সুজন ভট্টাচার্য - মায়াজম

Breaking

৬ মে, ২০১৬

সুজন ভট্টাচার্য

                         ফান্ডামেন্টাল







          দিনসাতেক হয়ে গেল সমীরণের কোন পাত্তা নেই; সঠিকভাবে বললে সমীরণের কবিতার পাত্তা নেই। এমনটা সাধারণত হয় না। যেখানেই থাকুক, আর যে অবস্থাতেই থাকুক, পেজে ওর কবিতা আসবেই; কখনো কখনো দিনে দু-তিনটেও। আজ অবধি এর কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। এর আগে একবারই চব্বিশ ঘণ্টায় একটাও কবিতা আসে নি। পরে জানা গেল নেট ব্যালেন্স ছিল না।
 সমীরণ প্রথম দশকের কবি। প্রথম মানে মিলেনিয়াম হুল্লোড় কেটে যাবার বছর দশেক পরে যে দশকটা এল, তার কবি। এই দশকে ছেলেপুলে মায়ের পেট থেকে পড়ে না; ডাক্তারের ছুরিকাঁচির টাচে মাঝপথেই বেরিয়ে এসে সেক্টর ফাইভে নাম লেখাতে ছোটে। দশকটার মহিমা এমনই যে দিনের শেষে নারান উঠোনে রিক্সা পার্ক করে ঘরে ঢুকলেই বৌ ফোঁড়ন কাটে – মোবাইল না খেলি ঝদি আগের মতো চুল্লু খেতা, তালে সমসারটা বাঁচি যেত। নারান অবশ্য আগের মতো আর মুখে বা হাতে উত্তর দেয় না; দুটোই যে মোবাইলে এনগেজড।
 প্রথম দশকের কবি মানে অবশ্য এই নয় যে সমীরণের বয়েস মাত্র বছর- চারেক। মা ষষ্ঠীর কৃপায় আরো বছর চল্লিশেক পিছনে হাঁটলে তবে অনিমেষের বার্থ সার্টিফিকেট লেখা হচ্ছে দেখা যাবে। কিন্তু একটা গোটা দশকের ব্যক্ত- অব্যক্ত- নিরুক্ত সমস্ত কথা বলার দায় যে স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিতে চায়, তার বয়েস নিয়ে প্রশ্ন তোলে কোন আহাম্মক! জন্ম একটা বায়োলজিক্যাল ইভেন্ট , আর বয়েসটা সাইকোলজিক্যাল । যুগটাই যেখানে যাবতীয় ট্রান্স আইটেম নিয়ে নাচানাচির, তখন ট্রান্স ইউথ নিয়ে সমস্যা হবার নয় । অতএব সমীরণ প্রথম দশকের কবি ।
 প্রথম দশক জানে সর্ষের তেলে কোলেস্টেরল বাড়ে; তাই একমাত্র ভরসা জাপানি তেল। সমীরণের কবিতা সেই তেলেই ভাজা হয় বলে ওর ভক্তদের বিশ্বাস। কবিতা আর সাপখেলানো বাঁশির এক দুর্দান্ত ফিউশন। ক্লাস টুয়েলভের বায়োলজি বই পড়বার সৌভাগ্য যাদের হল না, সমীরণ তাদের অন্যতম ভরসা। সাতদিন আগেই সমীরণ নোটিশ দিয়েছিল কোন একটা মেলায় যাবে বলে। কিন্তু মেলায় গেলে তো আরো কবিতার বান ডাকার কথা! তাহলে! হল কি লোকটার? দিব্য ঠিক করল কলেজে না গিয়ে আজ স্যামিদার বাড়িতেই যাবে। প্রথমদিন ফোনটা তবু খোলা ছিল। কিন্তু তারপর থেকেই সুইচ অফ। কাজেই বাড়িতে না গিয়ে উপায় নেই।
 বেলটা বাজানোর বেশ খানিকক্ষণ পরে এক মহিলা দরজা খুলল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কাজের লোক।
- স্যামিদা আছে? দিব্য জিজ্ঞেস করে।
- অমুন কেউ এ বাড়িতে থাকে না। মহিলা দরজা বন্ধ করতে যায়। ভুলটা যে ওরই দিব্য বুঝতে পারে। কবিতা ঠেকের উপাধি কি আর কালের লোকের জানার কথা!
- সরি, সমীরণদা আছে? দিব্য শুধরে নেয়।
- আছে, শরীলডা ভাল না। মহিলার কথাগুলো বড্ডো রুক্ষ। কবির বাড়িতে কাজ করেও তাঁর কোনও ছাপ পড়ল না ভাষায়!
