পূজা মৈত্র

মায়াজম
2
                      এবং ড্যাস......





অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল তিতিক্ষার। রোজ সকাল ছ’টায় অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। সকালে বিছানা ছেড়ে ওঠা ওর বরাবরের অভ্যাস। উঠেই যে গাদাগুচ্ছের কাজ পড়ে থাকে। যেমন চা করা,ব্রেকফাস্ট করা,মুনাই-এর স্কুলের টিফিন রেডি করা, সে সকালের টিউশন থেকে ফিরলে তাকে হাতের কাছে সব জুগিয়ে দেওয়া, নিজে অফিসের জন্য রেডি হওয়া,তারপর মুনাইকে রওনা করে নিজে অফিসের জন্য ঘড়ি ধরে ন’টায় বেরোনো। টালিগঞ্জ থেকে দেশপ্রিয় পার্ক। আধঘণ্টা হাতে নিয়ে বেরোলেই হয়। তবে তিতিক্ষা একটু আগেই বেরোয়। কোন কিছুতে লেট হতে অপছন্দ করে ও। সব কাজ নিয়মমাফিক করতে পছন্দ করে। ছোট থেকেই এইভাবে বড় হয়েছে। বাবা আর্মিতে ছিলেন। বদলির চাকরি। মা যখন মারা যান, তিতিক্ষার বয়স নয়। তারপর থেকে বোডিং-এর ডিসিপ্লিনড জীবনযাপন তিতিক্ষাকে সময়ের মূল্য বুঝিয়েছে। ছোট থেকেই নিজের কাজ নিজে করে অভ্যস্ত। তাই এখন কেউ করলেও পছন্দ হয়না। কাজের লোকটোক বলতে ঘর মোছা,বাসন মাজার ঠিকে মাসি। রান্নাবান্না,ঘর গোছানো এসব তিতিক্ষা নিজে করতেই ভালোবাসে। কাপড়ও নিজে কেচে নেয়। নিজেরটাও আর মুনাই-এর টাও। অন্য কেউ কাচলে ঠিক পরিষ্কার হয় না মনে হয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে তিতিক্ষা। টিপটপ থাকে সবসময়। সকালে সময় হয় না বলে বিকালে অফিস থেকে ফিরে অ্যারোবিকস্ আর যোগা করে। সাঁইত্রিশেও তাই ওকে ত্রিশের নীচেই মনে হয়। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি ঝকঝক করে। পার্লার তো বটেই,বাড়িতেও ত্বক আর চুলের যত্নের জন্য সময় দিতে হয় এ জন্য। বিশেষত সানডে। ঐ দিন অফিস থাকে না। নিজেকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়ার জন্য সানডের তুলনা হয় না। তিতিক্ষা দীর্ঘাঙ্গী,ছিপছিপে গড়নের। একটা ষোলোবছরের মেয়ের মা ও-এটা মানতে অনেকেরই কষ্ট হয়। নতুন যাদের সাথে পরিচয় হয়,তারা মুনাইকে ওর সাথে দেখে মেয়ে না ভেবে ভাইঝি,ভাগ্নি বা বোন ভেবে বসে। তিতিক্ষা বেশ এনজয় করে ব্যাপারটা। ওর স্কুলের বান্ধবীদের ফেসবুকে দেখে। কেউ বেঢপ মুটিয়েছে,কারোর মাথার চুলের সামনেটা ফাঁকা হয়ে গেছে,কারোর বা মুখের চামড়ায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। কলেজের বান্ধবীদেরও এক দশা। তবে তিতিক্ষার মনে হয় ওর যে বয়স বোঝা যায় না,এর জন্য ওর নিয়মানুবর্তী জীবন,মেপে খাওয়া-দাওয়া,প্রচুর ফল আর জল খাওয়া আর যোগার উপরেও জেনেটিক ব্যাপারও কিছুটা আছে। বাবার বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি। এখনো চাবুকের মত সোজা। মাথার চুলে পাক ধরেনি বললেই চলে। মর্নিং ওয়াক,যোগা,অ্যারোবিকস্ এসবের পাশাপাশি ক্লাবে গলফ্-ও খেলে চলেছেন পুরোদমে। ভাই কতবার বলেছে ওর সাথে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে থাকতে,তিতিক্ষাও বলেছিল ওর ফ্ল্যাটে শিফট করে যেতে-বাবা নারাজ। বালিগঞ্জে নিজের ফ্ল্যাটে একা থাকবে। এখন কেয়ারটেকার থাকে যদিও,আর মাসিমণির ফ্ল্যাটও একই ফ্লোরে-কিন্তু তবুও চিন্তা তো একটা হয়েই থাকে। টাচউড্, বাবার কোন রোগ নেই। তিতিক্ষারও মনে হয় ডায়াবেটিস,হাইপারটেনশন হবে না। ও বাবার ধাত পেয়েছে,গড়নটাও। মুখশ্রী আর গায়ের রংটা মায়ের মত। ভাই পুরো উল্টো। ওকে দেখতে বাবার