মলয় রায়চৌধুরী - মায়াজম

Breaking

২ নভে, ২০১৫

মলয় রায়চৌধুরী

                                             স্বমেহনের দর্শন



কামস্তদগ্রে সমবর্ততাধি মনসো রেত: পরথমং যদাসীত ।
সতো বন্ধুমসতি নিরবিন্দন হর্দি পরতীষ্যাকবয়ো মনীষা ।।
ঋগ্বেদ, দশম সুক্ত
To intervene in this personal, secret activity, which masturbation was, does not represent something neutral for parents. It is not only a matter of power or authority, or ethics ; it is also a pleasure.
( Michel Foucault, Politics, philosophy, culture : interviews and other writings, 1977-1984 ). 1990.
এতটা বয়স হোলো তবু লোভ কুণ্ঠিত হোলো না ।
লুণ্ঠিত বীর্যের ফেনা চেয়ে চেয়ে দেখি ।
এত যে প্রলোভ তবু সাহস অর্জিত হোলো না ।
স্খলিত স্পর্ধার আঠা টিপে টিপে দেখি ।
আত্মরতি, সুকুমার চৌধুরী
স্বমেহনের কি দর্শন হতে পারে ? কেননা দর্শন তো প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ, এটি জ্ঞানের একটি ধারা যা, আমরা কি ভাবে বেঁচে থাকি আর থাকব, তা নিয়ে আলোচনা করতে চায় । দর্শনের জন্য কাম্য প্রজ্ঞায় তাই সম্ভবত প্রয়োজন ব্যক্তি-এককের অন্তর্দৃষ্টি, স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি আর বিচার-বিশ্লেষণের সামঞ্জস্য । কিন্তু আমরা কি ভাবে বেঁচে থাকি আর থাকব, তা তো দেশ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জাতি, রাষ্ট্র, ধর্ম ইত্যাদিতে একই হবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে । সেক্ষেত্রে স্বমেহনের দর্শন কেমন করেই বা সম্ভব ! তাছাড়া, কৌমপ্রজ্ঞা কি সম্ভব ? এমন একটি মানবজোট যার প্রতিটি ব্যক্তি-একক সদস্য একই প্রজ্ঞার উৎস ? আর স্বমেহন তো যৌনতা । যৌনতা কি ব্যক্তিএককের নিজস্ব প্রায়ভেট এলাকা নয় ? তার ভেতরে কেন কৌমপ্রজ্ঞাকে নাক গলাতে দেয়া হবে, যদি কৌমপ্রজ্ঞা বলে কিছু হয় ? কৌমপ্রজ্ঞা হিসাবে যদি ধর্মগুলোর কথা চিন্তা করা হয় তাহলে দেখি একটি ধর্ম নানা ফ্যাঁকড়ায় বিভাজিত, এমনকি সেসব ফ্যাঁকড়া গুলো এতই পরস্পর বিরোধী যে খুনোখুনি করতেও পেছপা নয়। কৌমপ্রজ্ঞা হিসাবে যদি রাজনৈতিক মতবাদকে নিই, যেমন মার্কসবাদ, তাতেও নানা রকমের ফ্যাঁকড়া-বিভাজন। শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ফ্যাঁকড়ার শীর্ষে থাকেন একজন বলিয়ে-কইয়ে গাজোয়ার, অর্থাৎ ব্যক্তি-একক, যিনি নিজের মতামতকে সমূহ ব্যক্তিএককদের ওপর অন্তত কিছুকালের জন্য চাপিয়ে দিতে সফল হন । তাহলে ? দেখা যাক যাচাই করে ।
সুরজিৎ সেন তাঁর ‘শহর সংস্করণ’ উপন্যাসে যে প্যারাগ্রাফটি লিখেছেন, সেটা আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি : “লেখক আখতারুজ্জমান ইলিয়াসশহর নামে একটা লিটল ম্যাগাজিনে যা লিখেছেন তা প্রণিধানযোগ্য । উনি লিখেছিলেন, “আমি মাস্টারবেশন বা স্বমেহনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিই, কারণ এর মধ্যে আমি সোসাইটিকে দেখি । যে লোকটা মাস্টারবেশন করছে সে চূড়ান্ত নিঃসঙ্গ ও ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ। এই বিকারগ্রস্ততা সমাজের প্রোডাক্ট । কেননা সেক্স ব্যাপারে সঙ্গীই প্রধান । যে লোক মাস্টারবেট করে, ধরে নিতে হবে তার সঙ্গী নেই । থাকলেও সে তার যৌনতার পূর্ণ তৃপ্তি ঘটাতে অক্ষম । ফলত তাকে মাস্টারবেট করতে হচ্ছে । সমাজে ইউজুয়াল সেক্সের সুযোগ নেই, কেননা তা মুক্ত নয়, এমনকি স্বাস্থ্যকর বা সুস্থও নয় । সিক সোসাইটিতে লোকে মাস্টারবেট করে। বহু বিবাহিত পুরুষকেও করতে হয় ( প্রসঙ্গত, লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাছে স্বীকার করেছেন, যে, তিনি মাস্টারবেট করে সঙ্গমের চেয়ে বেশি তৃপ্তি পেয়েছেন । এটা আমাদের সমাজের সম্ভবত ৯০ শতাংশ পুরুষের ক্ষেত্রে সত্য । কিন্তু স্বীকার করার মতো কালেজা নেই ) । এটা আসে গভীর নিঃসঙ্গতা থেকে । অসুস্থ সমাজেই মানুষের এ দুরবস্থা হয় । আমেরিকানরাও মাস্টারবেট করে এবং গর্বাচভকেও সেটা করতে হয়, কারণ সেও এক সিক সোসাইটির হোতা । মাস্টারবেশন আর নিঃসঙ্গতার ব্যাপারে আমার মিলান কুন্দেরার লাইফ ইজ এলসহোয়্যার বইটির কথা মনে পড়ছে । ওখানে একটা চ্যাপ্টার আছে ‘পোয়েট মাস্টারবেট’ নামে । সত্যি, এ এক ভয়াবহ ব্যাপার । এই নিঃসঙ্গতা, আমি মনে করি এটা একটা ইউনির্ভার্সাল প্র্যাকটিস । আমরা সবাই আনহেলদি ওয়ার্ল্ডে আছি । এটা একটা টোটাল লিবার্টির ব্যাপার, আমাদেরকে সেই কনসেপ্ট তৈরি করতে হবে, যেটা সোভিয়েত ইউনিয়ন বা অন্য কোনো সোশ্যালিস্ট কালচার তৈরি করতে পারেনি । আমি যে সমাজের কথা ভাবি, সেখানে সেক্স ব্যাপারে কোনো সংস্কার বা বেড়া থাকবে না । আমি চাই পূর্ণ স্বাধীনতা । না হলে ফ্রিডমকে লিমিটেড করে রাখা হয় । আর যে ফ্রিডাম সীমাবদ্ধ, তা কি আদৌ ফ্রিডম ?
