সৌরাংশু সিংহ - মায়াজম

Breaking

৬ মে, ২০১৬

সৌরাংশু সিংহ

  দ্য পিলগ্রিমেজ





প্রথম পর্ব :-

(১)
বেয়ারাটা নীল টুরিষ্টারটাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বখশিশ নিয়ে সেলাম ঠুকে চলে গেছে। রুম সার্ভিসে ফোন করে এক প্লেট চিকেন স্যালাড পাঠাতে বলে দিলাম। সিগনেচারের বোতলটা টুরিষ্টারের আনাচে কানাচে কোথাও ওঁত পেতে বসে আছে।
পিঠের ঝোলাটা থেকে নীল রাত পোষাকটা বার করে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষন- রূপম ছোঁড়াটা একটা গান লোকের ঠোঁটে ঝুলিয়ে দিয়েছে বেশ “নীল রঙ ছিল ভীষণ প্রিয়... তাই নীল রঙে মিশে গেছে লাল...”
নিজের দীর্ঘশ্বাসের শব্দে চমক ভাংলো, রাত পোষাকটা বাথরুমের বাইরে ড্রেসিং টেবিলে রেখে মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটা এসএমএস করলাম ‘I’m fine- bz 4 few days, will b back on 7.’
সুইচ অফ করে রাখলাম- ২০ বছর পড়ে যখন ছেলে গ্র্যাজুয়েশনের পথে তখন মনযোগ কারুর জন্য পড়ে থাকে না- শুধুমাত্র ভবিষ্যতের সুরক্ষায় হাত না পড়লেই হলো।
এদের ব্যবস্থাপনা আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে-বাথটাবের সুদৃশ্য আনুষাঙ্গিক দেখে ভাবলাম- সময় পালটায়- সময় এগিয়ে যায়- মানুষ পিছিয়ে পড়ে তাল মেলাতে না পেরে।
জলটা হালকা গরম হয়েছে- নিরাবরণ শরীরটাকে ডুবিয়ে দিলাম তাতে- মনটাও...







(২)
'हर आहट पे तेरी जुस्तजू जिन्दा होती है..'(হর আহট পে তেরী জুস্তজু জিন্দা হোতী হ্যায়)
সময় গড়াতে লাগল পিছন পানে- পনের বছরের কাছে পৌঁছে কাঁটাটা এদিক ওদিক দুলতে থাকল।
......
“पता है, जिन्दा हूँ मैं, मुझे भी हैरानी होती है-
तुझे भी पता है के नही शास लेती हूँ मैं...”
(পতা হ্যায়, জিন্দা হুঁ ম্যায়, মুঝে ভী হ্যায়রানী হতী হ্যায়
তুঝে ভী পতা হ্যায় কে নহী, শ্বাস লেতি হুঁ ম্যায়।।)
ইনল্যান্ডটা টেবিলের উপরে রেখে মনকে বলেছিলাম-“এবারে তাহলে সাগরে?”
মনের টান যে বড় টান- যুক্তি তক্ক গপ্পোর একশো হাত দূর দিয়ে যায়- আমার তো কথাই নেই- পারি না, করি না, দেখি না, শুনি না- কিন্তু মনকে ছেড়ে দিই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
দু-তিনদিনের ব্যপার- ঋজুর পরীক্ষা ফুরিয়েছে, মামাবাড়ি গেছে ওরা। ঝাড়া হাত পা এখন। অফিসের ছুটি জমে জমে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শুকিয়ে যায়- নিরস লোক আমি- ছুটি পেতে দেরী হয় না- নীলে মুড়ে বেড়িয়ে পড়ি নীলের সন্ধানে।
কত বছর? দশ হয়ে গেছিল কি? দশ- আমার নির্বাক নিশ্চুপ বছরগুলো। দশ-আমার পাথর চাপা বছরগুলো। দশ- আমার গতানুগতিক বছরগুলো...
দেড় দিনের ট্যাক্সি ট্রেন বাস পেড়িয়ে এসে দাঁড়ালাম সেখানে, যেখানে তিন সমুদ্র মিলিত হয়েছে।গান্ধীধামের ছাদের উপর- বিদিশার নিশার মতো চুলগুলো মুখে লাগছিল- একটা ছিম ছাম মিষ্টি গন্ধ। সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিল-
“মুঝে পতা থা...দোস্ত নেহী হ্যায় মেরা... তুম ভি তো নেহী হো... কেয়া হো তুম?”
হঠাত মাথায় দুষ্টুমি খেলে গেল, মিচকে হেসে বললাম “লাইট হাউস।“
তাকালো সে, কতদিন পরে? কতদিন? পাল্টেছে কি? হবে হয়তো কিন্তু চোখের গভীরতা তো একই আছে- ভাঁজগুলো আরও গভীর হয়েছে আর চুলও হয়েছে বড়- মিষ্টি হাসিটা খেলে গেল তার মুখে
“এক নম্বর কা বদমাশ হো তুম- স্মার্ট হো গয়ে হো- শাদীকা ফল মিঠা হোতা হ্যায়, বোলো?” হাসলাম- আবার একটু মেঘ খেলে গেল- রেলিঙে ভর দিয়ে বলল “পতা নেহী মুঝে হামেসা সে হি করেলা বহুত পসন্দ হ্যায়- শেহদ হজম নেহী হোতি...”
স্যালাডটা দিয়ে গেছে- আজ আর বেশী খাব না- একটা পেগ নিয়ে বারন্দায় এসে বসি- হালকা ঠান্ডা আছেই। আজ ঘুম আসবে না বোধহয়।
ঘুম তো সেদিনও আসে নি- একফালি চাঁদ ঘুমোতে দেয় নি যে- ঝড় উঠেছিল সেদিন- আগুন লেগেছিল সাগরে।
তারও আগে একদিন ছিল- মনে রঙ ছিল- অন্ধকার আকাশটায় রামধনু পোঁচ পড়েছিল- হালকা বৃষ্টি, মন ভিজেছিল সেদিনও- নাকি সেদিনই ভিজেছিল মন প্রথম...
“Are you a photographer? Of course having a camera does not qualify you as one. I do freelancing. But currently on a pilgrimage- to have peace with myself. Oh! Hi! I am Anita, Anita Shroff…”
হাতটা এখানেই ছুঁয়েছিল হাত- না ঠিক এখানে নয়, কিমি ১৫ দূরে পাহাড়ের ধারের একটা চায়ের দোকানে- চুল ছোট ছিল অনেকটাই- ছিল না মেক আপের প্রয়োজন। অবশ্য মেক আপের প্রয়োজন কখনই ছিল না অনিতা-র, অন্ততঃ আমার কাছে- কি দেখেছিল কে জানে? প্রশ্ন করলে বলত না কিছুই- মুখ নামিয়ে হাসতো নিজের মধ্যে, আর চোখটা চক চক করতো। একবারই খালি লিখছিল-
“You know, what you are? When I am lost in the dusty lanes with flutter of questions and nowhere to go, I see thy face comes out of the dark with the plate in hand full of answers. Yes, you are my answer, I always knew you have them, I will always know…”
না অনিতা, প্রশ্নের উত্তর নেই আমার কাছে- নেই নেই- ছিল না কোনোদিনই। হাঁপিয়ে যাই- সাধারণ ভাবে প্রতিটি পূর্বনির্ধারিত পদক্ষেপে মিলিয়ে মিলিয়ে যেতে যেতে- ভিতরটা বিদ্রোহ করে- কিন্তু আমি তো তুমি নই অনিতা- আমার যে একটা স্পষ্ট ছবি আছে- তাতে তো একটাও অস্পষ্ট দাগ নেই, সবই তো সেই নিখুঁত, cut to cut.
বাইরের কুয়াশা ডান গাল বেয়ে কখন যে নেমে আসে... অর্ধভুক্ত প্লেটটা বাইরেই রেখে উঠে আসি- সিগনেচারকে ঘুম পাড়াতে। আমি জেগে থাকি কড়িকাঠ হীন সিলিং ভেদ করা দৃষ্টি নিয়ে। ধীরে ধীরে তাও ঝাপসা হয়ে আসে- ভোর হয়- চোখ খুলে দেখি- পর্দার ওপার থেকে দেবদারুর মাথা ছুঁয়ে সূর্যের এলার্ম- যাত্রা শুরু হবে আজ।









(৩)
সাড়ে সাতটায় গাড়িটা এল- তার পর পয়তাল্লিশ মিনিট- ধাবাটা যেখানে ছিল- সেখানে একটা ছোট্ট খাট্টো মোটেল- The Nilgiris-সময় নষ্ট করার মানে হয় না- তাই তার পাশ দিয়ে ট্রেকিং শুরু করলাম- ক্যাননটা রুকস্যাকে রেখে- শরীরটা জুত ছিল বলে- বিশেষ অসুবিধা হলো না।
ঘন্টা দেড়েক লাগল- গতবারের থেকে কুড়ি মিনিট বেশী- যদিও এবার একাই চড়ছি- তবুও পথের থেকে পথ প্রদর্শকের আকর্ষণ ছিল বেশী সেবারে।
“You know, there is a better place, an hour’s hike from here. Let’s go.”
এক প্রকার হাত ধরেই টেনে নিয়ে গেল আমায়- মন্ত্রমুগ্ধের মতো চড়তে শুরু করলাম। কখনো খাড়াই কখনো একটু সমতল- তবে অনিতার সঙ্গে তাল মেলানো বেশ মুশকিল হচ্ছে। অনিতার সে দিকে যে বিশেষ নজর আছে সেটা বলে মনে হচ্ছে না- নিজের মনেই বক বক করতে করতে উঠছে- কিছু কানে ঢুকছে কিছু ঢুকছে না- শুধু নিশিডাকের মতো কিসের আহবানে উঠেই যাচ্ছি উঠেই যাচ্ছি! একবার বোধহয় পা ফস্কেছিল- খপ করে একটা শক্ত হাত ধরে নিল আমার বাড়ানো হাতটাকে- দ্বিতীয়বারের জন্য- ভরসা জাগানোর মতো হাত- বিহবল হয়ে তাকিয়েছিলাম- বলল-
“লাগতা হ্যায় লড়কি নেহী দেখা জিন্দেগী মে”।
আঁতে ঘা লাগল, “নেহী নেহী...” বলতে গিয়েও ভাবলাম প্রথম পরিচয়ে সব কিছু খুলে বলাটার নাম বোধহয় আদেখলাপনা। মৃদু হাসলাম- খোঁচাটা তখনও চলছে-
“হায়, ম্যায় মর জায়ুঁ...লাগতা হ্যায় মেরা Assessment গলত হ্যায়”। মিচকে হাসি- উত্তর দিলাম না, সামলে নিয়ে বললাম “চলে?”