মত,গায়ের রং চাপা,বাবার মত লম্বা। কিন্তু এই বয়সেই সব রোগ ওকে ধরে নিয়েছে,ঠিক মায়ের মত। তিতিক্ষা মজা করে বলে,“মা তোকে বেশি ভালোবাসত,তাই সব রোগ তোকে দিয়ে গেছে।” আসলে ব্যাপারটা তা না। ছোট থেকে বই মুখে গুঁজেই তো কাটিয়ে দিল ভাই। তন্ময় মুখার্জী স্কলার। সব কিছুতেই একসাথে টপার। আই আই টি থেকে এম টেক করে এখন ব্যাঙ্গালোরে কলেজে পড়ায়। তিতিক্ষার থেকে সাত বছরের ছোট, বছর দুয়েক হল ওর বিয়ে দিয়েছে বাবা। মাসিমণিই পাত্রী খুঁজেছিল। ছোট থেকেই মাসিমণির কাছে মানুষ তন্ময়, মাসিমণির আদরে, ভালোবাসায় সেই নিরাপত্তায় বড় হয়েছে,যেটা সব ব্যাপারেই পাওয়া উচিৎ,যেটা তিতিক্ষা পায়নি। বাবা ভাইয়ের জন্য মাসিমণির বাড়ি আর ওর জন্য বোর্ডিং-এমনটাই স্থির করেছিলেন। নিজে একরাজ্যে থেকে আর এক রাজ্যে ঘুরে বেড়াতেন,কালেভদ্রে দেখা করতে যেতেন তিতিক্ষার সাথে। প্রথম প্রথম ভারী অভিমান হত তিতিক্ষার। বাবার উপরে রাগ হত। কিন্তু ছোট থেকেই দেখে এসেছে, বাবা এমন রাশভারী মানুষ-তার সাথে চোখে চোখ রেখে কেউ কথা বলতে পারে না। মা-ও না। ছোট্ট তিতিক্ষা বাবাকে যেসব অভাব অভিযোগ করতে ভাবত,বাবা এলেই বাবার স্থির,শান্ত চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে সব কথা গিলে নিত। বাবা ইংরাজিতে কথা বলতেন।কেটে কেটে। ইন্টারভিউয়ারের মত। জরিপ করে
-সো,হাউ ইজ ইওর স্টাডি গোয়িং?
-ওকে,বাবা।
বাবার ভুঁরু কুঁচকে যেত, ‘ওকে’ শুনতে তিনি দিল্লী থেকে উড়ে দেরাদুন আসেননি বুঝে তিতিক্ষা শুধরে নিত নিজেকে
-ইনফ্যাক্ট ইট ইজ গোয়িং ওয়েল।
-আই সি।
বাবা এবার খুশি হতেন। মুখ দেখে বোঝা যেত না যদিও।
-আর ইউ ইন্টারেস্টেড টু স্পেন্ড ইওর ভ্যাকেশন ইন দিল্লী?
বাবার সাথে দিল্লিতে একা? তিতিক্ষা একদমই ইন্টারেস্টেড ছিল না। আগের ভ্যাকেশন বাবার ওখানে ছিল পনেরো দিন। বোর্ডিং এর থেকেও কড়া ডিসিপ্লিন। তার উপর বাবা যদি ইংলিশ আর ম্যাথ নিয়ে বসেন-তো হয়ে গেল। রোজ চড়,থাপ্পড় বাঁধা,কিন্তু মুখের উপর না বলাও যায় না। চুপ করে থাকত ও। বাবাই তখন বলতেন
-অর কলকাতা?
মাসিমণির বাড়ি! ভেবেই নেচে উঠত তিতিক্ষা। ওখানে ভাই আছে,মেসোমণি আছে-বকার কেউ নেই। মাসিমণি যদিও ভাইকে বেশি ভালোবাসে,ভাইয়ের কোন দোষ দেখতে পায় না,কিন্তু মেসোমণি সবসময় ওর দলে। তিতিক্ষা বলে ডাকেনি কখনো মেসোমণি। সবসময় ‘মা’ বলেই ডাকত। আর মেসোমণি থাকতে কেউ বকতে পারবে না ওকে।
-কলকাতা।
অস্ফুটে বলত ও,বাবা মৃদু হাসতেন। মানে হাসি বলেই মনে হত আর কি। ঠোঁটের মৃদু সরণ দেখতে পেত তিতিক্ষা।
-আই নিউ দ্যাট। সো,গো অ্যান্ড গেট রেডি।
হাতে যেন স্বর্গ পেত তিতিক্ষা। হোক না পনেরো,কুড়ি দিন,তাও বাড়ির সবার কাছে তো থাকা যেত। বিশেষ করে ভাইয়ের কাছে। ভাইকে ওখুব ভালোবাসত।তবে এখন মনে হয়,যা হয়,ভালোর জন্যই হয়। বাবা যদি ওকে বোর্ডিং-এ না দিয়ে ভাইয়ের মত মাসিমণির কাছে রেখে দিতেন,তাহলে এখন এভাবে এত ঝড় ঝাপটা সামলে মুনাইকে নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারত না। মাসিমণি তুলোয় মুড়ে মানুষ করেছে ভাইকে। আতুপুতু করে বড় করেছে। কোন সিদ্ধন্তই তাই একা একা নিতে পারে না ও। এই যে ক্যালিফোর্নিয়ায় পি এইচ ডি করতে যাবে, যাবে কি যাবে না-এই ডিলেমায় ভুগছে। মাসিমণির মত যেতে হবে না,বাবা চান যাক,ওর বৌ প্রেগন্যান্ট-শ্বশুর বাড়ি থেকে অমত তাই-উফ্! সবার মত নিয়ে এত ভাবলে চলে না। তিতিক্ষা নিজের জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্তই নিজে নিয়েছে। আর তার জন্য কোনও রিগ্রেট নেই ওর। মাঝারি মানের ছাত্রী ছিল। গ্র্যাজুয়েশনের লাস্ট ইয়ারে দীপ্তর সাথে আলাপ। দীপ্ত বাবার রেজিমেন্টেরই। বাবার প্রিয়পাত্র। তাই বাবাকে বোঝাতে বেগ পেতে হয় নি। তাছাড়া দীপ্তর সাথে বিয়ের সময়ই তিতিক্ষা দু’মাসের প্রেগন্যান্ট ছিল। মুনাই চলে এসেছিল বিয়ের আগেই। বাবাকে ব্যাপারটা আভাস দিতেই দিন পনেরোর নোটিশে বিয়ে হয়ে যায়। সেটা নাইনটি এইটের ফেব্রুয়ারি। দীপ্তর সাথে কাটানো সময়টুকু তিতিক্ষার জীবনের গোল্ডেন পিরিয়ড। সেপ্টেম্বরে মুনাই হল। তার পরের বছর জুলাই-এ কার্গিলে শহীদ হল দীপ্ত। মেরে কেটে এক বছর নয়-দশ মাসের সহাবস্থান ওদের। নাইনটি সেভেনের অক্টোবর থেকে, নাইনটি নাইনের জুলাই। তাও এর মধ্যে ক’দিন দীপ্তকে পাশে পেয়েছে-হাতে গুনে বলা যাবে। তবুও প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত তিতিক্ষার মনে চিরকালীন ছাপ ফেলে গেছে। চোখ বুজলেই তাদের দেখতে পায়, হাত বাড়ালেই যেন ছুঁতে পারবে সেই সময়টাকে। হাত বাড়ায়না তিতিক্ষা। হাত বাড়ানো বোকামি। অতীতকে ফেরাতে চাওয়া বোকামি। তেরঙ্গায় মোড়া ক্যাপ্টেন দীপ্ত গাঙ্গুলীর কফিনের সামনে বাইশ বছরের সদ্য বিধবা তিতিক্ষাকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখবে ভেবেছিল সবাই। সেদিনও তিতিক্ষার চোখে সংযত আবেগের অতিরিক্ত কিছু দেখেনি কেউ। দীপ্তর মা,বাবা,দিদি,পরিজনেরা এই নিয়ে পরে অনেক কথাই শুনিয়েছিলেন। দীপ্তকে তিতিক্ষা আদৌ ভালোবাসত কি না,এ নিয়েও কথা উঠেছিল। তিতিক্ষা জানে সেদিন ও কেন নিজের আবেগে বাঁধ দিয়েছিল। প্রথমত,মুনাই-এর জন্য। দীপ্ত না থাকলেও মুনাইকে বড় করার দায়িত্ব তিতিক্ষার তাছাড়া,বাবা তখনো ওয়ার ফন্টে। তিতিক্ষার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দু’জন পুরুষ তাদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার তীর্থঙ্কর মুখার্জী তিতিক্ষাকে শিখিয়েছিলেন সৈনিকের মৃত্যুতে চোখের জল ফেলা মানে তাদের দেশপ্রেমকে অসম্মান করা। দীপ্ত বা বাবা কারোর দেশপ্রেমকে অসম্মান করতে চায়নি তিতিক্ষা। চোখের জল ফেলেনি তাই। বাবা কথা রেখেছিলেন,শত্রুপক্ষকে সুদে আসলে সব হিসাব বুঝিয়ে ফিরে এসেছিলেন বিজয়ীর বেশে। বাবার চোখে সেইবার প্রথম জল দেখেছিল তিতিক্ষা। ওর কষ্টে,নাকি পুত্রসম দীপ্তকে হারিয়ে,তিতিক্ষা বোঝেনি-তবে তিতিক্ষার সাথে বাবার সম্পর্কটা সহজ হয়ে উঠেছিল এক ধাক্কায়। কাঠিন্যের আড়াল থেকে কিছুটা হলেও বেড়িয়ে এসেছিলেন বাবা। বাবা যে ওকে নিয়ে ভাবেন,কেয়ার করেন-সেই থেকে বুঝেছে তিতিক্ষা। বাবা, মাসিমণি,মেসোমণি সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ওর আর ছোট্ট মুনাই-এর ভবিষ্যৎএর কথা ভেবে। মাসকয়েক যেতে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল সবাই। তিতিক্ষা তখন বাবার কাছে। বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। দীপ্তর বাড়িতে থাকা সম্ভব হয়নি আর। সম্পত্তি নিয়ে আকচাআকচি ,তার উপর কথায় কথায় অপয়া হওয়ার অপবাদ,খোঁটা-এইসব সয়েও হয়তো থাকত,কিন্তু দীপ্তর দিদি ঠারেঠোরে যখন দীপ্ত আর তিতিক্ষার বিয়ের সাতমাসের মাথায় মুনাই-এর আসা নিয়ে কথা তুলে মুনাই আদৌ দীপ্তর কিনা-প্রশ্ন তুলেছিল,তিতিক্ষা আর সময় নষ্ট করেনি। এক কাপড়ে চলে এসেছিল বাবার কাছে। তেমনি এক মুহূর্তও ভাবেনি