আছে কঠোরতা। একজন মুসলমানের কাছে কোরান ও হাদিসের আলোকে যৌন সম্পর্ক শুধু মাত্র একজন বিবাহিত স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই পরিসীমাতে সুস্থ্ যৌন সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।সন্তান ধারণ ছাড়াও যৌনসম্পর্ক একটি সুখী বিবাহিত জীবনে প্রধান ভূমিকা রাখে। হাদিস শরিফে রাসুল মহিলাদের রজঃ থেকে বীর্যস্খলন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এতে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পারস্পারিক ভালোবাসা ও নৈকট্য বাড়ে। পরবর্তী দুইটি আয়াতে স্বামী/স্ত্রীর যৌনসস্পর্কের ব্যাপারে সরাসরি উল্ল্যেখ আছে।"তোমাদের জন্য রমজানে রাত্রে স্ত্রী-সম্ভোগ বৈধ করা হয়েছে............।" (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৭) "লোক রজঃস্রাব সম্পর্কে তোমায় প্রশ্ন করে বল, ‘এটা নাপাকি’, সুতরাং ঋতুমতীর কাছ থেকে দুরে থাক এবং তার সঙ্গে সংগত হোয়ো না। যখন তারা পবিত্র হবে আল্লাহ অনুমোদিত পথে, তখন গমন করিও। (সুরা বাকারা : আয়াত ২২২) মহিলাদের রজঃকালীন সময়ে সংগম না-করার কথা বলা হয়েছে, এতে মহিলাদের কষ্ট হয়।বিবাহের লক্ষ্য হল দুজন ভিন্ন প্রজাতীর মানুষকে পারস্পারিক সঙ্গ উপভোগ ও মৌলিক মানবিক চাহিদা নিবৃত্তি করার জন্য একত্র করা। "এবং তার চিহ্ন সমূহের মধ্যে একটি হল, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গী তৈরি করেছেন যাতে তোমরা শান্তি পাও এবং তোমাদের মাঝে প্রেম ও ক্ষমা রেখেছেন, যারা চিন্তা করে তাদের জন্য এতে চিহ্ন রয়েছে"। (সুরা রুমঃ আয়াত ২১)
একটি সম্পর্ক বিবাহে রূপ দেওয়ার জন্য স্বাভাবিক কারণেই পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ প্রয়োজন। পরস্পরের সন্মতি অথবা ব্যাতিরেকেই যৌনসম্পর্ক স্থাপন করা যায়। বিবাহ বহির্ভূত যৌনসম্পর্ক স্থাপনে মুসলমানদের কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর যেহেতু পারস্পারিক ঘনিষ্ঠতা থেকে বিপরিত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভূত, আর তার থেকে যৌনসম্পর্ক স্থাপিত হয়। মুসলিমদেরকে এর জন্য তাদের আচার-ব্যবহার পোশাক-আশাকে শালীনতা বজায় রাখতে বলা হয়েছে। অবিবাহিত যুবক-যুবতীদেরকে একত্রে নির্জনে একলা সময় কাটাতে নিষেধ করা হয়েছে, যাতে করে অবাঞ্ছিত সমস্যা এড়ানো যায়।বিবাহ বহির্ভুত যৌনসম্পর্কের কুফলের মধ্যে, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, যৌন রোগ, পরিবার বিভাজন, বিবাহ-বিচ্ছেদ ও শারিরীক ও মানসিক বিপর্যস্থতা অন্যতম। ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মেও প্রাকবিবাহ ও বিবাহ-পরবর্তী পরকীয়া অনুৎসাহিত করা হয়েছে এবং পাপ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম অনুসারে কাম (শারীরিক যৌনতার উদ্দেশ্যে কাম) হল ছয়টি ষড়রিপুর একটি, খ্রিস্টধর্মে এটি সাতটি মারাত্মক পাপের মধ্যে একটি পাপ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম ধর্মে অবৈবাহিক (যৌন)কাম নিষিদ্ধ, বৈবাহিক কাম বৈধ এবং বিবাহিত স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কারও দিকে ইচ্ছাকৃতভাবে কামদৃষ্টিতে তাকানো নিষিদ্ধ। কাম বা লাস্য হল শরীরে অনুভূত প্রবল চাহিদা, কামনা ও বাসনার একটি আবেগ বা অনূভূতি। কাম বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন -- যৌনসঙ্গমের জন্য কাম, জ্ঞানের জন্য কাম, শক্তির জন্য কাম, লক্ষ অর্জনের জন্য কাম ইত্যাদি। তবে যৌনসংগমের বাসনা অর্থেই এটি অধিক হারে ব্যবহৃত হয়।আশ্রমের প্রথম ধাপ, ব্রহ্মাচার হচ্ছে কোন বালকের শিক্ষার প্রারম্ভকাল। আধুনিক ভারতীয় ভাষাসমূহে ব্রহ্মাচার বলতে সংযম বোঝায়। শিশুর চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থায় জীবনের কোন আনন্দ বা ভোগসুখের অবকাশ ছিল না, কারণ এগুলি ছিল কাম (প্রেম ও সৌন্দর্যতত্ত্ব) বৈশিষ্ট্যমূলক, এবং আশ্রমের পরবর্তী ধাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আশ্রমের দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে গার্হস্থ্য, অর্থাৎ সাংসারিক দায়িত্ব পালনের স্তররূপে বিবাহ এবং বৈষয়িক বিষয়াদিও এর অন্তর্ভুক্ত। গার্হস্থ্য পর্যায়ে কামের ভূমিকা ব্যাপক। আশ্রমের তৃতীয় ধাপ বানপ্রস্থ হচ্ছে বৈষয়িক বিষয়াদি হতে অবসর গ্রহণ। এ পর্যায়ে যৌনক্রিয়া কিংবা প্রজনন সংগত বিবেচিত হয় না। বাংলাদেশে পরিণত বয়সে সংযম প্রত্যাশিত, সাবালকত্বের তারুণ্যে যৌনতার প্রাচুর্য গ্রহণযোগ্য, এবং নারী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রে মধ্যবয়সে যৌনক্রিয়া, এমনকি অনাচারও প্রত্যাশিত।