ঘন্টা খানেক পরে একটা চাতালের মতো জায়গায় উঠে এলাম- সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম... “হামিনস্ত হামিনস্ত হামিনস্ত”। এখানেই স্বর্গের একটুকরো creation of Adam-এর মতো দেবলোক থেকে নেমে এসেছে। ভারতবর্ষের মধ্যেই যে এত সুন্দর এক ফোঁটা স্বপ্ন লুকিয়ে আছে জানা ছিল না।অনিতার দিকে তাকিয়ে দেখলাম- আমার দিকে দেখছে না আর- দু হাত ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে, বুকটা অবাধ্য ঢেউএর মতো ওঠা নামা করছে- চোখ বন্ধ করেই বলে উঠলো-
“You know, every time, every time I come here- the clouds, the silent clutters of lonely trees, the misty air of foregone mountains, the vibrations of unseen river flow through my veins. Feel it, can you? Breathe, breathe, breathe... Bring it out, your passion, your pleasure, your existence all will be culminated in one breath. You listen to it Dear, দিল পে লে লো ইসে.....”
কিছু বলার ছিল না তখন- খালি মন ও শরীর জুড়ে বিদ্যুতের চলাফেরা অনুভব করলাম আর অনুভব করলাম অবর্ণনীয় মহাজাগতিক চেতনাকে ... “হামিনস্ত হামিনস্ত হামিনস্ত”।
বছর ২৫ পরে তার একটু কি পরিবর্তন হয়ে গেছে? খালি খালি লাগছে? জানি না- জানার চেষ্টা করলে একগুচ্ছ প্রশ্ন মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু করবে- যার উত্তরের জন্য এখনো তৈরী করতে পারি নি মনকে। ভাবলাম কিছু কিছু প্রশ্ন অনুত্তরিত থাকলেই ভালো। মাটিটা ভোরের শিশিরের ছোঁয়ায় ভিজে আছে- চিত হয়ে দু হাত ছড়িয়ে শুলাম! সারা পৃথিবীর ভালোলাগা ভালোবাসা দু হাতে জড়ো করে নিলাম- মনের আয়নায় একটা মুখ- তির তির করে কাঁপছে- ভালো লাগা না কি হারানো সুরের ঝঙ্কার? একটা দ্বীর্ঘশ্বাস পড়লো...
কিছুক্ষণ... তারপর উঠে পড়লাম। খামখেয়ালি ক্যামেরায় যত্নশীল প্রকৃতির আঁকি বুকি ধরার খানিক চেষ্টা- তারপর বসলাম শান্ত হয়ে, একটা পাথরের উপর।
রুক স্যাকটা থেকে একটা বাক্স বার করলাম-দীর্ণ জীর্ণ তার অবয়ব। আমার মন? খুললাম তাকে। থরে থরে সাজানো হৃদয়ের ইতিহাস- রক্তক্ষরণ নাকি সুগন্ধ?অভস্থ আঙুলের টানে উঠে এলো একটা কাগজ- খুললাম।
পুরোনো রুলটানা খাতার পাতা- পড়তে পড়তে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল-
“A red rose craved for a bunch of bees, but was always bereaved of them. But she always dreamt in night that the heaven is full of bees and when night falls all the bees fly down to drench the rose with soft kisses. It never happened of course. One night, the full moon asked the rose. “Why do you wait as you always knew this will never be reality?” “Its not just waiting, but keeping yourself open so that I can live the next day. I want to live the next day, the next and the next…” You know na... হর কিসিকো মুকম্মল জাহাঁ and blah blah blah?”
দুটো ভেজা ঘাস তুলে রাখলাম কাগজটার ভিতর- বেশ কয়েকটা কাঠি খরচ করে তবে আগুনটা জ্বলল- কালো কালো প্রজাপতিগুলো উড়ে গেল সূর্যের দিকে- চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ, অনিতা বোধহয় কাছে পিঠেই কোথাও আছে।
নেমে গিয়ে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলাম পাশের গ্রামের উদ্দেশ্যে পা বাড়াবার জন্য! মিনিট পঁচিশের ড্রাইভ- পঁচিশ বছর পেরিয়ে এলাম। সেবার একটা লজঝরে জীপ জোগাড় করেছিল অনিতা। জিজ্ঞাসা করেছিলাম “পেলে কোত্থেকে?” থামিয়ে দিয়ে বলছিল- “সওয়াল বহুত করতে হো- বুরি আদত...”