“যদি কোনো ফ্রিডমের কথা বলি তাহলে অ্যাবসলিউট ফ্রিডমের কথাই বলা উচিত । কেননা মানুষের যৌনতা নিছক বায়োলজিক্যাল ব্যাপার নয়, কালচারাল ব্যাপারও বটে । আরও সরাসরি বললে বলতে হয়, এর মধ্যে একটা সৃষ্টিশীলতার অনুভূতিও রয়েছে । স্পষ্ট না হলেও অত্যন্ত গভীরে সেটা আছে । দৈহিক সুখের সঙ্গে সৃষ্টির আনন্দ যখন যুক্ত হয়, তখন সেটাই সর্বোচ্চ আনন্দ । এখন নানা উপায় আছে যা ব্যবহার করলে নরনারী সঙ্গম করতে পারে অথচ তাদের সন্তান হবে না । কিন্তু এতে কি দৈহিক তৃপ্তির দিক থেকে আগের মতো আনন্দ পাওয়া যায় ? যখনই একজন কনডোম ব্যবহার করে, তার সৃষ্টিশীল অনুভূতিটা অর্ধেক মার খেয়ে যায়, ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এই যে, মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে নিজের অপার সম্ভাবনাময় প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে শুধু ।”
আখতারুজ্জমান ইলিয়াস সাহেবের কয়েকটা শব্দের বিশেষ ঝোঁক রয়েছে । যেমন, ‘নিঃসঙ্গ’, ব্যাধিগ্রস্ত, ‘বিকারগ্রস্ততা’, ‘যৌনতার পূর্ণ তৃপ্তি’, ‘সিক সোসায়টি’, ‘অসুস্থ সমাজ’, ‘ভয়াবহ ব্যাপার’, ‘আনহেলদি ওয়ার্ল্ড’, ‘টোটাল লিবার্টি’, ‘অ্যাবসলিউট ফ্রিডম’, ‘সৃষ্টিশীল অনুভূতি’, ‘প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ’ ইত্যাদি । উনি আমেরিকানদের আর গর্বাচভের উল্লেখ করেছেন, অথচ বাংলাদেশী কোনো নেতার বা কবি-লেখকের নাম উল্লেখ করেননি । উনি নিজেও স্বমেহন করতেন কিনা অথবা কখনও করেননি, তা হয়তো অন্যত্র লিখেছেন, আমার চোখে পড়েনি । ওনার লেখাটা কবেকার তা জানি না । ওনার বক্তব্যের সঙ্গে আঠারো শতকের দার্শনিক জাঁ জাক রুশোর বক্তব্যের মিল আছে, যা রুশো ‘এমিলে’ ( ১৭৬২ ) এবং ‘কনফেসানস’ ( ১৭৮২-১৭৮৯) বইতে করেছিলেন । রুশো লিখেছিলেন যে, স্বমেহন হল নিজের মনকে ধর্ষণ, স্বমেহনের উৎস হল সমাজের দূষিত পরিবেশ ও প্রভাব, যে মানুষেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে সহজ জটিলতাহীন জীবন যাপন করে, তারা স্বমেহনের মতন অস্বাভাবিক জঘন্য কাজ কখনই করবে না ।
পশ্চিমবাংলায় বহুকাল আগে থেকেই কবি-লেখকরা যে নিজেদের স্বমেহন নিয়ে লিখছেন তা ওপরে সুকুমার চৌধুরীর ২০০৩ সালে লেখা কবিতাটি থেকেই স্পষ্ট । শূন্য ও তার পরের দশকের তরুণীদের কবিতা বা গদ্যতেও স্বমেহন আর মুখমেহন প্রসঙ্গ পাওয়া যাবে ।
আমরা যারা খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকে লেখা, ফিকে হয়ে আসা মনুস্মৃতির ঘেরাটোপে শৈশব কাটিয়েছি, যৌবন শুরু করেছি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে লেখা বাৎস্যায়ন পড়ে, বয়স্কদের বাণী শুনেছি ব্যক্তিজীবনের চারটি লক্ষ্য ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ নিয়ে, ইলিয়াস সাহেবের ঝোঁক আমল করতে বসে সবই গুলিয়ে ফেলছি । স্বমেহন কেমন করে করতে হবে তার নির্দেশ বাৎস্যায়ন দিয়ে গেছেন; সিংহের বিক্রমে । বাৎস্যায়নের সময়ে, দ্বিতীয় শতকের সনাতন ভারতীয়রা কি ‘নিঃসঙ্গ’, ব্যাধিগ্রস্ত’, বিকারগ্রস্ত’ ছিল ? তারা কি ‘সিক সোসায়টি’, ‘আনহেলদি ওয়র্ল্ড’, ‘অসুস্থ সমাজ’-এর সদস্য ছিল ? তারা কি ‘প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ’ করা আরম্ভ করেছিল ? আমার তো তা মনে হয় না । যৌন সম্পর্ক নিয়ে পুরাণ গুলোয় যে সমস্ত কর্মকাণ্ড আছে, তা থেকে মনে হয় সে সময়ে যথেষ্ট যৌন স্বাধীনতা ছিল ।
ভারত, গ্রিস, মিশর, চিন ইত্যাদি ভূখণ্ডগুলোর প্রাচীন অতিকথা ও পুরাণ কাহিনিতে কেন স্বমেহনকে অনৈতিক মনে করা হতো না ? সেসময়ের মানুষরা কি প্রাজ্ঞ ছিলেন না ? উপনিবেশবাদের কাঁধে চেপে আধুনিকতা আসার পর গোষ্ঠীপতিদের আওতায় নৈতিকতা নির্ণয়ের ক্ষমতা কুক্ষিগত হবার ফলে, তার মানে, নতুন মানদণ্ড গড়ে উঠল যৌনতার, বিশেষ করে স্বমেহনের, বিভিন্ন উপনিবেশের সমাজগুলোয় !
