পাঠ প্রতিক্রিয়া /কবি স্বরূপ চন্দ'র কাব্যগ্রন্থ "এক ঠোঙা মুড়ি দুটো বাতাসা"
'' কোথায় গিয়েছে মিশে আকাশের চাল
কার পাকস্থলীতে জন্মাচ্ছে কবিতার ঢাল ।''
কবিতা লেখা হয়তো খুবই সহজ কাজ , কবিতা লেখা হয়তো খুবই কঠিন কাজ ! জীবন মানেই তো নিজেকে আবিষ্কার করা , জীবন মানেই তো নিজেকে খুঁজে ফেরা ! তবে , সবাই কি আর জীবনকে খুঁজে পেয়েছেন ? যিনি পেয়েছেন তিনি পেয়েছেন । সাহিত্যের আঙিনায় অমূল্য রতন ই নয় ,শহর কলকাতার থেকে বহুদূরে বসে এক কবি যে অবিরাম অমর সাহিত্য সৃষ্টির সাধনায় ব্রতী হয়েছেন যার ফলস্বরূপ আবিষ্কৃত এক বিশালাকায় স্বর্ণখনি।প্রান্তিক অঞ্চলে বসেও যে সোনার চাষ-আবাদ করা সম্ভব কিছু মানুষ তাদের কলমের ধারে বারবার প্রমাণ করে চলেছেন।আর আমরা শিক্ষিত মূর্খের দল শাদা পাতায় দুর্বোধ্য কিছু শব্দ ছিটিয়ে দিয়ে বিজয় উল্লাসে গর্বিত হয়ে উঠছি।যেখানে মানুষের আধুনিক মনের মত কবিতার শব্দ গাঁথুনি এবং বোধ হয়ে উঠছে দুর্বোধ্য ,কবিতা সৃষ্টিকারী হয়ে উঠছেন নগণ্য পাঠকের ধরাছোঁয়ার বাইরে সোনার পাথরবাটির মত।সেখানে প্রশ্ন থেকেই যায় এই আটলান্টিক জয় টাইপের কবিতাদের আয়ু কতদূর বিস্তীর্ণ তা নিয়ে।তবে আশার কথা এই যে চাঁদ-তারা-ফুল -পাখি নিয়ে ন্যাকা ন্যাকা শব্দের মোহজাল বিস্তার ,নাগরিক বিকৃত উন্নয়ন,অকারণের যৌনলিপ্সার উলঙ্গ হাতছানির বাইরেও যে কবিতা লেখার জগত রয়েছে। চোরাবালিতে চাপা পড়া কিছু কবিরা কিন্তু দেখিয়ে দিচ্ছেন যাবতীয় একমুখীন সাহিত্য বিষয়ক ধ্যান ধারণাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে নৎসাৎ করে দিয়ে।আর এখান থেকেই তাঁর /তাদের জয়যাত্রার শুরু।জীবন বোধ বলে, মোক্ষম উন্মাদ না হলে বোধহয় শিল্পের জন্মদাতা/দাত্রী হওয়া যায় না।পক্ষান্তরে বলা যায় শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির জন্য বিশেষ উন্মাদনার প্রয়োজন।সমাজের যা কিছু গলদ কবি চিৎকার করে বলতে পারেন অবশ্য গ্রহণযোগ্যতা বর্তায় পাঠকের মেরুদণ্ড কতখানি সবল তার উপর।
কবি স্বরূপ চন্দ'র দ্বিতীয় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ "এক ঠোঙা মুড়ি আর দুটো বাতাসা" পড়ার পর প্রথমেই এই কথাটিই মনে হয়েছিল।কবি স্বরূপ চন্দকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই কারণ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "হালুম" যারা পড়েছেন তারা জানেন কবির কবিতা কোন গভীরতায় অবস্থান করে।আজকে আমার আলোচনা কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে।সুন্দর রুচিসম্মত প্রচ্ছদের ভিতরে ৬৪ পাতার বইয়ে মোট ৪১ টি কবিতায় নানা স্বাদের নানা স্রোত ধারায় ধাবমান। ফলন্ত ব্রাহ্মণীর মত ঢেউ , প্রতি ঢেউয়ে মণিকাঞ্চনমালা ছড়িয়ে রয়েছে অক্ষরে অক্ষরে।কবিতার প্রতিটি তন্বী শরীর জুড়ে এক অনাঘ্রাতা সোঁদামাটির গন্ধ।যার শাখা প্রশাখা বিস্তীর্ণ দিগন্তকে চুম্বন করলেও শেকড় যে মাটির গভীরে তা কবিতা গুলি পড়লেই বোঝা যায়।