নাহ, প্রশ্নগুলোকে কোনোদিন প্রশ্রয় দিই নি আর। সেদিন যখন বলেছিল, “চলো ভাগ চলে- কোই হামে ঢুন্ড নেহী পায়ঙ্গে” প্রশ্ন করি নি কোনো, মাথা নীচু করেছিলাম- প্রশ্ন ছাড়াই উত্তর পেয়ে গিয়েছিল অনিতা। “ডরপোক নেহী, বুঝদিল হো তুম”। বলতে পারি নি- “আমার বাড়িতে মানবে না অনিতা- আর মাকে কষ্ট দেবার মতো নিষ্প্রাণ এখনো হয়ে উঠতে পারি নি গো”।
অনিতা বুঝেছিল- বা হয়তো বোঝে নি- পরের দিন সকালে আর খুঁজে পাই নি- একটা চিঠি ছিল বেয়ারার হাত দিয়ে পাঠানো-
“हर एक से पूछा शबाब उसके न मिलने का
हर एक ने बताया के वो मेरे लिए बना ही नहीं...
(হর এক সে পুছা শবাব উসকো ন মিলনে কা
হর এক নে বতায়া কে ও মেরে লিয়ে বনা হী নহী)
Blue suits you superbly as you are Neelkantha, who sips all the blues from my darkness. Stay put and be happy Dear. You are really unique….
इक ज़रा सा गम-इ दौरा का भी हक है जिस पर
मैंने वो सांस भी तेरे लिए रख छोड़ी है”।।
(ইক জরা সা গম-এ দৌরা কা ভী হক হ্যায় জিস পর
ম্যায়নে ও শ্বাঁস ভী তেরে লিয়ে রখ ছোড়ী হ্যায়)
নীচে কোনো সাক্ষর ছিল না... অনেক না বলা কথা, না নেওয়া নিশ্বাস না দেখা চোখের জল রাখা ছিল বোধহয়। না বোঝা অনেক ভাষা না জোড়া অনেক তার জমা হয়েছিল আমার মনেও...







(৪)
গ্রামটা এখনো সেই রকমই আছে- সেই মায়ায় জড়ানো- আধবোজা চোখে চেয়ে থাকা- দুলকি চালে জীবন চলে- পরিবর্তনের মধ্যে বাড়িগুলো পাকা হয়েছে, দু তিনটে ডিশ বাড়ির ছাদে আর কয়েকটা কেবলের আর বৈদ্যুতিক তার কাটাকুটি খেলছে। ভালো করে ঠাহর করলে দেখা যাবে- পথ ঘাট বাঁধানো, কয়েকটি মোটরচালিত সাইকেল এবং বেশ কিছু তিন চাকার গাড়ি এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে- তা এটুকু তো আশা করা যেতেই পারে।
এক বাক্স টফি ছিল, বাচ্চাদের মধ্যে বিলি করলাম-ইতস্তত বড়রাও উঁকি ঝুকি দেওয়া শুরু করল। কয়েকজন মাতব্বর প্রশ্ন করছিল- ‘কাগজের লোক’ ‘রাইটার’ ইত্যাদি বলে ম্যানেজ করলাম!
কিছু পরে একটা আধবুড়ো লোক এগিয়ে এলো- দেখে টেখে মোড়ল বলেই মনে হলো- জিজ্ঞাসা করল “আপ কিসিকো ঢুন্ড রহে হো কেয়া?” মুখটা চেনা চেনা লাগল- ছোট চোখ চোখা নাক ফরসা রঙ- চোখের নীচের চামড়া একটু কুঁচকেছে- পিঠটা একটু বাঁকা। একটু ইতস্তত করে বললাম- “অনিতা স্রফ?” লোকটার চোখ দুটো চক চক করে উঠলো পুঁতির মতো। “ভাইয়াজি, পহচানে নেহী? ম্যায় জোগিন্দার হুঁ, জোগিন্দার বিস্ত- দিদি আপকে বাতে কিয়া করতি থি। আপ বহুত দিন পহলে আয়ে থে দিদি কে সাথ- আপ শায়দ মুঝে পহচান নেহি পায়ে।” মুখের মিলটা খুঁজে পেলাম এবার- সেবার যখন এসেছিলাম বছর চল্লিশের লোকটা খুব বাধ্য ছাত্রের মতো সঙ্গে সঙ্গে থাকছিল- অনেক ব্যাপারেই অনেক সহযোগিতা করেছিল- অনিতা এখানে বাচ্চাদের একটা স্কুলের ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছিল- একটা আত্মার যোগাযোগ তো ছিলই- যে কোনো unconventional কাজের প্রতি অসম্ভব উতসাহ দেখেছিলাম মেয়েটার- যা কিছু নিয়ম মতো চলে সবেতেই বিতৃষ্ণা- সবই খারাপ-
“ভাঙ ভাঙ ভাঙ কারা আঘাতে আঘাত কর
ওরে আজ কি গান গেয়েছে পাখী এসেছে রবির কর।।”
অনিতা সেই রবিরশ্মির খোঁজেই তোলপাড় করত- নিজেকে, সারা বিশ্বকে- কে জানে শেষ পর্যন্ত পেল কি না?
দুপুরের খাবারটা বিস্তজীর বাড়িতেই সারলাম- সাধারন ডাল- ভাতও আপ্যায়নের গুনে অমৃত হয়ে ওঠে। বিস্তজী নবনির্মিত স্কুলবাড়িটা ঘুরে দেখালেন- আসার সময় গাড়ির কাছে এসে পকেট থেকে একটা পুরোনো বাসি চামড়ার ছোট্ট প্যাকেট বের করলেন, আমার হাতে দিয়ে বললেন, “দিদি নে দি থি, আপকে লিয়ে?” অবাক হলাম- জানলো কি ভাবে? নাহ, প্রশ্ন তো করবই না... গাড়ী চলতে শুরু করল। প্যাকেটটা খুললাম- একটা কাঠের গলার হার- চমকে গেলাম দেখে। পুরানো, রঙ চটে গেছে কিন্তু ছোঁয়াটা সেই থেকেই গেছে- গ্রাম্য মেলা থেকে আপাত নিরীহ সস্তা একটা উপহার আমার কাছে তখন মুক্তোর মালার থেকে কম কিছু লাগলো না। চিঠি ছিল কি? নাহ সে রকম কোনো আভাস পেলাম না!
হোটেলের সামনের ঢালু জমিটার উপর সব থেকে লম্বা ঝাউগাছটার নীচে কবর দিলাম তাকে- তাকিয়ে থাকলাম উথাল পাথাল জমিটার দিকে- জীবনরেখার ওঠা নামা জীবনপথের এক কোনে পড়ে থাকল- আমি ছাড়া কেউ জানলো না যে মাটির বুকে কি ঐশ্বর্য বিলীন হলো- মাটিতে এক টুকরো ভালোবাসা মিশে গেল।
মনটা কিরকম অন্য রকম হয়ে আছে বলে বোঝাতে পারব না- অদ্ভুত একটা দোলাচল- যাকে যেমন ভাবে ভেবেছিলাম সে কি সেটুকুই? ব্যাপ্তিকে বুঝতে পারি নি তার? অক্ষমতা আমারই। নশ্বর মানুষ মাত্র- ছুঁতে চেয়েছিলাম হাত দিয়ে- কাঁচের মনে করে নাড়া চাড়াও করতে পারি নি- কিন্তু মন দিয়ে ছুঁতে পেড়েছি কই? ব্যালকনিতে বসে ভাবছিলাম।
দু একজন বোর্ডার হয়তো একটু উতসাহ নিয়ে কথা বার্তা বলতে এসেছিল- কিন্তু আমার মনটা জলের মতো টল টল করছে- সেটা নিজের কাছেই রাখার মানসিকতা উষ্ণতা উতপন্ন করতে পারে নি। একা থাকি না একটু? একা? থাকি নি তো কোনোকালেই- সব সময় তো অন্যের জন্য বাঁচলাম- অনিতা জিজ্ঞাসা করেছিল চিঠিতে
“Do you know how to breathe for your own? Your every heart beat is for others. Even when you reply to my madness- it’s only that you care for me and not that you really desire to do so…”
কি করে বুঝেছিল কে জানে? হয়তো আমার চিঠিগুলোতে আমার কথা থাকতো না- কি লিখতাম? আমি খুশী আছি- তুমি খুশী থাকো, ইত্যাদি লিখতে গিয়ে পেনের গতি মুখে চড়া পড়তো। কি করে লিখি? ভাবিই নি কোনোদিন আমি কিসে খুশী? অন্যের খুশীকেই নিজের খুশী হিসাবে ধরে নিয়ে পরিতৃপ্ত থাকাটা খুব সুন্দর শিখে নিয়েছিলাম- মনকেও শিখিয়ে দিয়েছি- কিন্তু কত দিন?
মন বলে উঠল- “আমার মন যখন জাগলি না রে... মনের মানুষ এলো দ্বারে......” কাজ করা গ্লাসটায় চুমুক মারলাম- না, মাতাল আমি হবো না- আমার চিন্তন এই কটা দিন আর হারিয়ে যাবে না! প্রতিটি মুহুর্ত তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে- প্রতিটি চমক, প্রতিটি জানা, প্রতিটি মুহুর্তের প্রতিটি অজানা- প্রতি হৃদস্পন্দনে অনুভব করবে সে।
রাত বাড়ে, টলো মলো পায়ে একরাশ অনুভব নিয়ে ফিরে গেলাম অচিন্তের কোলে- কাল আরেক নতুন চলা- নতুন করে জানার চেষ্টা- অনিতা স্রফ, অনিতা, নীতা, এনী, এনিটা...... কে? কে? কে সে? আমার সে কে?
ভোর এল নতুন আলো নিয়ে, বেড়িয়ে পরলাম- কালকেই ঠিক করে ফেলেছি- জীবনের আরামকেদারায় বসে এই সফর করব না। Comfort level-এর বাইরে বেড়িয়ে এসে অনিতাকে খুঁজে পাওয়া যাবে বলেই বিশ্বাস জন্মাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। তাই সূর্যের সঙ্গে সঙ্গেই উঠে পড়ে বাস টার্মিনাসের দিকে এগিয়ে গেলাম- ড্রাইভারকে বললাম বিল যথা জায়গায় পেমেন্ট হয়ে যাবে আর সঙ্গে যেতে হবে না- দুশো টাকা বকশিশ দিলাম আমার নতুন পথের প্রথম সারথীকে।







(৫)
সাধারণ যাত্রীবাহী বাসের আরাম বহুদিন সহ্য করি নি- কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই অসুবিধাগুলো সুবিধার সঙ্গে মিশে গিয়ে গা সওয়া হয়ে গেল- ভোরের দিকে শিশিরের ঘুম ভেঙে উঠে ঝাউপাতার ডগায় যখন আলোর প্রবেশ ঘটে তখন থেকেই যেন দিনের রূপবদল শুরু হল- সমতলে নামতে নামতে দিন নিজের রূপে প্রকাশিত হতে শুরু করল।
এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখলাম যে প্রকৃতি আমার মনের সঙ্গে এই পথে মিশে যায়-পঁচিশ বছর আগেও দেখেছিলাম শুধুমাত্র অজ্ঞানতা বশত চিনতে পারে নি- আমার মনে তখন অঝোরে ঝরছে- কোনোকিছুকে পেয়েও না পাওয়ার আকুতি- জাল ছিঁড়ে বেরোতে না পাবার জ্বালা- শূন্য মনের আপাত ভাবলেশহীনতা- সব মিলিয়ে বাইরের অবিরাম বরিষণের সঙ্গে সঙ্গে অস্পষ্ট হয়ে মুছে মুছে যাচ্ছে। আমি যেন সেই সব পেয়েছির দেশ থেকে বিতারিত- পালাতে চাইছিলাম কিন্তু সময় পেরিয়ে গেছে- রোদ্দুরের রঙ কখন যেন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পালিয়ে গেছে- একমনে খুঁজেও পাচ্ছিলাম না তাকে- বেশ কিছুকাল পরে সে নিজেই এসে ধরা দিল।বর্ণান্ধ খামে ভরে- সেই রুলটানা কাগজঃ
“दे के दिल हम जो हो गए मजबूर
इस में क्या इख्त्यार है अपना
कुछ नही हम मिसाल-इ- उनका लेके
शहर- शहर इश्तहार है अपना।।
हय्रानी तो हुई होगी के कैसे तुमे खोज निकाले हम
पता है दुनिया में बे-ईमान और भी है
हर पता की कोई तो निशानी होती है
हर वफ़ा का बेहिसाब और भी है...”
(দেকে দিল হম জো হো গয়ে মজবুর
ইস মেঁ কেয়া ইখতিয়ার হ্যায় অপনা
কুছ নহী হম মিসাল-এ-উনকা লেকে
শহর- শহর ইস্তহার হ্যায়া অপনা।।)
(হ্যায়রানী তো হুই হোগী কে ক্যায়সে তুমে খোজ নিকালে হম
পতা হ্যায় দুনিয়া মে বে-ইমান ঔর ভী হ্যায়
হর পতা কী কোই তো নিশানী হোতী হ্যায়
হর বফা কা বেহিসাব ঔর ভী হ্যায়)
হাতের লেখাটা ততদিনে বড়ই পরিচিত হয়ে গেছে! শেষ লেখাটা চোখের উপর ভাসতো- ছট ফট করলাম কটা দিন- ভালো করে জানাই হয় নি মেয়েটাকে- তার আগেই...
কিন্তু কদ্দিন আর অনির্বচনীয়র আনন্দে উত্তাপহীন মাতোয়ারা হওয়া যায়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভুলে গেলাম- বা বলা যেতে পারে চাপা পড়ে গেল অনিতা, অনিতা স্রফ। জীবন আমায় আবার দোলাতে দোলাতে নিজের পথে মোহাবিষ্টের মতো টেনে নিয়ে গেল।
এখন যেমন চলেছি-খানা খন্দ পেরিয়ে- ছাগল- ভেড়ার গন্ধ নিয়ে- রংচঙে কৃত্রিম কলসির দোলা খেতে খেতে। আকাশ এখন আমায় দেখে হাসছে। হাসুক- উপাদান দিয়েছি তাকে আনন্দের, এটাই আমার সবথেকে বড় পাওয়া। সবসময় অন্যদের খুশী করার জন্য বেঁচেছি সেটা ক্ষুদ্র স্বার্থর উপর হয়তো- কিন্তু প্রকৃতিকে আনন্দ দেবার মধ্যে একটা মহাজাগতিক অনুভব লুকিয়ে আছে- কাল থেকে সেটা টের পাচ্ছি- পরিবর্তনটা কি খালি কাউকে জানার আনন্দ, চেনার আনন্দ নাকি না পাওয়া না চাওয়ার মধ্যেও স্বর্গীয় আলোড়ন লুকিয়ে থাকে?