বাইবেলে এমন কোনো হিব্রু বা গ্রিক শব্দ নেই যেখানে নির্দিষ্ট করে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কের কথা বলেছে। বাইবেলে ব্যভিচার ও যৌন অনৈতিকতাকে দৃঢ়তার সঙ্গে ‘অন্যায়’ বলে থাকে। তাহলে কি বিয়ের আগে যৌনতা অনৈতিক কাজ বলেই ধরা হবে ? ১ করিন্থীয় ৭:২ পদ অনুসারে এর সুস্পষ্ট উত্তর হচ্ছে -- হ্যাঁ। “কিন্তু চারদিকে অনেক ব্যভিচার হচ্ছে, সেইজন্য প্রত্যেক পুরুষের নিজের স্ত্রী থাকুক এবং প্রত্যেক স্ত্রীর নিজের স্বামী থাকুক।” এই পদে পৌল বিয়েকে যৌন অনৈতিকতার “চিকিৎসা বা রক্ষাকবচ” বলে উল্লেখ করেছেন। ১ করিন্থীয় ৭:২ পদে মূলত বলা হয়েছে, যেহেতু লোকেরা তাদের যৌনতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং তারা বিয়ে ছাড়াই যৌন অনৈতিক কাজ করে বলেই তাদের বিয়ে করা উচিত। তাহলে তারা তো তাদের যৌন উত্তেজনা নৈতিকভাবে প্রশমন করতে পারে। যেহেতু ১ করিন্থীয় ৭:২ পদে সুস্পষ্টভাবে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ককে যৌন অনৈতিকতা বলে উল্লেখ করেছে এবং বাইবেলে বলা অনেক পদে যৌন অনৈতিকতাকে পাপ বলা হয়েছে, সেই অর্থে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কও পাপ বলে ধরা যায়। বাইবেলের সংজ্ঞা অনুসারে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক মূলত যৌন অনৈতিকতার পর্যায়ে পড়ে। বাইবেলে এমন অনেক পদ রয়েছে, যা বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ককে পাপ বলে (প্রেরিত ১৫:২০; ১ করিন্থীয় ৫:১; ৬:১৩, ১৮; ১০:৮; ২ করিন্থীয় ১২:২১; গালাতীয় ৫:১৯; ইফিশীয় ৫:৩; কলশীয় ৩:৫; ১ থিশলনীকীয় ৪:৩; জিহুদা ৭ পদ দ্রষ্টব্য)।
অপরদিকে, প্রায়শই আমরা যৌনসম্পর্ক স্থাপন “আনন্দের” বিষয় বলে মনে করি। কখনও চিন্তা করি না এর ফলে সন্তান জন্ম হওয়ার মতো একটা নেতিবাচক দিক আছে। বিয়ের মধ্য দিয়ে যৌনসম্পর্ক আনন্দের এবং ঈশ্বর এভাবেই তা সাজিয়েছেন। ঈশ্বর চান যেন পুরুষ ও স্ত্রী তাদের বিয়ের গণ্ডির মধ্যে থেকে যৌনানন্দ উপভোগ করে। সলোমনের লেখা পরমগীত এবং বাইবেলের অন্যান্য পদে (হিতোপদেশ ৫:১৯) সুস্পষ্টভাবে যৌনানন্দের কথা বলেছে। যাই হোক, স্বামী-স্ত্রীকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, সন্তান জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ঈশ্বর যৌনতা দিয়েছেন। সেইজন্য, বিয়ের আগে নারী-পুরুষের যৌনমিলন চরমতম ভুল। কারণ তারা তো শুধুমাত্র আনন্দের জন্য এটা করছে এবং পারিবারিক কাঠামোর বাইরে সন্তান জন্ম দিতে সুযোগ নিতে যাচ্ছে, যা তাদের প্রত্যেক সন্তানের জন্য ঈশ্বরের উদ্দেশ্য নয়।
যখন বাস্তবভাবে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল -- তা এভাবে নির্ণয় করা যায় না। তবু বিয়ের আগে যৌনতা সম্পর্কে বাইবেলের উপদেশ মেনে নিলে যৌনরোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকবে না, অবৈধ গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকবে না, বিয়ে ছাড়াই মা হওয়ার সম্ভাবনা এবং অনিচ্ছায় গর্ভ হওয়ারও সম্ভাবনা থাকবে না। তা ছাড়াও, পিতা-মাতা উভয়ের সাহচর্য ছাড়া সন্তানের বেড়ে ওঠার সুযোগ তাদের জীবনে থাকবে না। বিয়ের আগে যৌনতা বর্জন বিষয়ে ঈশ্বরের দেওয়া একমাত্র নীতি হচ্ছে সংযম পালন করা। সংযম পালন করলে জীবন রক্ষা পাবে, বাচ্চারা রক্ষা পাবে, যৌন সম্পর্ক সঠিক মূল্য পাবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঈশ্বরকে সম্মান দেওয়া হবে।
খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, যৌনতা অশ্লীল নয়। যৌনতা ঈশ্বর পরিকল্পিত একটি পথ। ঈশ্বর যেদিন বলেছিলেন, মানুষ আপন স্ত্রীতে আসক্ত হবে এবং তাঁরা একাঙ্গ হবে (আদি পুস্তক ২ অধ্যায় ২৪ পদ)।সেদিনই ঈশ্বর যৌনতাকে অনুমোদন করেছিলেন। ঈশ্বর যা অনুমোদন করেন, যা ঈশ্বরের ইচ্ছার অনুসঙ্গী – তা কখনোই অশ্লীল বা পাপময় হতে পারে না। বাইবেল কখনোই যৌনতাকে অশ্লীল বা নোংরা বলে মনে করেনি। যৌনতা ঈশ্বর প্রদত্ত। তিনটি কারণে ঈশ্বর মানুষের হৃদয়ে এই যৌনতার সৃষ্টি করেছেন। প্রথমত, পুরুষ যেন আপন স্ত্রীতে আসক্ত হয়। আসক্ত হওয়ার অর্থ লেগে থাকা বা সেঁটে থাকা। এদন উদ্যান থেকে বিতাড়নের সময় প্রথম মানবী ইভকে ঈশ্বর অভিশাপরূপে আশীর্বাদ দান করেছিলেন : স্বামীর প্রতি তোমার বাসনা থাকবে (আদি ৩ : ১৬)। এই বাসনাই যৌনতা। বাসনা ব্যতীত সার্থক ‘একাঙ্গতা’ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, স্বামী-স্ত্রী ‘একাঙ্গ’ হবে। যৌনমিলন দ্বারাই এই একাঙ্গতা সম্ভব হয়। নর-নারীর মধ্যে যদি যৌনবোধ না থাকত, তাঁরা যদি পরস্পরের প্রতি আসক্তি অনুভব না করত – তবে স্বামী-স্ত্রীর মিলন আদৌ সম্ভব হত না।আসক্তি এবং একাঙ্গতা শুধুমাত্র বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তৃতীয়ত, ঈশ্বর প্রথম মানব-মানবী আদম-ইভকে সৃষ্টি করার পর তাঁদের আশীর্বাদ করেছিলেন, “তোমরা প্রজাবন্ত এবং বহুবংশ হও”। পরবর্তীকালে ইভকে তিনি বলেছিলেন, “আমি তোমার গর্ভবেদনা অতিশয় বৃদ্ধি করব, তুমি বেদনাতে সন্তান প্রসব করবে” (আদি ৩ : ১৬)। মানব-সৃষ্টি ধারার মধ্য দিয়েই ঈশ্বর সৃষ্টির যে কাজ শুরু করেছিলেন তা অব্যাহত থাকবে।
বিবাহের মাধ্যমে যুবক-যুবতীর কাছে এক অনাস্বাদিত জগতের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। তাঁরা পরস্পর পরস্পরকে আবিষ্কার করে। প্রথম দম্পতি আদম ও ইভ উভয়ে উলঙ্গ থাকত। আর তাঁদের লজ্জাবোধ ছিল না (আদি পুস্তক ২ : ২৫)। বিবাহিত জীবনে উলঙ্গতাই বড়ো কথা। স্বামী-স্ত্রীর জীবন হবে স্বচ্ছ কাঁচের মতো। পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে তাঁরা কোনো কিছুই গোপন করবে না। এই উলঙ্গতা প্রাকবিবাহিত জীবন সম্পর্কে প্রযোজ্য। বাইবেলে ঈশ্বর বিবাহের উদ্দেশ্য বিষয়ে বলেছেন, “মানুষ পিতা-মাতাকে ত্যাগ করে আপন স্ত্রীতে আসক্ত হবে এবং দুজনে একাঙ্গ হবে” (আদি পুস্তক ২ : ২৪)। এই একটি বাক্যের মধ্যে বিবাহের উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়েছে – (১) স্ত্রীর প্রতি আসক্তি এবং (২) দৈহিক মিলন।
বিবাহে কন্যার বয়স বেশি হবে না কম হবে ? পাশ্চাত্য দেশে স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর বয়সের পার্থক্যটা কোনো ব্যাপারই নয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন রাজ্যে স্ত্রীর বয়স স্বামীর বয়সের চেয়ে অনেক বেশিও হয়ে থাকে। অবশ্য বাঙালিদের মধ্যে আত্মীয়স্বজনের যোগাযোগের মাধ্যমে যে বিয়ে সংঘটিত হয় তাতে কন্যার বয়সকে সবসময়ই কম হতে হবে। যৌনতার দিক দিয়ে বিচার করে কোনো কোনো যৌনবিজ্ঞানী অবশ্য স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর বয়স বেশি হওয়াকেই বাঞ্ছনীয় মনে করেন। তাঁদের মতে নারীর যৌনশক্তির চরম বিকাশ হয় ২৪/২৫ বছর বয়সে এবং পুরুষের ক্ষেত্রে সেই বয়স ১৮/২০। অর্থাৎ ২৫ বছরের একটি যুবতীকে চরম তৃপ্তি দিতে হলে ২০ বছরের যুবকের সঙ্গে মিলিত হওয়া দরকার। ৩০ বছরের পর নারীর এবং ২৫ বছরের পর পুরুষের যৌনশক্তি ক্রমশ কমতে থাকবে। পুরুষের বয়স নারীর চেয়ে বেশি হলে উভয়ের যৌনক্ষমতার সামঞ্জস্য রক্ষা করা কোনোদিনই সম্ভব হয় না। নারী যৌন-অতৃপ্তিতে ভোগে।
কেউ কেউ মনে করেন, যৌনতার দিক দিয়ে পুরুষের চেয়ে নারীর বয়স কম হওয়া প্রয়োজন। সাধারণত ৪০/৪৫ বছরের পর নারীর ঋতুচক্র বা পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায় এবং স্থায়ী বন্ধ্যাত্ব আসে। নারীর যৌনকামনা তখন থেকে ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। অথচ পুরুষের জীবনে যৌবন এবং যৌনতাড়না তখনও অটুট থাকে, স্ত্রীর বয়স বেশি হলে মধ্যবয়সে পুরুষরা যৌন-অতৃপ্তিতে ভোগে। স্ত্রীর কাছে যৌনমিলন বিরক্তকর হওয়ায় স্বামীর ডাকে সে সাড়া দিতে রাজি হয় না। যৌনমিলন তখন একটা ‘কর্তব্য’ হয়ে দেখা দিতে পারে। ফলে দুজনের মনেই বিরক্তি এবং অতৃপ্তি বাসা বাঁধে। পরস্পর পরস্পরকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। অচিরেই সংসারে ভাঙন ধরে।
বিয়ের বয়সের কোনো সুনির্দিষ্ট সীমারেখা টানা না গেলেও পুরুষদের ক্ষেত্রে এই সীমা ২৫-৩০ এবং নারীদের ক্ষেত্রে ২০-২৭ হওয়া বাঞ্ছনীয়। ২৫ বছরের আগে পুরুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা এবং পরিপক্বতা আসে না। ৩০ বছরের বেশি হলে বিবাহিত জীবনে সামঞ্জস্য রক্ষা করা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বিবাহের পর সন্তান-সন্ততি হলে তার অবসর গ্রহণের আগেই তাদের স্বাবলম্বী করে যেতে হবে। ২০ বছরের আগে নারীর বিয়ে হলে তার অপরিণত দেহযন্ত্র বহু সন্তানের জন্মদান করে যেমন তার স্বাস্থ্যকে ভগ্ন করবে, তেমনই সংসারের সভ্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে দুঃখ-দারিদ্র্যকে আহ্বান করে আনবে। অপরদিকে ২৭ বছরের পর নারীর দেহযন্ত্রের মধ্যে কাঠিন্য এসে পড়ে। এরপর সন্তান ধারণ করা তার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। বেশি বয়সে বিয়ে করলে নারীর সন্তান ধারণের মধ্যে অনিশ্চয়তাও দেখা দেয়।
পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রজাতির প্রাণী বসবাস করে। তারা কেউ বিয়ে করে না। বিয়ে না-করলেও সেইসব প্রাণীদের জন্য যার সঙ্গে খুশি যৌনমিলনে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। বিয়ে করে শুধুমাত্র মানুষ। বিয়ে ছাড়া যৌনমিলন মানুষের জন্য অবৈধ, নিষিদ্ধ। তবে প্রাচীন যুগে মানবসমাজে বিয়ের প্রচলন ছিল না। যে-কোনো নারী যে-কোনো পুরুষের ভোগ্যা ছিল। এই ব্যাভিচার বা বহুগামিতাকে রোধ করার জন্য, নিজের সন্তানের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং যৌনতাকে একসঙ্গীতে সীমাবদ্ধ করার জন্য বিয়ে প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। বিবাহ ছাড়া মানুষের যৌনমিলনে নিষেধাজ্ঞা জারি হল।
কিছুদিন ফেসবুকে আমি একটা সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। প্রশ্ন করেছিলাম “মানুষ বিয়ে করে কেন ?” অনেকেই অংশগ্রহণ করেছিল। মানুষ কেন বিয়ে করে সে প্রশ্নের উত্তর নানা মানুষ নানাভাবে বলেছে। যে কারণগুলি উঠে এসেছে, তা হল : (১) আমার অর্জিত সম্পত্তি কে পাবে তার জন্য বিয়ে। (২) জীবনটা শেয়ার করার জন্য বিয়ে। (৩) সহবাসের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য বিয়ে। (৪) নিরুপায় হয়ে বিয়ে। (৫) নিজেকে বংশ পরম্পরায় জীবিত রাখার বাসনায় বিয়ে। (৬) একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য বিয়ে। (৭) নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিয়ে। (৮) সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বিয়ে। (৯) ভরসা স্থল খুঁজে নেওয়ার জন্য বিয়ে। (১০) মনের কথা বলতে মনের মতো মানুষের সঙ্গে আজীবন যাপন। (১১) পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া ইত্যাদি।
