সহেলী রায়

মায়াজম
1
                       ইনোসেন্ট বৃষ্টি








ইদানীং প্রেম শব্দটা শুনলেই কেমন যেন মধ্যযুগীয় লাগে তিতিরের। সব কিছু সময় মেপে করা। পাঁচটায় দেখা কর, ভোরবেলা ওয়াটস্যাপে গুড মর্নিং উইশ, রাতে নিয়মমাফিক গুড নাইট, তারপর লাইফের সব দাঁড়ি কমা নাকি শেয়ার করতে হবে নইলে বুঝবেনা, তুমি যে আমার। কি কেস মাইরি, পুরো বোঝো কেস যাকে বলে। জীবনে ল্যাদ নামক এমন সুন্দর বস্তু থাকতে খামোখা লোকে প্রেম করে কেন তিতিরের মাথায় ঢোকে না। বাইরে ঝম ঝম বৃষ্টি, কোথায় কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ফরিদা খানুমের ‘আজ জানে কি জিদ না করো’ অথবা বিটলসএর ‘উইথিন ইউ উইদাউট ইউ’ বা মির্জা গালিব- সব কিছু নিয়ে ফিউশন হলেও মন্দ নয়। তা নয়, বৃষ্টিতে পাশাপাশি হেঁটে প্রমাণিত হোক সারা কলকাতা শহরে এমন রোমান্টিক কাপল আর নেই। ইউনিভার্সিটির মেয়েগুলোকে দেখলে গা পিত্তি জ্বলে যায় তিতিরের, এই কাঁদছে, এই হাসছে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে নারীশক্তির আন্দোলন করতে নামছে তারপর মাঝপথে ইশারা ইশারা, কেটে পড়ো মামনিরা। অবশ্য গোটা দেড়েক প্রেম তিতিরও করেছে। প্রথমটা কয়েক বছর লাস্টিং, তারপর ফুল ল্যাং। চুল কেটেছ কেন, এত ভাল রেজাল্ট করে ইংলিশ অনার্স কেন? সায়েন্স নয় কেন? ফেসবুকে এত ছেলে বন্ধু কেন? আরে দূর ব্যাং , অত প্রশ্নের উত্তর তিতিরেরই অজানা। দ্বিতীয়জন হেব্বি জ্ঞানী, পৃথিবীর সব বিষয়েই তিনি মাস্টার। ওই করেই তিতিরের ঘাড় অব্দি পৌঁছেছিল। তিতির মালটাকে রিসার্চ করতে গিয়ে ধরতে পারে অর্ধেক তথ্যই ভুল। শুধু তিতিরের সামনে ইমেজ জমানোর কায়দা। আড়াই মিনিট সময় নিয়েছিল বাই বলতে। আজ পর্যন্ত অনিন্দিতা রায়ই পারেননি জ্ঞান দিতে তিতিরকে। আর এরা তো কোন ছাড়।
- হোয়াট হ্যাপেন অনুজা? হোয়াটস রং উইথ ইউ ডিয়ার?
হেরিটেজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সুন্দরী ব্যক্তিত্বময়ী প্রিন্সিপালের প্রশ্নের সামনে তিতিরের চোখ ছাপিয়ে জল গড়াচ্ছে। ক্লাস টিচার বিপাশা মিসও দাঁড়িয়ে আছেন পাশেই। তিতির শব্দহীন। প্রিন্সিপাল ইশারা করলেন বিপাশা মিসকে তিতিরকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
- সমস্যাটা ওর মা ম্যাডাম। ভদ্রমহিলা টেস্ট কপিতে এক-আধ নম্বর কম দেখলেই মেয়েকে সাঙ্ঘাতিক বকাবকি করেন।ও প্রত্যেকটা টেস্ট কপিতে মার্ক্সগুলো রিরাইট করেছে। ডাইরিতে পেরেন্ট কল করেছি, সেই পেজটা পর্যন্ত ছিঁড়ে দিয়েছে।
বিপাশা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো জানালেন প্রিন্সিপালকে।
- মেয়েটা ভালই রেজাল্ট করে দেখছি। এভাবে তো ডিটরিয়েট করবে। পেরেন্টকে আসতে বল, আমি কথা বলব। বাবা কি করেন?
প্রিন্সিপাল লোপা গুপ্তকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।
- ওর বাবা-মায়ের সেপারেশন হয়ে গেছে বছর দুয়েক আগেই। মা হয়তো আসবেন।
বিপাশা পরনিন্দা পরচর্চা ভঙ্গীতে বললেন কথাটা।
- ওহ। বুঝেছি, ডাকো ওনাকে।
বাড়ি ফিরে ক্লাস ফোরের তিতির উইকলি টেস্টের পড়া করতে বসল। অনিন্দিতা সজোরে দরজা খুলে আছড়ে পড়লেন।
- তোমার কোন ব্যাপারে আমি নাক গলাতে চাই না। আমায় যতই টিচার কল করুক আমি কিছুতেই যাব না।
অনিন্দিতা রায়, তিতির ওরফে অনুজা মাসান্তার বায়োলজিকাল মা। প্রশান্ত মাসান্তা, তিতিরের বাবা এক শিপিং কোম্পানীর চাকরির সূত্রে বাইরে বাইরে থাকতেন। ওনার পার্সোনাল সেক্রেটারি রোজির সাথে ওনার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। অনিন্দিতা প্রথম দিকে আমল না দিলেও পরে এই নিয়ে অশান্তি শুরু করেন। দুজনে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সেপারেশনের একমাসের মধ্যেই প্রশান্ত রোজিকে বিয়ে করেন। অনিন্দিতা কলকাতার একটি নামকরা কলেজের প্রফেসর। আর্থিক অসুবিধে তাঁকে না ছুঁলেও একটা ভয় পেয়ে বসেছিল। তিতির যদি জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হয়, কোন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারবে না। রেজাল্টে পান থেকে চুন খসলেই ধৈর্য হারাতেন। বাবা নিয়ে তিতিরের মনে সঠিক কোন ছবি নেই প্রশান্তর। জ্ঞান হওয়া থেকে দুটো মানুষকে শুধু ঝগড়াই করতে দেখেছে সে। লোকটা কোনদিন তিতিরের কাস্টডি নিয়েও কথা বলতে আসেনি, এমনকি দেখতেও না। অথচ পদবীটা তিতিরকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। একবার খুব বায়না তুলেছিল অনিন্দিতার কাছে এফিডেফিট করে সেও অনুজা রায় হতে চায়। অনিন্দিতা বিশেষ পাত্তা না দেওয়ায় আর এগোনো যায়নি। ক্লাস টেনে তুখোড় রেজাল্টের পর নিজের স্কুলেই ভর্তি হয় তিতির মায়ের ইচ্ছেতে সায়েন্স নিয়ে। তখনই কোচিং ক্লাসের ফিচেল প্রেম শৌনক। অনিন্দিতাও বেশ পছন্দ করতেন ছেলেটিকে। টুয়েলভে জেলায় তৃতীয় স্থান অধিকার করে তিতির আর শৌনক সপ্তম। বেঙ্গল জয়েন্ট , আইআইটি সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও তিতির বেঁকে বসে ইংলিশ অনার্সের জন্যে। যাদবপুরে ভর্তিও হয় কাউকে তোয়াক্কা না করে।
- আমায় প্রিন্সিপাল রুমে হেনস্থা করেছিলে একদিন। আজ আমিই চাইনা তুমি আর নাক গলাও।
তিতিরের কাটাকাটা কথাগুলো অনিন্দিতাকে আহত করে।
শৌনককে গুডবাই বলে সাহিত্য দুনিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তিতির। স্বপ্নময় যাদবপুর। কেউ তিতিরের রূপে মুগ্ধ, কেউ সাহিত্যচর্চায়। তিতির কলেজ ফেস্টে র‍্যাম্পে হাঁটছে, ইতালিয়ান উপন্যাস পড়ছে, লিখছে, ভাসছে নতুন শব্দের জোয়ারে। অবসরে ল্যাদ, গান আর ছোট ছোট ক্যালিগ্রাফিতে ভরাচ্ছে মায়ের পুরনো তোরঙ্গ। নাহ অনিন্দিতে রায় ইমপ্রেস হবার নয়। তিনি দিব্য আছেন, সারাদিনে গণ্ডা গণ্ডা ফোন কলস। কিসব ন্যাকা স্টুডেন্টস। যত বয়স বাড়ছে নিজেকে অপ্সরা ভাবতে শুরু করেছেন। ফেসবুকে রোজ ছবি আপ্লোডান, আজ হ্যান্ডলুম তো কাল কলমকারি। তাতে আবা কমেন্টের জোয়ার। তিতিরের আগে রাগ হোত এখন হাসি পায়।
(২)
ফ্লোর বেডে শুয়ে গ্লাস উইন্ডো দিয়ে অবিরাম বৃষ্টিধারায় কলকাতা শহরকে শৈলশহর মনে হচ্ছে তিতিরের। হার্ড পেপার দিয়ে অনেক নৌকো বানিয়েছে আজ। মন দিয়ে তার উপর আস্টেরিক্সের সব চরিত্রদের ক্যালিগ্রাফি করতে ব্যস্ত তিতির। ‘আস্টেরিক্স এন্ড দ্য বিগ ফাইটের’ বেরলিক্সের নাকখানা আঁকতে তার খুব মজা লাগে। ছাদে ইট দিয়ে উঁচু করে জল ধরে রাখা হয়েছে, সেখানেই ভাসবে আজ এরা। মিসেস অনিন্দিতা রায় সক্কালবেলাতেই শিফন শাড়ি লেপটে কড়া মেকাপ নিয়ে বেড়িয়েছেন। আজ নাকি কলেজ কলিগদের সাথে ইলিশ ফেস্টিভাল। বাঁচা গেছে। এরকম একটা দিনে বাড়িতে একা থাকতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। নো ডিস্টার্বেন্স। অবশ্য মিনতিদি রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত। তিতির তখন বছর দুয়েক সেইসময় থেকেই মিনতি এই বাড়িতে। মাছওয়ালা অচিন্ত্যকে ফোন করে টাটকা ইলিশ আনিয়েছে। ডাইনিং স্পেসে গেলেই ওপেন কিচেন থেকে ডিমভরা মাছগুলোর অদ্ভুত কাঁচা সুবাস আসছে। যেকোনো র গন্ধ তিতিরের খুব পছন্দের। খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজার প্রস্তুতি চলছে। মিনতি তিতিরকে ঘাঁটায় না। তবে কলিংবেলের শব্দে দুজনেরই ছন্দপতন ঘটল।
- কে?
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক প্রায় কাকভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে। একটু আগেই মিস্টার প্যানিক্সের যে ছবিটা এঁকেছিল তিতির, অনেকটা ওরকমি লাগছে। তিতির নীচে এসে দরজা খুলল। চেনা লাগছে ভদ্রলোককে। মাথায় টাক, মুখে খোঁচা দাড়ি, লম্বা তবে ভুঁড়ি আছে বেশ।
- তিতির?
- আপনি?
ভদ্রলোক তিতিরকে চেনে দেখে বেশ অবাকই হল তিতির। কেমন একটা ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তিতিরের অস্বস্তি হতে লাগল।
- প্রশান্ত মাসান্তা, একটু ভেতরে এসে কথা বলা যাবে?
ওহ শিট। এই লোকটা? সতের বছর বাদে কি মনে করে? গেলোরে পুরো দিনটা। বাবার সামনে তিতিরের যেসব ফিলিংস হওয়া উচিত সেসব কিছুই হচ্ছে না। আর হবেই বা কি করে। কোন প্রতিচ্ছবিই তো নেই লোকটার। যা নেই, তা নেই। ঐ নেই নেই করে গলা শুকোনোর দলে তিতির নেই। বসার ঘরে নিয়ে এল তিতির প্রশান্তকে। মিনতি শশব্যস্ত হয়ে, একি দাদাবাবু, কি চেহারা হয়েছে ইত্যাদি প্রভৃতি শুরু করেছিল। তিতিরের চাহনিতে, বন্ধ হল।
- বলুন?
- তোকে এতদিন পরে দেখে দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। সেই ছোট্ট তিতির। বিশ্বাস হচ্ছে না-
- আমায় আপনি করে বলুন আর আমার সময় কম
প্রশান্ত এই ব্যবহারই আশা করেছিলেন। আফটারঅল অনিন্দিতার মেয়ে, কিছুটা তেজ থাকবেই। তাছাড়া প্রশান্ত তার কাছে স্ট্রেঞ্জারই বটে।
- আমার পুত্র সীমান্ত ইউএস স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাইড ম্যাথেমেটিক্স নিয়ে চান্স পেয়েছে। আমি আর রোজি দুজনেই রিটায়ার্ড। সঞ্চিত অর্থ যথেষ্ট নয় ওর যাওয়ার পক্ষে। তাই পৈতৃক বাড়ি বিক্রির জন্যে রাণাঘাট গিয়েছিলাম, জানলাম আমার পোর্শনটুকু মা অনিন্দিতাকে লিখে দিয়েছেন। অনিন্দিতার কলেজে গিয়েছিলাম, ও দেখা করেনি । তুমি মানে আপনি যদি হেল্প করেন
আচ্ছা গেঁড়ো তো। মা যে কি করে না। কোথাকার কে লোক তার সাথে কোন সম্পর্ক নেই অথচ তার বাড়িখানা ঝেঁপে বসে আছে? ঠাম্মি যতদিন বেঁচেছিল অনিন্দিতা তিতিরকে নিয়ে গেছেন রাণাঘাট। সেসব অতীত। উফ মা পারেও। খুট করে দরজা খোলার শব্দ হল। অনিন্দিতা সামান্য হাঁপাচ্ছে, তিতিরের পাশে তিতিরের হাতটা এমনভাবে টেনে ধরল যেন কেউ কেড়ে নেবে তিতিরকে। এরকম অদ্ভুত আচরণ করছে কেন মা?
- ভাগ্যিস মিনতি ফোন করে জানাল, কেন এসেছ এখানে?
অনিন্দিতার গলা কাঁপছে। হারানোর ভয় স্পষ্ট। কিন্তু কি? তিতির?
- শুনুন মিস্টার মাসান্তা আপনি এখন আসুন। আপনার ছেলের ভবিষ্যৎ আপনি ভাবুন, আমার মাকে ডিস্টার্ব করলে লিগাল স্টেপ নেব।
প্রশান্ত চলে গেলেন। অনিন্দিতার তিতিরের বুকে মুখ লুকিয়ে ফোঁপাচ্ছেন। শ্রেষ্ঠ আশ্রয়কে অবহেলা করার জন্যে বার বার ক্ষমা চাইছেন। একরাশ ইনোসেন্ট বৃষ্টি তিতিরের বুকে ঝরছে।
ঘরভর্তি ট্রোজান ভাইরাস মরছে আকাশ ছাপানো বর্ষায়।
-সমাপ্ত-




















একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন