অংশু প্রতীম দে - মায়াজম

Breaking

২৯ জুল, ২০১৬

অংশু প্রতীম দে



            পিকচার আভি বাকি হ্যায়





-“দ্যাখ, এখনো শ্রীর কোনো পাত্তা নেই!”
-“দেরী করছে কেন, বুঝতে পারছি না। আমাকে ঘন্টাখানেক আগে বলল রেডি হয়ে গেছি। এক্ষুনি বেরচ্ছি।”
-“ম্যাডাম কি ড্রেস পরে আসছেন শুনি! আজ তো ওনার পারফরম্যান্সও আছে।”
-“শাড়ী।”
উত্তর কলকাতার এক অভিজাত কলেজের মাঠের ধারে বট গাছের ছায়াতে বসে অলি আর সুদীপা। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ওরা অভিন্নহৃদয় বন্ধু। গার্লস স্কুলে ক্লাস টুয়েলভের গণ্ডি পার হয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। ওদের এখন ফার্স্ট ইয়ার। কলেজে ঢুকে বেশ কিছু নতুন বন্ধুও হয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম হল শ্রীপর্না, ছোট করে শ্রী।
-“ব্যস, হয়ে গেল। আরো একঘন্টা ধরে রাখ। শ্রী শাড়ীতে একদমই স্বচ্ছন্দ নয়। হটাৎ শাড়ী পড়ার ভুত তার মাথায় চাপলোই বা কেন?” অলি জিজ্ঞাসা করল।
-“আমিই বললাম শাড়ীর কথা। সকালে আমায় ফোন করে সাজেশন চাইছিলো।”
-“তোর ওপর এইজন্য রাগ হয়, জানিস ত সু! কি দরকার ছিল তোর ওকে শাড়ি পরে আসতে বলার।” অলির চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট।
ক্যান্টিনের আড্ডাতে সেদিন সবাই ফেভারিট ড্রেসের কথা বলছিল। অরুণাভর টার্ন আসতে ও যে কথাটা বলেছিল, এখনো মনে রেখেছে অলি।
-“যাই বল! শাড়ীতেই বাঙ্গালী মেয়েদের সবচেয়ে গর্জাস লাগে। যতই আধুনিক ড্রেস পড়িস না কেন, শাড়ী পড়লেই তোদের কেমন একটা অচেনা, রহস্যময়ী লাগে। চট করে ধরা যাবেনা, এরকম একটা ফীলিংস হয় মনে।” একমনে অরুণাভর কথা শুনছিল অলি। শ্রীপর্নার দিকে নজর যেতেই অলি লক্ষ্য করেছিল, মুখে গদগদ ভাব নিয়ে শ্রীপর্নাও অরুণাভর কথাগুলো গিলছে। উফফ্‌, সুদীপার মাথাতে যে কবে বুদ্ধি হবে! আজকের দিনে ও শ্রীকে শাড়ী পরে আসতে বলেছে।
-“তাতে কি হয়েছে অলি! আজকের ফাংশনে অতিথিদের আপ্যায়ণ করার সময় ওকে কত সুন্দর দেখাবে, বল্‌।” সুদীপা খুব সহজ সাধাসিধে মেয়ে। ও চায় ওর সব বন্ধু ভালো থাকুক। খুব অল্প বয়সে বাবা হারানো মেয়েটাকে স্কুল থেকেই অলি একইরকম দেখে আসছে। তাই ওকে সবসময় আগলে আগলে রাখে। সুদীপার নতুন কোনো বন্ধু হলে, অলি তাকে ভালোমত যাচাই করে নেয়। এই কলেজে ওদের ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরুর মাসখানেকের মধ্যে সুদীপা যখন অরুণাভকে ভাই পাতালো, অলি একটু খুঁতখুঁতে ছিল সম্পর্কটা নিয়ে।
-“অরুণ খুব কেয়ারিং, জানিস অলি! ওকে দেখলেই আমার খালি মনে হয়, আমার যদি এরকম একটা দাদা থাকত।” সুদীপা সরল মনে ওর ফীলিংসের কথা অলিকে বলেছিল।
-“হুম। অল্প চেনায় চট করে সবাইকে অত আপন করে নিস না সু। কে যে কিরকম, কিছু বলা যায়?”