বাৎসায়ন পুরুষার্থ নামক জীবনের চার উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন। যেমন --- (১) ধর্ম : ধার্মিক জীবন, (২) অর্থ : আর্থিক সমৃদ্ধি, (৩) কাম : নান্দনিক ও যৌন আনন্দ লাভ ও (৪ ) মোক্ষ : আধ্যাত্মিক মুক্তি। কাম বা যৌনমিলনকে আরও তৃপ্তিদায়ক করতে বাৎসায়ন একটি শাস্ত্রও লিখে ফেললেন, শাস্ত্রটির নাম “কামশাস্ত্রম্”।কাম কী ? কাম হল মানবজীবনের অবিরত প্রবাহকে ক্রমবহমান রেখে মানুষের জীবনের সহজাত প্রবৃত্তি নিবারণের পথ। কামের ভূমিকা মানুষের জীবনে প্রচণ্ড শক্তিশালী। কামের নিবারণ না-হলে মানুষের অবদমিত কাম ক্রোধের সঞ্চার করে। সেই ক্রোধ হতে মানুষের বিবেক নির্বাক হয়। বিবেক নির্বাক হলে মানুষ তার ধর্ম হতে ভ্রষ্ট হয়। আর ধর্ম ভ্রষ্ট মানুষ জীবনের লক্ষ্য পথ হতে সরে আসে। তখন পাপের সঞ্চার ঘটে, যা মানুষটিকে কষ্ট দেয়। কোন্ পথে হাঁটতে গেলে প্রাথমিক ভাবে যেটা জানার প্রয়োজন হয়, তা হল পথ চলা। কামকে আমরা একটি সহজাত প্রবৃত্তি মাত্র ভেবে যদি তাকে অবহেলা করি, বা একটি শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা মাত্র করে থাকি তাহলে আমরা কামের সঠিক নিবৃত্তি করতে পারব না, এর ফলে তৃষ্ণা বাড়ার বদলে কমে যাবে বা কাম বিকৃতি ঘটবে। এর জন্য শাস্ত্রকাররা কামশাস্ত্রের প্রচলন করে গেছেন, যা নারীপুরুষনির্বিশেষ সকল মনুষ্য মাত্রেরই পঠনীয়। গৌতম বুদ্ধও একটি কামসূত্র শিক্ষা দিয়েছেন। এটি “অত্থকবগ্গ” গ্রন্থের প্রথম সূত্রে পাওয়া যায়। এই কামসূত্র অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে বুদ্ধ ইন্দ্রিয়সুখের অনুসন্ধান কত ভয়ানক হতে পারে তা শিখিয়েছেন।
অর্থাৎ কাম বা যৌনমিলনের বিষয়টা না-থাকলে কে বিয়ে করত ? কামগন্ধহীন কার দাম্প্যজীবন অগ্রসর হয়েছে ? শুধুমাত্র যৌনতার কারণেই কত দাম্পত্যজীবন তছনছ হয়ে গেল তার খবর কে রেখেছে ? কামই মুখ্য, সার্থক যৌনমিলনই প্রথম এবং শেষ মার্গ – এটাই বৈবাহিক অধিকার। বাকি সবই “কর্তব্য”, যা সমাজ চাপিয়ে দিয়েছে। নিরাপদ, স্বাধীন ও অবাধ যৌনমিলনের শর্ত, যা বাধ্যতামূলক। যৌনমিলনহীন কোনো বিবাহ হয় না, কোনো ধর্মেই হয় না। শুধুমাত্র সন্তানের জন্য কেউ যদি বিয়ে করে থাকেন, তিনি কি সন্তান জন্ম নেওয়ার পরপরই যৌনমিলন বন্ধ করে দেন ? ষাটের দশকের আগে পর্যন্ত বিবাহ মানেই সন্তান দান। বছর ঘুরতে না-ঘুরতেই সন্তানের জন্ম, একাধিক সন্তানের জন্ম। মহিলারা যেন সন্তান-জন্মের কারখানা। এক-একটা পরিবারে ১০/১৫টা করে সন্তান। অনেক মরত, কিছু বেঁচে থাকত। তখনকার দিনে সন্তানের জন্ম নিয়ন্ত্রণ তেমনভাবে করা যেত না। তাই অনেকের মনে হতেই পারে বিবাহ মানেই সন্তানের জন্ম।
সব বদলে দিল মার্গারেট সেনগার। মার্কিন সংস্কারক মার্গারেট সেনগার ১৯১৪ সালে ‘দ্যা ওমেন রেবেল’ নামক একটি আট পৃষ্ঠার মাসিক পত্রিকা চালু করেন এবং এর মাধ্যমে জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রসার শুরু করেন। ইংরেজি 'বার্থ কন্ট্রোল' শব্দটিও তিনিই প্রচলন করেন। ১৯৬০-এর দশকে জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ি ও জরাযুস্থ গর্ভ-নিরোধক কলের বাণিজ্যিক উত্পাদন শুরু হলে সাধারণ জনগণের মধ্যে এটি কার্যকর বিস্তার লাভ করে। সোভিয়েত রাশিয়ায়, সামাজিক নারী-সমতা অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে জন্ম নিরোধক অত্যন্ত সহজলভ্য করে দেয়া হয়েছিল। আলেক্সেন্দ্রা কলনটাই (Alexandra Kollontai -- ১৮৭২-১৯৫২) নামক একজন মহিলা তত্কালীন জনকল্যাণ অধিদপ্তরে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি বয়স্কদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা শিক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থা নেন। অন্যদিকে ফরাসি নারীরা ১৯৬৫ সালে তাদের প্রবল বিরোধিতার মাধ্যমে ফ্রান্সের জন্ম-নিয়ন্ত্রণ নিষেধাজ্ঞা তুলে দিতে সক্ষম হয়। ১৯৭০ সালে ইতালিতে নারীবাদীরা জন্ম-নিয়ন্ত্রণমূলক তথ্যাদি আরোহণের অধিকার লাভ করে।
যদিও কন্ডোমের ব্যবহার আরও আগে থেকেই প্রচলিত ছিল কিন্তু এটি প্রধানতঃ যৌন রোগ পরিহারের উপায় হিসেবেই ব্যবহৃত হত। অষ্টাদশ শতকে ক্যাসানোভা তার উপপত্নীদের অন্তঃসত্ত্বা হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য এক প্রকার প্রতিবন্ধক ব্যবহার করেন যা কন্ডোমের পূর্বরূপ হিসাবে ধারণা করা হয়। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পরিবার পরিকল্পনার একটি অন্যতম বিভাগ। জন্ম বা গর্ভ ব্যাহত করার উপায়গুলিকে মূলত তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন -- শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন ব্যাহত করা, ভ্রুণ সঞ্চারণ ব্যাহত করা এবং ঔষধ অথবা অস্ত্রপচারের মাধ্যমে ভ্রুণ অপসারণ করা। ধারণা করা হয় যে, যৌনমিলন ও গর্ভধারণের সরাসরি সংযোগ উপলব্ধির পরই জন্ম নিয়ন্ত্রণের আবিষ্কার হয়। প্রাচীনকালে বিঘ্নিত যৌন মিলন ও বিবিধ প্রকার প্রাকৃতিক ঔষধি (যা গর্ভনিরোধক হিসাবে প্রচলিত ছিল) সেবনের মাধ্যমে জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা করা হত। মিশরীয় সভ্যতায় সর্বপ্রথম গর্ভনিরোধক ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে গর্ভনিরোধক ব্যবস্থার প্রচলন থাকলেও জনপ্রিয় না-হওয়ার কারণে নর-নারী একাধিক সন্তানের জন্ম দিতে দিতে জেরবার হতেন।
আজ আর সেইদিন নেই। বিবাহ মানেই সন্তান নয়। সন্তানের জন্ম এখন মানুষের নিয়ন্ত্রণে। এসে গেছে কন্ডোম। যৌনমিলনে এসেছে বিপ্লব। কন্ডোম এখন সীমাহীন সন্তানের জন্ম থেকে মুক্তি দিয়েছে। রেতঃস্খলনের পর কন্ডোম যৌনসঙ্গীর শরীরে বীর্য প্রবেশে বাধা দেয়। কন্ডোম প্রায় ৪০০ বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে এলেও ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই কন্ডোম ব্যবহার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় জন্মনিরোধ পদ্ধতি। আধুনিক সমাজে কন্ডোমের ব্যবহার ব্যাপক মান্যতা লাভ করেছে। এখন বিবাহ মানে যৌনমিলন, যৌনমিলন মানেই আনন্দ, তৃপ্তি।প্রয়োজন হলে সন্তান, না হলে নয়। অবাধ যৌনসুখ। আজকাল বহু দম্পতি সন্তান নেন না। আজকাল বহু দম্পতি জন্ম দিতে অক্ষম হয়। তা সত্ত্বেও কিন্তু বিয়ে টিকে থাকে যদি যৌনতা থাকে। যৌনতা না থাকলে বিয়ে টিকিয়ে রাখা দুষ্কর। যদি টিকেও থাকে তবে সেখানে নিশ্চয় তৃতীয় পক্ষের অস্তিত্ব লক্ষ করা যাবে।
২০১০ সালের মার্চ মাসে সুইজারল্যান্ড সরকার ঘোষণা করেছে যে তারা ১২ থেকে ১৪ বছরের ছেলেদের জন্য ছোটো আকারের কন্ডোম প্রস্তুত করবে। এই কনডমের নাম রাখা হয়েছে হটশট। সেদেশের সরকারি গবেষণা থেকে দেখা গেছে, বারো থেকে চোদ্দো বছর বয়সি ছেলেরা যৌনসংগমের সময় যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিরোধক ব্যবহারের সুযোগ পায় না। একটি প্রমাণ আকারের কন্ডোমের ব্যাস ২ ইঞ্চি (৫.২ সেন্টিমিটার); কিন্তু হটশটের ব্যাস ১.৭ ইঞ্চি (৪.৫ সেন্টিমিটার)। তবে উভয় প্রকার কন্ডোমের দৈর্ঘ্য একই থাকবে – ৭.৪ ইঞ্চি (১৯ সেন্টিমিটার)। একটি জার্মান সমীক্ষায় দেখা গেছে ১২,৯৭০ জন ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সিদের দলে এক-চতুর্থাংশেরই বক্তব্য প্রমাণ আকারের কন্ডোম বেশ বড়ো। এ রিপোর্ট থেকে আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না যে, বৈধ বিবাহ পর্যন্তও মানুষ অপেক্ষা করতে পারে না। বিবাহ বহির্ভূত যৌন-সম্পর্ক মানুষ আদি যুগ থেকে আজও করে থাকে, সুযোগ পেলে। শুধু বিয়ের আগেই নয়, বিয়ের পরেও মানুষ বিবাহ বর্হিভূত যৌন-সম্পর্ক করে থাকে। একাধিক নারীসঙ্গ বা পুরুষসঙ্গ লাভ করে। এমন একটা সময় ছিল যখন পরিবারের স্ত্রীদের সতীন নিয়েও ঘর করতে হত।
যৌনতা থেকে মানুষের মুক্তি কবে ছিল ? নিঃঝঞ্ঝাটে যৌনজীবন উপভোগ করার জন্য বিবাহের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। এখানেই শেষ নয়, একটু যৌনসুখের জন্য মানুষ কি না-করে ! এমনকি যথাযথ যৌনসঙ্গীর অভাবে হস্তমৈথুন পর্যন্ত করে থাকে। মানুষের মধ্যে হস্তমৈথুনের হার নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন রকমের জরিপ ও গবেষণা হয়েছে। আলফ্রেড কিনসের ১৯৫০-এর দশকের এক গবেষণায় বলা যায়, মার্কিন নাগরিকদের মাঝে ৯২% পুরুষ ও ৬২% নারী তাঁদের জীবনকালে অন্তত একবার হস্তমৈথুন করেছেন। ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের মানুষের মাঝে করার একটি জরিপেও কাছাকাছি ফলাফল পাওয়া যায়। জরিপে দেখা যায় ১৬ থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে ৯৫% পুরুষ ও ৭১% নারী তাঁদের জীবনের যে-কোনো সময়ে অন্তত একবার হস্তমৈথুন করেছেন। সাক্ষাৎকারের চার সপ্তাহ আগে হস্তমৈথুন করেছেন এমন পুরুষের হার ৭১% ও নারী ৩৭%। অপর দিকে ৫৩% পুরুষ ও ১৮% নারী জানিয়েছেন যে, তাঁরা এই সাক্ষাৎকারের ১ সপ্তাহ আগে হস্তমৈথুন করেছেন।
২০০৯ সালে নেদারল্যান্ড ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যেও বয়সন্ধিকালীন ছেলেমেয়েদের কমপক্ষে প্রতিদিন হস্তমৈথুন করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়। অর্গাজম বা রাগমোচনকে শরীরের জন্য উপকারী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলিতে শিশু গর্ভবতীর ও যৌন সংক্রামক রোগের হারের প্রাপ্ত উপাত্ত লক্ষ করে, তা কমিয়ে আনতে এই কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়, এবং এটিকে একটি ভালো অভ্যাস হিসাবে উল্লেখ করা হয়। হস্তমৈথুন নতুন কোনো ফ্যাশন নয়, বিশ্বজুড়ে প্রাক-ঐতিহাসিক যুগের বহু শিলাচিত্রে পুরুষের হস্তমৈথুন করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ থেকে ধারণা করা হয়, অপ্রাকৃতিক যৌন আচরণের সঙ্গে মানুষের পরিচয় প্রাচীন যুগ থেকেই। মাল্টা দ্বীপের এক মন্দির সংলগ্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত, খ্রিস্টপূর্ব প্রায় চতুর্থ শতকে নির্মিত একটি মাটির ভাস্কর্যে একজন নারীর হস্তমৈথুরত সময়ের চিত্রও পাওয়া গেছে। তদুপরি, প্রাচীন যুগে মূলত পুরুষের হস্তমৈথুনের প্রমাণই বেশি পাওয়া যায়। তাই ধারণা করা হয় সে সময় এটিই বেশি প্রচলিত ছিল। প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন সুমেরীয়দের যৌনতার বিষয়ে শিথিল ধ্যানধারণা পোষণ করত, এবং হস্তমৈথুন সেখানে সক্ষমতা তৈরির একটি উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হত। এটি একাকী বা সঙ্গীর সঙ্গে উভয়ভাবেই সম্পন্ন হত। প্রাচীন মিশরে পুরুষের হস্তমৈথুন আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসাবে বিবেচিত হত। যখন কোনো দেবতার দ্বারা হস্তমৈথুন সংঘটিত হত, তখন তা অনেক বেশি সৃষ্টিশীল ও জাদুকরী কাজ হিসাবে বিবেচিত হত। বিশ্বাস করা হত মিশরীয় দেবতা আতুম হস্তমৈথুনের মাধ্যমে হওয়া বীর্যপাতের দ্বারা এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সঙ্গে নীলনদের জলপ্রবাহও তার বীর্যপাতের হার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এর সূত্র ধরেই মিশরীয় ফারাওদেরও আনুষ্ঠানিকভাবে নীলনদে হস্তমৈথুন করতে হত।
