সায়ন্তন - মায়াজম

Breaking

৩০ সেপ, ২০১৬

সায়ন্তন


                         তিস্তার ওপারে



ল্পটা শুরু হল তিস্তার নাকের ডগা থেকে। একটা সবজে ফড়িং অনেকক্ষণ ধরে সেখানে বসার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তিস্তা তা হতে দেবে কেন? সেও বারবার অলসভাবে মাথা ঝেড়ে তার বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল। মিনিট তিনেকের ব্যর্থ চেষ্টার পরে অগত্যা সে উড়ে গেল পাশের ঝোপটার দিকে। কয়েকটা মাটির ভাঁড় এখানে সেখানে পড়ে আছে।  একটা যুতসই কাপ দেখে ফড়িংটা সেখানে ল্যান্ড করল।  এখন শীতকাল।  সকালবেলা ভাঁড়ে বিন্দু বিন্দু শিশির জমে রয়েছে। ফড়িংটা সেই জলের দিকে চুপ করে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে থাকল। সামনে চায়ের দোকানে একটা মোটা লোক বলল, “ভোলাদা, একটা কড়া করে আদা চা দাও তো!”
সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। বড় রাস্তা দিয়ে অল্প অল্প গাড়ি চলতে শুরু করেছে।  ভোলাদার চায়ের দোকানে একে একে নুটুকাকা, পলাশদা, বোসজ্যেঠু এসে জুটেছে। কিন্তু কুয়াশা এখনও কাটেনি। দূরে ‘অ্যাক্টিং শিখুন’ পোস্টার সাঁটানো ল্যাম্পপোস্টটা দেখা যাচ্ছে না এখনও। ‘মোহনবাগান আবার হারবে’ বলে পলাশদা ফড়িংটাকে তাক করে চায়ের ভাঁড় ছুড়ে মারল। ফড়িং এবার অল্প উড়ে পাশে পড়ে থাকা একটা কমলা বিস্কুটের প্যাকেটের উপর বসল।
বিস্কুটের প্যাকেটরা সচরাচর বাইরে সবুজ, কমলা, লাল আর ভেতরের দিকে রুপোলি হয়। যেখানে রোদ পড়লে চোখ ঝলসানো আলো তৈরি করে — ডাস্টবিনের ইলিশ টাইপের ব্যাপার।কিন্তু আমাদের প্যাকেটটা কাগজের ছিল। ম্লান, ধূসর, শিশিরভেজা আর বাঁদিকের কোনায় কৌশিকের কিটো জুতোর ছাপ লাগা একটা নিরীহ প্যাকেট।

- কৌশিক চ্যাটার্জি?
- ইয়েস স্যার।
- ডু ইউ নো আজ যতজন ইন্টারভিউ দিয়েছে, তাদের মধ্যে উইকেস্ট সি ভি আপনার?
- বাট আই অ্যাম স্কিলড স্যার।
- কীসের স্কিলড? জুলজি-তে গ্র্যাজুয়েশনের পর ফাঁকা। ই সি এ-তে বলছেন ভালো ক্রিকেট খেলেন। ব্যস। তা আপনার জুলজি আর ক্রিকেট সেলসের কোন কাজে আসবে?
- স্যার আমি জানি আমি হয়তো দুর্বল। বাট আই উইল লার্ন।
- বি এস সি-র পরে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছেন কেন?
- মার্কস কম ছিল। মাস্টার্সে কোথাও চান্স পাইনি বলে...
- আপনি তো ২০১০ পাস আউট। দু বছর ধরে বসে ছিলেন কেন? অ্যাট লিস্ট কোনও ছোটোখাটো ডিপ্লোমা কোর্স-টোর্স তো করতে পারতেন?
...
- মিস্টার চ্যাটার্জি, ডোন্ট ইউ থিঙ্ক আপনার মতো একজন আন-এক্সপিরিয়েন্সড নাইভ কাউকে সেলসের কাজে নেওয়াটা একটা বিরাট গ্যাম্বলিং হবে?
- আমি গত দু বছর অন্যান্য জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছি। ১১-তে বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়, তারপর থেকেই উনি প্যারালাইজড। বাবার পেনশনের টাকায় আমাদের সংসার চলে। ঘরের সমস্তকাজ আমায় করতে হয়।
- ওয়েল আই অ্যাম সরি ফর হোয়াট হ্যাড হ্যাপেনড টু ইউ, বাট দিস ইস বিজনেস। কোম্পানি তো কোনও ইন্ডিভিজুয়ালের ভালো-মন্দ অনুসারে চলে না!
- আই নো। সেই জন্যেই প্রথমে একবারও আপনাদের কাছে এসব আমি বলিনি। সিম্প্যাথি ক্রিয়েট করতে চাইলে অনেক আগেই বলতাম।
- বাট ইউ সেইড।
...
- লুক মিস্টার চ্যাটার্জি, ইউ হ্যাভ ফেইলড টু কনভিন্স আস। আপনার সেলস সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই, কাস্টমার হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা নেই। মোট কথা আপনি এই ফিল্ডের কিচ্ছু জানেননা।
- আমি খিদে জানি।

