গৌতম চট্টোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

২৯ জুল, ২০১৬

গৌতম চট্টোপাধ্যায়


অনি






আজ সন্ধ্যে থেকেই মাথাটা বেশ দপদপ করছে অনির। পুরো মাথাটা বললে ভুল হবে বরং ডানদিকটাই এই উড়ে এসে জুড়ে বসা উৎপাতের কেন্দ্রস্থল রূপে শোভা পায়।ডান ভুরুর উপর বেয়ে এই দপদপানি ডান কান কে কেন্দ্র করে বেশ খানিকটা চুলের ভিতরে হারিয়ে যায়। অর্থাৎ মগজের ঘিলুর আশেপাশে যে শিরা বা উপশিরা রয়েছে তারাই যে এই নৃত্য অনুষ্ঠানে যোগদান করেছে তা বলাই বাহুল্য। দপদপানি বললাম এই কারণেই যে এ কোন অবিরাম চিনচিনে ব্যথা নয়।হঠাৎ করে চাগাড় দিয়ে ওঠে তারপর নিষ্কৃতি কিছুক্ষণের,আবার শুরু হয়।ঠিক যেন কেউ হাতুড়ি নিয়ে অনির খুলির ভিতরে পেরেক ঠুকে চলেছে।অক্লান্ত পরিশ্রম,বিশ্রাম কিছুক্ষণের আবার শুরু হয় নতুন পথচলা। কাল রাতেও এই হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছিল ঠিকই কিন্তু আলো বিভ্রাটের জেরে সেই কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে।তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়াতে অনিকে এর আঁচ বিশেষ পেতে হয়নি।কিন্তু আজ শ্রমিক বেড়েছে,বেড়েছে কাজের তাগিদও আর এই মানব যন্ত্রণার একমাত্র ভাগীদার থেকে গেছে অনি।আধিকারিক কে অসাড় করে শ্রমিকদের যে দৌরাত্ম্য তা বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারে সে।এই মাথা ধরা কে সঙ্গ করে যে ধুম জ্বর তা একপ্রকার তাদের হরতালেরই সমান।
বেশ কিছুদিন ধরেই তার ইচ্ছা ছিল একটা গল্প লিখে সকল কে সে শোনাবে।কিন্তু সে গুড়েও বালি।কে শুনতে চায় আর কাকেই বা শোনাবে সে!যে বন্ধু উন্মাদ বলে টিটকিরি দেয়,তাকে?যে মেয়ে ন্যাকা বলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়,তাকে?না যে পরিবার পাগল বলে একঘরে করে রাখে,তাদের?তাই তার শিল্প কে সায় দেওয়ার পরিবেশ অনি পায় নি।এ জন্য অবশ্য তাকে দোষ দেওয়া চলে না।কিই বা করতে পারে সে,যদি সব মূর্খের দল এক যায়গায় ভিড় করে।আর ঠিক এই কারণেই কলেজে যাওয়ার সময় তার পছন্দ মর্গের ধারে নির্জন রাস্তাটিকে।ঘুমন্ত মানুষগুলি সাদর আমন্ত্রণে দগ্ধ সূর্যের ছত্রছায়া থেকে নিয়ে যাবে শীতল চাঁদের আড়ালে।সমাদরে,আহ্লাদে,মাথায় হাত রেখে শিখিয়ে দেবে জীবনের ব্রত।যেখানে স্বমহিমায় গলা ছেড়ে খোলা আকাশের নীচে অনি চেঁচিয়ে উঠবে, “দেখো সকলে দেখো,আমায় চেয়ে দেখো;আমি বন্ধু চাই না,চাই না নারীসঙ্গ,নিজেকেই স্ব-কামী বানিয়ে নিতে শিখেছি।”

“আর কতক্ষণ দেরি হবে শুনি!”ফোনের ওপার থেকে এক ঝাঁঝালো নারীর কণ্ঠস্বর।
-“রাগ করো না বাবু,এই তো-এই তো আর পাঁচ মিনিট,” বলেই সাথে সাথে ফোন কেটে দেয় অনি।পাঁচ মিনিট ঠিকই কিন্তু আসন্ন তিরিশ মিনিটের মধ্যে সে পৌছাতে পারবে কিনা সন্দেহ।সন্দেহ এই জায়গা তে জাগে যে সে এখন তার লেখার রিভিউ পেতে ব্যস্ত।ফেসবুক নামক যে বিষম বস্তু উপস্থিত ও তিলতিল করে এই তিন বছরে ধরে যে সাহিত্যের জগত সে গড়ে তুলেছে তার থেকে অতি সহজেই নাড়িচ্ছেদ হওয়ার পাত্র অনি নয়।ঘণ্টার পর ঘণ্টা না খেয়ে না নেয়ে অবলীলায় কাটিয়ে দিতে পারে এই অচেনা জগতে অজানা পথের সন্ধানে।কে কি বলল,তার লেখা মার্কেটে দৌড়ালো কিনা না প্রতিবন্ধী রূপে আগেই ঘরবন্দি তার উপর নির্ভর করে তার টিআরপি।
রাস্তায় যেতে যেতে নিজের খেয়ালেই ডুবে থাকে সে বা বলা ভালো সায়ন্তিকার;এই প্রথম নিজের আভিজাত্য কে বাজি রেখে মন থেকে এতটা ভালো কোন মেয়েকে সে বেসেছে। ফর্সা,সুশ্রী ও মর্যাদাপূর্ণ মেয়েটি কখন যে নিজের অজান্তেই তাকে বশ করেছে,তা বুঝতেই পারেনি অনি। শুধু সে এইটুকুই বুঝেছে আজ এক মুহূর্তও তার সায়ন্তিকা কে ছেড়ে থাকবার জো নেই।সে খুশি আছে,সে ভালো আছে,নিজের গম্ভীর মুখ আপনা থেকেই হাসির রেখায় ভরে ওঠে,প্রতিটা কাজ অনেক স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সে করতে পারে। সবসময়েই সায়ন্তিকা যেন তার পাশে আছে,সে দেখছে,মাথায় হাত বুলিয়ে গাঢ় স্বপ্নের মায়াজালের মধ্যে দিয়ে এক নব দিগন্তের আলোর ছটার দিকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে অনিকে।
ভাবতে ভাবতে অনি স্থির চোখে ঘুমের দেশে চলে যায়।সেখানে এক শান্ত পার্কে বসে অনির কোমর জড়িয়ে,কাঁধে মাথা এলিয়ে সায়ন্তিকা শোনাচ্ছে তার প্রিয় অরিজিতের গান।আহা, এত মিষ্টি গান সে কতকাল শোনেনি,এত রসালো গলা কতদিন যে তার মন ভেজায় নি,এত গভীর প্রেমে আগে কখনো নিজেকে বিসর্জন দেয়নি সে।মনে মনে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করে অনি, “জনম জনম তুই শুধু আমারই জন্য জন্মেছিস।প্রতিটি ক্ষণেই আমায় শুধু সঙ্গ দিয়ে যাস।খুব বড় হবি তুই,খুব বড়।সবাই তোকে নতজানু হয়ে প্রণাম করবে একদিন,তোর জীবন তখন ধন্য।আমি তোকে একবিন্দুও হারিয়ে যেতে দেব না।তুই শুধু আমারই;আজীবন,আমরণ, শুধু আমার।”তাই অনির মন আজও দু’হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে থাকে অন্তত একবার সায়ন্তিকাকে কাছে পাওয়ার জন্যে।
হঠাৎ সজোরে গাড়ির ব্রেক মারার শব্দে ঘোর কেটে গেল তার।পিছনে আনমনা হয়ে বসে থাকা অনি সামনের দিকে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পরে।বেশ রেগে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে সে, “এত জোরে কেউ ব্রেক মারে!”
--“Kya karenge sab,samne ek taxi rukh gayi.”
--“Toh itna jor se kuin gari chalate ho?”
--“Aap toh bekar ka garam ho rahe hai.”
--“Thik hai,thik hai..aaur kitna waqt lagega?”
--“Aaur jyada samay nehi lagega,bas aah gaye.”
মনে মনে দু’চারটে খিস্তি মেরে অনি আবার চলে যায় তার স্বপ্নের সন্ধানে। মাঝে মাঝে সে ভাবে কি হবে এত সায়ন্তিকা সয়ন্তিকা করে!ও তো আমাকে নিয়ে একটুও ভাবে না;ভালো আছি না মন্দ,অন্তত বেঁচে আছি কিনা সেইটুকুও যদি......।
এই তো সেইদিন,কথা বলছিল অনি, “তুমি আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে বসেছিলে কেন?”
“আমি তো স্টেজের দিকেই মুখ করে বসেছিলাম,” উত্তর দেয় সায়ন্তিকা।
--“ তবুও, একবার অন্তত আমার দিকে তাকাতে পারতে;চোখে চোখ রেখে কথা বলা যেত।”
--“তো কি হয়েছে?”
--“তুমি জানো না, আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি।”
--“হুম, জানি তো,” এক নিরস উত্তর দেয় সায়ন্তিকা।
--“তাহলে?আমার সাথে কথা বলা, একটু ঘুরতে যাওয়া তোমার কাছে অবান্তর বলে মনে হয়?”
--“এই শোনো, ভালোবাসা মানে এই নয় যে সবসময়ে তোমার সাথেই কথা বলতে হবে,তোমার সাথে ঘুরতে যেতে হবে।নিজের mind টা কে একটু broad করো,বুঝলে?”
--“তুমি কি একটুও বোঝো না যে তোমায় এক ঝলক দেখতে আমার কতটা ইচ্ছে করে।”
--“বুঝি তো।”
--“তাহলে চুপ করে থাকো কেন? আচ্ছা, তোমার কি একটুও ইচ্ছা করেনা আমার সাথে দেখা করার?”
--“কই নাতো!আমি সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের অপেক্ষায় আছি।”
--“তার মানে? আমি কি বেঠিক?”
কোন উত্তর আসে না,শুধু নীরবেই রয়ে যায় অনি।কেন বারবার এই মরীচিকার পিছনে দৌড়ায় সে? দৌড়ায়, আছাড় খেয়ে পড়ে, উঠেই আবার দৌড় শুরু।তার কারণ একটাই,অনি জানে এই গোলকধাঁধার মাঝেই আসল রত্ন লুকিয়ে থাকে।শুধু খুঁড়ে বের করতে সময়ের প্রয়োজন।তাই আজও সে ছুটে চলেছে, এক বিন্দুও না হাঁপিয়ে।সে যেন চিনেও চিনতে পারে না তার মনের মানুষটি কে।

দেখা হবার পর সায়ন্তিকার এত ঊর্ধ্বগামী মেজাজের সম্মুখীন হতে হবে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি অনি।রাগ অবশ্য হওয়ারই কথা,সময় যেখানে ছিল সকাল দশটা সেখানে এগারোটার কাটা পেরিয়ে এখন বারোটার কোঠায়।
--“এতক্ষণে সময় হল আসার!” প্রায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে সায়ন্তিকা, “সেই সকাল থেকে wait করছি তোমার জন্য।তোমার কি একটুও সময় জ্ঞান নেই! তুমি জানো আমার কত......”
কোন কথাই যেন শুনতে পায় না অনি।তাকে দেখলেই কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সে।হাত পা ঠাণ্ডা হতে থাকে,কেউ যেন হাতুড়ি পেটায় মনের জানালায়।তাই অনি শুধু চুপচাপ চেয়ে থাকে তার টানা-টানা কাজল রঙা ওই দুটো নীল মণির দিকে।
--“অমন হাঁ করে দেখছ কি?আমায় কোনদিনও দেখনি নাকি?” জিজ্ঞেস করে ওঠে সায়ন্তিকা।
অনি নিজের অজান্তেই গেয়ে চলে তার কবিতার বুলি,
“আজ শুধু দেখবো তোমায়,
নিয়ে যাবো মন সদুর প্রান্তরে;
সেখানে বাঁধা নেই,সঙ্গী হয় না সন্দেহ,
আছে কেবল উদার মস্তিষ্ক প্রবাহ।”
--“আরে ধুর ধুর,তুমি থামো তো।রাখো তোমার কবিতা। কি যে সব ছাতার মাথা লেখো,কিছুই বুঝতে পারি না।এবার যাবে কি?রোদে দাড়িয়ে দাড়িয়ে রঙটা একেবারে পুড়ে গেল,” বলেই সটান হাঁটা লাগায় সে।
কি যে বলবে কিছুই বুঝতে পারে না অনি। তাই চুপিচুপি তার ভালোবাসার মানুষটির পিছু নেয়,সাত পাঁক কাটার আশায়।
আজ সত্যিই বেশ খুশি খুশি লাগছে সায়ন্তিকা কে। প্রথমে দামী পারফিউম,তারপর সোনার দোকানে হার,কানের দুল,বাউটি,মান্তাসা অর্ডার দিয়ে অনি কে নিয়ে সোজা কাপড়ের দোকান।
--“এই তাঁতের শাড়ীটা দেখো,কি সুন্দর না,” বলে ওঠে সায়ন্তিকা।
--“সত্যিই দারুণ,তোমায় কিন্তু খুব ভালো মানাবে,” উত্তর দেয় অনি।
--“আমার জন্য নয় বাবু, এগুলো সবাইকে দিতে হবে।”
--“কেন?সবাই কেন দিতে হবে কেন?”
--“প্রণামী, বুঝলে? আচ্ছা প্রণামী তে তাঁত ভালো লাগবে না পিওর সিল্ক?”
--“দেখো,মেয়েদের ব্যাপারে অতসত বুঝি না,তবে আমার মনে হয় পিওর সিল্ক টাই বেটার।”
কেনাকাটার পর অনি অব্যর্থ প্রশ্নটা ছুড়ে দিলো সায়ন্তিকার দিকে, “এত কেনাকাটা,প্রণামী,কি ব্যাপার বলো তো?কারুর বিয়ে টিয়ে নাকি?”
--“এমা,তুমি জানো না?আমারই তো বিয়ে,আগামী মাসের ১০ তারিখ।”
--“তোমার বিয়ে!!”হতচকিত হয়ে চেয়ে থাকে অনি তার ভগ্ন হৃদয়ের দিকে।
এ কি শুনছে সে!! সে ঠিক আছে তো?নিজেকে একবার চিমটি কেটে দেখে নিল,তার সেন্স পুরোপুরি সচল।
সায়ন্তিকা বলে ওঠে, “হ্যাঁ গো,অভীকের সাথে।”
--“ অভীক!! কে অভীক?”
--“অভীক সেনগুপ্ত,a billionare businessman. আজ প্যারিস,কাল লন্ডন তো পরশু দুবাই। তার উপর ভালো গান করে,খুব সুন্দর গীটার বাজায়। তোমায় বলেছিলাম না আমি সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের অপেক্ষায় আছি,সেই মানুষটি কে আমি পেয়ে গেছি।Am too much happy.”
--“তাহলে আমার কি হবে?এতগুলো বছর তো তোমার পথ চেয়েই বসেছিলাম।”
--“What nonsense!!তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম আমার থেকে কিছু expect করো না।আর তাছাড়া তুমি কি করেই বা ভাবলে আমি তোমাকে মেনে নেব!!একটা ল্যাদ খাওয়া ইঞ্জিনিয়ার,তাও যদি কোন ঢঙের চাকরি করতে।”
--“এখানে এইভাবে আমাকে ডাকার কারণ কি?”
--“এতদিন তো কানের কাছে প্যানপ্যান করতে;আমার সাথে কোথাও যাও না, আমার মনের কথা বোঝো না,তাই ভাবলাম আজ তোমায় ডেকে নি।তোমার বহুদিনের স্বাদ টাও পূরণ হয়ে যাবে।এখন চলো,যেতে হবে আমাদের।”
--“তুমি যাও,আমার একটু কলেজ স্ট্রীটে কাজ আছে।”
--“ওই ম্যাদা মারা জায়গা তে পড়ে থাকো বলেই তো জীবনে কিছু উন্নতি করতে পারলে না,” বলে মুখের সামনে ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করে শিয়ালদাহ স্টেশনের দিকে রওনা দিলো সায়ন্তিকা।
আর কিছু ভেবে উঠতে পারে না অনি। যাকে এত বছর ধরে নিজের থেকেও ভালোবেসে এসেছে,যাকে প্রত্যেক টা দিন সম্মান করেছে,নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে এসেছে,সে কিনা আজ অন্য সংসারের ভাগীদার!!এই বাস্তব সত্যটা মেনে নিতে দ্বিধা হয় তার।সে ধপ করে বসে পড়ে পাশের বেঞ্চটা তে।“লন্ডন, প্যারিস,দুবাই”।অনির মাথায় বাজছে শুধু এই তিন শব্দ, “লন্ডন, প্যারিস,দুবাই”।আশেপাশের রাস্তাঘাট,মানুষজন,গাড়ি,বাড়িঘর সব বোঁবোঁ করে ঘুরছে। সত্যিই পৃথিবীটা গোল।সামনের পূবের আকাশ তখন গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা,পশ্চিমে সূর্যাস্তের এক বিন্দু রেখা তখনও দেখা যাচ্ছে।সেই পশ্চিম থেকে পূবের দিকে এগিয়ে চলেছে অনি।
ট্যাক্সির দরজায় “NO REFUSAL” লেখাটা তখন মলিন হয়ে গেছে।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র