সুপ্রিয় মিত্র - মায়াজম

Breaking

২৯ জুল, ২০১৬

সুপ্রিয় মিত্র

                  গাছের চোখ আর কোদাল






সত্য হল একটি অপ্রমাণিত মিথ্যে। যেমন তোমার একটা চোখ আছে যে তোমার ঘুমেরমধ্যে তোমায় স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন দেখাবার দায়িত্ব নিয়েছে, হাওয়ায় পাতায়-ডালে পরের বাড়ির দাওয়ায় প্রিয় অপ্রিয়জনের সন্ধ্যে সকালে ঘোরে ফেরে ভেসে-বেড়ায়, বহু কিছু দ্যাখে যা তুমি আন্দাজ করেছ, কিন্তু মস্তিষ্কের সাথে কোনও যোগাযোগ রাখেনা। এমনকি তুমি যে দু'চোখ দিয়ে তোমার দুটো চোখের অস্তিত্ব স্বীকার করেছ, তাদের সাথেও ওই একটি চোখের কোনও সত বা জঠরজাত সম্পর্ক নেই।গত বা পরজন্মের কিছু ধার দেনা অগ্রিম মিটিয়ে নেওয়ার বাজার হিসেবে এই জীবনে তোমায় তারা বেছে নিয়েছে।



আচ্ছা, কখনও এরকম হয়েছে কি? মনে ক'রে দ্যাখোতো, সারাদিনে একবারও হয়তো চোখ ভেজেনি, কিন্তু রাস্তায় যেতে যেতে গাছেরতলায় দেখতে পেলে তোমার দু তিন ফোঁটা কান্না মাটির ভেতর আস্তে আস্তে ঢুকে-পড়ছে, আলমারি খুলে পেটে আসছে মুখে আসছে না একটা শব্দের মানে অভিধানে খুঁজতে গিয়ে পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখলে সেই অক্ষরমালার পড়শি পাতায় এক ফোঁটা সদ্য সেঁদিয়ে কাগজের রোঁয়া তুলে দিল, রাস্তার কুকুরকে আদর করতে গেলে আর কত কাল স্নান না করা শুকনো লোমের ভেতর তোমার আঙুল হালকা ভিজে গেল আরও কত কী ইত্যাদি ইত্যাদি... হয়েছে কি? তবে মাথা তুলে উপরের দিকে তাকিও না সেসময়...এটা জানা জরুরি নয় মাথার উপরে কখন কে আছে... নিশ্চই আন্দাজ করতে পারছ, কি বলতে চলেছি এবার? হ্যাঁ - মিথ্যে হল সেই নিখোঁজ হওয়া সত্য।