সেটানিজম অনুসারে পেন্টাগ্রাম অশুভ শক্তিদের দূরে রাখে। আর ওলটানো পেন্টাগ্রাম,  যাকে অনেকটা মোটা হুইস্কারওয়ালা কুকুরের মুখের মতো দেখতে, ব্যবহৃত হয় ইভিল প্র্যাকটিসের জন্য। তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে ভালো-মন্দ ব্যাপারটা যাতা ঠুনকো! একটা তেরচা টোকায় যে কোনও সময় পেন্টাগ্রাম পালটে সাদা-কালোর ফারাক গুলিয়ে দিতে পারে। যেমন বাটারফ্লাই এফেক্টে হয়।
সেদিন এমনই একটা ন্যালাখ্যাপা প্রজাপতির ডানায় ধাক্কা খেয়ে পাতার ফাঁকফোঁকর দিয়ে আসা একটা নরম, পেন্টাগ্রাম রোদ বাড়ি খেল একটা রুপোলি চিপসের প্যাকেটে। সাথে সাথে একটা মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া দেওয়ায় প্যাকেটটা ঈষৎ নড়ে গেল। প্যাকেটের মাথায় বসে ছিল সেই সবুজ ফড়িংটা। সে আবার উড়তে উড়তে দুটো শুকনো পাতা, একটা পিঁপড়ের লাইন, একটা উড়ন্তসুতো আর দুটো এক্স সেজে বসে থাকা তাঁতি মাকড়সার জাল এড়িয়ে কৌশিকের ঝোলা ব্যাগের উপর এসে বসল।
দ্য গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স এড়ানোর জন্য একদল বৈজ্ঞানিক আমাদের ইউনিভার্সের প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলেছিলেন। ধরা যাক সেই পৃথিবীতে ঠিক এই সময় কৌশিকের মোবাইল বেজে উঠল।
“হ্যাঁ মা... কী! বাবা হাঁটতে পারছে! কথা বলছে? কী যাতা বলছ? আমি আসছি এখুনি।”
কৌশিক উঠে দাঁড়াতেই দেখল একটা চুলখোলা ফর্সা মেয়ে ওর দিকেই হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। মেয়েটার অদ্ভুত সুন্দর শরীর, লাল-পাড় সাদা শাড়ি, চোখে কাজল,  কানে রুপোলি ঝুমকো, কপালে লাল টিপ, সোনালি বিনুনি দেওয়া হার... জোরালো হাওয়ায় পতপত করে আঁচল উড়ছে। না, একে চেনে না কৌশিক। কিন্তু মেয়েটা সোজা কৌশিকের দিকেই এগিয়ে এল, ডানদিকের ভুরুটা হালকা উপরের দিকে নাচিয়ে কৌশিকের কড়ে আঙ্গুল জড়িয়ে ধরল। আর অল্প হেসে বলল, “রান্নাবাটি খেলবি?”
আবার ফোন।
“কংগ্র্যাচুলেসন্স মিস্টার চ্যাটার্জি, ইউ আর সিলেক্টেড ফর দা জব। আপনার স্টার্টিং প্যাকেজ হবে থ্রি পয়েন্ট টু ফাইভ ল্যাক পার এ্যানাম! এনজয়...”