তবে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে হস্তমৈথুনের ইচ্ছা এবং প্রবণতা বাড়ছে। যৌনচিন্তা, পর্নোমুভি, চটি কাহিনি, প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে কল্পমৈথুন, বেশি বয়সে বিয়ে, যৌনসঙ্গীর অভাব, সুলভ নগ্নতাই হস্তমৈথুনের কারণ। যত দিন যাচ্ছে ততই এসব সুলভ হয়ে যাচ্ছে। খুব কম বয়সি ছেলেমেয়েরাও হস্তমৈথুনে জড়িয়ে পড়ছে। স্বপ্নদোষেও মানুষ যৌনমিলন করে। হস্তমৈথুনে সন্তান হয় না, পরিবার হয় না, ভরসাস্থল হয় না – তবুও মানুষ বিকল্প যৌনতৃপ্তির জন্য হস্তমৈথুন করে এবং করবে।
অতএব মানুষের জীবন যৌনময়। প্রায় সারাজীবনই যৌনতার ফ্যান্ট্যাসিতে মানুষ ভেসে থাকে। একমাত্র মানুষই যৌনতা নানা বৈচিত্রে উপভোগ করে। নানা কায়দার আসন গ্রহণ করে, যা অন্য প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায় না। একমাত্র মানুষই কমবেশি অন্যের যৌনমিলন দর্শন করেন, যে আগ্রহ অন্য প্রাণীদের মধ্যে নেই। তা সত্ত্বেও মানুষ ভাবের ঘরে চুরি করতে বেশি পছন্দ করে। ইনিয়ে-বিনিয়ে সত্যকে আড়াল করতেই মানুষ বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। তাই মানুষের মেয়েদের পিরিয়ড বা ঋতুচক্র হয় না, হয় শরীর খারাপ।
সাময়িক উত্তেজনা বা শুধুমাত্র রতিবৈচিত্র্র্যের জন্য বহু পুরুষ বা নারীকে ব্যভিচারে লিপ্ত হতে দেখা যায়। কত বিবাহিত পুরুষকে কুলি-কামিন, ভিখারিনী বা কুমারী কন্যার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলতে দেখা যায়। বিবাহিত নারীদেরও এইরকম যৌনাসক্তি লক্ষ করা যায়। নাগরিক জীবনের ধনী-দরিদ্র, সম্ভ্রান্ত-সাধারণ সকল স্তরেই এই প্রবণতা থাকে। এসব ক্ষেত্রে নারীরা সাধারণত বাবুর্চি, খানসামা, ড্রাইভার, মালি, আর্দালি, চাকর, এমন কী পথের মানুষদের সঙ্গেও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। নারীর এই ব্যভিচারের মনস্তত্ত্ব অনুসন্ধান করতে গিয়ে নন্দগোপাল সেনগুপ্ত তাঁর “সমাজ সমীক্ষা : অপরাধ ও অনাচার” গ্রন্থে লিখেছেন : নারীরা ভদ্রলোকের কাছে কাছে আপন সম্ভ্রম ক্ষুণ্ণ করতে চান না। কারণ তাতে অসন্মানের ভয় আছে। কিন্তু অন্ত্যজ বরাবর নীচুতে অবস্থিত সে কিন্তু প্রকাশও করতে পারবে না, কোনো অমর্যাদাও ঘটাতে সাহস পাবে না। সুতরাং তাকে আয়ত্ত করলে বদ-খেয়ালও চরিতার্থ হয়, আবার গৌরবও রক্ষা পায়। তা ছাড়া এই শ্রেণির সহযোগী জোগাড় হলে, তাকে দিয়ে কোনো কদাচার অনাচার নেই, যা অনায়াসে না রিয়ে নেওয় যায়। অপরদিকে পুরুষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
বিবাহ প্রথাই মূলত সৃষ্টি হয়েছে, নারীকে পুরোপুরি যৌনদাসী হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। নারী যাতে তার তথাকথিত সতীত্বকে টিকিয়ে রাখতে যত্নবান হয়, তার জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বিবাহের ফর্মূলা তৈরি করেছে। সময়ের সঙ্গেই বিবাহের ফর্মুলা জাদুঘরে চলে যাবে। শুধু নারী কেন ? পুরুষরাও কি যৌনদাস নয় ? মানুষ প্রকৃতিতে বহুগামী। তাকে জোর করে মনোগ্যামিস্ট বানানো এক ধরনের অসভ্যতা বলেই মনে হয়। বিয়ে নিয়ে অনেকই অনেক মহত্ত্বপূর্ণ দার্শনিক কথাবার্তা বলবেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সবাই একরকম ভাববেন কেন ? অন্যরকম যাঁরা ভাবেন, তাঁরা বলছেন -- বিয়ে অত্যন্ত ক্লান্তিকর ও ক্ষতিকর একটা নষ্ট প্রথা। সে আপনাকে এই বিশ্বাস দেবে যে একজনকে আপনি সম্পূর্ণ অধিকার করেছেন। কিন্তু সংসার জীবনে পদে পদে দেখবেন, সে আলাদা একটা মানুষ। তখন ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকবেন। আর সঙ্গে যদি সেক্সুয়াল জেলাসির যাতনা যুক্ত হয় তাহলে তো কথাই নেই। হয় নিজে বিধ্বস্ত হবেন, অথবা সঙ্গীকে করবেন। কিংবা দুটোই ঘটবে।
আরও বেশি ধ্বংস হবে আপনার সন্তান। জীবনের প্রতি পদে সে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি অনুভব করবে এবং এভাবেই শেষ হয়ে যাবে। অথচ সন্তান যদি দেখে যে তার জন্মের আগেই তার পিতামাতা আলাদা হয়ে গেছে, তাতেও তার মধ্যে হতাশা আসে না (যতক্ষণ সমাজ নিজে তাকে ডিপ্রেসড্ না করে) যদি কারো শৈশবে/কৈশোরে পিতামাতার বিচ্ছেদ হয়, তখন কী ঘটবে তা নির্ভর করে নানা পরিস্থিতির উপর। কিন্তু বিয়ে কখনোই কোনো সমস্যার সমাধান নয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎপত্তির জন্যই নারী আজ যৌনদাসী। তার আগে যতদিন মানুষ নমাডিক বা প্যালিওলিথিক সমাজের অংশ ছিল, সেখানে বিবাহের প্রয়োজন ছিল না। শিশুরা ছিল কমিউনিটির সম্পতি। কে বাবা তাতে কিছু যায় আসত না। কারণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বালাই ছিল না। নারী বা পুরুষের একাধিক সঙ্গী ছিল। তারা একাধিক লিভ-ইন করত। যেমনভাবে মানবেতর অন্য প্রাণীরা জীবন যাপন করে। মানবেতর অন্য প্রাণীরা এইভাবেই জীবন যাপন করে চলেছে আবহমান কাল ধরে। তাতে কোন অসুবিধাটা হয়েছে? বিবাহ অবাধ যৌনাচারের বৈধ ছাড়পত্র বই তো নয় ! সেই যৌনাচার বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে উপভোগ করে। যৌনবোধকে অবদমন করা যায় না। আইন দিয়েও নয়, ধর্ম দিয়েও নয়। বিবাহের মাধ্যমেও নয়, বিবাহ বহির্ভূতও নয়।
বিবাহ নিয়ে নারী এবং পুরুষ একইরকম ভাবে না। বিবাহ নিয়ে নারী ও পুরুষের চিন্তা ও চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। আমি না। এ ব্যাপারে এক আলোচনায় রনবীর সরকার কী বলছেন, সেটা দেখে নিতে পারি – (১) অধিকাংশ নারীই পার্টনার পছন্দ করার ক্ষেত্রে লং টার্মের কথা চিন্তা করেই করে। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে ব্যপারটা ভিন্ন, একটা নারীকে দেখে লং টার্ম পার্টনার হিসেবে গ্রহণ করার থেকে সেক্স করে আনন্দ পাওয়ার কথাই সে বেশি চিন্তা করবে। এখন ধরুন একটা পুরুষ এক নারীকে প্রলুব্ধ করে সেক্স করে চলে গেল, হয় নারীকে গর্ভপাত করতে হবে, অথবা সেই ছেলের দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। কী করবে সেই নারীটি? (২) সন্তানের জন্মদানের পর সে যদি বাবার সঙ্গে থাকে, তাহলে মার ভালোবাসা হতে বঞ্চিত হবে, আর মার সঙ্গে থাকলে বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে, আর অন্য কোথাও থাকলে তো বাবা-মা উভয়ের ভালোবাসা থেক বঞ্চিত হল। উপরন্তু আমাদের মতো অসভ্য সমাজে স্বাভাবিকভাবে বাবা বা মার নতুন পার্টনারের খারাপ ব্যবহার হয়তো-বা তার জীবনকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দেবে। (৩) পুরুষদের এখানে দায় থাকবে না কন্ট্রাসেপশন ব্যবহার করার, কারণ সে সন্তানের দায়-দায়িত্ব নিতে বাধ্য নাও থাকতে পারে। আর যদি এখানে আপনি আইন দিয়ে পুরুষকে বাধ্য করতে চান সন্তানের দায়িত্ব নিতে তাহলে কি আইন দিয়ে বাধ্য করবেন ? আইনগুলো কী ধরনের হবে ? (৪) ধরুন আপনি ২৫ বছর বয়সে সেক্স করার পর আপনার পার্টনারকে ছেড়ে দিলেন। তার একটা মেয়ে হল যে মেয়েকে আপনি দেখেনইনি। ২০ বছর পর আপনার বয়স ৪৫ আর মেয়ের ১৯-২০। (৫) একটি ছেলে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করল। মেয়েটি ছেলেটির বিরুদ্ধে মামলা করল। হ্যাঁ, প্রমাণিত হল যে ছেলেটি মেয়েটির সঙ্গে সেক্স করেছে। কিন্তু এর অর্থ কি এই যে সে ধর্ষণ করেছে ? হয়তো ধরা পরতে পারে কিছুটা forced sex হয়েছে। ছেলেটি বলতেই পারে তারা ভালোবাসা থেকেই সেক্স করেছে। ছেলেটির বিরুদ্ধে কি এখন আমরা সত্যি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারব ? (৬) অনেকে ছেলেমেয়েই আছে যারা প্রেম করতে পারে না। তাই বলে কি তাদের কখনো সেক্স করা হবে না ? অ্যারেঞ্জড ম্যারেজই তাদের অনেকক্ষেত্রে ভরসা। মতান্তর আছে বইকি।
বিবাহ বলতে আজকের সমাজ যেটা দেখছে বা জানে, সেই মন্ত্র আর আইনের কাগজপত্র খুবই আধুনিক ব্যাপার-স্যাপার। ঘটা করে বিয়ে প্রাচীনকালে একমাত্র রাজা-উজিরদের মধ্যেই চালু ছিল। নারী-পুরুষ একসঙ্গে থাকলেই সমাজ তাকে স্বীকৃতি দিত। রোমেও সাড়ম্বর বিবাহ বলতে অভিজাত শ্রেণিদের মধ্যে রাজনৈতিক পুনঃবিন্যাস। সাধারণ মানুষের এত ঘটা করে বিয়ে করার কোনো উপায় ছিল না। লিভ-ইন করত, আর তাই-ই ছিল বিবাহ। সেটা করত সমাজের উঁচুশ্রেণির ব্যক্তিরা। সে যুগের আম-আদমির জন্য যাই-ই লিভ-ইন, তাই-ই বিবাহ। ‘বিবাহ ব্যতীত যে-কোনো যৌনমিলন হল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে উদ্ধত মানুষ ঔদ্ধত্য প্রকাশের স্বাভাবিক ভঙ্গি’ – একথা সব ধর্মের ধর্মবাদীরা মনে করেন। দুর্বিনীত পুরুষ অতি সহজ শর্তে বিবাহ নামক কঠিন সামাজিক বাধানিষেধের বেড়াজালে নারীকে শৃঙ্খলিত করেছিল। নারীজাতিকে গৃহপালিত পশুরূপে গণ্য করার মধ্যে পুরুষ-হৃদয়ে আনন্দ সঞ্চারিত হতে পারে, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু নারীদের কাছে এই অবস্থা যন্ত্রণার এক ধারাবাহিক উপাখ্যান মাত্র।
বাইবেল বা টোরায় দেখা যায় ইজরায়েলিরা প্রথম বিয়ের ব্যাপারে কড়াকড়ি শুরু করে। বিবাহ বর্হিভূত সেক্সের জন্য শাস্তির ধারণা একেশ্বরবাদী ধর্মগুলির আমদানি। কনস্টানটাইন, যিনি আদতে খ্রিস্টান ধর্মের আসল প্রতিষ্ঠাতা, তার আমলেই প্যাগান রোমানদের বিবাহের “পবিত্রতার” প্রথম প্রকাশ। এরপরে ইসলাম এসে বিবাহের পবিত্রতার উপর আর-এক প্রস্থ পোঁচ লাগায়। ক্যাথলিক চার্চ বিবাহের পবিত্রতা রক্ষায় এবং নরনারীর ব্যাভিচারিতা আটকাতে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আইন জারি করে মধ্যযুগে। নরনারীর স্বভাবসিদ্ধ আকর্ষণ এবং সেই কারণে আরও স্বাভাবিক লিভ-ইন সম্পর্কের ফল্গুধারা ধ্বংস করে আব্রাহামিক ধর্মগুলি। ফলে চার্চের বন্ধন আলগা হতেই এখন ফ্রান্সের ৩০% লোক ও বিবাহিত নয়, সেখানে লিভ-ইনকেই বিবাহের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইউরোপের বাকি সভ্য দেশগুলিতেও আস্তে আস্তে বিবাহ প্রায় অবলুপ্তির দিকে। বিবাহিত নর-নারীর জীবন এমন কোনো স্বর্গীয় শয্যা নয়, যে লিভ টুগেদারকে বৈধতা দিলে একেবারে অনর্থ ঘটে যাবে সমাজে। আসলে আমরা “পরিবর্তন” শব্দটাকে খুব ভয় পাই। আমরা চাই সমাজ তেমন থাকুক, যেমনটা দেখে আমরা অভ্যস্ত। আইনি সংস্কার আর তার সমান্তরালে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। বিয়ে কখনোই কোনো কিছুর সমাধান নয়। বিবাহ সংঘঠিত সম্পর্কটি টিকে থাকে অনেকটা জোর করেই। তবে অনেক চেষ্টা ও সাধানার ফলে এটি একটি স্বাভাবিক শিল্পায়িত পরিমার্জিত রূপে আনা সম্ভব। তবে স্বভাবতই মানুষের ভিতরেই বহুগামিতার লক্ষণ থেকে গেছে। এটি স্বীকার করেই সভ্য দেশগুলী তার প্রচলন রেখেছে। সাধারণ মানুষের জন্য যা খুবই গুরুত্বপুর্ণ ও সমাজ ও সুন্দর থাকে।
