জলপরী

মায়াজম
2
                            নক্সী গাঁথা






ধড়মড় করে উঠে বসল নক্সী, দরদর করে ঘেমে নেয়ে একাকার, শরীর টা অসম্ভব অস্বস্তিতে ভরপুর, মনে হচ্ছিল দূরে নীলশূণ্যে
কোথাও ভাসতে ভাসতে এখনি দুম করে পড়ে যাবে।
হয়ত জল খেলে ভালো লাগবে, ধুর নিয়ে খেতে ইচ্ছা করছে না ।চুপচাপ দমখিচে কিছুক্ষণ বসে থাকল, তারপর আস্তে করে উঠল ঘরের লাগোয়া খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়াল ঠিক চাঁদের নীচে। ভালো লাগছে এবার শিরশিরানি হাওয়ায় আবল-তাবল ভাবনা। ওর আঁকার খাতাটা নিয়ে বসল, আঁকিবুঁকি কাটল, গভীর ভাবে দেখল, 'নাহ এবার ঘুম পাচ্ছে' ।
পরের দিন ইন্সটিটিউট থেকে ফেরার পথে ভাবতে ভাবতে ফিরছিল নক্সী - কি অদ্ভুত স্বপ্ন না আজকাল দেখে সে। বাড়ী ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে কফির কাপটা নিয়ে ছাদে উঠে এল, আবীর ছড়ানো বিকেল । ছেঁড়া মেঘগুলোর মধ্যে খুঁজতে লাগল ঘোড়া, হাতির শুঁড়, মানুষের মুখ, ষাঁড়ের শিং। একটা একটা করে এবার তারা ফুটতে শুরু করেছে । 'আজ প্রোজেক্ট টা শুরু করতেই হবে'।
ভাবনার জাল ছিঁড়ে মায়ের ডাক, এক রাশ বিরক্তি মেখে নীচে নেমে এল নক্সী । বিরক্ত কন্ঠে বলে, উঠল হুমম কি হয়েছে? একটুও যদি নিজের মত থাকতে দাও । মা বলল, হুঁশ নেই তোর ছাত্র এসেগেছে । ওহ, হাতি-ঘোড়া ভাবতে ভাবতে সে যে ভুলেই মেরেছিল। স্টুডেন্টের সামনে মুখটা কে গম্ভীর করে নিল। এ ভালো ছেলে চটপট পড়া করে নেয়, বাকিগুলোর মত এর পেছনে অত বকতে হয়না। আরো দুটো আছে, বাবা কি বিচ্ছু ; কি বকতে হয় রে ওদের পেছনে। আজ ওরা আসবে না, তাড়াতাড়ি পড়িয়ে প্রজেক্ট টা নিয়ে বসতে হবে ।আজ তবুও ছাদে ঘোরার টাইম পেয়েছে অন্য দিন এত টাইম থাকে না, সপ্তাহে তিন দিন তো নিজেরই পড়া থাকে, ইন্সটিটিউট থেকে ফেরার পথে পড়ে বাড়ী ফেরে। সেদিন গুলো ফিরতে রাত হয়। বাকি দিন ফিরতে না ফিরতেই হাজির ছাত্রদল, তাড়াতাড়ি করে সেরে পড়াতে বসে নক্সী । খুব খাটে মেয়ে টা। নিজের পড়াশোনার খরচ, হাত খরচ পুরোটা বাবার ওপর চাপাতে চায়না।
রবিবারে ওর পড়তে বা পড়াতে ইচ্ছা করে না,ঘুরে আসে বন্ধুদের সাথে নদীর ধারে বা পাড়ার মোড়ে এদোকান সেদিক ঢুঁ মেরে দেখে। প্ল্যান করে সিগারেট খাওয়ার, বাড়ির চিলেকোঠায় লুকিয়ে সিগারেট খায়। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজে এক হাঁটু জল নিয়ে 1st ডে 1st শো দেখতে যায় মিথ্যে কথা বলে । বন্ধুর বার্থডে যেতেই হবে, ওর মা সকাল থেকে কত্ত রান্না করে বসে থাকবে, সব নষ্ট হবে না গেলে। যথারীতি আগের দিন থেকে প্রস্তুতি, বন্ধুর নেমন্তন্ন করে যাওয়া । মিথ্যে বলা ঠিক হয়নি কিন্তু না বললে মজাটাও হত না একটা অদ্ভুত দোলাচালে ভোগা।বন্ধুদের সবার স্পেশাল ফ্রেন্ড আছে, ওর কাপ অফ টি এখনও মেলেনি। তবে বিয়ে করলে প্রেম করেই করবে।