পথ অনেকটাই- চড়াই উতরাই, জঙ্গল শহর, গ্রাম মাঠ সবই চিত্রকল্পের মত চোখের সামনে দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে- কত রকম মানুষ, কতরকম সাজপোষাক-জঙ্গলের আদিবাসী- গ্রামের গরীব শহরের খেটে খাওয়া মানুষ- ভেড়া ছাগল সব মিলিয়ে বাসটা পেটমোটা টিফিন বক্সের মত দুলে দুলে চলেছে। শক এবসর্ভার লাগানো সেডান বা হাওয়াই জাহাজে চড়ে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে- দুলুনিটাই আর অনুভব করতে পারি না। কিন্তু এই ঝাঁকুনিটা মন্দ লাগছে না- যেন বাসটা বারে বারে বলছে থিতু হতে যেও না- তাহলেই বিপদ।
এতটা পথের একটা শারিরীক ক্লান্তি আছেই কিন্তু মন ফুরফুর করছে। ও হ্যাঁ, আরেকটা কাজ করেছি- আমার বহুমুখী ক্যামেরাটাকে ক্যুরিয়র করে আমার ক্যামেরাওলার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি- এই বলে- কিছু গলদ আছে, কিন্তু এক্ষুনি যেন না খোলে- আমি গিয়ে কথা বলে নেব।
গলদটা তো আসলে মনে- ভুলে গেছিলাম- রকমারি বাক্সে যে ছবি জমা রাখা যায় মন তার থেকে অনেক শক্তিশালী ইনবক্স। আর চোখের ১৬০০ মেগাপিক্সেলের লেন্স দিয়ে যে ছবি তোলা হবে তার ধারে কাছে থাকবে না ওই মেক আপ বক্সের আয়তনের ক্যামেরার মনে রাখা ছবির কোয়ালিটি। তার চেয়ে এই বেশ আছি...
অনিতার কথাও তো সেইরকমই ছিল। মনের চোখটা খোলো-মন কি আঁখে-আর পৃথিবীকে সেই অপার্থিব চোখ দিয়ে দেখার আনন্দটা তারিয়ে তারিয়ে অনুভব কর- ওই যে বাচ্চাটা প্রথমবারের জন্য বাসে চড়েছে- দুচোখে তার অপার বিস্ময়। পিছনের দিকের সিটে এক আধ বুড়ো বসে আছে- শরীর ভেঙেছে, কিন্তু মন? চোখ দেখে মনে হয় এখনো বছর ২০ টেনে দেবার ক্ষমতা রয়েছে ওই একদা সুঠাম শরীরে।
কিন্তু আমরা? মানসিক বয়স যে জোয়াল টানতে টানতে দিগন্তের দিকে ঢলে পড়েছে- বিলাস বহুল জিম আর সউনা বাথের শরীর চর্চাও বাঁচাতে পারবে বলে মনে হয় না- প্রকৃতি দুহাত ভরে দিয়েছে যেমন ধীরে ধীরে নিয়েও নিচ্ছে- যদি না প্রকৃতির বুকে নিঃশর্তে ফিরতে পারি।
গত পাঁচ বছর ধরে কত রকম ভাবে অনিতাও সেই কথা বলেছে- আমি আমার মতো করে “হুঁ, হাঁ” করে গেছি- আর মনে মনে বলে গেছি “ ঘানি তো আর টানলে না- বুঝবে কি করে?” এখন বুঝতে পারছি অনিতা কতটা সত্যি কথা বলতো-দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, পিছুটান না রাখা, সব যোগ হয়েছিল এই ফিলোজফির সঙ্গে।









(৬)
পাঁচ বছর কেটে গেল তখন থেকে? নিজেকেই প্রশ্ন করলাম। হাতটা আপনা আপনিই মাথায় চলে গেলো পাকা চুল খোঁজার তাগিদে... ৫ বছর...Five years have passed; five summers, with the length of five long winters!
এই পাঁচটা বছরের দোলাচল, এই পাঁচটা বছরের অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে দম বন্ধ করা পরিস্থিতি ছিল-কাল থেকে অনেকটা মেঘই যেন সরে গেছে।
আমার শহরে বসন্ত এনেছিল- পাঁচ বছর আগে- সঙ্গে নিয়ে গল্পের ঝুলি- দশ বছর পরের অনিতা অনেক বদলে গেছিল- শরীর, অভিজ্ঞতা এবং বয়সের ভারে একটু ভারী হয়েছে- তবে ব্যক্তিত্বের জন্য মানিয়ে যেত- মেক আপহীন মুখে যে আলগা চটক লেগে থাকত তার কোনো পরিবর্তন হয় নি। রোদের রঙ সারা শরীরে নিয়ে- হঠাত করে অফিসের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল- একটা হৃদস্পন্দন কি পড়ে নি? নাকি অনেকগুলো- অবাক হতেও পারি নি ঠিক করে- হাসতে পেরেছিলাম খালি-মনটা সত্যিই মেঘ সরিয়ে হেসে উঠেছিল-মুখ লোকায় নি কিছুই।
“হায়, ম্যায় মর যাউঁ...” সেই একই ভাবে গালে হাত দিয়ে ইষত বেঁকে মুচকি হেসে বলে, “বড়ে আদমি বন গয়ে হো-চেহরে মে ভি রৌনক আ গয়ে। আয়ি থি তুমহারে ইঁয়াহা, সোচে কে মিলকে জাউঁ? ক্যায়সে হো?”
মাথা নাড়লাম, “How are you? হাওয়া কা ঝোঁকা কি তরহা আতি হো- অউর ফির...”
“অউর ফির কেয়া? Like a silent river I flow, through the veins of time and grow- through the vines of mountain I bloom and the sundrenched stones caresses the gloom....”