প্রাচীন মিশরের দেবতা আপসু স্বমেহন করে আকাশে ছায়াপথ সৃষ্টি করেছিলেন । এটা নিছক একটা গল্প ; কিন্তু এই গল্পের মাধ্যমে, যেহেতু দেবতারা স্বমেহন করেন, স্বাভাবিক যে ফ্যারাওদের প্রজারাও ইচ্ছে করলে স্বমেহন করতে পারত । গ্রিক দেবতা হারমেস নিজের ছেলে পানকে তার প্রেমিকাকে কল্পনা করে স্বমেহন করতে শিখিয়েছিলেন, কেননা পানকে প্রত্যাখ্যান করেছিল একো নামের সুন্দরী নিমফ । এরকম কাহিনিতে দৈবিক অনুমতি দেয়া হচ্ছে না কি,যে, প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক তার প্রেমিকাকে কল্পনা করে স্বমেহন করতে পারবে ?সারা ডেনিং তাঁর ‘দি মাইথলজি অফ সেক্স’ ( ১৯৯৬ ) গ্রন্থে জানিয়েছেন যে প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ায়, এখনকার দক্ষিণ ইরাকে, স্বমেহনকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল, মনে করা হতো যে একা বা দুজনে পরস্পরের স্বমেহনে সাহায্য করলে বীর্যশক্তির বৃদ্ধি ঘটে আর তা পৌরুষের জন্য জরুরি । এই একই কধা এখনকার সেস্কপার্টরাও বলেন ।
দেবী-দেবতার জগত থেকে বেরিয়ে আথেন্সের তৎকালীন বাস্তব জগতে এলে দেখি, খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের ‘দার্শনিক’ ডায়োজেনেস সকলের সামনে স্বমেহন করতেন; তাঁর বক্তব্য ছিল মানুষের কোনো কাজকে লজ্জাকর মনে করার কারণ নেই, এবং স্বমেহন কোনো লজ্জার ব্যাপার নয় । খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকে রোম সাম্রাজ্যের গ্রিক শল্যচিকিৎসক অ্যালিয়াস গালেনাস তাঁর রোগীদের স্বমেহন করার পরামর্শ দিতেন ; তিনি মনে করতেন যে দেহে বীর্যের আধিক্য থেকে নানা রোগ দেখা দিতে পারে । সেসময়ের গ্রিসে ও রোমে ধনীরা স্বহস্তে কাজটি করতেন না, তার জন্য তাঁরা চাকর অথবা ক্রীতদাস রাখতেন, কেননা নিজের হাতে করাটা দারিদ্র্যের লক্ষণ মনে করা হতো।
আথেন্সের নারীরা স্বমেহন করতেন ‘অলিসবোস’ বা ‘বাউবন’ নামে একটি বস্তুর দ্বারা যা অনেকটা এখনকার ডিলডোর মতন। ডিলডো ভারতের বাজারে নিষিদ্ধ বলে যাঁরা ইউরোপ-আমেরিকা-ব্যাংকক যান তাঁরা কিনে আনেন । ‘অলিসবোস’ জিনিসটা হতো নরম চামড়ায় তৈরি । গ্রিস ও রোমে স্বমেহনকে মনে করা হতো সমাজের ‘সেফটি-ভালভ’ ।
দশম থেকে দ্বাদশ শতকে নির্মিত খাজুরাহোর মন্দিরে, যা রাজপুত চাণ্ডেলা রাজারা হিন্দু আর জৈন সম্প্রদায়ের ধার্মিক আচার-ব্যবহারের জন্য তৈরি করিয়েছিলেন, আঠারো শতকেও শিবরাত্রিতে পুজো হতো, সেখানে পুরুষ আর নারীর স্বমেহনের মূর্তি আছে । অর্থাৎ সনাতন ভারতে স্বমেহনকে উপরোক্ত নৈতিক দৃষ্টিতে ‘খারাপ’ জীবন দর্শনের তকমা দেয়া হয়নি । সংস্কৃত সাহিত্যে জায়গাটির নাম ছিল জিহোতি আর জেজাহোতি । অধিকাংশ মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসক কুতুবুদ্দিন আইবক আর সিকন্দর লোদির সময়ে। মন্দিরগুলো থাকলে আমরা আরও লিবারেটেড ও সৃষ্টিশীল ভাস্কর আর স্থপতিদের সুস্হ ও বিস্ময়কর কাজের সঙ্গে পরিচিত হতুম । এই বিদেশি শাসকরা ধ্বংস করতে চেয়েছেন, কেননা তাঁদের সাম্প্রদায়িক জীবন দর্শনের বিরোধী ছিল মূর্তিগুলোয় দর্শানো ক্রিয়া ; তাছাড়া তাঁরা ছিলেন মূর্তি-নির্মাণ ধারণার বিরোধী ; এর সাম্প্রতিক নমুনা তালিবানের দ্বারা আফগানিস্তানে বুদ্ধমুর্তি ধ্বংস, ইরাকে আইসিস বাহিনীর দ্বারা তাবৎ প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ধ্বংস । খাজুরাহো ধ্বংসের আগে কুড়ি বর্গ কিলোমিটারে পঁচাশিটি মন্দির ছিল । ধ্বংসের পরে বেঁচেছে ছয় বর্গ কিলোমিটারে কুড়িটি মন্দির, তার কারণ এই মন্দিরগুলো জঙ্গলের আড়ালে ছিল ।
কেবল ভারতেই নয়, যতকাল মানুষ প্রকৃতিকে পূজ্য মনে করেছে ততোকাল স্বমেহনকে ‘খারাপ’, ‘অসুস্থ’, ‘ব্যাধিগ্রস্ত’, ‘নিঃসঙ্গ’ জীবনদর্শন-প্রসূত মনে করেনি , তার কারণ তখনও ‘আলোকপ্রাপ্ত’ ব্যক্তিএককের জন্ম হয়নি । মালটায় চতুর্থ শতকের স্বমেহনরতা নারীমূর্তি পাওয়া গেছে । প্রাচীন মিশরে বিশ্বাস করা হতো যে দেবতা অতুম-এর স্বমেহনের ফলে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে, নীল নদের জোয়ার-ভাটাও তাঁর স্বমেহনের কারণে ঘটে। ফ্যারাওরা প্রতি বছর নীল নদে স্বমেহনের উৎসব পালন করতেন ।