বাবা,মাসিমণি,মেসোমণির আবার বিয়ে করার প্রস্তাব নাকচ করতে। দীপ্তর বাইরে কোনকিছুই ভাবা সম্ভব নয় ওর পক্ষে। জীবনে দীপ্তর জায়গা আর কাউকে দিতে পারবে না। তাছাড়া ওর জীবন ওর একার নয়। তার সাথে মুনাই-এর জীবন-ও জড়িয়ে আছে ওতপ্রোত ভাবে,তাই গত পনেরো বছরে বহু প্রস্তাব এলেও তিতিক্ষা তাদের সযত্নে প্রত্যাখ্যান করেছে। তা বলে কি ওর পুরুষ বন্ধু নেই? আলবাৎ আছে। অফিস কলিগরা,স্কুলমেটদের হাজব্যান্ডরা,ফেসবুকের পরিচিতরা অনেকের সাথেই ওর আলাপচারিতা রয়েছে। পার্টি,পিকনিক,সোশ্যাল গ্যাদারিং-সবেতেই হাজিরা দেয় তিতিক্ষা,আসলে মানুষ সামাজিক জীব। আর বিপদে,আপদে বন্ধুদের যে কতটা দরকার হয়-তা এই পনেরো বছরে বারবার বুঝেছে ও। ফ্যামিলি পার্টি,আউটিংগুলোতে মুনাইকেও নিয়ে যায় টেনে হিঁচড়ে। মেয়ে যা ঘরকুনো আর বইপোকা-ওকে ঘরের বাইরে বার করতে তিতিক্ষার ঘাম ছুটে যায়-তবুও সবারই সোশ্যালাইজ করা উচিৎ। না হলে ভবিষ্যত-এ কাজের জায়গায় গিয়ে,কলেজে গিয়ে মানাতে পারবে না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিতিক্ষার সাথে শপিং,সিনেমা,পার্টি,আউটিং-এ যেমন যেতে হয় মুনাইকে-তেমন ব্যায়াম-ও করতে হয়। ভাই-এর মত কাউচ পটেটো আর রোগের ডিপো মুনাইকে কিছুতেই হতে দেবে না তিতিক্ষা। আপাদমস্তক মামার ধাত পেয়েছে মেয়েটা। সারাদিন বই,বই আর বই। ঘর আগোছালো,জামাকাপড়ের ঠিক নেই,নিজের রূপ,সাজসজ্জার উপর বিন্দুমাত্র যত্ন নেই-শুধু পড়া,মার্কস আনছে গাদা গাদা। স্কুল টপ করেছে টেনথে। নাইনটি এইট পার্সেন্ট। ইলেভেনেও সায়েন্স নিয়ে তেমন-ই ফল। সামনে টুয়েলভথ্ একসাম। জয়েন্ট এন্ট্রান্স,আইআইটি,এ আই ট্রিপল ই-বই থেকে মুখ তোলার সময় নেই তার। খেতে অবধারিতভাবে ভুলে যায়। তিতিক্ষা খাবার চাপা দিয়ে কোথাও গেলেও বাড়ি ফিরে দেখে-খাবার খাবারের জায়গায়, আর মুনাই পড়ার টেবিলে বইমুখে,অথবা মামাকে স্কাইপে প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দিচ্ছে। মামাও ভাগনিকে একের পর এক উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। চশমার পাওয়ার কি দিনে দিনে সাধে বাড়ছে? পার্লারে নিয়ে যাবে-বহুদিন আই-ব্রো আর ফেসিয়াল করানো হয়নি-মেয়ের সময় হলে তো? তিতিক্ষা না বেঁধে দিলে চুল বাঁধার,চুল আঁচড়ানোর সময়টুকুও নেই। তিতিক্ষার মাঝেমধ্যে রাগ হয় এত কেয়ারলেস কি করে হল ওর মেয়ে! চশমাটা চোখের সামনে ফেলে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায় মুনাই। শেষমেষ তিতিক্ষাকেই চশমা উদ্ধারে আসতে হয়। দেখা যায় ওর বালিশের পাশে,কি বইয়ের তলায়,ল্যাপটপের পিছনে,মোবাইলের আড়ালে চশমা পড়ে আছে। কপট রাগ দেখায় তিতিক্ষা
-এই তো চশমা। তুই এতক্ষণ ধরে খুঁজে পাচ্ছিলি না, আমি পাঁচ মিনিটেই পেলাম কি করে?
মুনাই তিতিক্ষাকে জড়িয়ে ধরে
-এই জন্যই তুমি মামমাম্। আর আমি মুনাই।
তিতিক্ষা হেসে ফেলে। মুনাইকে ও বকে না। তেমন ভাবে বকতে হয়নি কখনো।
-আর পড়তে হবে না। রাত কত হল দেখ তো?
-সবে তো বারোটা। কয়েকটা ম্যাথ বাকি আছে। করে নিই?
মুনাই সব কথায় এখনো মামমামের পারমিশন নেয়।
-আচ্ছা। তবে ওনলি হাফ অ্যান আওয়ার। আমি বসছি এখানে।
-তুমি শুয়ে পড় তোমার ঘরে। কাল তো তোমাকে আর্লি উঠতে হবে।
তিতিক্ষা জানে এটা মামমামকে সরাবার জন্য মুনাই-এর বাহানা। তিতিক্ষা চলে গেলে ও রাত তিনটে বাজাবে। সকাল ছ’টায় মুনাইকেও উঠতে হবে, টিউশন আছে। মাত্র তিনঘণ্টা ঘুমালে শরীর থাকে?