"হলুদ দাঁত বের করে লোকটা হাসল
তারপর একঠোঙা মুড়ি আর দুটো বাতাসা দিয়ে বলল:
খেয়ে নিন।
সেইদিন আমি প্রথম জানলাম খিদে কী জিনিস
সেদিন বুঝলাম -একঠোঙা মুড়ি ও দুটো বাতাসার
ক্ষমতা কি রকম
সেদিন বুঝলাম দাঙ্গা থেকে জঠরাগ্নি
আগুন নেভানোর শ্রেষ্ঠ উপায়
এক ঠোঙা মুড়ি আর দুটো বাতাসা।"(এক ঠোঙা মুড়ি আর দুটো বাতাসা,পৃ:৯)
জঠরাগ্নি থেকে আদি অনন্ত মুক্তির পথ কবি বলে দিয়েছেন অতি গভীর অথচ সহজ সরল ভাষায়।বাংলা কবিতা এখন অনেক বেশি সাবালক ।তার ' বাবা ' সিরিজের কবিতাগুলি পড়লেই বোঝা যায় অসম্ভব রকম পরিপূর্ণ।আসলে আমরা সকল অপূর্ণতার মধ্যেই পূর্ণতা খুঁজে নেওয়াকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছি।যাবতীয় না পাওয়াকে পাওয়ার চেয়ে অলোকবর্ষ দূরে ভেবে নেওয়ার মধ্যেই পাওয়ার সফলতা খুঁজে পেয়ে থাকি।অথচ কবির কাব্যভূমি কর্ষণ করলে পাওয়া না পাওয়ার ফাঁকিটুকু নিয়ে অযথা মেঘের ঘনঘটায় মন ভারাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই বরং উষ্ণ চামড়ার নীচে সাপের রক্তে পরিণত হওয়ার থেকে কিছুটা হলেও যেন মুক্তি। টগবগ করে ফুটে উঠতে পারি।শিরায় উপশিরায় খনিক হলেও মাতন ধরায় কিছু লাইন।
আমায় ভয় দেখিও না/যমের মুখে চুমু খেয়ে আমার জন্ম(আমাকে ভয় দেখিও না,পৃ:৩৪)
পাশে পড়ে আছে ইনসাস রাইফেল/পাশে পড়ে আছে সহযোদ্ধার লাশ/আমাকে দেখে ঠোঁট চাটছে দুটো হায়েনা/রাগে ও হিংসায় তার চোখে জ্বলছে আগুন"
"আমাদের লাজ-লজ্জা নেই বলে/আমরা বলি:ইনকিলাব/আমাদের মান-সন্মান নেই বলে /আমরা বলি :জিন্দাবাদ /আমাদের গায়ে গণ্ডারের চামড়া বলে/আমরা বলি:বন্দেমাতরম।"(রাজনীতি পৃ:৫৪)
যখন বাংলা কবিতার আধুনিকীকরণে মসগুল কবিসমাজ অহরহ টেস্টটিউবে ফেলে কাঁটাছেঁড়া পরীক্ষা নিরীক্ষায় ভয় পেতে শুরু করেছে গোলাপায়রা জাত সাধারণ পাঠকগণ (এখানে বলে রাখা ভাল ৭০% কিন্তু এই গোলা পায়রাজাত পাঠক)।সেখান থেকে যেন কিছুটা হলেও এক পশলা ঝাঁঝালো -শীতল-নরম-গরম-চরম-পরম বৃষ্টির স্বাদ কবির কলম জুড়ে।
'ফুলমণির গায়ে নিম তেলের গন্ধ/ফুলমণির চুলে গোঁজা পুটুস ফুল' (ফুলমণি উপাখ্যান, পৃ:২৭)
কবি সজ্ঞানে যখন শহরের কৃত্রিম নেশা থেকে দূরে টেনে পাঠকদের নিয়ে ছুটে যান কেদুপাতার মৌতাতে তখন জঙ্গল যেন জঙ্গল থাকেনা।হয়ে ওঠে কি বিশেষ কিছু?
"বুধন মুরমু ফুলডুংরির জঙ্গলে শিকার করে
বুধনের ভাই স্কুল ছেড়ে বিড়িবাঁধে
বুধনের মা কেদু পাতা তোলে।"(বুধন, পৃ:১৩)
অথবা
"লঘু মুরমু ,চিরকু হাঁসদা,লিকুমচাঁদ টুডু
তিন বন্ধু একটা বনমোরগের পিছনে ধাওয়া করে
হারিয়ে যায় ফুলডুংরি জঙ্গলে।"(ফুলডুংরি কবিতা,পৃ:১৮)
বা
"একদিন বাঁকুড়া থেকে দিল্লি যাচ্ছি
আমার প্লেন ক্র্যাশ করল ফুলডুংরির জঙ্গলে
দুদিন জ্ঞান ফিরল না
তৃতীয় দিন মাঝরাতে জ্ঞান ফিরল যখন
দেখি একটা লোক পিঠে স্লিপিং ব্যাগ,কাঁধে বন্দুক নিয়ে
একটা আধপোড়া খরগোশের ঠ্যাং চিবাচ্ছে।"(রূপেন হাঁসদা কবিতা,পৃ:২৬)
এখানে কমন বিষয় হচ্ছে ওই ফুলডুংরি নামটি।কবিতায় নানাভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে জঙ্গল আর মানুষজনের যাপনযাত্রায়, যেন এই জঙ্গলসহ ফুলডুংরি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।যাকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষমতা বোধহয় স্বয়ং কবির ও নেই।কখন যেন এই ফুলডুংরি নিজেই চালচিত্র থেকে চরিত্র হয়ে উঠেছে আর কবিতাগুলিকে করে তুলেছে দারুণ ভাবেই জীবন্তস্বরূপ।তেমনি প্রত্যন্ত মানুষজনেরা স্বমহিমায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থের বাঁকে বাঁকে।
টানটান ভাবধারা পাঠককে বেঁধে রাখে কবিতায়।অকারণে শব্দের ঝড় তুলে কোথাও কোনখানে পাঠককুলকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস নেই।পাঠকে অন্ধকারে রাখার প্রয়াস নেই কোথাও।কবি দৃঢ় কণ্ঠে নিজেই বলেন -
"কবিতা নয় আপনাকে তিনটি বারুদ ভরতি কামান পাঠালাম
কবিতা নয় আপনাকে তিনটি তেজস্ক্রিয় ভরতি আগ্নেয়াস্ত্র পাঠালাম
কবিতা নয় আপনাকে তিনটি বন্দুক ভরতি কার্তুজ পাঠালাম।
....
আর সেই রক্তের দাগ দেখেই চিনবেন
কবিতা তিনটি রোমারু স্বরূপের বিষাক্ত তির
কবিতা তিনটি বিষাক্ত স্বরূপের নির্ভেজাল ঘুষি।"(তিনটি কবিতা,পৃ:৪৫)
কবিকে ভালো করে চেনার অবকাশ এরচেয়ে বেশি আর কি হতে পারে!একহাতে রণদুন্ডুভি অন্যহাতে বিজয়শঙ্খ নিয়ে কবির চারণক্ষেত্র।কবি হাজারবার মরে আবার হাজারবার শব্দসহ জন্মাতে দেখি।যে কবিতাটির কথা না বল্লেই নয় সেটি হল 'কিষণলাল "।
"কিষণলালের কোন দুঃখ নেই/কিষণলালের সুখ নেই/তাই সে কাঁদতে জানে না/তাই সে হাসতে জানে না/সে সকাল দেখে ,সেকাল না দেখা লোকের মতো/সে বিকেল দেখে ,বিকেল না দেখা লোকের মতো।"(পৃ:৪৯)
সাহিত্যে আধুনিকতাটা ঠিক কি!পোষ্টমর্ডানিজম আর পুরাধুনিক যথেচ্ছচারের মধ্যে যদি কবিতাকে বেঁধে দেওয়া যায় তবেই কি উৎকর্ষ শিল্প সৃষ্টি সম্ভব!আলোচ্য গ্রন্থটিতে কবি সেসব যাবতীয় সম্ভাবনা কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কবিতাগুলি আধুনিকতার সীমা ছুঁয়ে যায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।সমাজের যেখানেই অসামঞ্জস্য সেখানেই দারুণ স্মার্ট এবং তীক্ষ্ণ ভাষায় তার নিজস্ব লেখার চলন ভঙ্গিতে বিদ্যুতের ফলার মত গর্জে উঠেছেন। তার 'বাংলা একাডেমী' ,"ভীতু স্বামীর গল্প","স্টারডম" ,"কাওয়ার্ড","পোর্টেবল "ইত্যাদি কবিতাগুলির আমাদের হূদয়ের ভীত নাড়িয়ে যায়।
কিছুশব্দ নজরবন্দী মানুষের মতো যখন ঘুরে ফিরে আসে তাকে কি বলা যায় লেখকের দুর্বলতা নাকি সেই সব অক্ষরজাত ভাবনাই লেখকের আইডেন্টিটি হয়ে ওঠে তা আলোচনা সাপেক্ষ বিষয়।সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ জুড়ে যেন এক রিদম একসুর বেঁধে রেখেছে।তার সুরমূর্ছনা মাঝেমাঝে মোহিত করেছে মাঝেমধ্যে সৃষ্টি করেছে ঘোর।এক কবিতার শরীর থেকে অপর কবিতার শরীরের আনাচ কানাচ ছুঁতে পিটুরিটাহির অধিক ক্ষরণের প্রয়োজন পড়েনি বিশেষ। তবে সুন্দর মোড়কের অন্দরমহলে যে ছড়িয়া থাকা স্বর্ণরেণু আছে তাকেই ঝুলি ভরে নিতে নিতে পাঠক নিজেকে ধনী মনে করবেন একটা সময় বলতে পারি।
"শহর থেকে দূরে করব শুয়োর চাষ
শহর থেকে দূরে খুলবো মুরগি পালন কেন্দ্র
মুরগির ছাল চামড়া দিয়ে বানানো মন্ড বেচব
রাস্তায় রাস্তায়
শুয়োরের গু মুত দিয়ে ঢেলা বানিয়ে বলব
গঙ্গা মাটি চাই গো ..."(সাকসেসফুল,পৃ:৬৩)
গ্রন্থটির সমাপ্তি ঘটেছে "মানুষের বাচ্চা" কবিতাটি দিয়ে।শেষ কবিতায় এসে যেন একটা জার্নির সমাপ্তি।
"কান্না কী জিনিস এতদিনে জানলাম
এতদিনে জানলাম আমি পশু নই
মানুষের বাচ্চা।"
কাব্যগ্রন্থ আলোচনায় সোনালী মিত্র
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
1মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
3/related/default
খুব ভালো আলোচনা সোনালী। কবি ও কবিতার স্বরূপ উঠে এলো।
উত্তরমুছুন