সনাতন ভারতীয় চিন্তা-চেতনায় তাহলে কবে থেকে এই ধারণা সেঁদোলো যে স্বমেহন ‘খারাপ’, ‘অসুস্থ’, ‘ব্যাধিগ্রস্ত’, ‘নৈতিক অধঃপতন’ ‘স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’, ‘নিঃসঙ্গ’, জীবন দর্শন-প্রসূত ? আমি মনে করি, এই ভাবনা এসেছে বিদেশী শাসকদের মূল্যবোধের সঙ্গে । অথচ বাইবেলে স্বমেহন সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা নেই । বাইবেলের বুক অফ জেনেসিস এর ৩৮তম পর্বে যা আছে, এবং যেটি স্বমেহনবিরোধী দর্শনের উৎস সূত্র, তা হল ‘এর’ এবং ‘ওনান’ নামের দুই ভাইয়ের কাহিনি ।
য়াহওয়েহ বা জেহোভা বা ঈশ্বর প্রথমে এরকে হত্যা করেন, কেননা ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করেছিল এর , সে সন্তান চাইত না, এর মনে করত সন্তান হলে তার সুন্দরী স্ত্রী তামার-এর রূপ নষ্ট হবে যাবে ; তার মনোভাবকে জেহোভা ক্ষতিকর এবং দুর্নীতিপরায়ণ আখ্যা দেন ,আর তাকে মেরে ফ্যালেন । এর যখন মারা গেল তখন তাদের বাবা জুডা ওনানকে আদেশ দিলেন যে “লেভিরেট সম্পর্ক-প্রথা”( ছোটো বা বড়ো ভাইয়ের বিধবাকে বিয়ে করা বা তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করা ) অনুযায়ী ওনান তামার-এর সঙ্গে সঙ্গম করে সন্তানের জন্ম দিক । এর যখন মারা গেল তখন স্বাভাবিকভাবে সম্পত্তির অধিকারী হবার দাবিদার ছিল ওনান । ওনান তাই তামার-এর গর্ভে সন্তান চায়নি, তার ঔরসে সন্তান জন্মালেও সে সন্তান পেতো এর-এর উত্তরাধিকার । বাবার আদেশ অনুযায়ী ওনান প্রতিরাতে সঙ্গম করত কিন্তু তামার-এর যোনিতে বীর্য পড়ার আগেই তা বাইরে পৃথিবীর মাটিতে ঝরিয়ে নষ্ট করে ফেলত । বীর্য নষ্ট করার কারণে জেহোভা তাকেও হত্যা করেন । এই গল্প থেকেই ইহুদি আর খৃষ্টধর্মী যাজকরা প্রচার আরম্ভ করেন যে বীর্যকে পৃথিবীর মাটিতে ঝরিয়ে দেয়া একটি গর্হিত কাজ, ঈশ্বর তাতে কূপিত হন; বীর্যের একমাত্র কাজ হল সন্তান উৎপাদন । পৃথিবীর মাটিতে ওনান স্বমেহন করে ধাতুরস ঝরায়নি, কিন্তু ইহুদি আর খৃষ্টধর্মী প্রচারকরা যুক্তিটিকে টেনে নিয়ে গেলেন স্বমেহন বিরোধিতায় । ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুসারী আব্রাহামিক ধর্মগুলো যৌনতার দর্শন নির্মাণে এই গল্পটির আশ্রয় নিয়েছে । আমেরিকায় সপ্তদশ শতকে ওনানের গল্পটির এতই প্রভাব ছিল যে গোঁড়া খ্রিস্টধর্মী গ্রাম কনেকটিকাটের নিউ হেভেনে স্বমেহনকারীকে ফাঁসি দেয়া হতো । ওনানের গল্পটি আশ্রয় করে খ্রিস্টধর্মী যাজকরা স্বমেহনের বিরোধিতা করলেও, ইহুদিরা আর মুসলমানরা টেস্টামেন্টের কাহিনিকে মান্যতা দিয়ে পুরুষদের সুন্নৎ করান, যাতে মেসমা নামের মোম না জমে যায় চামড়ার তলায়, এবং ওই মেসমার কারণে নারীদের ইউরিনারি ট্র্যাক্টে রোগ না হয়, কিন্তু খ্রিস্টান যাজকরা এই প্রথাটিকে সর্বসন্মত স্বীকৃতি দেননি ।
ইহুদি আর খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকরা ‘ওনানিজম’ নামক একটি ‘পাপ’ এর কথা প্রচার করতে লাগলেন । ওনানিজম, অর্থাৎ বীর্যকে সন্তান উৎপাদন ছাড়া অন্য কাজে প্রয়োগ করা । নারীর যোনিতেই কেবল বীর্য ফেলতে হবে ; সেকারণে গোঁড়া ইহুদি আর ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা কনডোম ব্যবহারকে মনে করেন ওনানিজম, পায়ুসঙ্গম আর পশুসঙ্গমও তাই । সমকাম বিরোধিতার উৎসও হল ওনানিজম ।
অষ্টাদশ শতকে শিল্প বিপ্লবের ফলে যখন দলে-দলে যুবক শ্রমিকরা শিল্পাঞ্চলগুলোয় জড়ো হতে লাগলেন, তাঁদের জীবন একঘেয়ে হয়ে উঠল, অনেকে, যাঁরা বেশ্যালয়ে যাবার মতো রোজগার করতেন না, তাঁরা স্বমেহনের আশ্রয় নিতেন । শিল্পাঞ্চলগুলোয় গিয়ে পাদ্রিরা স্বমেহনকে ওনানিজম নামক পাপের তকমা দিয়ে যুবক শ্রমিকদের উপদেশ দিতেন আর তাদের বোঝাতেন তারা যেন নিজেদের ধাতুরসকে পৃথিবীর মাটিতে না ঝরায় । ওনানিজমের ভয়ের কারণে শিল্পাঞ্চলগুলোয় বেশ্যালয় গজিয়ে ওঠে, এবং তার বিরোধিতা সেসময়ের পাদ্রিরা করতেন না, কেননা বেশ্যাদের কাছে গেলে ধাতুরসকে বাইরে ফেলা হবে না । শিল্পাঞ্চলগুলোয় গজিয়ে উঠতে থাকে শ্রমিকদের জন্য বাজার, আর এই বাজারে স্বমেহনকে ওনানিজমের ছাপ্পা মেরে চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যের অবনতির ভয় দেখিয়ে বাড়িতে তৈরি শিশির ওষুধ, ওষুধের বড়ি, ওষুধের পাউডার ইত্যাদি বিক্রির বাজার খুলে বসেন ।
ওনানিজমের ভয় দেখিয়ে প্রথম যিনি ১৭১৬ সালে লন্ডন থেকে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন তিনি ঈশ্বরতাত্বিক পাদ্রি বালথাজার বেকার । তাঁর বইটির নাম ছিল, ‘ওনানিয়া, দি হিনিয়াস সিন অফ সেল্ফ পলিউসান অ্যাণ্ড অল ইটস ফ্রাইটফুল কনসিকোয়েনসেস, ইন বোথ সেক্সেস কনসিডার্ড, উইথ স্পিরিচুয়াল অ্যাণ্ড ফিজিকাল অ্যাডভাইস টু দোজ হু হ্যাভ অলরেডি ইনজুয়র্ড দেমসেল্ভস বাই দিস অ্যাবোমিনেবল প্র্যাকটিস’ । বালথাজার চিকিৎসক ছিলেন না, কিন্তু ওষুধপত্র বিক্রি করতেন । তাঁর পুস্তিকাটি গুরুত্ব দিয়েছিল স্বমেহন করার ফলে সংগ্রহ করা পাপ আর নিজের আত্মাকে নোংরা করে তোলার কারণে অধঃপতন, আর তা থেকে মুক্তির উপায় । পুস্তিকাটি স্বীকৃতি দিচ্ছে যে পুরুষ এবং নারী উভয়েই স্বমেহন করতেন ।
আত্মিক অধঃপতনের দরুণ, বালথাজার লিখেছিলেন যে স্বমেহনের কারণে এই অসুখগুলো হয় : পাকস্থলীর গোলমাল, পাচনশক্তির অভাব, ক্ষুধামান্দ্য, দাঁড়কাকের মতন রাক্ষুসে খিদে, বমির ভাব, মৃগীরোগ, খসখসে গলা, নপুংসকতা, পিঠ ব্যথা, ক্ষীণ দৃষ্টি শক্তি, কালা হবার সম্ভাবনা, মুখময় ব্রণ, ফ্যাকাসে ত্বক, বৌদ্ধিক ক্ষমতা হ্রাস, স্মৃতিহীনতা, মূর্খতা, এবং আত্মহত্যার ইচ্ছা । বইটির সঙ্গে কয়েকজন যুবকের দেয়া চিঠিও ছিল, স্বমেহনের ফলে তাদের অসুখের ফিরিস্তি দিয়ে । এই সমস্ত শারীরিক আর মানসিক অধঃপতন থেকে বাঁচার জন্য তিনি বিক্রি করতেন দশ শিলিঙে শক্তি ফিরে পাবার এক বোতল ওষুধ আর বারো শিলিঙে এক প্যাকেট পাউডার । পুস্তিকাটির ষাটটি সংস্করণ হয়েছিল এবং ইউরোপের প্রায় প্রতিটি ভাষায় অনুদিত হয়েছিল । স্বমেহন করলে ওষুধের মাধ্যমে শারীরিক আর মানসিক অধঃপতন থেকে যে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়, প্রটেস্ট্যান্ট ব্রিটেনে পুস্তিকাটি প্রকারান্তরে সেকথাই প্রচার করেছিল । কিন্তু ক্যাথলিক ইউরোপে পুস্তিকাটি ওনানিজমের ভীতি সঞ্চার করতে সফল হয়েছিল ।
ভারতে এবং অন্যান্য উপনিবেশে ইভানজেলিস্টরা কাঁধে করে ওনানিজমকে নিয়ে গিয়ে সেখানকার জনসমুদায়ের ওপর প্রচার ও আইনের মাধ্যমে চাপিয়ে দিতে পেরেছিলেন । ইউরোপের দেশগুলো প্রতিটি উপনিবেশের মানুষদের ‘উন্নত’ করে তোলার জন্য তাদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল, এবং সফলও হয়েছিল জনসমূদায়ের বৃহদাংশকে, বহু দেশে সবাইকে, ধর্মান্তরিত করতে। ফলে, উপনিবেশগুলোর নিজস্ব যৌনদর্শনের ওপর ক্রমশ মোটা চাদরের পরত পড়ে গেল, আর সে জায়গায় জমে বসল সাম্রাজ্যবাদীদের যৌনদর্শন । ইউরোপে খৃস্টধর্মীদের নিজেদের মধ্যে রেফর্মেশান, রিভাইভালিজম, রেসটোরেশানিজম আন্দোলনের কারণে নৈতিক গোঁড়ামি এই তিন-চারশো বছর যাবত সমাজকে আঁকড়ে ব্যক্তিএকককে নীতিজালের ভেতরে বেঁধে ফেলতে পেরেছিল ।
জিন স্ট্রেনজার্স এবং অ্যানে ভ্যান নেক তাঁদের ‘ম্যাস্টারবেশান : দি হিস্ট্রি অফ এ গ্রেট টেরর’ ( ২০০১ ) বইতে জানিয়েছেন যে, ১৭৪৩-৪৫ সালে রবার্ট জেমস নামে একজন চিকিৎসক তাঁর ‘এ মেডিকাল ডিকশনারি’তে লিখলেন যে, স্বমেহন হল এমন একটি জঘন্য অসুখ যা সারে না, এবং এটি একটি এমনই পাপ, যার ফলাফল অকল্পনীয় । বালথাজার তবুও মেকি ওষুধের মাধ্যমে সারাবার ব্যবস্থাপত্র করেছিলেন । রবার্ট জেমস, যেহেতু চিকিৎসক, তার পথও বন্ধ করে দিলেন ।
ইউরোপে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে সফল হয় সুইডিশ চিকিৎসক স্যামুয়েল আগুস্তে তিসো’র বই ‘লে ওনানিজমো’; বইটিতে তিনি জানিয়েছিলেন যে ধাতুরস হল শরীরের ‘অত্যাবশ্যক তেল’ আর ‘জীবনরস’ । তিনি তাঁর কাল্পনিক রোগীদের ইতিহাস একত্র করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে স্বমেহনের ফলে তাদের দেহ থেকে অত্যাবশ্যক তেল আর জীবনরস বেরিয়ে যাবার দরুণ তাদের স্মৃতিক্ষয় হয়ে গেছে, স্নায়ুবিপর্যয় ঘটেছে, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে এবং তাদের স্বাস্থ্য সংকটাপন্ন ।
১৮৭০ সালে খ্রিস্টধর্মী সংস্থা সেভেন্হ ডে অ্যাডভেনটিস্ট পাবলিশিং অ্যাসোসিয়েশান একটি বই প্রকাশ করেছিল, এলেন জি হোয়াইট সম্পাদিত, ‘এ সলেমন অ্যাপিল রিলেটিভ টু সলিটারি ভাইস অ্যান্ড দি একসেসেস অফ দি ম্যারেজ রিলেশানস’ নামে । তাতে সাবধান করে দেয়া হল নারী আর পুরুষ উভয়কেই, যাদের বয়স পনেরো বছরের বেশি, তারা যদি স্বমেহন করে এবং যোনি ছাড়া অন্যত্র ধাতুরস ফ্যালে, তাহলে এই প্রকৃতি বিরোধিতার জন্য প্রকৃতিই তাদের শাস্তি দেবে । পুরুষদের ফুসফুস, বৃক্ক, যকৃত রোগাক্রান্ত হবে আর ক্যানসারাস টিউমার দেখা দেবে । নারীদের ক্যাটারাহ, ড্রপসি, পিঠ আর কোমর ব্যথা এবং ক্যানসারাস টিউমার হবে ।
‘আলোকপ্রাপ্তি কাকে বলে’ ( ১৭৮৪ ) এবং ‘মেটাফিজিকস অফ মরালস’ ( ১৭৯৭ ) রচনার লেখক-দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্ট স্বমেহন বিষয়ক একটি দার্শনিক বক্তব্য রেখেছিলেন । তিনি বলেছিলেন স্বমেহন হল এমন এক অস্বাভাবিক কাজ যা একজনের নিজের চিন্তাভাবনার গোরায় কুড়ুল মারে, নিজের প্রতি দায়িত্বকে অস্বীকার করে এবং কাজটি অনৈতিক । তবে তিনি একথাও বললেন যে, অমন অস্বাভাবিক কাজের একটি যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয় ; শেষ পর্যন্ত কাজটি এই জন্য অনৈতিক যে ব্যক্তিএকক তার নিজের প্রতিস্বকে বিসর্জন দিয়ে স্রেফ নিজের জান্তব তাড়নাকে চরিতার্থ করে । আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটেছিল আলোকপ্রাপ্তির ভাবনাচিন্তা থেকে, যা শেষ পর্যন্ত মানুষকে প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে নিয়ে গেল বিশ্বযুদ্ধের আত্ম ধ্বংসে । ইউরোপের প্রতিটি দেশের নেতারা ভাবতে লাগলেন তাঁরাই সবার চেয়ে বেশি উন্নত ও সভ্য ।
উনিশ শতকের ব্রিটেনে এবং তার উপনিবেশ গুলোয় ভিকটোরিয় নৈতিকতার প্রসার ঘটানো হয় । ছেলেদের ট্রাউজার এমনভাবে সেলাই করানো হতো যাতে তারা পকেটে হাত ঢুকিয়ে লিঙ্গ নিয়ে খেলতে না পারে; স্কুলের ছাত্রদের বসার জন্য সিট এমনভাবে তৈরি করা হতো যাতে তারা পায়ের ওপরে পা দিয়ে না বসতে পারে । মেয়েদের ঘোড়ায় চাপা এবং সাইকেল চালানো নিষিদ্ধ ছিল, কেননা তার ফলে যে ধরণের গোপন আনন্দ হয় তা স্বমেহনের সমতুল্য । ছেলে বা মেয়ে কেউ যদি স্বমেহন করা অবস্থায় ধরা পড়ে যেত তাহলে মনে করা হতো যে তার ইচ্ছাশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে ; ইচ্ছাশক্তিকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের বিস্বাদ নিরামিষ খাবার দেয়া হতো । ভিকটোরিয় আমলের ডাক্তাররা মনে করতেন যে স্বমেহন থেকে মুক্ত করার উপায় হল ইলেকট্রিক শক দেয়া । তাতেও যদি রোগী নিজের অভ্যাস বদলাতে অক্ষম হতো তাহলে চেস্টিটি বেল্ট পরানো হতো । ছেলেদের চেস্টিটি বেল্ট ছিল চামড়ার খোলে লিঙ্গকে ঢেকে রাখার বেল্ট, যার ফুটো দিয়ে কেবল প্রস্রাব করা যেতো । মেয়েদের ক্ষেত্রে যোনিকে সম্পূর্ণ ঢেকে কেবল প্রস্রাব করার ফুটো রাখা হতো । চেস্টিটি বেল্টের চাবি থাকত বাবা-মায়ের কাছে । গরিব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের পরানো হতো লম্বাহাতা জামা, যার হাতাগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা সেলাই করে দেয়া হতো যাতে হাত ব্যবহার করা না যায় । শাস্তি হিসাবে শিশ্নের ওপরের চামড়াকে ছ্যাঁকা দেবার প্রথাও ছিল । ভিকটোরিয় যুগে ব্রিটেন আর আমেরিকায় শৈশবে ছেলেদের সুন্নৎ করে দেবার প্রথা বহুকাল চালু ছিল । পরবর্তীকালে তা এই যুক্তিতে বন্ধ হয় যে অমন শল্যচিকিৎসার জন্য শিশুরা অনুমতি দিতে পারে না, এবং বড়ো হয়ে তারা এর প্রতিবাদ করলে বাবা-মাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে ।