প্রাবন্ধিক বিপ্লব পাল মনে করেন, “সময়ের নিয়মে যে কোন সভ্য সমাজে বিবাহর অবলুপ্তি দরকার। বিয়ের পেছনে না আছে যুক্তি, না স্ফূর্তি। এক পার্টনারের সাথে সারাজীবন কাটানো যাব্জজীবন কারাদন্ড। প্রেমের সমাধি। যদি ধরে নেওয়া যায় সন্তানের কারনে সেটা দরকার, তাহলেও এটা পরিষ্কার নয় কেন ঘটা করে, এত অপচয় করে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে হবে। কেউ যদি সারাজীবন এক পার্টনারের সঙ্গে থেকে খুশি থাকে, থাকুক। কিন্ত কেউ যদি সেটা না চায়, উকিলদের পকেটে পয়সা দিয়ে ডিভোর্স মামলা, খরপোশ মামলা কেন? বিবাহ একটি অসভ্য প্রথা। জোর করে দুই নরনারীকে চিড়িয়াখানার খাঁচায় ভরে সামাজিক তামাশা। এই বৈবাহিক অসাড়তা আমরা যত দ্রুত বুঝব, ততই মঙ্গল”। যদিও পরিবারের অন্তরালে জৈবিক কারণ বিদ্যমান, কিন্তু সুসভ্য সমাজব্যবস্থায় বিবাহের মধ্য দিয়ে পরিবার হল আইনসিদ্ধ ফলশ্রুতি।
অনেকেই বিপ্লববাবুর চিন্তায় আঁতকে উঠে বলতেই পারেন -- বিবাহ প্রথা উঠে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নারীরা। যেমন আমি ভালোবেসে আমার স্বামীকে বিয়ে করলাম বা লিভ টুগেদার শুরু করলাম। আমি আর আমার স্বামী দুজনেই সমবয়সি। আমরা পরিশ্রম করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলাম। স্বাভাবিকভাবেই একজন ৪০ বছরের নারী আর পুরুষের মধ্যে পুরুষটি অধিক যুবক থাকে। এখন এই চল্লিশে এসে যদি আমার সঙ্গী আমাকে ছেড়ে চলে যায় তাহলে সে খুব সহজেই একটা যুবতী মেয়ে পাবে। কিন্তু আমার সঙ্গী পেতে সমস্যা হবে। আর বাস্তব একটা উদাহরণ লেখক হুমায়ূন আহমেদ। গুলতেকিনের মতো নারীর সংখ্যা বাড়বে, অন্যদিকে শাওনদের অভাব নেই। এছাড়া কেউ যদি অসুস্থ হয়, আর তা হতেই পারে তখন বিবাহ প্রথার কারণে সঙ্গীর দায়িত্ব নেওয়া জরুরি। বাবা মা যদি সারাজীবন প্রেমকেই গুরুত্ব দিয়ে সঙ্গী পালটানোতে ব্যস্ত থাকে, তাহলে সেই সন্তানও বড়ো হয়ে বাবা-মাকে ওল্ড হোমে পাঠাতে দ্বিধা করে না। সমস্ত ভালোর মন্দ দিক থাকে, আর মন্দেরও ভালো দিক থাকে। তবে ভালো মন্দের উভয়ের বিচারে একটা স্থিতিশীল সমাজ তৈরিতে যেই নিয়ম বেশি কার্যকরী আমরা সেটাই সমর্থন করব।
“রাতভোর বৃষ্টি”-তে বুদ্ধদেব বসুর বিয়ে প্রসঙ্গে বলেছেন – বিয়ে ! কী জটিল, কঠিন, প্রয়োজনীয়, সাংঘাতিক মজবুত একটা ব্যাপার, আর কী ঠুনকো ! দুজন মানুষ সারজীবন একসঙ্গে থাকবে – পাঁচ দশ পনেরো বছর নয় – সারাজীবন – এর চেয়ে ভয়ংকর জুলুম, এর চেয়ে অমানুষিক আদর্শ আর কী হতে পারে ? সন্তানের সঙ্গেও সারাজীবন একত্রে থাকি না আমরা, বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন বন্ধু বেছে নিই। কিন্তু আশা করা হয় দাবি করা হয় যে একবার যারা স্বামী-স্ত্রী হল, তারা চিরকাল তাই থাকবে। এই অস্বাভাবিক অবস্থাটা সহ্য করা যায় এটাকে ঈশ্বরের বিধান বলে মেনে নিলে, আমাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখলে। কিংবা যদি বিয়েটাকে শুধু একটা নিয়মমাফিক পোশাকি গোয়াল বলে ধরে নিয়ে, দূরে-কাছে ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা থাকে দুজনেরই।
“বিয়ে অনেকটা দিল্লির লাড্ডুর মতো, যে খেয়েছে সে পস্তায়, যে না খেয়েছে সেও পস্তায়। ……… বিয়ে কোনও সমাধান নয়। ভালোবাসা সমাধান। ভালোবেসে একত্রবাস করো, অথবা পৃথকবাস করো। প্রথাট্রথা ঝেঁটিয়ে বিদেয় করো। মানুষকে প্রথার উর্ধ্বে উঠতে হবে, এ ছাড়া আর উপায় নেই। প্রথাকে বিদেয় না করলে প্রথা বিকট হতে হতে মানুষকে একদিন গিলে ফেলে। আসলে গেলা হয়ে গেছে অনেক আগেই। প্রথার পেটের ভেতর মানুষ এখন বাস করছে, মানুষ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হচ্ছে। ওই অন্ধকার গহ্বর থেকে মানুষকে বেরোতেই হবে, এ ছাড়া আর উপায় নেই”-– তসলিমা নাসরিন।
পরিশেষে বলব, একমাত্র একজোড়া নর-নারীকেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা তিল তিল করে নির্মাণ করতে হয় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে। বাকি সব সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবে মানুষ জন্মসূত্রে পেয়ে থাকে। যেমন – মা, বাবা, ভাই বোন, মাসি, পিসি ইত্যাদি। বিয়ের উদ্দেশ্য যাই-ই হোক, যেমনই হোক – বিয়ে ব্যতীত মানুষ সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবে না, করতে পারে না। বিয়ে নিষিদ্ধ হলে মানুষের নাবালকত্ব ঘুচবে না কোনোদিন। সৃষ্টিশীলতা স্তব্ধ হয়ে যাবে। সম্পর্ক-শৃঙ্খল বাধাপ্রাপ্ত হবে। মানুষ পুনরায় দিশেহারা হয়ে পড়বে। হয় যৌন অবদমনে মানুষ হিংস্র হয়ে যাবে, অথবা সীমাহীন যৌনতা এবং যৌনসঙ্গী ভোগের ফলে ভয়ংকর যৌনরোগে মনুষ্যসমাজে ধস নামবে। বিয়ে অবশ্যই স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা। এ পৃথিবীতে মানুষের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কার তিনটি -– (১) ঈশ্বর (২) আগুন এবং (৩) বিবাহ। বিবাহের আবিষ্কর্তাকে হাজারো সেলাম।
-------------------------------------------
তথ্যসূত্র : (১) বাংলার লোক-সংস্কৃতি -- আশুতোষ ভট্টাচার্য, (২) পবিত্র কোর-আনুল করীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর) -- খাদেমুল-হারমাইন বাদশাহ ফাহদ, (৩) জীবনসাথী – শচীন দাস, (৪) Marriage and Morals -- Bertrand Russell (৫) ভারতের বিবাহের ইতিহাস – অতুল সুর, (৬) কামশাস্ত্রম্ – বাৎসায়ন, (৭) মনুসংহিতা – সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুচিন্তিত মতামত দিন