ট্রাম জার্নি অনেকটা বাইজান্টিনিয়ান চ্যান্ট বা রামকৃষ্ণ মঠের প্রার্থনা সঙ্গীতের মতো। গম্ভীর, হালকা, ঢুলঢুলে... হেলেদুলে সবার পিছনে যাচ্ছে, যেন তার ডেস্টিনেশন রিচ করার কোনও ঠ্যাকানেই, রাইডটাই আসল। কোনও গম্ভীর ফিলোজফিকাল উপদেশ টাইপের রাইড নয়। একটা সাধারণ ছোটো যাত্রা। যেভাবে অলি পাবের সামনে কোনও ওভারডোজড মাতাল বমি করার পর তার গাজরের টুকরো, মাছের কাঁটা মেশানো হলুদ ফ্লুইড নিজের খেয়ালে একেবেঁকে একটা অপেক্ষাকৃত সমতল যায়গায় এসে পেনিনসুলা তৈরি করে, যেভাবে তিস্তার সদ্যোজাত লাল-কালো-সাদাবাচ্চারা এদিক-ওদিক হোঁচট খেতে খেতে তিস্তার স্তনের কাছে এগিয়ে আসে অথবা যেভাবে কেমোথেরাপি চলা পেশেন্টের ধীরে ধীরে চুল উঠে যায়। এরা সবাই অলস। সবাই নিউটোনিয়ানফিজিক্স মেনে... অনির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করার পর... সূর্যাস্তের সময় ধর্ম হয়ে যাচ্ছে।
চাকরিটা হয়নি। কৌশিক ট্রাম থেকে নেমে ভোলাদার দোকানের দিকে এগিয়ে এল। সন্ধেবেলা। বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়ে গেছে বলে দোকানে লোকজন কম। অন্যদিন হলে পলাশদা, বোসজ্যেঠু,  বলাইদারা জমিয়ে আড্ডা দিত। কৌশিক ভালো করে কানে মাফলারটা জড়িয়ে নিয়ে একটা তিন টাকার চা বলল।
আমি খিদে জানি — ওয়াট দ্য হেল!
সেদিন সারারাত তিস্তা কাঁদল। ওর একটা বাচ্চা হারিয়ে গেছে। ভোলাদার ঝাঁপ দেওয়া খয়েরি দোকান, সাদা-কালো সি পি এম-তৃণমুল পতাকা দেওয়া রাস্তা, কালো যোগ চিহ্ন দেওয়া ওষুধেরদোকান, ওই ফুটের ঘোলাটে ফুচকাস্ট্যান্ড, তার পেছনের অফ-হোয়াইট খেলার মাঠ এমনকী অন্য কুকুরের এলাকা অব্দি চলে গেল তিস্তা। কিন্তু বাচ্চাটাকে আর পাওয়া গেল না। হয়তো ঠান্ডায় মরে জমে গেছে, বা হয়তো কোনও হাফ-প্যান্ট পরা মিষ্টি ছেলে কোলে তুলে বাড়ি নিয়ে চলে গেছে। কে জানে! কত কিছুই তো জানে না তিস্তা। কে ওর এমন সফিস্টিকেটেড নাম রেখেছে...বা পৃথিবীতে এত কম রঙ কেন... বা রাত্রিবেলা প্রজাপতিরা কোথায় যায়...

সেদিন বিকেলটা ভারী সিনেম্যাটিক ছিল! সিক্সটিজের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট সিনেমার মতো। হালকা হাওয়ায় একটা কালচে প্রজাপতি দিগভ্রান্তের মতো এখানে সেখানে উড়ে বেড়াচ্ছিল। গল্পের শুরুর সেই অ্যাশ কালারের ফড়িং প্রজাপতিটাকে পাশ কাটিয়ে প্রথমে ভোলাদার কুসুম বিস্কুটের ঢাকনার উপর বসল। তারপর সেখান থেকে সাদাটে ল্যাম্পপোস্ট, বিড়ির দোকান ঘুরে, ডানদিকে হেলানো একটা সাইকেলের বেল ছুঁয়ে ফড়িংটা বসল সিনেমার হিরোর ফেলে দেওয়া পোড়া দেশলাই কাঠির ওপর। হিরোর কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট। হাতে সাদা সিগারেট। বসে আছে।পাশে কালো বেঞ্চির উপর রাখা কালচে চায়ের ভাঁড়, তার উপর সাদা ধোঁয়া, তার উপর কালচে ফড়িং, তার উপর সাদা আকাশ। তিস্তা উঠে গা ঝাড়া দিয়ে এগিয়ে গেল।
কৌশিকের বাবা মারা গেছেন। গত পরশু। একদম সাদামাটা, অনাটকীয় মৃত্যু। ঘটনাটা এতটাই অবভিয়াস ছিল যে, কেউ খুব একটা কাঁদেওনি। কান্নাকাটির চেয়ে কৌশিকের কাছে এখন অনেকবেশি ইম্পর্ট্যান্ট চাকরি পাওয়া। সামনের শনিবার একটা ইন্টারভিউ আছে, হবে না। জানে কৌশিক। নিজের পরিধি জানতে পারার এই একটা সুবিধে। চরম মুহূর্তেও ভাবলেশহীন হয়ে থাকা যায়। কৌশিকের দিকে এগিয়ে আসা নেড়ি কুকুরটার মতো। কুকুরটাকে চেনে কৌশিক। এখানেই থাকে। মাঝে মাঝে কৌশিক ওকে টোস্ট বিস্কুট, পাউরুটি ছিঁড়ে খাওয়ায়। কুকুরটা কিছুক্ষণ কৌশিকের দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা দু পা তুলে কৌশিককে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল। কৌশিক অল্প মাথা ঝুঁকিয়ে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে কুকুরটার ভেজা নাক স্পর্শ করে বলল,“সিগারেট খাবি?”
তিস্তা আরও কিছুক্ষণ আদর খেয়ে নেমে গেল। ওকে রাস্তার ওদিকে যেতে হবে, যেখানে রোজ বিকেলে কয়েকটা চশমা পরা বুড়ো লোক আড্ডা মারে আর তিস্তার পরিবারকে চা-বিস্কুট খাওয়ায়। তিস্তা একবার পিছনের দিকে তাকিয়ে বড় রাস্তায় উঠল, সঙ্গে তার ছোটো ছোটো চারটে ছানা।
ঠিক যেই সময় আমাদের সবুজ ফড়িং ভোলাদার দোকানের কমলা বাল্বে ধাক্কা খেয়ে উলটো দিকে পালাতে গিয়ে তাঁতি মাকড়সার জালে আটকে গেল, যখন একটা পরিত্যক্ত ট্রাম ডিপোর সামনে শুয়ে থাকা কোনও এক উলঙ্গ পাগলকে টপকে একটা হলুদ প্রজাপতি অনেকদিন অকেজো হয়ে পড়ে থাকা ট্রামের জানালায় এসে বসল, যখন প্যারালাল ইউনিভার্সের কৌশিক তারফর্সা বৌকে নিয়ে আড়াইশ মুসুর ডাল আর এক কেজি চিনি কিনে দোকানদারকে একশ টাকার নোট দিয়ে বলল, “খুচরো নেই ভাই”, ঠিক সেই সময় আলোর বেগে ছুটে চলা একটা ট্যাক্সি তিস্তার পেটের উপর দিয়ে চলে গেল।
বাচ্চাগুলো এবার রাস্তা পার হবে কীভাবে?

(গল্পটি সায়ন্তনের সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিতব্য গল্পের বই ‘যারা নিয়ম ভালোবাসে’-র অন্তর্গত) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র