এই অদেখার মায়া বাঁশিটা আমাকে বড্ড ভোগায় | সত্যি বলছি তোমাদের, এই দেখা আর অদেখার ব্যাপারটা যে কি ভীষণ রকমের ঘোরমেলে কি আর বলি | তবে পেরেম যে কি রকমের শক্ত ব্যাপারখানা, তা টের পেলুম এই পেত্নিজম্মে |
এই তো দু হপ্তা হয়, সবে তখন কোজাগরে জোচ্ছনাটি ফুটি ফুটি করে আকাশে ছাইছে আর ওই বাঁশ বনের ওধার থেকে কেমন যেন এক শিরশিরানি মনকেমনের হাওয়া দিয়ে উঠেছে, ঠিক তক্ষুনি আমার কেমন বেজায় ‘উনি’ পেয়ে গেল | তা উনি যখন চেপেচে একবার দেখার আশাতে মন ছটফটাচ্ছে, তখন কিনা বিটলে বুড়ো বেম্যদত্যিটার পা টেপানোর প্রেয়োজন পড়ল | আমি তবু একটু হাসি টেনে বলতে চেষ্টা কল্লুম, রোসো দিকি, একটু চাঁদিম আলোয় মাথাটা খোলসা করে নিই | হাড়ে হাড়ে টক্কর দিতেছে | কেমন যেন ঠান্ডা মেরে যাচ্ছি | তা সে শোনবে ক্যান বলো | সে অমনি মুখ ভেংচিয়ে বলে বসলো, আ মাগী মনে ভেবেছ তোমার মতলব আমি বুঝি নে ? এইমাত্তর তোমার সেই পিওপাত্তর হারামজাদা কেষ্ট এসে ডাকবে আর তুমি কিনা কদম গাছের তলায় বসে দোল্লা খাবে ? বলি, ও চলবেনি কো | আগে পা টেপো, আমার ঘুম আসুক, তকন যেও খনে, বারণ করব নে | দেকছেন আমার কপাল, শালার মরেও শান্তিটুক নেই কো | আমি বেম্মর হাড় কয়খান টিপতে বসি | আর সে ওই বিরাট দশাসই চেয়রা খান এ গাছের ডাল থেকে ওই গাছের মগডাল অব্দি মেলে দিয়ে আয়েশে চক্ষু বুজে ফেলেন |বলব কি, আমি আজ খুব সেজে ফেলেছি জানেন গো | ঘেঁটু ফুলের মালা গলায় দিছি, কিছুটা গোবর গোলা জল দিয়ে রূপটান করেছি, আর, কি যেন বলে, একটা ঊর্ণজাল জড়িয়ে নিছি গায় | অবিসার কিনা | আমাকে একন যা দেকাচ্চে তাতে ওই সবজান্তা কেশো ভিরমি না খেলেই হয় | তবে কিনা বেঁচে থাকতে কত্তে পারিনি বলেই কিনা জানি না এই সব ইয়ে টিয়েতে আমার ভারী মন গেছে এখন | বেশ করে মুক টুক মেজে ঘষে পোষ্কার করে, এখন শুধু বাঁশির অপেক্ষায় | এ দিকটাতে আমার ভারী নামডাক | কারণ মানদা পেত্নীর মত এমন রূপ এই কুহক্পুরের রাজ্যে আর মেলে নে | এদিকে সব বাগদি ভূতনি, মাসি পেত্নী, চূড়েল, গলায় দড়ে বউ যারা রয়েচে তারা আমার কাছে ঠেক খায় না কো l
তা হোক, তবু যদি ওই বুড়ো বেম্মদত্যিটা একটু ভাব ভালোবাসা কত্ত | নিজেও করবে নে আর অপরে কল্লেও দুষবে | হা আমার পোড়া কপাল | সেবারে এই কেশো ভূত মিনসেটা এসে পরার আগে গো, সে এক নীল বন্নর পাল্লায় পড়েচিলুম আর কি | আর্টু হলেই চিত্তির হত গে, কিন্তু ঠিক সময়ে এসে ওই পোড়ার মুখ বেম্মদত্যিটা বেরেক কষে দিল গা | আর নীল বন্ন পালাতে পথ পায় নে | ভূতেদের কি এক মুকের বই আছে, তাতে ছবি টবি ছেপে একাক্কার কান্ড | সে নীল বন্নর কি কেলেঙ্কারী | মা গো | আমিও তিন দিন মুখ দেখাতে পারতে ছিলুম নি, কিন্তু আমি হলেম গে মানদা পেত্নী | আমার অত্ত সয় না কো | ততদিনে এই কেষ্ট ব্যাটাও জুটে গেল আর আমি যাকে বলে তার ‘কলঙ্কভাগী’ হয়ে পল্লুম |
কিন্তু আজ যা হলো তাতে আমার পেরেমের উপর থেকে ভক্তি ছেরেদ্দা উটে যায় কিনা তোমরাই বল না | আজ গিয়ে দেখি সেই কেশো, তার আসর জমজমাটি | কে নেই সেখেনে | সেই শাঁকচুন্নি, ভূতনি মাসি, বাগদি পিসি, ঘ্যাঘা, মিসেস হুতুমথুম, চেঁড়ি, গরগরের মা, আলতা পেত্নী, মেছো ডাকিনী, মা গো, কি ঘেন্না কি ঘেন্না | তারা সব কদম ডালে ভারী আহ্লাদে দোল খেতেছে | হায় হায় আমার অত সাধের সাজ বৃথায় গেল | আমি এ দু:খু রাকি কোথায় গে একন | রাগে অপমানে হিংসাতে আমার বুক ফেটে মরতে ইচ্ছে হলো আরো একবার | আমাকে দেখেই সবাই এসো এসো কত্তে লাগলো আর কেশোটা ? দিব্য হেসে হেসে মুন্ডু দুলিয়ে তাতে সায় দিলে ! কেশো আমার একটি আসন রেকেছিল বটে তার পাশে কিন্তু আমি নজ্জায় ঘেন্নায় বমি কত্তে কত্তে ফিরিচি | তাড়াতাড়ি ফিরতে সেই বেম্মদত্যি বুড়োর কি হাসি | জগতে এত শত্তুরও হয় আর পুরুষ গুলান মলেও পাল্টায় নে কো, এই আমি তোমাদের সোজা বলে রাকলুম | ক্ষমা? কোনো ছিনই নেই |
এখন তাই ঘেন্নায় চলিছি আরো একবার গলায় দড়ি দিতে | আবার পিছু ডাকে | কে ও !! ওই দেকো সেই বুড়ো বেম্যদত্যিটা ঠিক পিছু নিয়েচে | এমন কল্লে কি করে যাই বল দিকি | পেত্নী হলেও এক কালে তো মানুষী ছিলুম | বলি মায়া দয়া কি নেই মোটে আমার? না কি লজ্জা ঘেন্না সব হারিয়েছি | এই অবেলায় আত্মহত্যা, সে যে মহাপাপ | যাই তবে ওব্লার কিছু চ্যাঙ্গা ব্যাঙ্গার তরকারী আছে, তার সাথে কিছুটা ফুলেল জোচ্ছনা মেকে খেতে দিইগে ওকে, পেরেমের মাথায় বাড়ি মেরে |
সুচিন্তিত মতামত দিন