অনেক কথা হল সেদিন-মানে বেশির ভাগ সময়েই আমি শুনলাম সে বলল। বরাবরই অবশ্য তাই হয়ে থাকে আমি সেই ধরিত্রীর মতো সব কিছু শুষে নিই আর সে অকাতরে ঢেলে যায়- তার রাগ, ক্রোধ, ঘৃণা, ভালবাসা, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা উত্তাল নদীর মতো আছড়ে পড়ে আমার বুকে- আর আমি সর্বংসহা প্রকৃতির মতো শুধু নিয়েই যাই- শুধু নিয়েই যাই।
ঝড়ের মতো যেমন আসে সে তেমন করেই চলে যায়-একদিন একটা ফোন আসে STD, ল্যান্ডলাইন থেকে “Sorry... কহকে নেহী আ সকি...” চুপ করে থাকি- বহমান নদী কৈফিয়তের জন্য জিরোয় না তো একটুও। মাঝে মাঝে চুপ, ভাঁটার টান, কখনো জোয়ারের জলের মতো এক রাশ আবেগ আছড়ে পড়ে কম্পিউটারের পাতায়...







(৭)
জলোচ্ছাসের শব্দ পেতে শুরু করলাম- হাওয়াটাও অনেক মনোরম-এত লম্বা বাস জার্নি করে হয়ে ওঠা হয় নি বলেই বোধহয় কলকব্জাগুলো জানান দিতে শুরু করেছে- কিন্তু আমার সে সময় কোথায়? আমি তো উদগ্রীব অন্য কিছুর জন্য- পঁচিশ বছর লেগে গেল যা বুঝতে তাকে পেতেই তো এলাম এত দূর- কতদিন পরে আবার একা-আদৌ কি একা? একটা ছোঁয়া কোথায় যেন মাখা মাখি হয়ে আছে- সারা শরীর মন ঘেঁটেও জায়গাটা ধরতে পারছি না।
টুরিষ্টারটার দশ খুব একটা ভালো নয়- নামলাম সবার শেষে- উঠতে গিয়ে দেখি- আমি যে দাঁড়িয়ে আছি তার কোনো অনুভব নেই- মনে হয় ভাসছি। এখান থেকে চার কিলোমিটার দূরেই মহানায়কের নামে সংস্থা- যেখানে ডেরা বাঁধব আজকের জন্য।
তবু তার আগে একবার চোখ তুলে দেখলাম সেই বিশালের দিকে- তিন রঙে তিনি নিজের প্রাচুর্যের নিদর্শন দিচ্ছেন। বাঁদিক থেকে ধুসর নীল এবং কালো- টালমাটাল আহবানে- অনিচ্ছাকে শুষে নিচ্ছেন- মন আবার মাতছে উদ্দীপনায়- কিন্তু এবারের যে যাত্রা পথে আগেই ভেবে নিয়েছিলাম যে একবারও তাড়াহুড়ো করব না। ধীরে ধীরে আসুক তার নিজের সময় নিয়ে-
গান্ধীধামের বারন্দাটায় দেখলাম অনিতা দাঁড়িয়ে আছে- তার পাশেই আমার মতোই দেখতে কিন্তু বছর পনেরো কমের যুবক এক। পয়ত্রিশটা তো রাজার বয়স- পৃথিবীর কালো আর সাদাকে নিজের নিজের ভাগ দিয়ে- সুবিস্তৃত ধূসর অঞ্চলে পায়চারি করার সময়। এখন? আমি কি সেই আমিতে আছি? প্রতিটি অনুভব তার বয়স নিয়ে একটার পর একটা পাঁচিল তুলে গেছে চোখের সামনে- জীবনদর্শনের পেরিস্কোপটা দিয়ে তার-ও ওপর দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা...
চোখ এখন তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে সারাক্ষণ, এই তো উপরে, সিঁড়ির ধাপে- কার পার্কিঙে- বাস টার্মিনাসে- ট্রেন স্টেশনে- ভূগোলের শেষ অধ্যায়ে- ইতিহাসের পাতায় অনিতার উপস্থিতি জলীয় বাষ্পের মতো উড়ে গিয়ে আকাশের বুকে আধো অন্ধকারে- তারামন্ডলের সৃষ্টি করছে- বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছি- মিষ্টি চেনা গন্ধটা আমার চার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে- স্পর্শ, স্পর্শ, স্পর্শ- দুটো সুগভীর চোখ আমার আত্মাকে স্পর্শ করছে। বিহবল মুহুর্ত............।
কতোক্ষণ ছিলাম কে জানে? জোরালো হেডলাইটের আলোয় বুঝতে পারলাম যে সন্ধ্যা নেমেছে আর শরীর জুড়ে একরাশ ক্লান্তি। বিবেকানন্দ আশ্রম-এ এসে বেছে বেছে সেই সেবার-এর জায়গাটার কাছাকাছি একটা কটেজ নিলাম- ওদের ক্যান্টিন সামনেই-অমৃত পরশে খাওয়া দাওয়া ফুরোতে ফুরোতে রাত হলো।
কিছু দূর হাঁটতে গিয়ে অনুভব করলাম অনিতা আমার সঙ্গেই আছে- জিজ্ঞাসা করলাম, “খাওয়া হল?” হাসল একটু, বলল না কিছুই-আমিও অনুভব করলাম আজ রাতটা সঙ্গেই কাটবে- ফিরে গেলাম কটেজে।







                                                                                                                        ক্রমশঃ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র