-ছ’টায় আমি রোজ উঠি। আর আজ আমার নিজের ঘরে ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না। ভাবছি,মুনাই-এর কাছে ঘুমাব। এই কথাটায় কাজ হবে,জানে তিতিক্ষা। মামমামের কাছে শোবার লোভে মুনাই ঝটপট সব কাজ সেরে নেবে। তিতিক্ষার কাছে শুয়ে তারপর মামমাম গল্প বলো,চুলে বিলি কেটে দাও,মাথায় হাত বুলিয়ে দাও-এসব আব্দার হবে। তিতিক্ষা হাসি মুখেই সব আব্দার মেটায়। নিজে মায়ের আদর পেয়ে হারিয়েছিল। বাবার আদর কাকে বলে জানেনি কখনো। মুনাইটাও তো বাবা পায়নি। তাই তিতিক্ষা একাই মা আর বাবা-দুজনের আদর ওকে দিতে চায়। কোথাও যেন ফাঁক না থেকে না যায়,সেই চেষ্টা করে সবসময়। মুনাই এর মত বাধ্য মেয়ে আর একটাও হয় না। শুধু পড়া থেকে ওঠানো ছাড়া, আর কোনকিছুতেই তিতিক্ষাকে বকতে হয় নি কোনোদিন। আর বকতেও মন চায় না তিতিক্ষার। বরং প্রশ্রয়ই দেয়। চাইবার আগেই সব এনে দেয় মুনাইকে। “মামমাম-আবার দুটো ড্রেস! এই তো লাস্ট উইকে আনলে! আমার এত লাগবে না!” “তোমার তো পেত্নি সেজে থাকতেই ভালো লাগে!” মুখে এটা বললেও তিতিক্ষা মনে মনে বলে,“তোর লাগুক না লাগুক,আমার তো সাধ হয়,আমার একটামাত্র পরীকে সাজাতে,তাই না?” সাজলে খুব ভালো লাগে মুনাইকে। মায়ের মতই দেখতে হয়েছে। শুধু গায়ের রং একটু চাপা-দীপ্তর মত। লম্বাটে গড়নটাও তিতিক্ষার থেকে পেয়েছে। আর গজ দাঁতটা দীপ্তর মত। মেয়ে হাসলেই তাই দীপ্তকে মনে পড়ে যায় তিতিক্ষার। মুনাইকে হাসাতে চায় তাই সবসময় নিরন্তর। নিজে এত ডিসিপ্লিনড হয়েও মেয়ের সমস্ত সৃষ্টিছাড়া খেয়াল। আগোছালো ভাব-হাসিমুখে মেনে নেয় তিতিক্ষা। জোর করে বকে বকে ওকে বদলাতে চায়না। নিজের মত করে বেড়ে উঠতে দিতে চায়। ষোলো বছরের মেয়ের সবটুকু কাজ এখনো তিতিক্ষাকেই করতে হয়। স্নান করানো আর ড্রেস আপ বাদে। খাইয়ে দিতে হয় এখনো, জুতোর ফিতে বাঁধা দেখে দিতে হয়। বইয়ের ব্যাগ ঠিক গোছাল কিনা রুটিন মিলিয়ে দেখে নিতে হয়। চুল বাঁধা তো আছেই। এই সমস্ত কিছুই হাসি মুখে করে তিতিক্ষা। মুনাই-এর হাসিটা যাতে মিলিয়ে না যায়। ঐ হাসিটার মধ্যেই তো দীপ্ত বেঁচে আছে।
(দুই)
মামমামের ছোঁয়া পেয়ে ঘুম ভাঙল দীক্ষার। দীক্ষা মানে মুনাই। মুনাই নামটাই ওর বেশি প্রিয়। মামমাম আরো কত কি বলে, “বাবু’,‘বাবাই’,‘সোনা’,‘মা’-তবে সবার সামনে মুনাইটাই বেশি করে বলে। দীক্ষা নামটা আনকমন। এতে মামমাম আর বাবি দুজনের নামই আছে। এইজন্য নামটা লিখলে আলাদা মনের জোর পায় মুনাই। মনে হয় বাবি আর মামমাম ওর খুব কাছে আছে। বাবি ওর মধ্যেই আছে। এটা মামমাম সবসময় বলে। ওর গজ দাঁতটা বাবির মত,হাসিটা,খাওয়া-দাওয়ার পছন্দ,অপছন্দ-সব। এদিকে দাদুভাই বলে মুনাই নাকি একদম মামমামের মত। মামমামের মত দেখতে,তেমন কথা বলার ঢং,তেমন হাঁটাচলা-মামা এসব শুনলে রেগে যায়। বলে,“আমার ভাগনি আমার মত।” মামমাম শুনে বলে, “তোর মত বুক ওয়ার্ম বটে,কিন্তু তোর মত রোগের বাসা আর আনস্মার্ট আমার মেয়েকে হতে দেব না।” দাদুভাই-ও মামমামকে সাপোর্ট করে, “ফিজিক্যাল ফিটনেস না থাকলে চলবে না। মামনি,তুই মুনিয়াকে কিন্তু যোগা,ওয়ার্ক আউট করাবিই।”