অলি জানে, ওর এরকম রেসপন্স পেয়ে সুদীপা দুঃখ পেয়েছিল। এরপর যখন অরুণাভ ভাইফোঁটা নিতে সুদীপার বাড়ী গিয়ে হাজির হল, ওর আনন্দ যেন আর ধরে না।
-“দেখলি অলি! কি বলেছিলাম। মানুষ চিনতে আমার ভুল হয়না।” পাগলিটা ফোনে ওর মাথা খেয়ে নিয়েছিল সেদিন।
হৈ হৈ করতে করতে কলেজে ঢুকেই সুব্রত, অরিন্দম আর দেবারতি, অলি আর সুদীপার সাথে জয়েন করল। প্রত্যেকেই রীতিমত ঘেমে নেয়ে অস্থির। গ্রীষ্মের দুপুরে সুর্য যেন আগুন ঢালছে চারিদিকে। আজ কলেজে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান। ওদের ব্যাচের প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী এটা। তাই প্রত্যেকেই কম বেশী উত্তেজিত। সুদীপা গান গাইবে অনুষ্ঠানে। শ্রীপর্না সীনিয়ার ব্যাচের দিদি দাদাদের সাথে অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্বে।
আজ সুদীপা অলি দুজনেই শাড়ী পরে এসেছে। সুদীপা শাড়ীতে বেশ স্বচ্ছন্দ, মাঝমধ্যেই পরে আসে। অলি ক্যাজুয়াল আউটফিট প্রেফার করলেও সেদিন অরুণাভর কথাটা শোনার পর থেকেই মনস্থির করেছিল, আজকের এই স্পেশাল দিনে ও শাড়ি পরে এসে অরুণাভকে একটা সারপ্রাইজ দেবে।
অলি অরুণাভকে পছন্দ করে। বন্ধুত্বের সম্পর্কের বাইরে কোনও এক গভীর সম্পর্কে যেতে মন চাইছে বেশ কিছুদিন ধরেই। কিন্তু অরুণাভর দিক থেকে সীরিয়াস কোনো সম্পর্কের প্রতি আগ্রহ আছে কিনা, বুঝতে পারে না অলি। অলির সাথে খুব কথা বলে অরুণাভ। কলেজে না এলে খোঁজখবর করে। কিছুদিন ধরে ওয়াটসাপে ভাল ভাল মেসেজ, গান পাঠাতে শুরু করেছে। তবে অলি জানে এসব স্পেশাল কিছু না। দেবারতি, মনীষার সাথেও কলেজের বাইরে অরুণাভর যোগাযোগ আছে। কালো, লম্বা, পেটানো স্বাস্থ্য, দুটো বড় চোখে সরল দৃষ্টির অরুণাভকে মনে মনে অনেক মেয়েই পছন্দ করে। সেই লিস্টে সবার আগে শ্রীপর্নার নামটা জ্বল জ্বল করছে।
-“একি! দেবা-দেবী দুজনেই গায়েব!” দেবারতির কথাটা একদম ভাল লাগলো না অলির। ইঙ্গিতটা অরুণাভ আর শ্রীপর্নার প্রতি।
-“শ্রী বলল, এসেই গেছে” সুদীপা জানালো। আসছে না দেখে শ্রীকে ফোন করেছিল একটু আগে। “অরুণাভর ফোন লাগছে না।”
-“একসাথেই আসছে দুজনে। ওরা এলে মিলিয়ে নিস আমার কথাটা।” দেবারতির মুখে বাঁকা হাসি।
-“কাছাকাছি থাকে। একসাথে আসলে তোর কি?” সুব্রত যোগ দিল আলোচনায়।
-“আমার আবার কি! এত ঢাকঢাক গুড়গুড় কেন? বলে দিলেই হয়, তোরা প্রেম করছিস! অরুণাভ এমনভাবে সব মেয়েদের সাথে কথা বলে, যেন ও তারই প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।” দেবারতির গলাটা রীতিমত অসহিষ্ণু লাগছে।
-“কি বলছিস দেবু!” এত ইন্টারেস্টিং কথাতে অরিন্দম আর চুপ করে থাকতে পারলো না। “তোর সাথে অরুণ কি এমন কথা বলেছে, যা শুনে তোর মনে হল ও তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে?”
অরুণাভ, সুব্রত আর অরিন্দম একই স্কুলে পড়াশোনা করেছে। ওদের মধ্যে একটা ভালো বণ্ড আছে স্কুলের সময় থেকেই।
-“সেটা আমি তোকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। তোরা সব বুঝলে ত হয়েই গেছিল।” যুক্তিতে অরিন্দমের সাথে পেরে উঠবে না জানে দেবারতি। তাই প্রশ্নটা পাশ কাটিয়ে গেল।
সেইসময় বিটি রোডে রাস্তার ওপরে বিপদজ্জনক ভাবে চলে আসা একটা বাচ্চাকে বাইকে যেতে যেতে পাশ কাটালো অরুণাভ। কলেজের এরকম ঘটনাবহুল দিনে সকলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু অরুণাভ কলেজের রাস্তায় না গিয়ে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় ক্রশ করে বাইকে চড়ে ডানলপের দিকে এগিয়ে চলেছে।
একইসময়ে কলেজের গেটে শ্রীপর্না খুব সন্তর্পনে গাড়ী থেকে নামছিল। এক বিশেষ কারণে আজ ওকে শাড়ি পরতেই হয়েছে। ডাকাবুকো স্বভাবটাকে কন্ট্রোল করে হাতেপায়ে একটু সাবধানে থাকতে হবে যে আজ!
-“জানিস, রোহণ শ্রীকে প্রপোজ করেছে!” অরুণাভর বাড়ীতে ঢুকে ওর পড়ার ঘরে এসে প্রথম কথা এটাই বলল অরিন্দম। অরুণাভ তাকালো ওর দিকে। বেশ কিছুটা সাইকেল চালিয়ে এসেছে। গরমে কাহিল দশা বেচারার। জ্যৈষ্ঠ মাস, রোদের প্রখর তেজে সবাই অস্থির। বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা আগামী একমাসেও নেই।
-“তাই” শুকনো গলা অরুণাভর। রোহণ ওদেরই ব্যাচমেট। বড়লোক বাপের ছেলে। দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম ছেলেটিকে। তবে ওর নাকউঁচু স্বভাবের জন্য ব্যাচের বাকি স্টুডেন্টের মধ্যে একদমই জনপ্রিয় নয়। হালে শ্রীপর্ণার সাথে রোহণের ঘনিষ্ঠতার খবর অরুণাভর কানেও এসেছে। কিন্তু ব্যাপারটা যে প্রপোজ করা অব্ধি এগিয়ে গেছে, সেটা নতুন খবর বটে।
-“তবে আর বলছি কি! রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন থেকেই তো দুজনকে মাঝেমধ্যেই একসাথে দেখা যাচ্ছে। তখনি বুঝেছি, ডাল মে কুছ্‌ কালা হ্যায়। আজ নয় কাল এটা হওয়ারই ছিল ব্রাদার।” অরুণাভর বিছানায় আধশোয়া অরিন্দমের মুখে যেন যুদ্ধজয়ের হাসি। আজ রবিবার। প্রতি রবিবারে অরিন্দম, অরুণাভ আর সুব্রতর মধ্যে কোনো একজনের বাড়ীতে আড্ডার আসর জমে। কলেজের কাণ্ডকারখানা নিয়েই চলে চর্বিত চর্বন। তবে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের পর থেকেই অরিন্দম আর সুব্রত দুজনেই লক্ষ্য করেছে, অরুণাভ একটু যেন দমে গিয়েছে।
অনুষ্ঠানের দিন বেশ অবাক করা আচরণ করেছিল অরুণাভ। অনেক লেটে কলেজে পৌঁছেছিল সেদিন। ফোনে হাজারবার ট্রাই করেও ধরা যায়নি অরুণাভকে। যখন পৌঁছল, সুদীপার গান শেষ হয়ে গিয়েছে। অভিমানে সুদীপা তো কথাই বলল না অরুণাভর সাথে। এতক্ষণ গরহাজির থাকার জন্য সুযোগ বুঝে দেবারতিও ক্যাট ক্যাট করে কিছু কথা শুনিয়ে দিল অরুণাভকে। অলির মুখটা স্বভাবতই বেশ থমথমে ছিল। অরুণাভর পছন্দসই ড্রেস পরে আসার কোনও এফেক্টই কাজ করল না। অরুণ ওকে দেখল কই সেভাবে!
প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার জাস্ট আগে গ্রীনরুমের দিকে অরুণাভকে যেতে দেখেছিল অরিন্দম। শ্রীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে ভেবে খুব একটা মাথা ঘামায়নি সে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে রোহণ আর অরুণাভকে উত্তেজিত গলায় বাদানুবাদ করতে দেখে বেশ অবাক হয়েছিল অরিন্দম। তখন অবশ্য ধারেকাছে কোথাও শ্রী ছিল না!
-“প্রপোজ করার খবরটা তোকে কে দিল?” জানতে চাইল অরুণাভ।
-“সারা কলেজ জানে। কাল তো তুই আসিসনি। আমাদের লাস্ট ক্লাসটা হল না। কলেজ থেকে বেরিয়ে আসছি, দেখি গেটের সামনে রোহণ দাঁড়িয়ে। শ্রী আমাদের ছেড়ে ওর সাথে ভীড়ে গেল, জানিস! আমরা তো দেখে অবাক।”
-“তারপর?”
-“কেন? শ্রী তোকে কিছু বলেনি? তোরা নাকি এত ক্লোজ ফ্রেণ্ড!”
-“সেদিনের পরে শ্রীর সাথে আমার খুব বেশী কথাবার্তা হয়নি রে।”
-“কেন?” মিনমিনে গলায় অরুণের কথাটা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল অরিন্দম। ছেলেটা কেমন যেন জলে ভেজা পাঁপড়ের মত মিইয়ে গেছে।
-“সেদিন ফাংশন চলাকালীন রোহণের সাথে ওভাবে ঝামেলা করা শ্রী ভালোভাবে নেয়নি। আমাকে পরে বলেছে সেকথা।”
-“সেদিন তোর কি হয়েছিল বল তো! সারাদিন কোথায় ছিলি? শেষবেলায় এলি। এসেই আবার ঝামেলায় জড়ালি!”
-“তোকে তো বলেইছি সোদপুরে আমার এক রিলেটিভকে দেখতে গিয়েছিলাম। ফিরে আসতে আসতে দেরী হয়ে গেছিল।”
-“আর রোহণের সাথে ঝামেলাটা কেন করলি? কাউকেই কিছু বলিসনি তুই। রোহণ কলেজে কি রটিয়েছে, শুনেছিস তো? শ্রী ওকে বন্ধু বানিয়েছে বলে তুই নাকি জেলাস হয়ে ওকে মারতে গিয়েছিলি ওইদিন।”
-“শুনবো না কেন! যে যা খুশী রটাক, আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।” গোঁজ হয়ে বলে অরুণাভ।
-“কি কারণে ঝামেলাটা হয়েছিল, তুই সেটা তো আমাদের বলবি রে ভাই!” সুব্রত খুবই আন্তরিক গলায় বলল। কিছুক্ষণ হল ও এসে রবিবাসরীয় আড্ডায় যোগদান করেছে।
অরুণাভ যেসময় ওর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে সেদিনের ঘটনাটা ব্যাখ্যা করছিল, সেইসময় অরুণাভর বাড়ীর অনতিদূরেই শ্রীপর্না ওর বাড়ীতে রোহণের সাথে অনলাইনে চ্যাটে ব্যস্ত। আজ সন্ধ্যেবেলা রোহণ ওর সাথে মুভি দেখবে বলে বায়না করছে। কিছুতেই না শুনবে না। অগত্যা রাজি হতে হল শ্রীপর্নাকে। রোহণ ছেলেটা টু মাচ হ্যাণ্ডসাম। রেজিস্ট করা যায় না ওকে।
একইসময়ে কসবায় ওর বাড়ীতে বসে মনীষা ভাবছিল, অনেকদিন কলেজ যাওয়া হচ্ছে না। কাল থেকে কলেজে যেতেই হবে। ক্লাস মিস হচ্ছে প্রচুর। তাছাড়া ফোনে অলি, সুদীপা, দেবারতির কাছে অনেক মশালাদার খবরই পাচ্ছে। নিজে চোখে সেসব যাচাই করাও দরকার।
-“কি রে! এত মুষড়ে পড়েছিস কেন?” কলেজ ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসে মনীষা আর অরুণাভ। পক্স হয়েছিল বলে বেশ কয়েকদিন বাড়ীতে বসে ছিল। এই মাঝের ২০-২২ দিনে কলেজে ওদের বন্ধুমহলে অনেক উথালপাথাল হয়ে গেছে। ফোনে কিছু কিছু শুনলেও এতটাও ও ভাবতে পারেনি। আজ এসে রোহণ আর শ্রীর হট টপিক ডিটেল্‌সে শুনে মনীষার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। রোহণের মত ছেলেকে শ্রী কি করে এত পছন্দ করে বসল, মাথাতেই আসছে না ওর। এদিকে অরুণাভ গোবেচারা মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওকে একটু চিয়ারআপ করার জন্য একটা ক্লাস বাঙ্ক করে ক্যান্টিনে নিয়ে এসেছে অরুণাভকে।
-“আমি ঠিক আছি। চিন্তা করিস না।”
-“তুই কি শ্রীকে ভালোবাসিস? আমাকে বল তো সত্যি কথাটা।”
-“এখন আর এসব কথার কি মূল্য আছে?”
-“আছে। আমি শ্রীকে চার্জ করব।” ইলেভেন টুয়েলভ শ্রী, অরুণাভ আর মনীষা একসাথে ইংলিশ স্যারের ব্যাচে পড়ত। সেই থেকে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওরা। তবে কারো প্রতি কারো দুর্বলতার কথা কেউ প্রকাশ করেনি কখনো। আজকে শ্রী রোহণের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্যেই কি অরুণাভ ধরা পড়ে গেল মনীষার কাছে? অরুণের মুখচোখে যেন প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
-“তুই খেপেছিস! একদম কিচ্ছু বলবি না ওকে। ও যদি রোহণকে পছন্দ করে থাকে সেটা ওর ব্যাপার।” কথা বলতে বলতে ওরা দুজনেই দেখল ক্যান্টিনের দরজায় শ্রী আর রোহণ। রোহণ ডানহাত দিয়ে শ্রীর সরু কোমরটা জড়িয়ে রেখেছে। আজ সকাল থেকে ক্লাসে দুজনকে দেখা যায়নি।
-“কিরে মনীষা, কেমন আছিস তুই? ইশশ্‌, কত রোগা হয়ে গেছিস!” মনীষাকে দেখেই শ্রী ছুটে এসেছে ওর কাছে।
-“আছি একরকম।” ছোট্ট উত্তর দিল মনীষা। কেন জানে না, ওর কথা বলতে ইচ্ছেই করছে না শ্রীর সাথে।
-“এভাবে কথা বলছিস কেন?” শ্রী আহত হল মনীষার কথা বলার ধরনে। আড়চোখে দেখল, অরুণ টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। অরুণ কি ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যাবে?
-“কিভাবে আর বলব শ্রী। যেমন দেখছিস, সেরকমই আছি এখন। এই কদিন কেমন ছিলাম, সে খোঁজ তো আর নেওয়ার সময় হয়নি তোর।” পাশের টেবিলে বসে রোহণ উসখুস করছে, বুঝলো মনীষা। “তুই যা, বোস ওখানে। রোহণ বোর হচ্ছে। আমি এবার উঠি। নেক্সট ক্লাসটা করতে হবে।”
-“দাঁড়া, যাস না। এস কে আসেনি আজ। পরের ক্লাস ফাঁকা আছে। আমি খবর নিয়েছি।” রোহণের পাশে বেশ ঘনিষ্ট হয়ে বসে কথাটা বলল শ্রী। “তোর বেস্ট ফ্রেণ্ডকেও যেতে বারন কর। কিছু কথা আছে আমার।” টেবিলের ওপর রাখা রোহণের আইফোনটা নাড়াচাড়া করছে শ্রী। চোখ দুটো অরুণের ওপর স্থির।
-“আমার অন্য কাজ আছে। অরুণকে আটকাতে হলে তুই সেটা বল ওকে।” মনীষার শ্রীর দিকে তাকাতেই ইচ্ছা করছে না। তাকাতে গেলেই রোহণের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। নোংরা ছেলেটাকে দেখতে চায়না ও। দেখতে অত সুন্দর হলে কি হবে, দৃষ্টিটা খুব বাজে রোহণের। কলেজে ঢোকার পর পরই রোহণ মনীষার সাথে ঘনিষ্ঠতা করতে এসেছিল।
ক্যান্টিনে এইসব ঘটনা যখন ঘটছে ঠিক সেসময় ওদের কলেজের উল্টোদিকের ফুটপাথে একটা কালো আই টেন এসে দাঁড়ালো।
একইসময়ে ক্লাসের সামনে থেকে অরিন্দম, সুব্রত, অলি, দেবারতি, সুদীপা এবং আরো কয়েকজন বন্ধু মিলে ক্যান্টিনের দিকে রওনা হল। অরিন্দমের মোবাইলে ওর কাছে খবর এসেছে ক্যান্টিনে জলদি পৌঁছতে হবে।
পিকচার আভি বাকি হ্যায়
-“সেদিন রোহণের সাথে কি নিয়ে ঝামেলা করেছিল অরুণ, তোরা শুনতে চাস?” ক্যান্টিনে জমায়েত ক্লাসের ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে কথাটা ছুঁড়ে দিল শ্রী। সমস্বরে ইতিবাচক আওয়াজ পেয়ে আবার কথা শুরু করল,
-“তবে তার আগে বোধয় জানা দরকার, অরুণ সেদিন কোথায় ছিল সারাদিন। অরুণ তুই কিছু বলিস না। আমাকেই বলতে দে।” হাত তুলে অরুণাভকে থামালো শ্রী। অরুণাভর কঠিন মুখের দিকে অলি বেশ ঘাবড়েই গেল। খুব রেগে আছে অরুণ, বোঝা যাচ্ছে। কে জানে, কি বলতে চলেছে শ্রী। ওর পাশে বসে থাকা রোহণের মুখে একটা দেঁতো হাসি।
-“সেদিন ও সোদপুরে গিয়েছিল ঠিকই, তবে নিজের কোনো রিলেটিভের বাড়ী না। গিয়েছিল মনীষার পিসির বাড়ীতে। মনীষা সেসময় পিসির বাড়ীতেই ছিল। প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে ছিল। চেনাজানা কাউকেই সহ্য করতে পারছিল না। কলেজে আমাদের বলেছিল, পক্স হয়েছে। অরুণাভ ওকে দেখতে যাওয়ার জন্য জেদ করলে তখন বাধ্য হয়ে মনীষা জানিয়েছিল, ও পিসির বাড়ীতে আছে।”
-“গিয়ে দেখলাম, পক্স হয়নি। জেরা করতেই বেরলো আসল কথাটা। যার জন্য ওর এই দশা, তার নামটাও বলল। রোহণ। কলেজে ঢোকার কিছুদিন পরই রোহণ ওকে প্রপোজ করেছিল। তারপরে ওর সাথে প্রেমের নাটক করে বেশ কিছু ঘনিষ্ট মূহুর্ত কাটিয়েছে। সেসব মূহুর্তগুলো মোবাইলে বন্দী করে রেখে ওকে এখন ব্ল্যাকমেল করছে। শুনে মাথায় খুন চেপে গেল। কলেজে ফিরে রোহণকে দেখে তাই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম শয়তানটার ওপরে। কিন্তু কিছু লাভ হল না। উলটে জানোয়ারটা বলল, আমার এই ঝামেলা করার ফল ভুগতে হবে মনীষাকে।” রোহণ উসখুস করছে, বলতে চাইছে কিছু। এত লোকের সামনে উঠে বেরিয়ে যেতেও পারছে না। সবচেয়ে বড় কথা, ওর আইফোনটা এখন শ্রীর জিম্মায়।
-“প্ল্যান চেঞ্জ করলাম। অরুণের সাথে আলোচনা করে ধরা দিলাম রোহণের প্রেমের জালে। বাকিটা তোরা সবাই দেখেছিস। সিনেমাহলে রোহণের ছোঁকছোঁকানি সহ্য করতে হয়েছে, ওর বিশ্বাস আদায় করার জন্য। আজ সকালে রোহণের ফ্ল্যাটেও গিয়েছিলাম। ফাঁকাই ছিল ফ্ল্যাট। রোহণ আমাকেও খেতে চেয়েছিল। কিন্তু কাল রাতের বন্ধুদের সাথে দারু পার্টির হ্যাংওভার ছিল বলে খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। বরং রোহণ যখন টয়লেটে গিয়েছিল, আমি সেইসময় ওর মোবাইল থেকে ওর আর মনীষার ভিডিও ক্লিপগুলো ডিলিট করে দিয়েছি।”
-“ও মাই গড্‌” মাথায় হাত দিয়ে বসে রোহণ। সামনে বসে থাকা জনগণ এবার ওকে ছিঁড়ে খাবে, বেশ বুঝতে পারছে সে।
-“তবে মালটা ওর সিস্টেমে ক্লিপগুলো কপি করে রাখতে পারে। তাই ওকে পুলিশে হ্যাণ্ডওভার করে দেওয়া খুব জরুরি। কলেজের বাইরে কালো আই টেনে বসে আমার দাদা ওর জন্য অপেক্ষা করছে। কলকাতা পুলিশের আইজি। বন্ধুরা চল, সকলে মিলে ওকে বাইরে নিয়ে গিয়ে দাদার হাতে তুলে দি।” শ্রীর এই আবেদনে সকলেই নির্দ্বিধায় সায় দিল।
তুমুল হৈ হট্টগোলের মধ্যে টেনে হিঁচড়ে রোহণকে বাইরে নিয়ে কালো আই টেনের দিকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন আকাশে বেশ মেঘ করেছে। গ্রীষ্ম শেষ, বৃষ্টি হতে পারে আজ। মনীষার গাল বেয়ে বৃষ্টি নেমে গেছে অনেক আগেই। শ্রী ওকে এত ভালবাসে! কত বড় রিস্ক নিয়েছে ওর জন্য।
ওদিকে অলির মনটা বেশ খুশি খুশি এখন। অরুণাভর মনটা যে কত বড়, আজ বোঝা গেল। আর দেরী করা ঠিক হবে না। আজই অরুণকে প্রপোজটা সেরে ফেলতে হবে।
-সমাপ্ত-

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র