রত্নদীপা দে ঘোষ - মায়াজম

Breaking

২ নভে, ২০১৫

রত্নদীপা দে ঘোষ

                                             বিসর্জন





প্রথম পর্ব

ঠিক এইরকম মৃদু হয়েই লিখতে হয় বিসর্জন । আগমনীর ইমেজ জড়িয়ে যেমন প্রতিটি পাখি একযোগে বরসিত হরষিত হয় , হলুদ রোদ্দুরের সোনালি ইয়েতিরা মেতে ওঠে শরতের শিশিরসিমেন্টে , ঘুম ভাঙে আঙ্গুলের আটপৌরে টোকায় । টুক করে আঙ্গুলের মহাগ্রাফ পেরিয়ে পৌঁছে যাই বিসর্জনের উঠোনে , সেই গ্যালাক্সি বড় বেশি বাতাসিয়া বোতাম , বেদনার কুয়োরোম ।। যেন হারিয়ে ফেলেছি সব , হারিয়ে গেছে নিউটনরঙের নেশাতুর পৃথিবী । চকমকি ক্লোরোফিল সব সব ভেসে গেছে , চার হাত পা ... নখ চুল সব সব উড়ে গেছে সিনথেটিক সিনেমার চলচিত্রে ...
সেই চালচিত্রটুকু ধরে রেখতে চেয়েছি বারবার । যাবতীয় প্রটোকল ভুলে ... আহা , একগোছা আগমনী যদি জড়িয়ে রাখা যেতো চিরকাল ... যদি বিস্তৃত থাকা যেত অদম্যপিয়াসার পিয়ালক্ষেত্রে । মন্দ্র ছুঁয়ে থাকতুম , সপ্তক মোচড় দিত আমার চোখের বিলাবলে । আহিরের সাদা কালো , অন্ধকার আলো ... সে যেমন অপরূপ সারং ... বৃন্দাবনের বাদ্যযন্ত্র আর শরীরীভুঁই । সেই স্নান খোলা স্বর , সেই ওষ্ঠবর্ণের আকুতি ... কী চরম তার দাহ্যতা ... কমলেকামিনী ছাই হতে দিতুম না কোনোদিনই ...
বরং বিভোর হতুম । ছায়ানটের জটিলতা দিতুম মুছে । শাক্যপৃথিবীর সবুজ বেসমেন্ট আরো আরো সবুজ হত , অক্ষরগ্রাম থেকে ছড়িয়ে জেত শহুরে তনয়া । জিনসবৃষ্টির সাঁচিস্তূপ । আদ্র আবহাওয়ার জেলায় আরও স্পষ্ট হত পার্বতী বাউল ...কাব্যগ্রন্থের কোথাও শিকারি থাকতো না কোনো , থাকতো না উপমামেঘের ক্যাপ্রি ... বন্যতার ভেতর থেকে , বনাঞ্চলের ভেতর ব্যক্তিগত আঙ্গুর বাজিয়ে চলেতেই থাকতো প্রবল সাহচর্যের আগমনী । আমিও নিখুঁত হতেম , নিভৃত হতে হতে নিখুঁত হতেম , সমৃদ্ধ আগুনের আঁচ ... দেওয়াল বদলে যায় ... ফিনিক দিয়ে দিয়ে ফিনিক্সের ওয়াল বদলে যায় , উত্থানের পথ থেকে উঠে দাঁড়ায় যে মানুষ ... তাকে আমি প্রেমিক বলে দিতেম ডাক ... তুমি প্রথম অথবা তুমি শেষ ? নাকি তুমি পরিব্রাজক ... আগমনী থেকে এতোটা হেঁটে এসেছ , বিসর্জনের বোদলেয়ারে ...