মামমামকে মামনি বলে দাদুভাই। বাবি থাকলে মুনাইকেও মামনি বলত হয়তো। বাবি থাকলে কি কি হত ভাবতে চায় মুনাই। এমন কিছু খুঁজে পায় না, যা হয় নি। মামমাম একাই ওর সবটুকু দেখভাল করেছে । সব কিছু দিয়েছে । দাদুভাই অত স্ট্রিকট-মামমাম,মামা খুব ভয় পায়। অথচ মুনাই-এর বেস্ট ফ্রেন্ড। স্পেশাল যা কিছু আবদার-দাদুভাই-এর কাছে করে মুনাই। দাদুভাই তৎক্ষণাৎ তা এনে দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হল গল্পের বই। মামমামের দাদুভাইকে কিছু বলার ক্ষমতা নেই,বাড়ি ফিরে নিজের মনেই গজগজ করে। "বাবা পারেনও। পড়ার বই থেকেই তার নাতনি ওঠে না,এর মধ্যে গুচ্ছের গল্পের বই। চোখের বারোটা আরো বাজবে।" চোখ নিয়ে দাদুভাই-এরও চিন্তা । মুনাই ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে,আর্মি জয়েন করতে চায়। অ্যাজ অ্যান ইঞ্জিনিয়ার। শুরুতেই ক্যাপ্টেন দীক্ষা গাঙ্গুলী। সাউন্ডস্ লাইক ক্যাপ্টেন দীপ্ত গাঙ্গুলী। বাবি খুশি হবে খুব । বাবির হিরোইকসের কথা এখনো সবার মুখে মুখে ফেরে। বারো জন ট্রেসপাসারকে মেরে,তারপর শহীদ হয়েছিল । দাদুভাই যখন বাবির গল্প বলে, দাদুভাই-এর চোখে অদ্ভুত একটা আলো দেখে মুনাই। একটা স্পার্ক,গর্বের দ্যুতি। মামার অ্যাচিভমেন্টও অনেক ।কিন্তু মামার ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে দাদুভাই-এর চোখে সেই স্পার্ক খুঁজে পায় না মুনাই। মামা,মামি,মাসিদিদা,মেসোদাদু- সবাই জানে মুনাই আই.আই.টি করে বিদেশ যাবে । ফর হায়ার স্টাডিজ। ওরা সবাই তাই-ই চায়। মামমাম কি চায় বোঝে না মুনাই। কোনদিন কোন কিছুতে জোর দেয়নি ওকে । অন্যদের মায়েদের মত- এটা করতে হবে, অত পেতে হবে, ফার্স্ট হতে হবে,অত পেতে হবে, ফার্স্ট হতে হবে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে-এসব নিয়ে কিছুই বলেনি কোনদিন। শুধু ঠিকঠাক করে খেতে হবে, ঠিক সময় ঘুমাতে হবে, রাতজাগা যাবে না, চোখের উপর বেশী স্ট্রেন পড়ে না যেন, দিনে আধঘন্টা সময় বার করে একসারসাইজ, মুনাইকে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রেসেন্টেবল করে রাখা-আর মাঝে মধ্যে জোর জবরদস্তি ঘোরা,ফেরা,শপিং,সিনেমা, পার্টি,আউটিং-ব্যাস। এইটুকুই মামমামের চাহিদা। খুব অল্প চাহিদা। মুনাই সুস্থ থাকুক,মুনাই কে সুন্দর দেখাক,মুনাই-এর মন ভালো থাকুক, ওর কোন কিছুতে কষ্ট না হোক-এটাই মামমাম চায়। মামমামের চাওয়ার উপরে কিছু চায় না মুনাই। তাই যখন যেটা বলে সেটাই করে। ওয়ার্ক আউট করতে ভালো লাগে না একদম-তবুও মামমাম চায়,তাই করতেই হয় । তবে দাদুভাই বলেছে আর্মিতে যেতে গেলে ফিটনেসটা মাস্ট। আর মামার মত অল্প বয়সে বুড়ো হতে চায় না মুনাই। মামমামের থেকে নয় বছরের ছোট মামা-দেখে মামমামের দাদা মনে হয় । ওরকম হতে চায় না মুনাই। তবে, মামার মত রেজাল্টটা ওর চাই । এখনো অবধি সব একসামে মামার থেকে বেশিই স্কোর করেছে । পরের একসামগুলোতেও করতে চায়। মাসিদিদা ভাবে ওনার ছেলের থেকে ভালো আর কেউ হয় না। মামা স্কলার- সেই কথা সবসময় বলে। মামমামকে লক্ষ্য করেই কথাটা বলা,বোঝে মুনাই। মামমাম স্কলার না হলেই বা কী? যথেষ্ট ভালো আর্ন করে,ভালো পোস্ট হোল্ড করে। আর মুনাইকে তো মামমাম-ই ছোট থেকে পড়িয়েছে। তাই মুনাই ভালো করা মানে মামমাম ভালো করা। এইজন্যই মামার থেকে বেশী নম্বর পেতে চায় মুনাই। মামাও তা-ই চায়। বলে ওকে রিসার্চ করতে হবে। ডক্টরেট করেও পোস্ট ডক্টরেট করতে হবে । কিন্তু মুনাই জানে ও কি চায়। ও আর্মি জয়েন করবে । বাবির মত। দাদুভাই-এর মত।