- একটু দেখা করা যাবে? দিব্য এবারে একটু ভয়েভয়ে জিজ্ঞেস করে।
- দাঁড়ান, জিগাইয়া আসি। কি নাম কমু? মহিলা দরজার পাল্লাটা প্রায় ভেজিয়ে ফেলেছে।
- বলুন, দিব্য এসেছে। ওর নাকের ডগার উপরে দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। দিব্যর খুব অপমানিত মনে হয়। স্যামিদার খুব কাছের লোক বলে সব্বাই জানে। এমনকি স্যামিদাও বহুবার বলেছে – আমার শেষ কবিতাটা লিখে পেনটা দিব্যকেই দিয়ে যাব; বাকিটা ওই লিখবে। বন্ধুরাও ওকে হিংসে করে এইজন্য। এত বড় মাপের একজন কবি ওকে এতটা কাছের বলে ভাবে বলে দিব্যও বিনাপ্রশ্নে স্যামিদার চা-সিগারেট- হাল্কা খাবারের দায় স্বেচ্ছায় নিজের মাথায় তুলে নেয়। গুরুসেবা না করলে কি আর বড় হওয়া যায়!
- ভিতরে আসেন। দরজাটা খুলে সেই মহিলা আবার এসে দাঁড়িয়েছে। বাধ্য ছেলের মতো দিব্য ঘরে ঢোকে।
- চটিখান ঐখানে ছাড়েন, মহিলা যেন ধমকে ওঠে। স্যামিদার চালচলন এমনিতে বোহেমিয়ান। নিজেও বলে, সংসারের নিয়ম মানতে গেলে কবিতার শব্দগুলো জীবন থেকে পালিয়ে যাবে। সেই লোকটাকেও বাড়িতে এমন অত্যাচার মানতে হয়! ইউ আর গ্রেট স্যামিদা, দিব্য মনে মনে বলে।
- এইখানে বসেন। বাবু আইতাছে। মহিলার গলার ধাক্কায় দিব্য দেখিয়ে দেওয়া চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে। মহিলা ওর দিকে একবার কেমন একটা বিষ-নজরে তাকিয়ে ভিতরে চলে গেল। স্যামিদাকে আস্তে আস্তে হেঁটে আসতে দেখে দিব্য উঠে দাঁড়াল। এ কি অবস্থা হয়েছে লোকটার! মুখটা শুকিয়ে আদ্ধেক; চশমাটাও যেন নাকের ডগায় লগবগ করছে।
- কি হয়েছে তোমার ? আমরা সবাই তো পাগল হয়ে গেলাম।
 সমীরণ সোফায় হেলান দিয়ে বসে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব ক্লান্ত গলায় বলে - প্রায় মরেই গেছিলাম রে! মেলায় বাসি ছোলার চাট খেয়ে ডায়েরিয়া। একরাত লোকাল হসপিটালে কাটিয়ে পরদিন অ্যাম্বুলেন্সে সোজা কলকাতা। আমার অবশ্য তখন আর সেন্স নেই। কাল রিলিজ হল।
- একটা খবর দেবে তো! দিব্যর গলায় যে অভিমানের বাষ্প চড়াও হয়েছে বুঝতে সমীরণের কষ্ট হয় না। তাই বলে – কি করব বল! নিজেরই খবর ছিল না।
- তার মানে এ কদিন নো কবিতা! দিব্য বলে।
- আর কবিতা। সমীরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
- এখন তো সেরে গেছ; বসে পড়। কবিতা এলেই তুমি কমপ্লিট সেরে যাবে। আর আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচব। ক্লিভেজ সিরিজটা জলদি নামাও, দিব্যর গলায় আবদারের সুর।
- ক্লিভেজ! অনিমেষের ঠোঁট বেঁকে যায়। - তিনদিন স্রেফ স্যালাইন, জানিস!
- সো হোয়াট! দিব্য প্রতিবাদ করে। - তাইবলে ক্লিভেজ আসবে না?

- দিব্য, আগে পেটভরে খেতে অ্যালাও করুক, তারপর ভাবা যাবে। ফাঁকা পেটে ক্লিভেজ আসে না রে ভাই; পেট ইজ মোর ফান্ডামেন্টাল দ্যান দা তলপেট। মেলার ট্রিপ থেকে এটাই শিখলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র