আমি কুশল। আগে থেকেই বলে রাখি, আমায় দেখতে ভালো না। আমার উপরের দাঁতের পাটি  বেরিয়ে থাকে। বন্ধুরা সামনে কোদাল বলে ডাকে। আগে শুধু পেছনেই ডাকত।কিছু বলিনা বলে ওরা বলে আনন্দ পায়। আমি কমই বলি। কিন্তু যারা আমার কথা শুনতে চেয়েছে, তাদের প্রতি আমি একটা দায়িত্ব চাপিয়ে দিই আমার কথা বোঝার।কথা বলার সময় অযাচিত থুতু বেরিয়ে আসার থেকেও এই ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা - অনেক বেশি সহ্যশক্তি লাগে। তুমি এখন সেই ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিচ্ছ। কারন তুমি শুনতে চেয়েছ, আমি তোমার ঘাড় ধরেও বলিনি, হাত ধরেও ডেকে বলিনি - শোনো।
তুমি এক্ষুণি উঠে চলে যেতে পারো। পা নাড়াতে নাড়াতে, বল রে কোদাল বলে ভেতর-ভেতর নিজেকে ঠোঙার মতো দুমড়ে মুচড়ে পাছাটা কে শক্ত করে নিজেকে বসিয়ে রাখতেও পারো। সবই পারো, যা যা ইচ্ছে হয়। কিন্তু হবেনা। আমার ইচ্ছে কে তুমি এখন উস্কে দিয়েছ। তোমায় শুনতেই হবে।
আসলে যাদের বন্ধু বললাম, ওরা কেউই আমার বন্ধু নয়। বিট্টু মানিক শান্টু লামা এমনকি বিন্তিও নয়। ওরা আমার সাথে দাঁতে চেপা কাউন্টার খায়, তবু কোদাল তো বলে, ঘরে মায়ের ফোটো দেখে জিজ্ঞেস করে তোর মানয় বে...বাবা মা কারোরই উঁচু দাঁত নেই, দিদার ছিল, পেয়েছি।মজা করে বুঝি, কিন্তু খারাপ লাগা টা দ্যাখেনা শালা রা।
আমি বাগানের-ছেলে। মেনরোড ধরে উড়তে উড়তে কলগোড়ার সামনে আমাদের বাড়ির ইলেকট্রিক লাইনের তার টা ফেঁসে যেতেই গোঁত্তা খেয়ে ডান দিকে বেঁকে গিয়ে আরও একটু লাট খেতেখেতে ঢিল দিল যখন তার লাগানোর বিল্টু কাকু, আমাদের বাড়ি টা গিয়ে বাম দিক ঘেঁষা আকাশমণি গাছের ওপর গিয়ে আটকে গেল, তারপর ধীরে ধীরে নেমে পেয়ারা গাছগুলো কে ঠেলে ঠুলে পুকুরধারে তাল দুটো যমজ আম ক'টা ইউক্যালিপটাস মেহগনি একটা-গুলঞ্চ দারুচিনি পেঁপে তিনটে নারকেল চারটে সুপুরি এক ঝাড় নয়নতারা তিন টব জারভেরা গোলাপ পুঁইমাচা বেগুনগাছ লঙ্কা চারা থানকুনির ঝোপ লজ্জাবতীর জঙ্গলের মাঝে ঠাঁই করে নিল। বাবার এই জায়গা টার প্রতি ভালোবাসা ছিল। আমিও সেই ভালোবাসা টা শিখে নিয়েছিলাম। বিল্টু কাকু সেই মতন নামিয়েও দিল। আগে পারত না, চাকরির প্রথম প্রথম। তখনও হাতে সেই এলেম টা আসেনি। ইলেকট্রিকের তার ট্রান্সফর্মার থেকে নিয়ে লাটাই করে বাড়ি ভাসাতো যখন মেনরোডে, তারপর ভুলভাল জায়গায় আছাড় খেতো।পালিত দের বাড়ি টা দেখবে, ওই পচা ডোবা বাঁশঝাড়ের পাশে নয়তো ওরম সুন্দর দোতলা বাড়ি হয়? শান্টুদের বাড়ি টাও, তিন মাথার মোড়ে দেওয়াল টা বমি করবার মতো করে মুখ বের করে রয়েছে, লোকে রাস্তায় যেতে আসতে খিস্তোয়। যা হোক। ঢিল দেওয়া টা যে আর্ট বিল্টু কাকু সেরা জানে এখন।
আমার বন্ধু হল ওই আকাশমণি, গুলঞ্চ, আম। ওরা আমায় কুশলও বলেও ডাকে না, কোদালও বলেনা। জড়িয়ে ধরলে ডাল নেমে আসে, ছায়া গাঢ় হয়। কান্ডতে পিঠ ঘষলে দশবারোটা পাতা ঝরে পড়ে। ভালো লাগে। খারাপও লাগে। কারন ওদের সাথে অন্য কোত্থাও আমার দেখা হবেনা। তবে জ্ঞাতি গুষ্টি তো আকছার রাস্তায় এখানে ওখানে আছেই।একটা বটচারার সাথে বন্ধুত্ব জমেছে সবে, তবে জানা নেই আদৌ বন্ধুত্ব কিনা, ওর বোধ বুদ্ধি তৈরি হতে এখন অনেক বছর, তদ্দিন বাঁচব না, কিন্তু একটা আকর্ষণ জন্মেছে দুই তরফেই, আমি অন্তত অস্বীকার করব না। ওই গুনে গুনে বারোটা পাতার-ছায়ায় কাল হাত টা রেখে বলেছি - সব ঠিকঠাক গেলে মোটামুটি পঞ্চাশ বছর পর আমার বডি বেরোবে এই উঠোনে ধূপ রজনীগন্ধা নিয়ে, তখন ছায়া সবটা পড়বে তো? আর মুহুর্তের জন্যে ওইটুকু জায়গার হাওয়া থম মেরে গেল, পাশের পুঁই-মাচা নড়ছে কিন্তু এনার পাতায় নোনড়নচড়ন। মজা পেয়েছি ভেতর ভেতর। ছেনালি করতে ভালোই লাগে, আর কাউকে তো পাই না। লামা শান্টু দের ওপর রাগের বোঝা টা আজ সন্ধ্যে থেকে একটু কম লাগছে।
এই বট, নারকেল আম, গুলঞ্চ সবই তো হল। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে অন্য এক ছায়ায়। বাড়ির উত্তর দিকের ছোট গেট টা থেকে বেরিয়ে দেওয়াল পেরোলেই একটা শিউলি গাছ রায়দের বাড়ির পাঁচিল টপকে গলির বুকে ঝুঁকে থাকে। কান্ড দেখা যায় না, ফুল তৈরির কারখানাও দেখা যায় না। যেন আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছে নিজেকে, লজ্জা পায়। ওই আদ্যিকালের চুন সুরকি খসে পড়া দেওয়াল যেন তার হিজাব। আমিও পুষে রেখেছি কৌতূহল, একদিন গিয়ে কোলে পেতেই দেব মাথা।আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই চাপানউতোর শুধু আমার একার নয়। দেয়ালের ওপারেও কিছু ঝড় সমান ভাবে বইছে।
আকাশের দিকে তাক করা ওই গাছটির বুঝলেতো, একটা চোখ আছে, নয়তো সকাল দশটা এগারোটায় বেরোচ্ছি যখন ফুল আমার মাথায় এসে পড়বে কেন। আমার পায়ের সামনে প'ড়ে আমায় থামিয়ে দেবে কেন। এই সব ছল চড়ুই ও বোঝে। আমি তো মানুষ।
এতক্ষণ ধরে এই যে আছে থাকে হয় এই সমস্ত ক্রিয়াপদে বর্তমান কাল লাগিয়ে চলেছি, এগুলোয় আসলে শিগগিরি মধ্যে ছিল হয়েছি থাকত ছিল না হয় নি ইত্যাদি সব বসতে চলেছে।
শরৎ আসবে খুব দেরি নেই। সাইকেল টা নিয়ে সেদিন গলি ধরে হুস করে পেরোব পেরোব করছি, আর সামনে দেখি ডাল নুয়ে এসেছে পাঁচিল টপকে আরও এদিকে, আর আকাশের দিকে তাক করা চোখ, তার দৃষ্টির আস্কারা দেওয়া এক সরল নাবিক-কে তার দ্বিধা প্রকাশ করছে, তার কান্ডের আগায় কি কোনও ফুল ফুটেছে কচি ডাল সমেত নাকি পেরেক? 
এরপর আমি যা দেখলাম, কী বলব, কী বলব... কুঠার দিয়ে পেন্সিল কাটারের মতো তীক্ষ্ণ করে কেটে গাছের কান্ড কে শেকড় থেকে আলাদা করে ঠেস দিয়ে রেখেছে দেয়ালে... কী বলব!কী বলব এরপর...
তার থেকে, সন্ধ্যায় ফুটে, সকালেই ঝরে পড়া ফুলের বিষণ্ণতা নিয়ে এই গাছ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঝিমিয়ে পড়ুক। যে টুকু প্রাণশক্তি আছে তাতে দিয়ে কুঁড়ি ফুটবে, মন বলছে।
তোমায় শুধু এটুকু জিজ্ঞেস করার ছিল, যারা কেটেছে তাদের কথা বাদ দাও। সকালে ওই কটা ফুল যারা মাড়িয়ে দিয়ে যাবে, তাদের পায়ে কোদালের ধার সইবে তো? 
না নানা ভয় পেয়োনা। ওসব আমার ধাতে নেই।
গত সপ্তাহে আহিরীটোলা ঘাটে নেমে একটা কাগজে তিনবার ' কষ্ট হয় কষ্ট হয় কষ্ট হয় ' লিখে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছি... আর, আমার সাথে তখন কেউ ছিল না। ওখানে অশথ-গাছের পাতায় পাতায় জ্ঞাতি বিয়োগের শিরশিরানি ছাড়া।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র