এইতো সেদিন ব্যাচে একটা ছেলে নন্দিনীর মারফত প্রোপোসাল পাঠাল ওকে। কিন্তু ছেলেটার প্রতি তো কনো ফিলিংস ই নেই নক্সীর। এটা যে মনের ব্যাপার সেটাই বুঝতে চায়না কেউ। জিতেন স্যর এর ব্যাচের সুজন তো নক্সীরই হাত দিয়ে লাভ লেটার পাঠাল শুভ্রা কে, যেই শুভ্রা না করে দিল দুম করে প্রোপোস করে বসল নক্সী কেই। পাগল না মাথা খারাপ, এদের কাছে ভালোবাসার মানেটা কি। দুদিন বাদে তো নক্সী কেই ছেড়ে অন্য দিকে টার্ন নেবে ভালোবাসার রাজপথ। ওই ভালোবাসায় কনো গভীরতা নেই। নক্সী শুধু জানত; অসময়ের প্রেম ঝরাপাতার মত, উড়ে যায় উঠে যায় ।
দু একজন কে যে তার ভাল লাগত না তা নয়, তবে যোগ্যতা যাচাই এ তারা ফেলে করে, কেউ বা পরীক্ষার ভয়ে আগেই চম্পট দেয় । খুব খারাপ লাগত নক্সীর । তবে একজন কে সে সত্যি করেই ভালবাসত, ইচ্ছে আছে পড়া কমপ্লিট করবে, চাকরি করবে ততদিন যদি সে অপেক্ষা করতে পারে করবে নয়ত আরকি। নক্সী প্রতি নিউ ইয়ারে একটা করে কার্ড বানাত আর এটা করে বার্থডে গিফট, ডেট অফ বার্থ না জেনেই। রুমাল কিনে তাতে নক্সা তুলেছিল লাল গোলাপ । জমিয়ে রাখত, একবারে দেবে, কতদিন প্রতীক্ষা করেছে তার জন্যে সেটা বোঝাবে। যেদিন নক্সীর দেখা হত ওর সাথে ও জানতেও পারত না ; নক্সী ডায়েরীর পাতায় ফুটিয়ে তুলতে মনের কথা, মনের ব্যাথা আর একটা পকেট ক্যালেন্ডারে সেই ডেট গুলোতে গোল করেছি নীল দাগ লাগিয়ে রাখত। কেউ জানত না নক্সীর মুখের গম্ভীর পরতের নীচে এত ভালোবাসা থাকতে পারে।
2
খোলা আকাশের নীচে ধূপের গন্ধ মাখা চুল এলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নক্সী মা এসে থুথু দিয়ে দিল, হিংসার চোখ থেকে আড়াল করার জন্য বা হয়ত শরীরের হিংসা থেকে। পুজো দিয়ে উঠেছিল নক্সী, মা আজ দিতে পারবে না , ঠাকুরের ভক্তি নেই তবুও মায়ের শেখানো মত সুন্দর করে পুজো দিতে পারে , কপালে চন্দনের ছোটো ফোটা ওপরে সিঁদুরের লাল ছোঁয়া । আয়নায় দেখেছে নক্সী ওই ছোট্ট ছোঁয়াতেই তাকে দারুণ লাগে,ভীষণ আকর্ষক। এবার বেরতে হবে ।
প্রোজেক্ট সাকসেস। এবার ফাইনাল সেম এর প্রস্তুতি, হঠাত্‍ ওর মা সেন্সলেস হয়ে পরে গেল। ব্যস আজ তিনদিন ধরে নক্সী পুরো নাজেহাল। ঘরের সব কিছুই সে ছাড়া করার আর কেউ নেই তার সাথে মা কে দেখাশোনা করা। টাইম করে মাকে খাওয়ানো, ওষুধ দেওয়া, ছাত্রদলের উৎপাত সামলানো। রান্নাটাই য্যান সমস্যা ওটা নক্সী একদম পারে না তবুও পারল, ভাইদের সকালে চা করে খাওয়ানো কিছু টিফিন করে দেওয়া; ভাত, ডাল আলু ভাজা, ডিমের মামলেট যতটা পারত আর কি। বাবা কাজ থেকে এসে ওকে সাহায্য করত।শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা টা সামলাতে পেরেছিল, মা সুস্থ্য হয়ে উঠেছিল কিন্তু ক্রমিকপদ (rank) টা তিন থেকে বেড়ে গেল হিসাব রাখল না নক্সী । ক্যাম্পাসেও উৎরে গেল আর এক ঝাঁক প্রজ্জাতি নক্সী কে ঘিরে ধরল। প্রজাপতি কে নক্সী প্রজ্জাতি বলে। এবার শুধু তাকে বলা এটাই পেরে উঠল না নক্সী কিন্তু কুছ পরোয়া না করা বন্ধুরা আছে যে। বন্ধুদের সৌজন্যে তার খবর পৌঁছাল , এবং বন্ধুদের জন্যই সে জানতে পারল তার কাঙ্খিত পুরুষটি তার নয় অন্য কারো। ভুল শুধরে নিল নক্সী ।নতুন চাকরি, নতুন জীবন, নতুন সম্পর্ক আর নতুন ব্যস্ততার মধ্যেই কোথা থেকে এক খবর এল - 'ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে '।
লাস্ট মান্থে কলিগ বিয়েতে আলাপ, সেখান থেকে কানাঘুষো, যেটা এখন সত্যি । পাত্রের বাড়ী থেকে যেচে এসেছিল বিয়ের কথা, আর না করেনি নক্সী, না করতে ইচ্ছা হয়নি।ভালোবেসে বিয়ের স্বপ্ন দেখত, আরেঞ্জ ম্যারেজ একদম সহ্য হত না। নক্সীর কাছে হাসবেন্ড মানে ছিল বেস্ট ফ্রেন্ড, খুব ভালো বন্ধুতা থাকবে দুজনের । সব ভাবনার মুখে একরাশ ছাই ঢেলে বিয়ের পিঁড়িতে বসল নক্সী ।
যাই হোক এক রকম মানানসই, হইহই করে এল অষ্টমঙ্গলা করতে; ফিরে গিয়েই কাশ্মীর, ফ্লাইটের টিকিট কাটা আছে। এই প্রথম প্লেনে উঠবে সে , চাপা উত্তেজনা থাকলেও বাচ্চামি টা মিসিং। মধুচন্দ্রিমায় গেল নক্সী । ফিরেও এল, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে, অনেক ফর্মালিটি সামলে। তিনদিন-দুরাত পেরিয়ে ঢুকল পাথরের নক্সী, একবারের জন্যও একা ছাড়েনি হাসবেন্ডের ডেট বডি কে। বাড়িতে পা দিতেই দরজা আটকে দাঁড়াল শ্বশুর, শাশুড়ির উগরে দেওয়া থুথুর সাথে "ছিঃ নক্সী ছিঃ"। সবার কটাক্ষ, ছুঁড়ে দেওয়া মন্তব্য কুলটা-কালনাগিনী-ভাতারখাগী । বিয়ের আগে কুণ্ডলী মেলানো হয়েছিল তবুও ধোপে টিকল না। নক্সীর পাশে মা,বাবা, ভাই। পুলিশ রিপোর্ট, ডাক্তারের রিপোর্ট, খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ কেউ ছাড়েনি যতক্ষণ না উত্তর মেলে। বাড়িতে পুলিশ এল পোস্টমর্টেমে বডি পাঠানো হল। নাহ ক্লু , মোটিভ, প্রুফ কিছুই মেলেনি, শুধু একটা পাঁচ লাখের মত পলিসি হোল্ড করছিল নিলয় যার নমীনিতে ছিল মা'র নাম।
নিলয়ের হঠাৎ ফুড পয়জনে গ্যাসটিক আটাক থেকে হার্ট ফেলিওর ।।
3
শহর জুড়ে বড় বড় ব্যানারে জ্বল জ্বল করছে নক্সী রায় চৌধুরীর ফ্যাশন শো, এক্সিবিশন । এক্সিবিশনে সাজানো হয়েছিল ওর বানানো কার্ড আর গিফট গুলো দিয়ে, ওর ছড়িয়ে থাকা নক্সা জোড়া দিলে একটা কাহিনী বলবে।
অনেক বড় হয়েও এমনকি বিয়ের আগেও নক্সী বাচ্চাদের মত করে কথা বলত মা'র সাথে, আধফোটা, আধো আধো। ধেড়ে বয়েসে আদুরে ভাবের জন্য ভাই রা ক্ষেপাত "নক্সা করিস না"। এখন খুব স্পষ্ট কথা বলে নক্সী ।
চোয়াল শক্ত করে গ্যারেজ থেকে গাড়ী টা বেড় করে জানলার কাঁচ তুলে ফার্স্ট গিয়ারে রেখে পার্কিং থেকে বড় রাস্তায় নামল।
মনা নীচে গিয়ে দেখ , মায়ের কথা শুনে দুড়দাড় নীচে!!!! ঊঊহহহুহুহু, নীল আটলাস, কি মজা বাবা,.............
তুমি ধরে রাখবে কিন্তু বাবা , একদম ছাড়বে না না হলে পরে গিয়ে কেটে যাবে , ছাড়বে না কিন্তু।
বাবা দিদি কে ক্লাস এইট এই সাইকেল কিনে দিলে আমাদেরও দিতে হবে,
কিছু দূরে গিয়ে পেছন ফিরে , বাবা অনেক দূরে; সাইকেল নিয়ে হুড়মুড় করে ধপাস,
বাবা দৌড়ে কাছে এসে- "পেছনে তাকাতে বারণ করেছিলাম তো"; তুমি কেন ছেড়ে দিলে বাবা?
দু এক ফোঁটা বৃষ্টি ছিটে চোখ থেকে গালে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

  1. আহ! কি অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম। কি শৈল্পিক শব্দখেলা! পরম মুগ্ধতায় পুরো গল্পটায় চোখ বুলিয়ে নিলাম- একবার, দুইবার, তিনবার, সাতবার। যতবার পড়ছি ততবারই মুগ্ধ হচ্ছি। গল্পের প্রতিটি স্তরে স্তরে যেন থোকায় থোকায় পাকা আমের ঝুলাঝুলি!
    অসং্খ্য থোকা থেকে তিনটে পাকা আমের থোকা তুলে নিলাম আমার ঝুড়িতে।

    ★ পরের দিন ইন্সটিটিউট থেকে ফেরার পথে ভাবতে ভাবতে ফিরছিল নক্সী - কি অদ্ভুত স্বপ্ন না আজকাল দেখে সে। বাড়ী ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে কফির কাপটা নিয়ে ছাদে উঠে এল, আবীর ছড়ানো বিকেল । ছেঁড়া মেঘগুলোর মধ্যে খুঁজতে লাগল ঘোড়া, হাতির শুঁড়, মানুষের মুখ, ষাঁড়ের শিং। একটা একটা করে এবার তারা ফুটতে শুরু করেছে । 'আজ প্রোজেক্ট টা শুরু করতেই হবে'।

    ★খোলা আকাশের নীচে ধূপের গন্ধ মাখা চুল এলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নক্সী মা এসে থুথু দিয়ে দিল, হিংসার চোখ থেকে আড়াল করার জন্য বা হয়ত শরীরের হিংসা থেকে। পুজো দিয়ে উঠেছিল নক্সী, মা আজ দিতে পারবে না , ঠাকুরের ভক্তি নেই তবুও মায়ের শেখানো মত সুন্দর করে পুজো দিতে পারে , কপালে চন্দনের ছোটো ফোটা ওপরে সিঁদুরের লাল ছোঁয়া । আয়নায় দেখেছে নক্সী ওই ছোট্ট ছোঁয়াতেই তাকে দারুণ লাগে,ভীষণ আকর্ষক। এবার বেরতে হবে।

    ★'বাবা দিদি কে ক্লাস এইট এই সাইকেল কিনে দিলে আমাদেরও দিতে হবে।'

    প্রচুর শুভ কামনা রইলো পরী।

    'গাজী মহসিন ফিরদৌস'
    ঢাকা কলেজ, ঢাকা, বাংলাদেশ।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এখন আমের মরসুম বুঝলাম । আমার কিন্তু অন্য পংক্তি পছন্দের, যেখানে বাবা পেছনে ফিরতে মানা করে কিন্তু ফিরে তাকাতেই হয় বাবার জন্যই ।।

      মুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন