রুখসানা কাজল - মায়াজম

Breaking

৩০ সেপ, ২০১৬

রুখসানা কাজল


                               শরীর শরীর








কেমন আছ ? 
আর থাকা । খোজা পাহারাদারের জীবন কাটাচ্ছি দোস্ত । ধারে কাছে কোথাও চালতা গাছ আছে নাকি জানো ? চালতা ? হঠাত?কিকরবা? শুনছি চালতা পাতা খাইলে নাকি ইয়ে টিয়ে কমে যায় । আর তো পারিনা। হাহহাহ হেসে গড়িয়ে পড়ে রুমকি আরে আমি ত শুনেছি বেলপাতা। আগেকার দিনে নাকি কমবয়সী বিধবাদের বেলপাতার শরবত বানায়ে খাওয়াত। আর কি কি আছে বল ত? পাতা ত পাতা আমি ছাল বাকলশিকড় খেতেও রাজী আছি। কি করুন দশা! স্বল্পচুক্তির একটা বিয়ে করে ফেল দোস্ত। সর্বনাশ – কি কইলে তুমি ? দেশে তাইলে টেকা যাবোনা !হাড্ডি গুড্ডি ভাইঙ্গা দেবেনে। রুমকি যুক্তি দেয়, আরে নিয়মে আছে ত। রুগ্নবউ থাকলে-- তাইলে এই দেশ কি দোষ করল। তুমি ভাল কোন হুজুরকে ধরো। কোন শালার বাপও কিচ্ছু বলতে পারবে না। সুস্থ বউ রাখেই কতজন---- ইমন অনেকক্ষণ ধরে হাসে । রুমকির সাথে কথা বললেই মন ফ্রেস হয়ে যায়। কিন্তু সত্যিই শরীর আর একা থাকতে চাইছে না। কতদিন পারা যায় ? সে এক ভোগি পুরুষ তার জন্যে শারীরিক উপোস বিরক্তিকর শাস্তিস্বরুপ।
সুমি যে এতটা অসুস্থ ইমন বুঝতে পারেনি। যখন যা চেয়েছে তাই দিয়ে এসেছে এতদিন । যদিও মনের দিক দিয়ে অনেক দূরে চলে গেছিল তারা। যারা বলে বয়েস বাড়লে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কোন না কোন পথধরেআবার এক বিন্দুতে এসে মিলে যায় তাদের কথা শুনে ইমন একসময় খুব হাসত। ইদানীং হিসেব করে দেখেছে তার আর সুমির সম্পর্ক দুটো জায়গায় এসে তাৎক্ষণিক মিল খায় তা হল সন্তান আর শরীরে। ইমনের খুব ইচ্ছে করে জানতে কি করে এই রথী মহারথীরা বুঝতে পারল জীবনের এই সাড়ম্বর প্রত্যাবর্তনের পাকদন্ডকে ?তবে কিশরীর আর মায়ার ভাষা আলাদা?এমনও হয়েছে অবিশ্রাম ঝগড়ার শেষে তীব্র ঘৃণার নীলরস সরে গিয়ে রি রি করে জেগে উঠেছে শরীর। সমস্ত লজ্জা ভয় ঝগড়া তুচ্ছ করে ইমন প্রবল আক্রোশে কেড়ে নিয়েছে সুমির শরীর। প্রাথমিক প্রতিরোধে হেরে গিয়ে সুমিও সাড়া দিয়েছে স্বেচ্ছায়। তবে কি এই কিসেই মিলনবিন্দু?শরীরেশরীর তবে মন কোথায় ! 
এর বাইরে সুমি কে ? সারা দিনে সুমির মুখ যদিওবা মনে পড়ে তা অই অসভ্যের মত ঝগড়ুটে মুখ। কি দুর্গন্ধময় শব্দ বাক্যের সমাহারে সুমী ঝগড়া করতে পারে তা ভেবে অফিসের টেবিলে একাই ঘুষি মারে ইমন।ইতর মহিলা। নন্সেন্স। ইমনের জীবনটাই তছনছ করে দিয়েছে। কে যেন বলেছিল , ইমন এ মেয়ে খুব ট্রিকবাজ। তুই বেরুতে পারবি না। ইমন তখন বেরুতে চায়নি। যে মেয়ে ঠা ঠা গ্রীষ্মের দুপুরে পুকুরের গরম জলের দিকেতাকিয়ে সাঁঝের পাখিরা ফিরিল কুলায় তুমি ফিরিলে না ঘরে গাইতে গাইতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলতে পারে তাকে কি করে ধান্ধাবাজ মনে করে ইমন? 
আর সেই চিঠি? মাত্র তিন লাইনের একটি চিঠি আত্মীয়স্বজন, বাবামা ভাইবোন, বিয়ের দেনমোহর, কাবিননামা, রঙ্গীন আলো, ফুলকেও ম্লান করে দিয়েছিল। ইমনের খেলারাম ভিত নাড়িয়ে গজিয়ে উঠেছিল দায়িত্ববোধ। তার সন্তান ! সুমি তাকে কোন বাঁধনেই আটকাতে চায়নি। আবার্ট করতে চেয়েছিল দু মাসের ছোট্ট প্রাণটিকে । সারারাত ঘুমুতে পারেনি ইমন। চিঠিটা কখন যেন একটি শিশু হয়ে জড়িয়ে ধরেছে ইমনের গলা। শীত রাত।ইমন নিজেই কেঁপে কেঁপে উঠেছে ঠান্ডায়। ওর মনে হয়েছে শিশুটি বুঝি উদলা হয়ে গেল দুরন্ত পায়ের দাপটে। এই বুঝি কেঁদে উঠবে অসহ্য ঠাণ্ডায় । কেবল মনে হচ্ছিল তার সন্তান মুছে যাবে এই পৃথিবী থেকে ? তার নিজের সৃষ্টি ? একটি প্রাণ! কি দোষ করেছিল শিশুটি ? দোষ ইমনের। সে কখনোই কোন প্রিকশন নেয়নি। সুমিকেও নেওয়ার সুযোগ দেয়নি। তার চাওয়াটা ছিল যখন তখন। তবে? রাজনীতিতে ব্যর্থতা, চাহিদামত চাকরী না পাওয়া, বন্ধুদের এক এক করে সরে যাওয়া , ভাই বোনদের সাথে দূরত্ব বেড়ে যাওয়ায় হতাশ ছিল ইমন। একা হয়ে পড়েছিল চারদিক থেকে। শূন্য হাতে কিছুই দাঁড়াচ্ছিল না কেবল সুমির সাথে প্রেম ছড়া। বার বার মনে হচ্ছিল তলিয়ে যাচ্ছে পাঁকে । অসংখ্য জলজ নালে সেজড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ। নালের কাঁটা তার শ্বাসনালী পেঁচিয়ে বার বার দম বন্ধ করে দিতে চাইছে। সেই সময় একটি ছোট্ট প্রাণ ইমনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।ইমনের একটি ছোট্ট শব্দে নির্ভর করছে শিশুটির বাঁচা মরা। ইমন কিছুতেই রাজী হয়নি এবার্ট করাতে। আঠাশ বছর আগে কারওয়ান বাজারের এক সবজিট্রাকে চড়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস স্টপজে এসে ইমন যখন নামে তখন রাত চারটা। সুমিদের হোস্টেলের সামনে বরকতউল্লার সবজান্তা দোকান।রাত চারটায় বরকতউল্লাকে ঝাঁপ খুলতে বাধ্য করেছিল ইমন। সরাসরি বরকতউল্লাকে বলেছিল, বিয়ে করব আজ।এইসকালেই। সাক্ষী হবা বরকতভাই?
সেই থেকে সুমি তার সংগী। অভাবে, দুর্দিনে এই রমরমা সুদিনেও সুমি আছে তার সাথে। কিন্তু প্রেম হারিয়ে গেছে। আঠাশ বছরের সংসার জীবনে প্রেম পাল তুলে চলে গেছে নিরুদ্দেশে। কিন্তু শরীর? ইমনের একটা শরীরে সহস্র শরীরের চাহিদা । ইমন এমনই। নর্মাল সময়ে কখনো সখনো হেসে হেসেই সুমি বাঁশ দেয়, রাক্ষস পুরুষ। লম্পট বললাম না তোমাকে । তাহলে মেয়েটা বেঁধে যায়। ইমনও তরল সুরে স্বীকার করে নেয়, দানাপানির যোগান কম থাকলে কি করা ! তখন অন্যের ক্ষেতে ঢুঁ মারতেই হয়! সুমি কালো মুখকে আরো কালো করে একই গ্লাস হাজার ধুতে থাকে ! 
আজ সন্ধ্যায় সে কিছুতেই পারছে না নিজেকে সামলে রাখতে।উতল হয়ে উঠছে শরীর। অফিস থেকেই ফোন করে দিয়েছে বন্ধু শিহাবকে, দোস্ত মাল রেডি থাকিস। হাসপাতালে স্ত্রীকে দেখে একটু খারাপই লেগেছে তার। কেমন একটা ঘন বিকেল জমে গেছে স্ত্রীর দুচোখের মণিতে। ছায়াছায়া দুগালে ফ্যাঁকাসে হলুদ অন্ধকার নেমেছে। যেন মৃত্যু উপত্যকার করুণ স্যাঁতসেঁতে ছবি। মন বলেছিল থাকি। বসে থাকি স্ত্রীর পাশে। হারানো সুর আবারযদি ফিরে আসে। শরীর ক্ষেপে উঠেছিল। আমি কি উপোস থাকব? কতদিন শুনি? গাড়ির ভেতরেই মামের বোতলে জলের সাথে মিশিয়ে কড়া ড্রিংক্স খেয়েছিল। স্ত্রীর হাতে নরম ছোঁয়া রেখে ইমন চলে আসে নির্দিষ্ট খোঁয়াড়ে । সেখানে অল্প বয়সি এক অভ্যস্ত শিকার খাদ্য হবে বলে আধবুড়ো শিকারীর অপেক্ষায় শরীর তাতিয়ে বসে আছে।
ইমন চলে যেতেই সুমির মনে হল এই বেশ ভাল হল। আজ জীবনের চূড়ান্ত সময়ে সত্যটা ফিরে এসেছে গুটিসুটি মেরে। ইমনকে সে ভালবাসে । এখনো । সুখ স্বাচ্ছন্দ্য , সন্তানের জন্যে নয় । এমনিই ভালবাসে। এই বেয়াড়া, ইন্দ্রিয়পরায়ণ , অসম্ভব কৃপণ, ঝগড়ুটে ননফ্যাশনেবল স্বচ্ছ সৎগোঁয়ার লোকটিকে সে নিজের বলে ভাবতে ভালবাসে। জানে ইমন কখনো তাকে ছেড়ে যাবে না। বিয়ের প্রথম কয়েক বছর কি যে নিরাপত্তাহীন ছিল সে। ইমনের জামাপ্যান্টের-পকেট, মানিব্যাগ, মোবাইল, অফিসের ড্রয়ার, পিয়ন, পরিচিত অপরিচিত স্বল্প-পরিচয়ের কাউকেই সন্দেহ করতে ছাড়ে নি সুমি। কতবার ইমনের কত মেয়ে সহকর্মীকে ফোন করে আজেবাজে কথা বলেছে। কতবার ইমনের বসের কাছে কমপ্লেন করেছে। ওর জন্যে বার বার অপমানিত হয়েছে ইমন। অফিসে, বন্ধুদের কাছে ফোনের পর ফোন করে বুঝিয়ে দিয়েছে ইমনের চরিত্র খারাপ। লম্পট । ইমন এক মূর্তিমান শয়তান। ঝগড়ার পর ঝগড়া, মারামারি, ভাংচুরে কেটে গেছে দিনরাত। রাগ করে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে সুমি। হাত খরচের টাকা রেখে ইমনের পুরো মাইনেটা কেড়ে নিয়েছে সে। তারপরেও ইমনকে পোষ মানাতে পারেনি। বরং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে হেসেছে ইমন। ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারত। সুমির চাইতে বহুগুণে ভাল আর সুন্দরী মেয়েরা এসেছিল ইমনের জীবনে। কেন যায়নি ইমন? 
দামি হাসপাতালের সাদা বেডে শুয়ে সুমির মনে হয় খুব অন্যায় হয়ে গেছে । ইমন এক অতিপুরুষ। কামতাপে ভরা পূর্ণ শরীর। সেও ত কতবার ফিরিয়ে দিয়েছে ইমনকে। উদ্যত পৌরুষকে হ্যাটা করে মেয়ের ঘরে গিয়ে শুয়ে থেকেছে কত রাত! কতবার ইমন বলেছে চলো অমুকের বাসায় ঘরোয়া অনুষ্ঠান আছে । তুমি গান গাইবে। কত ভাল গান কর তুমি! ইমনের গলায় আন্তরিক সুর। বিশ্রীভাবে রিজেক্ট করে দিয়েছে সুমি, আমি ওইসব ঢলানিদের সাথে গান গাইনা। তোমার ভাল লাগে তুমি যাও। ইমন আর কোনদিন বলেনি গান গাইতে। আশ্চর্য বিয়ের পর সুমির কখনো আর গান গাইতে ইচ্ছে করেনি। সুর আসেনি ওর গলায়। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়েও সে মাসিপিসির গান শুনিয়েছে।অন্য কোন গান বা সুর একবারের জন্যেও মনে আসেনি। ইমন হ্যা হ্যা করে হেসে ঠাট্টা করেছে, পাপে পুড়ে গেছে তোর অন্তর। গান আসবে কোথা থেকে! তুই কয়লার চেয়েও ময়লা। 
ইমনের প্রথম কবিতার বই প্রকাশ অনুষ্ঠানেও সে যায়নি যখন শুনেছে চেনাজানা অনেক মহিলা কবি থাকবে সে অনুষ্ঠানে । মার্কেটে, মলে, রেস্টুরেন্টে কোন বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলে সুমী মেয়েকে নিয়ে গোমড়া মুখে বসে থাকত। বাধ্য হয়ে চলে যেত তারা। ইমনের বন্ধুরা কখনো আর সুমিকে ডাকেনি। কেন সে এরকম করত? কিসের ভয় ছিল সুমির? ভাল হয়ে উঠলে ইমনকে সে আর জ্বালাবে না। চোখ বেয়ে জলের ঢল নামে। সে কি আর ভাল হয়ে উঠবে ? এই অসুখে কি কেউ ভাল হয় ? বুকের খাঁচা ভেঙ্গে যে প্রাণ পাখি উড়ে যেতে চায় যখন তখন! 
ইমনের অফিসের ব্যাগ ল্যাপটপ টেবিলের উপর ছেড়ে গেছে। কি যেন বলে গেল একনাগাড়ে, ঘন্টা দুই দেরি হবে। চলে আসবে। চিন্তা কর না। খারাপ লাগলে ফোন দিও। নার্সকে বলে আয়াকে রেখে গেছে সুমির কেবিনে। বাইরে কি সন্ধ্যা ?হয়ত তাই! কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে সবকিছু। আয়ার মুখ ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দেয়ালে। সুমীর কালো পান্ডুর মুখে ঢেউ খেলছে, কি সুন্দর সন্ধ্যা ! এসময় ইমন থাকলে বেশ হত। গান আসছে সুমির মনে।দূর বহু দূরের সমুদ্রের ঢেউয়ের মত সুরের পরে সুরজ মেমহাঢেউ হয়ে পর্দা সরিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে সুমির মনে। কেবিনের দেয়াল ছুঁয়ে সমপদী তালে ভেসে বেড়াচ্ছে , ধা ধি না, না থু না , ধা ধি না, না থু না, তোমার কুঞ্জ পথে যেতে হায়, চমকি চাহিয়া দেখিবে ধূলায় –
সুরে ভাসছে সুমি।সুরেরমায়াবী টানে হালকা হয়ে উড়ে যাচ্ছে সুমির দেহ।শরীর থেকে খসে পড়ছে রাগ, অভিমান, ঈর্ষা হিংসা আর ভালবাসার পালক।ভেসে যাচ্ছে সে।ভাসতে ভাসতে ইমনের গায়ের এলকোহলিক গন্ধে কিছুক্ষণ ডুবে থাকে। তারপরেই শহর ছেড়ে শতশত পথ পার হয়ে কোন এক মফঃস্বল শহরের মধুমঞ্জুরী ঘেরা গেটেএসে থমকে দাঁড়ায়।কুমড়োফুলের পরাগমাখা এক সন্তানপিয়াসী নারী নিরাভরণ দেহে আশ্লেষে জড়িয়ে নিয়েছে এক বাদামী পুরুষকে। তার উদ্ধত বুক শিশুর নরম ঠোঁট স্পর্শ পেতে থরথর কাঁপছে । গর্ভগৃহে অবিশ্রাম আলো ছড়াচ্ছে বাৎস্যায়ন রস।মা হতে চায় সেই নারী।সুমিতার গর্ভগৃহে ঢুকে পড়ে। নামহীন অবয়বহীন একটুকরো জমাট রক্ত হয়ে ভাবে আঃ কি শান্তি! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র