এই ইচ্ছেটার কথা দাদুভাই একমাত্র জানে । এনকারেজ করে খুব । ফিটনেসটা জরুরী বলে। ওইজন্যই ওয়ার্ক আউটটা এবার থেকে মন দিয়ে করবে ভেবেছে মুনাই। একটা আর্টিকলে পড়েছিল,ফিট শরীরে ব্রেন ফাংশান ও অনেক বেশী ভালো হয়। ব্রেনটা তো আরো ভালো করে খাটাতে হবে । মার্কস আনতে হবে তো। তবে ঝামেলা পাকাবে চশমাটা। দাদুভাই বলছিল ল্যাসিক সার্জারি করালে আর চশমা লাগবে না। আর্মিতে যাবার কোনও বাঁধা থাকবে না । টুয়েলভথের পর দাদুভাই করিয়ে দেবে বলেছে । মামমাম শুনলে ভাববে, মেয়ের সাজগোজের মন হয়েছে । নিজেকে সুন্দর দেখাতে চায় তাই চশমা ছাড়তে চাইছে । এমনিতেই প্রায়ই খোঁজ নেয় যে কোন প্রোপোজাল এল কিনা। কাউকে ভালো লাগছে কিনা। মুনাই এর ওসব দিকে মন-ই নেই । ক্লাসের ছেলেগুলোকে ইডিয়ট মনে হয় ওর। সো সুপারফিসিয়াল। কোনও কিছুতেই ডেপথ্ নেই । শুধু বাইক, পার্টি, হ্যাংআউট,স্যোশাল নেটওয়ার্কিং,ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস,মিউজিক,গেমস-ব্যাস্! গল্পের বই পড়ে না কেউ। কেউ কবিতা লেখে না,কেউ ক্লাসিক্যাল মিউজিক বোঝে না-আর যারা পড়ায় ভালো তাদের জ্ঞান সিলেবাসের বই অবধি লিমিটেড। মুনাই এর মত প্রশ্ন করে না কেউ,শিখতে চায় না,জানতে চায় না-ধুত! মামমাম ভারী অবাক হয়। কখনো মজা করে বলে, "তুই কোন কাজের না বাবাই। এত দিনেও একটা বয়ফ্রেন্ড হল না? তোর সব ক্লাসমেটদেরই তো....." "ওহো মামমাম! তুমি তো ছেলেগুলোকে চেনই। দে আর নট মাই টাইপ ।" "তাহলে তোর টাইপ টা কি শুনি?" "যখন আসবে তখন দেখবে।" ভাও খায় মুনাই । মামমাম বলে, "আসবে তো একটা আস্ত ভূত । নাহলে তোর মত পেত্নীকে কারো পছন্দ হবে?" "বাহ রে! দাদুভাই বলে আমি তোমার মত দেখতে । তাহলে তো তুমিও....." মুনাই এর চোখে দুষ্টুমি খেলে যায় । "আমি কি তোর মত চুল না আঁচড়ে,ফেশ ওয়াশ না করে, আই ব্রো না করে-পাগলের মত থাকি? তুই টিপটপ হয়ে থাক, তবে না প্রিন্স চার্মিং আসবে?" মুনাই জড়িয়ে ধরে মামমামকে, "ধ্যাত,ওসব প্রিন্স ট্রিন্স এসে কাজ নেই তার থেকে তুমি চুল বেঁধে দাও, আমি পড়তে বসি।" মামমাম মুচকি হাসে। যত্ন করে চুল বেঁধে দেয় তারপর । আলতো করে চুমু খায় কপালে। মুনাই-এর বড় ভালো লাগে আদরটা। মন দিয়ে পড়া করার ইচ্ছেটা বেড়ে যায়। মামমামের কাছে মুনাই এর ফেসবুক পাসওয়ার্ড,ইমেল-আই ডি সব আছে । মুনাই-ই দিয়ে রেখেছে। নিজে খুব কমই লগ ইন করে । মামমামই শখ করে ছবি তোলে ওর। প্রোফাইল পিকচার বদলে দেয়, লাইকগুলো গোনে। কমেন্টগুলো দেখে মজা পায়। মুনাই এর ওসব ভালো লাগে না । তার থেকে ম্যাথের চারটে প্রবলেম সলভ করা ভালো । বন্ধুদের ইনবক্সগুলো মামমাম-ও দেখে । কখনো বলে, "এই ছেলেটা ভালো তো,মুনাই-দেখ একবার।" মুনাই উচ্ছের মত তেতো মুখ করে । মামমাম তা দেখে চুপ করে যায়। মামমাম মুনাই এর সাথে সেলফি তুলে নিজের প্রোফাইলে পোস্ট করে। তাতে দু'এক জন কমেন্টও করে বসে, "তোমার বোন নাকি,তিতিক্ষা?" মামমাম এই কমপ্লিমেন্টটা এনজয় করে । কিন্তু তাও সগর্বে বলে, "না,মাই ওয়ান অ্যান্ড অনলি ডটার।" পরের কমেন্টটা হয়, "রিয়েলি????" "ইয়েহ। মাই প্রিন্সেস। মাই অ্যাঞ্জেল।" মামমামের প্যাম্পার করা কমেন্টগুলো এনজয় করে মুনাই । সত্যিই ওর মামমাম খুব প্রিটি। দেখে বোঝা দায় যে মুনাই এর মামমাম । বাকিদের