মেয়েরা যাতে স্বমেহন না করতে পারে, এবং বিয়ের আগে তারা যাতে পবিত্র থাকে, আফ্রিকার সাতাশটি দেশে, ইয়েমেন, ইরাকি কুর্দিস্তান, মধ্য-পূর্ব এশিয়ার দেশ-গুলোয়, এবং ডায়াসপোরা মুসলমানদের সমাজে শৈশবে ক্লিটোরিসের দৃশ্যমান অংশটুকু কেটে বাদ দেবার প্রথা এখনও আছে । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই কাজটি করেন অভিজ্ঞ মহিলারা, কাটা হয় ব্লেড দিয়ে ।
ইসলামে “যিনা” বা ব্যভিচারের বিরুদ্ধে আদেশ আছে, কিন্তু, যতটা তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি, স্বমেহনের বিরুদ্ধে শরিয়তে সরাসরি নির্দেশিকা নেই । কিন্তু পরবর্তীকালে সৌদি আরবের ধর্মব্যাখ্যাতারা জানিয়েছেন যে স্বমেহনও যিনার পর্যায়ে পড়ে । সম্ভবত সরাসরি নির্দেশিকা থাকলে আখতারুজ্জমান তার উল্লেখ করতেন এবং ব্যভিচারকারীদের জন্য নির্ধারিত শাস্তির উল্লেখ করতেন । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, আমেরিকান আর রাশিয়ানদের পাশাপাশি স্বদেশের কয়েকজনের নামও উল্লেখ করতেন । ব্রায়ান হুইটেকার তাঁর প্রবন্ধ ‘সেমিনাল কোয়েশ্চেন’, দি গার্জিয়ান-এ ২০০৬ সালে প্রকাশিত, জানিয়েছেন যে, ১৯৯০ সালে সৌদি আরবের প্রধান মুফতি আবদ আল-আজিজ বিন বাজ ইসলামের অবস্হানটি স্পষ্ট করে দেন ; তিনি বলেন যে স্বমেহন করলে পাচনশক্তির গোলমাল হয়, অণ্ডকোষ ফুলে যায়, শিরদাঁড়ার ক্ষতি হয়, দৈহিক কাঁপুনির রোগ হয়, মস্তিষ্কের গ্রন্থি দুর্বল হয়ে যায় এবং মানুষ উন্মাদ হয়ে যেতে পারে । তাই এই কাজটি থেকে পুরুষ ও নারী উভয়েরই বিরত থাকা উচিত । বিন বাজ যিনার উল্লেখ করেননি ।
সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে যে আইসিস নামের সুন্নি যোদ্ধাদলের সদস্যরা ইরাক ও সিরিয়ায় ব্যভিচারের ব্যাখ্যাকে সীমিত করে ফেলেছে নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ; তারা শিয়া এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নারীদের যৌনক্রীতদাসী হিসাবে ব্যবহার করছে । সংবাদপত্র আর বৈদ্যুতিন মাধ্যম থেকে জানা গেছে ,নাইজেরিয়াতেও বোকো হারাম যোদ্ধাদল কর্তৃক যুবতীদের স্কুল থেকে তুলে নিয়ে যাবার ঘটনা, যাদের যৌনক্রীতদাসী হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে । এখানে যে ব্যাপারটি প্রাসঙ্গিক, তা হল যুদ্ধ । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ( ১৯১৪-১৯১৮ ) দরুণ ইউরোপীয় সমাজে যাবতীয় নৈতিকতার মানদণ্ড ভেঙে পড়েছিল এবং তাকে ফেরত প্রতিষ্ঠা দেবার আগেই আরম্ভ হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ( ১৯৩৯-১৯৪৫), যে যুদ্ধে মানবসমাজের সমস্ত নীতিবোধের জলাঞ্জলি ঘটে যায় ; আণবিক বোমার বিস্ফোরণের মাধ্যমে নস্যাৎ হয়ে যায় এতাবৎ দার্শনিকদের ‘ভালো, ‘উন্নত’,’সভ্য’, ‘মানবিকতা’ ‘ব্যক্তি চরিত্র’, ‘নৈতিক চরিত্র’ ‘ন্যায়পরায়ণতা’, ‘সততা’, ‘কর্তব্যপালন’, ‘দায়িত্ব’ ‘ভালোমন্দ বিচার’ ‘বিশ্বাস’, ‘হিতসাধন’, ‘মানুষের মঙ্গল’, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয়ক বক্তব্যগুলো । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও যে আঞ্চলিক যুদ্ধগুলো হয়েছে, তাতেও দেখা গেছে শত্রুপক্ষের নারীদের আয়ত্ব করে ধর্ষণ করাটা সৈন্যদের প্রধান লক্ষ্যগুলোর অন্যতম । ভিয়েতনাম যুদ্ধে নাপাম বোমায় জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছে সেদেশের সাধারণ মানুষকে । বস্তুত লক্ষ-লক্ষ মানুষকে গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে, যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে, তারপর এই জ্ঞান দেয়া যে স্বমেহন অনৈতিক, ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তির কাজ, অসুস্থ বিকার, ইত্যাদি বুকনিকে মনে হয় মূর্খতার চরম এবং তা নিছক দার্শনিক জোচ্চুরি । সাম্প্রতিক কালে পাকিস্তানে দেড়শো স্কুলের বাচ্চাকে অকারণে হত্যা করেছে তালিবানের আদর্শে বিশ্বাসীরা । কেনিয়াতে সোমালিয়ার আল শবাব গোষ্ঠী খ্রিস্টধর্মী ছাত্রছাত্রীদের পৃথক করে প্রায় দেড়শজনকে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেছে ।
বিশ্বযুদ্ধের ফলে মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদণ্ডে বিপুল পরিবর্তনের মাধ্যমে আক্রান্ত দেশগুলোয় যৌনবিপ্লব ঘটে যায় । বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন ক্ষেত্রসমীক্ষা করে দেখা গেছে যে প্রতিটি সমাজের একটি বড়ো অংশ, পুরুষ ও নারী উভয়েই, স্বমেহন করে। আমেরিকায় কিনসে রিপোর্টে তার প্রমাণ মেলে । জাপানে বিয়ে করা ক্রমশ কঠিন হয়ে ওঠে বাসস্থানের সমস্যার কারণে । তাই সঙ্গমের জন্য সিনথেটিক জিনিসের ফোলানো নারী উদ্ভাবন করতে হয় । তাছাড়া, বৌদ্ধধর্মে কেবল ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীরা ছাড়া আর কারোর জন্য স্বমেহন নিষিদ্ধ নয় । এক্ষেত্রে তাদের অবস্থান হিন্দুদের মতোই, ব্রহ্মচর্যের পরবর্তী স্তরে সে স্বাধীন যৌনতার অধিকারী ।
শুক্রকীট নিয়মিত ধাতুরসের সঙ্গে বেরিয়ে না গেলে মৃত শুক্রের সংখ্যাবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে । পুরুষের ক্ষেত্রে স্বমেহনে ধাতুরস বেরিয়ে গেলেই কাজটি সেই সময়ের জন্য সমাধা হয়ে যায় । নারীর ক্ষেত্রে অরগ্যাজমের চাহিদা থাকে বারংবারের ; সেকারণে সঙ্গমের আগে বা পরেও তাদের স্বমেহনের প্রয়োজন হয় । নারীবাদী আন্দোলনের প্রবক্তাদের কাছে এই প্রসঙ্গটিও উল্লেখ্য ছিল যে পুরুষেরা নারীর চাহিদার কথা জানে না; তারা নিজেদের কাজ সমাধা করেই মনে করে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ হয়ে গেল ।
ষাটের দশকে ইউরোপ-আমেরিকায় যে যৌনবিপ্লব ঘটে, তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে প্রায় প্রতিটি দেশে । তার আগে পরাবাস্তববাদীরা মানুষের দেহকে ক্যানভাস হিসাবে ব্যবহার করে ছবি আঁকা আরম্ভ করেছিল ।কাউন্টার কালচার বা প্রতিসংস্কৃতির প্রবক্তারা নিজের দেহকে আবিষ্কারের কথা বলেন; সমাজের নৈতিক বন্ধন এবং আইনের সীমা থেকে নিজের ব্যক্তিপ্রতিস্বকে স্বাধীন করে তোলার কথা বলেন । তাঁদের বক্তব্যের উৎস ছিল দ্রোহের এই বোধ যে নিজস্ব ইরটিসিজম হল একটি উৎসব, এবং এই উৎসব অন্যের মানদণ্ড দিয়ে নির্ধারিত হতে পারে না । ব্যক্তির ইরটিক যাপন হল স্বাভাবিক জীবনের অঙ্গ । তাকে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না । গণমাধ্যম আর ইনটারনেট আসার পর প্রভাব আরও গভীর হয়ে উঠতে পেরেছে । তারপর যখন সঙ্গমান্তিক পিল আবিষ্কার হল তখন অবিবাহিত নারী-পুরুষের সঙ্গমের অসুবিধাগুলো আর রইল না ।
যাদের বাচ্চা হবার সম্ভাবনা নেই, তাদের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্বমেহনকে জরুরি করে তুলেছে, শুক্রকীট বিক্রির জন্য । নারীরাও তাঁদের ডিম বিক্রি করার সুযোগ পেলেন । একদা যারা স্বমেহনের বিরোধী ছিল, তারাও বাচ্চা পাবার জন্য স্বমেহনকৃত শুক্রকীটের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হলেন । স্বমেহনের দর্শন পুরো এক পাক খেয়ে প্রাচীন ভারত, গ্রিস, মিশর আর রোমের প্রজ্ঞায় ফেরত চলে এসেছে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র