হে বিসর্জন , তুমি এক সম্ভ্রান্ত এপিক । তুমি হাড়মজ্জার হারেমনির্যাস । তোমার গন্ধঘ্রাণ সেরে নিয়েছে আমার যাবতীয় স্নায়ু ... আমার ইচ্ছেরা সব আমার প্রান্তগুলো গণনা করেছে জন্মান্তরের রচনা । দিনযাপনের জুঁইফুল , চারাসকালের শিউলিফুল ... দ্রিমি দ্রিমি বোল তাদের , ভেবে দেখি ... আরে এই তবে দীপ ... আদিম সালসার অলৌকিক মদিরা । সেই মদের গ্রন্থি খুলে যাবে বলে কত ভয় , হেরে যাবার ভয় , হারিয়ে যা বার ভয় ... আসলে কিছুই কিছু না ... সব শুধু নাটকের ফেনা ... যেন বাঁধভাঙ্গা মরিচঝাঁপি ... আগমনি শেষে ... বিসর্জনের দহনে মেত্যে উঠেছে ... মুক্তাঞ্চল ...
সে কি অপচয় তবে ? । যার ভিজে চুল । যে কাদামাখা । সে তুমি ভাসমান ক্লান্তির ক্লান্তপ্রতিমা । তোমাকে চোখ দিয়ে শুন । তোমাকে মুখ দিয়ে দেখি । তমাকে কান্না দিয়ে গাই ... তুমি শোন , শুনতে পাও ? তুমি বুঝি ভুরুর সঞ্চালক ? ঢেউ ভাঙা তরী ? নাকি লৌকিক বনসাইয়ের ঝুড়ি ... বলয়ের দিন শেষ । শেষ আগমনীর পারানি । চতুর্ভুজ শ্রীনারায়ণী ... অন্তহীন পূর্বাপর ভেবে যে তোমাকে শাসন করে , তার দ্রাঘিমাকে তুমি এক নিঃশ্বাসে উদ্দালক করো , সেও তোমারি মহিমা । সংহারের ঢাক ঢোল বাজে । শিহরিত হয় কল্পপ্রয়াসে । কল্পনার সুউচ্চ চুড়াটি আর দীর্ঘ হয় ... ভ্রমণ ভুলে যায় মাস্তুলের গোধূলিনাভি ...
আমি সেই শৃঙ্গারগুলিকে আব্রু করি । খোঁপা বেঁধে দিই তাদের । রাজপথের দশাসই ঘুরে অস্তাচলের সূর্যনীরায় পৌছয়ই । কাঠামোর সংগীতে ধান ভানি । আতপের নাড়ি ছিঁড়ে ফিরে আসি । ভাঙাকোল চারিদিকে বাজায় অস্তসত্তার ঘুড়ি । বিরহীঋষির মত দুটি একটি তারা ফোটে ... পতাকার মত তারা কথা বলে , তারপর নিজেরাই ধ্বংস হয় ... ছবিতে কবিতে কেবল ধ্বংস আঁকে ... আত্মহারা চাঁদ ছতিফটিয়ে মরতে চায় , মরে ... সেই আত্মহত্যার কাদা ... থকথকে কান্নাদ্রবণ ... পৌঁছে যায় আগমনীর খুলিকোটরে । জানালার ঢাল বেয়ে দর্পিত বাঁশী , কুহুবাঁশী ।। যেন অমলতাসের রাজধানী , রাজদ্বার ... নদীয়ার রঙ্গালয়ে মেতে উঠছে বিসর্জনের তরোয়াল ...
কাকে বলে বিসর্জনের চিহ্ন ? বিসর্জনের নিজস্ব বুকসেলফ কো থায় ? বুকই বা কই ? বিক্ষিপ্ত শুধু বিষাদমেয়ের সই । আগমনী শব্দটিতে খুব খুব জোর । হাজার সিসির বারোয়ারিপনা । আমি তাকে দেখেও দেখি না । শুনেও শুনি না । আগমনী তে আমার গতিজাদ্যর বাতিঘর নেই কোন । গদ্য লিখি না আমি আমার স্ক্রিনের বিকেল জুড়ে বিসর্জনের মনিটর । আমি যেন ঝপ করে নিভে যাওয়া মিথোজীবী মানুষ । কাচগেলাসের আয়না পেতে দিলুম সাইজজিরোর এক অকালবিসর্জনে । আমার প্রেমিক ডুবে গেছে সূর্যের সাথে ... আর সমস্ত সম্ভাবনা গলে মাংস হয়ে গেছে । নিজের ছায়ায় লিখেছি বাদশাহ বিষণ্ণতা । আমার ভ্রান্তি জুড়ে জন্ম হয়েছে রিখটারের হেডলাইন ।
দু’হাতে জপেছি বিসর্জন । গ্রামোফোনের তীব্র গ্রাফাইট । ছায়াদের দৈর্ঘ্য প্রস্থ ।। ইঞ্চিকবচ মেপে দেখেছি সপ্তম তরঙ্গের বিসর্জন । আকাশের দিব্বি বলছি , সেই বিসর্জন আমাতেই ধ্বনিত । আমাকেই অনুরণিত সেই সুরভিত সিগনেচার । আমার হাতে হাত রেখে হাঁটছে অণুচক্রিকার স্কাল্পচার । বাস্তবিকই আমি খুব গভীরে চলে যাচ্ছি ... বিসর্জনের দরজায় নক করছি ...
ঝরে যাচ্ছি ... আমার কলাবৃত্ত ঝরে যাচ্ছে ... ঝরে যাচ্ছে বিশ্বাসী অক্ষরেখার ভাড়াটে পতঙ্গ । আমার প্রতিটি ভুল বুঝি এক একটি বিসর্জন । আমার প্রতিটি বিসর্জনই এক একটি ভুল ? তর্জনী তুলি ? কার অধিকারে ? কোন অধিকারে ?
একটা চন্দ্রবিন্দু আজকাল সহ্য হয় না । হাইফেন আমাকে নীল সোয়েটারের কথা মনে করায় । একটা উষ্ণতা আমাকে সিগারেট ঘেঁষা ধারাবাহিকের কথা মনে করায় । একটা আমি ঘুমের এপাশ ওপাশ ফিরি ... স্তনের উল্কিটি , ভস্মের ভেতরে ঝলসে যায় ... এবার অন্তত বিরহপর্বটি মিটুক । বহুকাল তো চলে গেল ... বহু জাহাজ নিমন্ত্রণে হারিয়ে গেল ... আমাদের ছদ্মবেশে ধুয়ে গেল দশমীর জয়পরিক্রমা ...
আমি শুভেচ্ছা পাঠাই তোমাকে ... হে বিসর্জন , ওগো বিসর্জনের বদ্যিবাজনা ... এখানে থেমো না ।। অসুখ অব্ধি হাঁটো । হেঁটে যাও । শনি আর মঙ্গলের দশা কেটে যাক । আবহাওয়া অফিস লিঙ্গ পরিবর্তন করুক । নিদেন পক্ষে বায়বীয় স্তর অতিক্রম করুক নবমরূপিণী দুর্গা ... বন্ধবৃষ্টির তড়িৎক্ষেত্রের যাবতীয় জিনকোড ঘাটুক মিছিল ...
গোলোক দুলুক স্লোগান আর পাঁচবার্ষিকীর শিরশিরে অনুভূতিতে ...
তোমার অসংখ্য স্মরণশক্তি । তোমার অসামান্য মায়াবী সহবাস
... তোমাকে পরিক্রমা করি ... ভ্রমণের স্লিপিং পিল করি .তোমাকে .. অথচ কিছুতেই বিসর্জনে সাজাতে পারি না ... তুমি আসাযাওয়া কর । তুমি যাওয়া আর আসা করো । তুমি শুদ্ধকল্যানের স্বরে ডাকাডাকি কোর । তুমি আমার বন্দীশালায় জাল ফেল জ্যান্তরঙের । তুমি আমাকে মৃত্যু দাও মহা-উৎসবের কাণ্ডপাতায় ... হে বিসর্জন , তোমার বুদবুদের ফুলদানিতে স্থাপন করি মৃদঙ্গের অন্তরাল ... তোমার গণসঙ্গীতে প্রশ্রয় দিই অন্তরবাসের আলাপচারিতা ...
নিরবরণ বিষণ্ণতাটি আমার ... বিসর্জনের ভেতরে ক্রমশ আন্তর্জাতিক হতে থাকে ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র