মায়েরা কেমন বুড়ি। মোটা হয়ে গেছে, চুল উঠে গেছে-ইয়াক। মামমাম ইজ লাইক আ কুইন। আর দুজনের এজ ডিফারেন্সটা একে কম, তার উপর মামমামকে দেখে নিজের টেন ইয়ারস ইয়ংগার লাগে । ফলে বোন তো লাগবেই। মামমামকে মামা দিদিভাই বলে। মুনাই-ও সেই দেখাদেখি 'দিদিভাই' বলে খেপায়। মামমাম চোখ বড় করে,বকে না। বকাঝকা কি ছোট থেকে বোঝেনি মুনাই। মামমামের খুব অপছন্দের কিছু হলে একবার বলে, "মুনাই,না।" ব্যাস। এই না শুনলেই মুনাই বুঝে যায়, মামমাম কি চায়। সেই কাজটা করে না আর। আর্মি জয়েন করার কথা শুনলে মামমামের রিঅ্যাকশনটা কি হবে ভেবে পায় না মুনাই । বাইরে পড়তে যাবে শুনলেই মামমাম আঁতকে ওঠে । মুনাই-ও বাইরে যাবে না আপাতত । বিটেক টা যাদবপুর থেকেই করবে । মামার অমত নেই তাতে । ও বাইরে গেলে মামমাম একা হয়ে যাবে । আর্মি জয়েন করে মামমাম কে আর জব করতে দেবে না মুনাই । ওর সাথে করে কোয়ার্টারে নিয়ে যাবে । ওর সাথে মামমাম-ও সারা ভারত ঘুরবে। আর্মি জয়েন করার নাম শুনলে হয়তো মামমাম বলবে, "নিজের কাজটুকু নিজে করতে আগে শেখ মুনাই, তারপর না হয় এসব ভাবিস। মুনাই কি নিজের কাজ নিজে করতে পারে না? খুব পারে, এখানে মামমাম আছে, তার উপর পড়ার চাপ- তাই করে না। ওখানে থাকলে খুব পারবে । দাদুভাই-ও তাই বলে। সবই অভ্যাস। তবে একটা বড় ভয় খুব করে কাজ করে মুনাই এর মনে । সব শুনে যদি মামমাম বলে, " মুনাই, না।" ঐ নাটুকুই বলবে । কেন না কি জন্য না- এসব তো বলবে না । আর ঐ না টুকু পার হতে পারবে না মুনাই । বাবি,দাদুভাই-সবাই চাইলেও পারবে না । কারণ মামমাম হল মুনাই এর ভগবান । আর ভগবান যা বলে, তা-ই করতে হয়।
-বাবাই, ওঠ্ মা- বেলা হল।
চোখ খুলে তাকায় মুনাই । মিষ্টি হাসে।
-গুড মর্নিং মামমাম ।
-মর্নিং মুনাই । উঠে পড়।
-উঁ....
মামমাম ঝুঁকে পড়ে। মুনাই এর কপালে,গালে,নাকে আদর করে দেয়।
-হল?
মুনাই মামমামকে জড়িয়ে ধরে
-আর টু।
-রাতে কখন শুয়েছিস? সেই তিনটে করেছিস,তাই তো?
-না তো।
-আবার মিথ্যে?
-মিথ্যে বলি?
-ক'টা তাহলে?
-হাফ পাস্ট টু।
মামমাম হতাশ হয়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে
-আমারই কপাল। লোকের বাচ্চাকে পড়তে বসাতে বেগ পেতে হয়,আর তুই পড়া থেকে উঠিস-ই না। এই করে করেই তো চোখের তলায় কালি পড়েছে,পিম্পল হচ্ছে গালে....
-হোক,আমি কি মিস ওয়ার্ল্ড হব?
-তা বলে অসুস্থ হতে চাস?
-এইটুকু সবাই পড়ে। তুমি একটু আদর করো না, মামমাম । এক্ষুনি পড়তে বসতে হবে ।
মামমাম হেসে ফেলে। মুনাই এর মুখের উপর পড়া চুল সরিয়ে দেয়।
-শুধু পড়া আর পড়া আমার পাগলীর।
-হুঁ, টপ করতে গেলে পড়তে হয়।
-কে মাথার দিব্যি দিয়েছে?
-কেউ না। বাট আমি চাই ।
মামমাম খুব খুশি হয়। অনেক করে আদর করে দেয় মুনাইকে। মুনাই জানে ও টপ করলে সবচেয়ে বেশী খুশি হয় মামমাম । কিন্তু মামমাম চায় না যে মুনাই টপ করার জন্য কোন অতিরিক্ত স্ট্রেস নিক। মুনাই যেন কোন কারণেই অসুস্থ, অখুশি না হয়,কষ্ট না পায়-সেটাই মামমামের প্রায়োরিটি। মামমাম বলে বাবির হাসিটা একদম মুনাই এর মত ছিল। তাই বুঝি মামমাম মুনাই কে হাসাতে চায়? তেমন হলে সারাজীবন হাসবে মুনাই । যত কষ্টই হোক- হাসিটা মুছবে না। মামমাম ওর মধ্যে দিয়েই বাবিকে পাবে যে।
(ক্রমশ.....)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন